শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ২৩ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


আষাড়মাসের উদাসীন বৃষ্টি ঝুপঝাপ কিছুক্ষণ পরপর বিরতিহীন ভঙ্গিতে নামছে। বর্ষাবাদলের দিনগুলো এভাবেই যায়। এই দেখা দেয় রোদ্দুর আবার পরমুহূর্তেই মেঘলা হয়ে ওঠে আসমান। অচিরেই নামে পুষ্পবর্ষণ। বিকেলবেলায় অবশ্য পরিষ্কার ছিল আসমান, আবহাওয়া। সন্ধ্যার দিক হিমশীতল বাতাস বইতে শুরু করল। নামল অঝোরে বৃষ্টি। তন্ময় তখনি বেরোল অফিস বিল্ডিং থেকে। আজ সে ছাতা আনেনি। ফোরকাস্ট দেখে এসেছিল, আজ বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা নেই। তাহলে এখন এগুলো আসমান হতে কী নামছে? মধু?

ফোরকাস্টের থেকে জবেদা বেগম আবহাওয়ার বেশ ভালো তথ্যসূত্র জানাতে পারেন। আজ সকালবেলা তিনি অত্যন্ত দৃঢ় গলায় বলেছেন, বৃষ্টি হবে। ছাতা সঙ্গে নিতে। তন্ময় ফোরকাস্টে নজর বুলিয়ে আর তার কথার গুরুত্ব দেয়নি। তন্ময় ভাবছে বৃষ্টির মধ্যেই বাইক টেনে বেরোবে। ওসময় কিছু কলিগস সামনে এসে দাঁড়াল। কথাবার্তার আসর পাতল। তন্ময় অগোচরে হু-হা বলে নিজের মতামত জানান দিচ্ছে। তার পাশে দাঁড়ানো নারী হলো লাবণ্য। তাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র এম্পলয়। তন্ময়ের থেকে বয়সে দু'বছরের বড়ো। কিছুটা উগ্রস্বভাবের। আঁটসাঁট পোশাক পরতে পছন্দ করে। আরও পছন্দ করে তন্ময়ের সঙ্গে কথায় কথায় উঠতে-বসতে, হুটহাট গায়ের ওপর পড়তে। এইতো এখনো অস্বস্তিজনক সিচুয়েশনে ফেলেছে তন্ময়কে। অস্বাভাবিকভাবে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে দাঁড়িয়েছে। তন্ময় ভদ্রতাপূর্ণ দূরত্ব বজায় রাখতে সরে এলো। কথা বলাবলির একসময় হঠাৎ করে নজর গেল রাস্তার ওপারে।

 ছাতা হাতে কামিজ পরিহিত এক ছোটোখাটো মেয়ে দাঁড়িয়ে। চমকে ওঠে তন্ময়। আঁতকে ওঠে হৃদয়। মেয়েটিকে চিনতে মিনিট খানেকের ও প্রয়োজন পড়ল না তার। চটজলদি পায়ে, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটল। রাস্তা পেরিয়ে সোজাসুজি থামল অরুর সামনে। গলায় থাকা ধমকটুকু গিলে ফেলতে হলো ওই ছলছল নয়ন পানে চেয়ে। ফর্সা লাল আধবোঁচা নাকের পাটা ফুলে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। ডান গাল বেয়ে ঝরল একফোঁটা নোনাজল। তন্ময় হাত বাড়াল জলটুকু মুছতে। পূর্বেই অরু ছাতা ফেলে হনহনিয়ে হাঁটা ধরল। অস্থির তন্ময় ধমকের সুরে ডাকে, 

'অরু!'

অরু থামে না। হাঁটার গতি বাড়ায়। বৃষ্টির জলে ইতোমধ্যে কামিজ লেপ্টেছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। তন্ময় বড়ো বড়ো পায়ের ধাপ ফেলে অরুকে আটকায়। 
ওর সর্বশরীরে নজর বুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সংবরণ করে শুধায়,

'তুই এখানে কী করিস? এক চড়ে হয়নি?'

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অভিমানিনী অরু চুপ করে রয়। টুঁশব্দ ও করতে রাজি নয়। তন্ময় ছাতা তুলে আনে। ছাতা বন্ধ করে অরুর ডান হাত টেনে রাস্তা পেরিয়ে অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে আসে। কলগদের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে পার্কিংয়ে পৌঁছায়। বাইকে চাবি পুরে উঠে বসে। ভারী গলায় বলে,

'ওঠ।'

অরু সময় নেয় তবে উঠে বসে বাইকের পেছন ধরে, তবুও তন্ময়কে ধরে না। তন্ময় লুকিং গ্লাসে একবার ওই জেদি মুখটি দেখে বাইক স্টার্ট করে। বাইকের গতি সাধারণ। বৃষ্টি এখনো একই গতিতে ঝরছে। বাতাসের তীব্রতা দারুণ তীক্ষ্ণ। এতক্ষণ ধরে চুপচাপ থাকার মেয়ে তো অরু নয়। এখন অবদি চুপ রয়েছে মানে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট দেবার জন্যই তো তন্ময় মাসের ওপর এই ফাজিল মেয়েকে এড়িয়ে চলেছে, সংযোগ বিচ্ছেদ করেছে। সেদিন রাতের ওই ভয়াবহ অনুভূতি বাধ্য করেছে তাকে এই স্টেপ নিতে। অরুকে শিক্ষা দিতে। এই শিক্ষার কথা মনে থাকলে ভবিষ্যতে এমন করার কথা দ্বিতীয় বার ভাববে না। 

বাইক এসে থামে শাহজাহান বাড়ির সামনে। তন্ময় জানে, অরু এখন বাইক থেকে নেমে অভিমানজনিত হৃদয় তুলে ধরবে। কাঁদতে কাঁদতে শুধাবে কেন সে এড়িয়ে বেরিয়েছে! তখন তন্ময় ধমক দিয়ে মিটমাট করে নিবে। ওর পছন্দের বিরিয়ানি ও পাঠিয়ে দিবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। অরু নির্বিকার ভঙ্গিতে বাইক থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। অন্যদিনের মতো ফিরে তাকাল না। দরজা ধরে উঁকিঝুঁকি ও দিল না। তন্ময় মাথাটা বাড়িয়ে ভালোভাবে দেখে নেয়। সত্যিই চলে গেল? তার বোকাসোকা অরু চলে গেল? তন্ময় কী পরিষ্কার দেখছে? সে কী এবার একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলল? তবে কষ্ট তো আর ও একা ভোগ করেনি। ওর থেকে দ্বিগুণ ভোগ করেছে তন্ময় নিজে। কীভাবে সহ্য করেছে গত দিনগুলো মেয়েটা জানে? তন্ময় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়। অবশেষে বাইকে উঠে বসে। একটানে চলে যায়। তন্ময় চলে যেতেই দোতালার আঁধারে বারান্দায় লুকানো মানবছায়া বেরিয়ে আসে। অপলক দেখে যায় ওই বাইক যাওয়ার রাস্তাটি।

______

জবেদা বেগম আড়ে-আড়ে কয়েকবার অশান্ত ছেলের পানে তাকালেন। তন্ময় সেলফোন হাতে এদিকওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। বেশ টেনশড দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। একবার ডেকেছে সাঁড়া দেয়নি। কিছুক্ষণ আগে একদম ভিজে জবজবে শরীর নিয়ে ঢুকেছে। জবেদা বেগম তক্ষুনি আদা চা বসিয়ে দিয়েছেন। চা-টা হয়ে এসেছে। কাপে ঢেলে লিভিংরুমে এলেন। তন্ময় এখন সোফায় বসে। মুখপানের সামনে মোবাইল ফোন ধরে রাখা। ভ্রু দ্বয়ের মাঝে সূক্ষ্ম ভাঁজ। জবেদা বেগম ডাকেন,

'আব্বা!'
'উম।'

তন্ময় মাথা তুলে তাকায়। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নেয়। চুমুক বসিয়ে খেয়াল করে, জবেদা বেগম একইভাবে দাঁড়িয়ে। তাই শুধোয়,

'কিছু বলবে মা?'
'কী হয়েছে তোর?'
'কী হবে?'
'চিন্তিত দেখাচ্ছে তোকে!'
'তেমন কিছু না।'
'তাহলে কেমন কিছু? দেখি, জ্বর টর বাঁধিয়েছিস নাকি!'

বলেই হাতের তালু তন্ময়ের কপালে ঠেকালেন। গরম গরম ভাব। জ্বর আসার সম্ভাবনা আছে। বিচলিত গলায় বলেন,

'খেয়েদেয়ে ঔষধ নিয়ে তারপর রুমে যাবি। ঠাণ্ডা ও বাঁধিয়েছিস।'

জবেদা বেগম রান্নাঘরের দিক যেতেই তন্ময় পুনরায় সেলফোনে চোখ ফেলে। অরুকে দুটো কল দিয়েছে সঙ্গে একটি ম্যাসেজ। মেয়েটা কল ও ধরল না ম্যাসেজের জবাব ও দিলো না। এমন কখনো হয়নি বলেই বুঝি এতো অশান্তি লাগছে? 

আজ বৃহস্পতিবার। কাল তন্ময়ের বন্ধের দিন। অরু এরমধ্যে তাদের বাসায় আসেনি আর ওই কল ম্যাসেজের রিপ্লাই ও করেনি। তন্ময় ভেবেচিন্তে অফিস থেকে বেরোনোর পূর্বে শাবিহাকে কল করে। গলা খাঁকড়ি দিয়ে শুধোয়,

'ঘুরতে যেতে চেয়েছিলি না সেদিন?'
'হু, চেয়েছিলাম তুমি তো নিলে না।'
'আজ বেরো।'
'এখন? এই সন্ধ্যাবেলা?'
'হ্যাঁ। মাওয়া নিয়ে যাই। এক ঘন্টার রাস্তা। আর রাতেই ওখানটা বেশি জাঁকজমকপূর্ণ হয়।' 

শাবিহা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করে,

 'কখন বেরোচ্ছি ভাইয়া?'
 'সাতটার পর।'
 'আমি অরুদের বলি গিয়ে। দেখবা খুশিতে এরা নাচবে।'

অফিস শেষ করে তন্ময় বাসায় ফিরে। গোসল নেয়। ড্রাইভার চাচাকে কল করে গাড়িটা তাদের বিল্ডিংয়ের পার্কিংয়ে দিয়ে যেতে বলে, তৈরি হতে শুরু করে। অরু প্রায়শই আকারইঙ্গিত দিয়ে বুঝায় তাকে সাদা শার্টে বেশ মানায়। আজ তন্ময় সাদা শার্ট পরল কালো প্যান্টের সাথে। হাত ঘড়ি পরে অরুর পছন্দের পারফিউমটাই ব্যবহার করল। চুল স্যাট করার সময় শাবিহার কল এলো। তন্ময় রিসিভ করতেই শাবিহা বলে,

'ভাইয়া অরু তো যেতে চাচ্ছি...'

তন্ময়ের বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। যার জন্য আয়োজন সে না গেলে কীভাবে কী? তন্ময় শাবিহার সম্পূর্ণ কথা না শুনেই বলে ওঠে,

'যাবে না মানে? সবাই যাচ্ছে ওর কী সমস্যা? ওকে বল এক্ষুনি রেডি হতে। নাহল...'

শাবিহা ঠোঁট চেপে হেসে ওঠে। দুষ্টু স্বরে বলল,

'ভাই। তুমি তো আগেই হাইপার হয়ে যাচ্ছ। আমার পুরো কথাটুকুও শুনলে না। আমি বলছিলাম অরু যেতে চাচ্ছিল না। আমি ওকে জোরপূর্বক তৈরি করিয়েছি।'

 আটকে থাকা শ্বাস টুকু তন্ময় এবার ছাড়ল। গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টারত ভঙ্গিতে বলল,
'ওহ, আচ্ছা। আয় তাহলে।'

শাবিহা তখনো মিটিমিটি হাসছে। তন্ময় অ্যাম্বারসড অনুভব করল। কল কেটে কপালে আঙুল ঘেঁষে চুপসে রইল। অরু আরও কিছুদিন এমন করলে সে নিশ্চিত হার্টএট্যাক করে বসবে। 

_______

জবেদা বেগম যাবেন না। সে বাচ্চাদের মধ্যে যেতে নারাজ। অগ্যত তাকে বাসায় রেখে বেরোতে হলো তন্ময়ের। পার্কিংয়ে ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। তন্ময়কে দেখে হাসল। চাবি এগিয়ে টুকটাক কিছু কথাবার্তা বলে বিদায় নিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর এলো শাবিহা, রুবি, দীপ্ত, আকাশ। আর শেষমেশ ঢুকল অরু। সেই বৃষ্টির রাতের মতো আজও চুপচাপ আছে মেয়েটা। মুখ গোমরা। তন্ময়ের এই প্রথম মনে হলো অরু ভীষণ ভয়ানক। চুপচাপ থেকে তাকে মেরে ফেলতে এই মেয়ের একদিন ও লাগবে না। 

ড্রাইভিংয়ে তন্ময় বসল। পাশে আকাশ। পেছনে অরু, দীপ্ত, শাবিহা এবং রুবি। গাড়ি বেরিয়ে পড়ল বিল্ডিং থেকে। আকাশ এফএম চালু করে দিল। এক প্রেমিকের রিকোয়েস্টে তার প্রেমিকার জন্য একটি রোমান্টিক গান প্লে করা হয়েছে। গানটা মৃদু আওয়াজে বেজে চলেছে। ডান কাঁধের ওপরের কর্নারের লুকিং গ্লাসটা তন্ময় কোণা করে স্যাট করল। অরুর মুখটা লুকিয়ে অগোচরে দেখল। 

দীপ্ত সন্দিহান চোখে অরুকে আগাগোড়া দেখে নিচ্ছে বারংবার। কিছুক্ষণ পরপর খোঁচা দিচ্ছে। তবুও তাকে কিছুই বলছে না অরু। এক দৃষ্টিতে বাইরেটা দেখছে। দীপ্ত আর থাকতে পারল না। প্রশ্ন করেই বসল,

'অরু আপু তোমায় কে বকেছে?'

অরু মাথা ঘুরিয়ে ফিরে তাকায়। বলে,

'কে বকবে?'
'না বকলে এমন হয়ে আছ কেন? মনে হচ্ছে এই জগৎসংসারে তোমার কেউ নেই।'

অরু বিড়বিড়িয়ে জানায়,

'নেই তো। কেউ নেই।'

তন্ময় স্পষ্ট শুনল। লুকিং গ্লাসে চোখ নিতেই অরুর সঙ্গে চোখাচোখি হলো। অরু দৃষ্টি ফিরিয়ে পুনরায় বাইরেটা দেখছে। অরুর এমন করুণ অবস্থা দেখে আকাশ ও চিন্তায় পড়ল,

'আমার বকবকানির রানীর কী হয়েছে? ওর বকবক ছাড়া তো এই ট্রিপ হজম হবে না। কিরে শাবিহা! অরুর কী হয়েছে?'

শাবিহা মিটিমিটি হেসে বলে,

'অরু অভিমান করেছে। অভিমান ভাঙলে ঠিক বকবক শুরু করবে।'

অরু মুখ ভেঙিয়ে বলল,
'আমার বয়েই গেছে অভিমান করতে। আমি মোটেও অভিমান করছি না। বরং নিজেকে হাতের মুঠোয় রাখছি। আমি বড়ো হচ্ছি, আমাকে অবশ্যই নিজেকে সংযত রাখতে হবে। এতো ন্যাকামি মেয়েদের মানায় না।'

দীপ্ত পানির বোতলে মুখ দিয়েছিল। অরুর কথায় ও কেশে নাকমুখে পানি ওঠে। কাশতে কাশতে চোখের কোণে জল এসে জমে। কোনোমতে বলে,

'আপু তুমি ঠিক আছ? জ্বর বাঁধেনি তো?'

তন্ময় কোনোমতে ঠোঁটের হাসিটুকু গিলে নিলো।
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন