শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ২১ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


তন্ময় বেরিয়ে গিয়েও পুনরায় ফিরে এলো। তাঁকে দেখে জবেদা বেগম প্রশ্ন করেন, 

'কিছু রেখে গেছিস?'

তন্ময় অস্পষ্ট স্বরে 'হু' বলে লিভিং রুম পেরিয়ে ঝটপট নিজের রুমে ঢোকে। মিনিটের মাথায় রুম থেকে বেরোয় পাতলা শুভ্র রঙের জ্যাকেট নিয়ে। জবেদা বেগম কালো রঙের ছাতাটি ছেলের হাতে ধরিয়ে দেন, 'অরুকে নিয়ে ফিরিস' বিড়বিড়িয়ে বলেন। 

তন্ময় এক হাতে ছাতা অন্যহাতে জ্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পার্কিং লটে দেখা হয় জিন্সপ্যান্টে জড়িয়ে থাকা আধুনিক রেবেকার সঙ্গে। কালো রঙের গাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে। রেবেকা গাড়িতে ঢুকতে নিচ্ছিলো, তন্ময়কে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। উঁচু হিলে শব্দ তুলে কিছুটা এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। মাথা দুলিয়ে হেসে শুধায়, 

'কোথাও যাচ্ছিলেন?'

তন্ময় ভদ্রতা বজায় রেখে অস্পষ্ট গলায় জবাব দেয়, 

'জি।'

রেবেকা চিন্তিত দৃষ্টিতে বাইরেটা দেখে নিলো। বাইরে এখনো তীব্র বর্ষণ। কমবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। গাড়ির আসাযাওয়া ও তেমন একটা নেই। তাই সে আশাবাদী গলায় বলল, 

'কোথায় যাচ্ছেন? আমি লিফট দিতে পারি।'

তন্ময় ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। পকেট হাতড়ে সেলফোন বের করতে নিয়ে জানায়, 

'উবার আসবে আমার৷'

রেবেকা হতাশ হয় বটে। তবে পরমুহূর্তেই হেসে প্রশ্ন করে, 

'ক'দিন আপনাকে দেখিনি। বিজনেস ট্যুরে ছিলেন বুঝি?'
'হ্যাঁ। গতকাল রাতে ফিরেছি।'

রেবেকা পুনরায় হতাশার চুড়ান্তে পৌঁছায়। এতো কম কথা মানুষ বলে কীভাবে? বিশেষ করে পুরুষ মানুষ এতো কম কথা বললে চলে নাকি? কই তার কলিগ কিংবা কাজিন অথবা চেনাজানা যেসব সিঙ্গেল পুরুষ আছে, সবগুলোই কথাবার্তায় পটু। মেয়ে পটাতে পাঁচ মিনিট লাগে না যেন ওদের! আর রেবেকার সামনে তো ওরা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। এটাসেটা বলে পটানোর জন্য এক সেকেন্ড বাদ রাখে না। কিন্তু ওদের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ কাজ করে না রেবেকার। অথচ এমন একজনের প্রতি আগ্রহ জন্মালো যার তার প্রতি আগ্রহ নেই। শব্দ যে মেপে মেপে ব্যবহার করে। ভীষণ সুদর্শন তবে গোমড়া মুখের অধিকারী। চুপচাপ থাকা শান্ত স্বভাবের। একদম রেবেকার অপজিট স্বভাবের। তাও এতো ভালো কেন লাগছে? এমন বাজেভাবে মনে ধরেছে যে সে এই প্রথম কোনো পুরুষের সঙ্গে সেধে সেধে কথা বলছে! কিছুই কী বুঝতে পারছে না সামনের এই লোকটা? হতাশা লুকিয়ে রেবেকা পুনরায় কথাবার্তা বাড়ানোর চেষ্টা করে, 

'শাবিহা থেকে জানলাম আমরা সেইম ভার্সিটিতেই ছিলাম। আপনি সিনিয়র… '

সাদা রঙের একটি প্রাইভেট গাড়ি মাত্রই এসে থামলো সদরদরজার সামনে। গাড়িটা দেখে তন্ময় তাড়াহুড়ো গলায় বলল, 

'অন্য একদিন কথা হবে। কিছুটা তাড়ায় আছি। আসি!'

তন্ময় দ্রুত পায়ে চলে গেল। রেবেকা দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। সদরদরজার পানে তার নজর। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে সে ভাবনায় বিভোর। 

_______

কলেজের সদরদরজা বন্ধ। এখনো ছুটি হয়নি। কলেজের সামনেই একটা কফি-শপ আছে। গাড়িটা শপের পাশেই থেমেছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তন্ময় গাড়ি থেকে নামে। ছুটে গিয়ে দাঁড়ায় কফি-শপের সামনে। এখনো অনেকটা সময় বাকি। তাই ডিরেক্ট কফি শপে ঢোকে। কলেজের সদরদরজা দেখা যাবে এমন কর্নার বেছে নেয় বসার জন্য। গ্লাস ভেদ করে ওপাশটা ক্লিয়ার তার দৃষ্টির সামনে। কাঁচের টেবিলে রাখা মেন্যুটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে রেখে দিলো। একজন অল্পবয়সী ওয়েটার এসে কী প্রয়োজন জানতে চাইলে, তন্ময় ইউজুয়াল কফির অর্ডার করে। কফি আসতে সময় নেয় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দিয়ে যায়। আবহাওয়া দারুণ।তাই বুঝি কফির তৃপ্তি বাড়লো? নাহলে এতো ভালো লাগবে কেন! কাঁচের গ্লাস বেয়ে পড়তে থাকা বৃষ্টির জল দেখতে দেখতে আনমনে কফিটা শেষ করে ফেলল। আরেকটা কফির অর্ডার দিলো। সেটি কেবলই টেবিলে দিয়ে গিয়েছে ওয়েটার। এক চুমুক ও খেতে পারেনি। পূর্বেই দেখা যায় কলেজের দরজা খোলা হচ্ছে। একঝাঁক অল্পবয়সী তরুণ তরুণী বেরোতে শুরু করেছে। কেউ ভিজে ভিজে কেউবা ছাতা মাথায়। কারো কারো ফ্যামিলি ছাতা নিয়ে হাজির কারো বা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। তন্ময় কফিটা রেখে দ্রুত ওঠে দাঁড়ায়। কাউন্টারে বিল মিটিয়ে বেরোয়। ছাতাটা মাথায় তুলে রাস্তা পেরিয়ে ওপাশ গিয়ে দাঁড়ায়। মিনিটের মাথায় একটি মেয়েকে দেখতে পায়। দুজন ছেলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। মেয়েটা অরুর মামাতো বোন সুমনা। তন্ময় চেনে। প্রায়শই আসতো বাসায়। তবে পারসোনালি মেয়েটাকে তার মোটেও পছন্দ নয়। তাঁকে দেখলেই শরীরের ওপর পড়ার জন্য তৈরি থাকে। স্বভাব ও নেগেটিভের চুড়ান্তে। চাচী আর অরুর মুখের দিক তাকিয়ে সে কিছু বলে না। 

ছাতাটা কাত করে মুখটা ঢেকে নিলো। সুমনার চোখের সামনে আর পড়লো না। মেয়েটা তার পাশ দিয়ে চলে গেল। ও যেতেই পুনরায় ভেতরে নজর ফেলল।দেখতে পেলো অরুকে। বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজে নেচে-কুঁদে আসছে। হাসি ঠোঁট থেকে সরছেই না।হাসতে হাসতে মারজির কোলে যেন পড়ে যাবে। সাদা কলেজ ড্রেস পরে এই মেয়েকে ভিজতে তন্ময় শতবার না করেছে! তবে কে শোনে কার কথা! শুধু শুধু কী আর ধমক দেয়?

 মারজি হুট করে সামনে তাকায় এবং তন্ময়কে দেখে ফেলে। কিছুটা চমকে ওঠে। পরপর অরুকে খোঁচা মেরে হাতের ইশারায় দেখায়। অরু ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। অদূরে ছাতা মাথায় দাঁড়ানো লম্বাটে তন্ময়কে দেখে, চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো। মারজি কে? ও চিনেই না এমন ভঙ্গিতে ওঁকে ফেলে দৌড় লাগালো। এক দৌড়ে তন্ময়ের সামনে চলে এলো। বোকার মতো হেসে শুধালো, 

'কখন এসেছেন তন্ময় ভাই? অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছেন? আমাকে ডাকলেই পারতেন দৌড়ে চলে এতাম।'

 তন্ময় চোখ রাঙাল, 

'তোকে না বলেছি বাইরে ভিজতে না? একদম কথা শুনিস না।'

বলতে বলতে ছাতাটা অরুর মাথার ওপর ধরে। হাতে থাকা জ্যাকেট খানা তড়িঘড়ি করে এগিয়ে দিয়ে বলে, 'তাড়াতাড়ি পরে ফেল।'

অরু ব্যাগটা কাঁধ থেকে খুলে তন্ময়ের হাতে ধরিয়ে দেয়। হেসে হেসে জ্যাকেট পরে নিলো। নিজেকে বাঁচানোর ভঙ্গিতে সকল দোষ মারজির মাথায় ফেললো, 

'আমিতো ভিজতে চাচ্ছিলাম না। এই মারজি বলল ওর নাকি খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। তাই আমি একটুখানি কাম্পানি দিলাম। বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে এতটুকু তো করতেই পারি তাই না?'

পেছনে দাঁড়ানো মারজির মুখে মেঘ জমলো। মেয়েটা কী ধরনের মিথ্যুক! ওই তো নেচেকুঁদে ভিজতে চাইল, এখন সব দোষ তার? আড়চোখে মুখ বাঁকালো। তবে কিছু বললো না। মেয়েটা যেভাবে হাহুতাশ করেছে কদিন ধরে তন্ময় ভাইয়ের জন্য! শ্বাস ফেলতে- নিতে শুধু একটাই কথা, তন্ময় ভাই! যাক অবশেষে দেখা পেলো। অন্যদিকে অরু মারজিকে দেখেও দেখছে না। সে বড়োই ব্যস্ত তার তন্ময় ভাইকে দেখতে। হাত নাড়িয়ে কোনোমতে বলল, 

'মারজি তুই বাসায় যা। আল্লাহ হাফেজ!'

তন্ময় আড়চোখে চঞ্চল মেয়েটাকে দেখে নিলো। যে কিনা পারছে না মারজিকে মাথায় তুলে দূরে ফেলে দিতে। ঠোঁটে আসতে চাওয়া হাসিটুকু আটকে, মারজিকে প্রশ্ন করে, 

'তুমি একা যেতে পারবে? নাকি আমাদের সাথে আসবে?'
'না ভাইয়া। যেতে পারব। এহসান আছে তো। ওইযে বন্ধুদের সাথে। ও আর আমি একসাথেই যাব।'

তন্ময় মাথা দোলায়। অরুকে নিয়ে হাঁটা ধরে। ডান হাতে ছাতা এবং বা হাতে অরুর কলেজ ব্যাগ। বৃষ্টি এখনো তুমুল গতিতে ঝরছে। মাথার ওপরে ধরা ছাতাটা বাতাসে হালকা দুলছে। তন্ময়ের টি-শার্ট প্রায় ভিজে গিয়েছে। হঠাৎ ভেজা তার শরীর ঘেঁষে অরু আলগোছে তার হাতটা জড়িয়ে ধরল। ধরে ও নিজেই কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে চলল। লজ্জায় মাথা তুলে তন্ময়ের দিকে তাকাতে পারলো না। অন্যসময় হলে তন্ময় ছাড়িয়ে নিতো কিংবা ওঁকে সরিয়ে দিতো। আজ আর ইচ্ছে করলো না। ধরতে দিলো। নিজেও উপভোগ করতে থাকলো ওর নরম হাতের স্পর্শ। ক্ষনে ক্ষনে লুকিয়ে আড়চোখে ওর তাকানোর প্রয়াস গুলোক উপভোগ করতে লাগলো। মোড়ে এসে দাঁড়ালো রিকশার জন্য। 

এমন সময় অরু হুট করে ছাতাটা টেনে নামিয়ে ফেললো। হালকা ভেজা তন্ময় এবার পুরো ভিজে জবজবে। ওঠানো স্যাট করা চুলগুলো ভিজে কপালে লেপ্টে এলো। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতেই অরু চুপসে যাওয়া গলায় আবদার করে, 

'বৃষ্টিতে ভিজে যাই? অল্প একটু রাস্তাই তো।'

মেয়েটার সাথে সে কখনোই পেরে উঠবে না। ছাতাটা গুঁটিয়ে বন্ধ করে নেয়। একটা রিকশা দাঁড় করায়। অরুকে উঠিয়ে নিজেও উঠে এসে পাশে বসে৷ পারতে সে কখনোই অরুর এতো কাছাকাছি আসে না, বসে না। পুরুষ মানুষ সে.. তার ওপর দৃষ্টি অপবিত্র। মোটেও ভালো কিছু মাথায় আসে না কাছাকাছিথাকলে। এরজন্যই এতো দূরত্ব রাখে। সেসব কী আর এই অবুঝ মেয়ে বোঝে? ও তো তন্ময়কে পুড়িয়ে, জ্বালিয়ে ছারখার করতে চায় প্রতিনিয়ত।

 স্বাস্থ্যসম্মত তন্ময় বসতেই রিকশা ছোটো মনে হলো। লেপ্টে বসতে হলো দুজনের। মেঘ ডাকছে ক্ষনে ক্ষনে। অরু ভীষণ খুশি যেন। বৃষ্টি হাত মেলে ধরছে, হেসে হেসে তাকাচ্ছে। তন্ময় সুযোগ পেলেই দেখছে। মাত্র কয়েকদিন এই মিষ্টি মুখটা দেখেনি, কিন্তু তার মনে হচ্ছে বছর ধরে দেখেনি। এখন তৃষ্ণা মিটছেই না হালকাপাতলা দেখায়। একদম ঘন্টা ধরে সরাসরি তাকিয়ে থাকলে হয়তো তৃষ্ণা মিটতে পারে। তবে সেই সুযোগ কী আছে? অরু তো আড়চোখে বারংবার তাকিয়ে চলেছে। পারছে না তন্ময়কে চোখ দিয়ে গিলে খেতে। 
 
'পড়াশোনা কেমন চলছে?'
'ভালো না। আমি কাল থেকে পড়তে আসি?'
'বাসায় টিচার রাখা হয়েছে না?'
'তাদের পড়ানো বুঝি না।'
'আমার মুখে কী এক্সট্রা মধু যে যা বলি তাই বুঝিস?'

অরু মিনমিনে গলায় বলে, 

'তারা আর আপনি কী এক হলেন!'

তন্ময়ের দৃষ্টি নরম হয়ে আসে। মুখশ্রী একই রেখে প্রশ্ন করে, 

'এক না?'
'একদমই না। আমি কাল থেকে পড়তে আসব। আসব তন্ময় ভাই?'

তন্ময় অন্যদিকে ফিরে হেসে নিলো। রুক্ষ গলায় বলল, 

'আচ্ছা।'
_____

জবেদা বেগম জানতেন ছেলেমেয়ে দুটো ভিজে ভিজে আসবে। হলোও তা। দরজা খুলেই দুটোকে ভেজা অবস্থায় দেখলেন। তাড়াহুড়ো করে অরুকে ওয়াশরুম পাঠালেন। শাবিহার কামিজ আর পরিষ্কার তোয়ালে নিয়ে এসে এগিয়ে দিলেন। তারপর রান্নাঘরে চা বসাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রঙ চা বানাবেন আদা দিয়ে। ঠান্ডা না লেগে যায়। 

তন্ময় ইতোমধ্যে গোসল করে ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরে হাজির। বা-হাতে তোয়ালে তার। সেটা দিয়ে ধীরে ধীরে ছোটো চুলগুলো মুছে নিচ্ছে। লিভিংরুমে এসে টেলিভিশন ওন করল। আজকে খেলা আছে। ইতোমধ্যে শুরু হয়তো। খেলা ছেড়ে সেসবই দেখতে ব্যস্ত। জবেদা বেগম কাপে রঙ চা এনে দিয়ে গেলেন। সেখানে চুমুক দিতে নিয়ে চোখ গেল বাম দিকের রুমটায়। সদ্যস্নান করা অরু ভেজা চুলে বেরিয়ে এসেছে। তন্ময়ের বুকটা বাজেভাবে শব্দ করে উঠলো। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েও মস্তিষ্ক হতে যাচ্ছে না ওই নারীশরীরের দৃশ্য। 
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন