'মাথা ভেতরে নে।'
অরু যেন কথাটুকু শুনল না। সেভাবেই মাথা বের করে চোখ বুঝে আবহাওয়ায় মিশতে মগ্ন। তন্ময় অসহায় অনুভব করল। মেয়েটা তাকে অবজ্ঞা করায় ডিগ্রি নিয়েছে যেন! আড়চোখে তাকিয়ে দেখল শাবিহা টেনে অরুকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। কান টেনে শুধাল,
'একটা গাড়ি পাশ দিয়ে গেলে কী হবে আইডিয়া আছে? কথা শুনছিস না কেন?'
'আমি খেয়াল রাখছিলাম তো।'
তন্ময় লুকিং গ্লাসে দৃষ্টি রাখে। ওর ভোঁতা মুখটা দেখে মিহি গলায় প্রশ্ন করে ,
'চোখ বুঝে খেয়াল রাখছিলি?'
অরু মুখ বাঁকায়। জড়ানো গলায় বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলে মুখখানা ঘুরিয়ে রাখে। হেসে ওঠে শাবিহা। দু-পাশে মাথা দুলিয়ে বলে ওঠে,
'তোর সাথে তর্কে পারব না।'
শহরের কোলাহল পেরিয়ে গাড়ি পৌঁছেছে স্থির, শান্ত, শুনশান সড়কপথে। দেখা মিলল গ্রামীণ সৌন্দর্যের। আরও দেখা গেল রাস্তার দুপাশে দিগন্ত বৃস্তিত ধূঁধূঁ সাদা বালির মাঠ। কিছুদিন আগেই এই বালির মাঠগুলি ছিলো সবুজ ধান খেত। বর্ষায় এই ধান খেত হয়ে যেত স্বচ্ছ জলের বিল। আজ আর সেই বিলের চিহ্ন মাত্র নেই। তবে আছে কিছু গ্রাম বাংলার চিরায়ত প্রাকৃতিক পরিবেশ। যা উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে।
ড্রাইভিং সিটের পাশের জানালার কাঁচটা তন্ময় নামিয়ে নিলো। হিমশীতল বাতাস ছুঁয়ে দিলো সর্বশরীর। স্পর্শনীয় অনুভূতি যাত্রাপথ করে তুলেছে নিদারুণ সুখময়। ডান হাতে স্ট্রিং হুইল এবং বাম হাতে গিয়ার শিফট কন্ট্রোলে ব্যস্ত। আঁখিযুগল নীরব সড়কপথে ঠাঁই রয়েছে। পাশের সিটে বসা আকাশ সেলফোনে টাইপিং করছিল। হঠাৎ মুখটা এগিয়ে গলা নামিয়ে তন্ময়ের কানের কাছটায় বলল,
'ভাই, একটা স্মোক করলে ভালো লাগত না? মুখটা ম্যাচম্যাচ করছে।'
'পড়ে।'
'গাড়িটা আশেপাশে থামানো যায় না?'
'যায়। তুই নামবি আমরা এগোব। খেয়ে একাই ফিরিস।'
'আচ্ছা, খাব না। চিল ব্রো! এভাবে নিজের ভাইকে থ্রেট দিতে তোর বিবেকে বাঁধল না?'
'বাঁধল না।'
মাওয়া ফেরিঘাট মূলত মুন্সিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। ঠিক পদ্ম নদীর তীরে। ঢাকার মধ্যে পর্যটকদের জনপ্রিয় প্রচলিত জায়গা এটি। একদিনের মধ্যে ঘুরেফিরে আসা যায় বলেই হয়তো বেশি আলোচিত। নদী ভ্রমণ এবং ইলিশ ভোজনের ক্ষেত্রে বেশ নামকরা। তন্ময় ভেবেছিল কাল শুক্রবার সকালে বেরোবে ওদের নিয়ে। রাতে ফিরবে ঘুরেফিরে। তারপর বন্ধুদের থেকে জানল মাওয়াঘাট নাকি রাতে ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। তাই রাত করেই বেরোল। ফিরতে ফিরতে ভোর হবে নিশ্চয়ই।
পদ্ম নদীপথ দেখে চোখছানাবড়া হলো অরুর। উজ্জ্বল হলো মায়াবী মুখশ্রী। চাঁদের আবির্ভাব পরা জলের সৌন্দর্য অপলক চোখে দেখল। সেই ডাগরডাগর হরিণটানা চোখে একরাশ মুগ্ধতা। প্রেয়সীর কালো কুচকুচে আঁখি যুগল দেখে তন্ময়ের ক্ষীণ মনটা নিমিষে ফুরফুরে হলো। দৃষ্টি হলো দৃশ্যমান রূপে কোমল।
মাওয়া ফেরিঘাটের সামনে মানুষের আনাগোনা দেখা গেল। ভীড়ের লক্ষণ ও কিছুটা রয়েছে। পদ্মর বুকে বোট করে অনেকেই এপারওপার পারাপার করছে। কেউবা নদীজল ভ্রমণ করছে। উত্তর দিকে নদীর পাড়দিয়ে বড়ো সরু রাস্তা গিয়েছে যার একপাশে রূপালী পদ্ম আর অন্যপাশে সবুজে ঘেঁড়া গ্রাম। চাইলে গ্রামের ভেতরটাও ঘুরেফিরে দেখা যাবে। ছায়া সুনিভির গাছগাছালিতে ঢাকা চমৎকার এই গ্রাম খানা দেখতে ঘন্টাখানেকের ও প্রয়োজন পড়বে না হয়ত। শহরের কোলাহল আর যান্ত্রিকতা মুক্ত এই গ্রামটি ঘুরার ইচ্ছে অরুর সুশ্রী মুখখানাতে লেপ্টে। সে আনমনে প্রশংসা করে চলেছে। ছটফট নয়নে দেখছে সবকিছু।
রাতে নদীর বুকপিঠে ওঠার ইচ্ছে শাবিহা, রুবি কিংবা আকাশের নেই। দীপ্ত উল্টো ভয় পায় গভীর নদী। শুধুমাত্র অরু ভীষণ আগ্রহী ছিল পদ্ম নদীর নৌকায় চড়ে ঘুরবে বলে। ভাই-বোনদের অনীহা দেখে মন খারাপের চিহ্ন ফুটে উঠল ওর সর্বমুখ জুড়ে। তন্ময় আড়ালে ওর মুখাবয়ব দেখে আকাশের উদ্দেশ্যে বলল,
'তোরা হোটেলে ঢুকে খেতে শুরু কর। আমি অরুকে নৌকা চড়িয়ে আসছি।'
অরু আড়চোখে তন্ময়ের পানে চেয়ে অভিমানী গলায় বলে,
'যাব না।'
তন্ময় অবাক হলো না। এবং আর কী বলে মেয়েটাকে মানাবে তা বুঝেও পেল না। সবসময় অরু তার সঙ্গে একা থাকার সুযোগ কুড়িয়ে বেরিয়েছে। তাকে কখনো এক-পা আগাতে হয়নি। সর্বদা মেয়েটা আগ বাড়িয়ে পাশে ছিল। এই প্রথম সে এমন অবস্থার সম্মুখীন। কীভাবে কী করবে মাথায় আসছে না। তাকে উদ্ধার করতে পদার্পণ ঘটাল শাবিহা। খিদে পাওয়ার বাহানা ধরে বলল,
'যাবি না বললে হবে? দেখা যাবে বাসায় ফিরে কাঁদতে বসবি। বলবি তোকে নদীতে বোট চড়তে দেইনি। আমরা বরং খেতে যাই। তুই নদী ভ্রমণ করে ভাইয়ার সাথে ফিরে আয়।'
কথাটুকু শেষ করে দ্রুত পায়ে সরে পড়ে বাকিদের নিয়ে। দীপ্ত অবশ্য ভয় নিয়েই যেতে চেয়েছিল তন্ময়, অরুর সঙ্গে। শাবিহা যেতে দেয়নি। হাত টেনে নিজের সাথে নিয়ে নিয়েছে।
_____
অরু দাঁড়িয়ে অন্যদিক ফিরে। তন্ময় পাশেই। অদূরে পদ্মঘাট। সেখানে নৌকা, বোটের অভাব নেই।আসমানে অপূর্ব এক সুন্দরী চাঁদ জ্বলে আছে। আলোকিত করে রেখেছে চারিপাশ। আজ বুঝি জ্যোৎস্নাময়ী রাত? চারিপাশটা কেমন আলোকময়! তন্ময় কোমল স্বরে শুধায়,
'নৌকা চড়বি না?'
অরুর একরোখা জবাব,
'না।'
'কেন!'
'আমার ইচ্ছে।'
'কী হয়েছে?'
'কিছু না।'
'রাত হচ্ছে! চল।'
তন্ময় হাত বাড়িয়ে ছোটো নরম হাতটা ধরল। টেনে নিতে লাগল নিজের সঙ্গে। অরু আর বাঁধ সাধল না।
ঘাটের সামনে এসে তন্ময় একটা নৌকা ভাড়া করল। আধঘণ্টা ঘুরাবে নদীর বুকে। অরুর হাত ধরে প্রথমে ওকে নৌকায় উঠতে সাহায্য করল। পিছু সেও উঠল। অরু ইতোমধ্যে জুতোজোড়া খুলে বসে পড়েছে। তন্ময় ঠিক ওর সামনে বসল। নৌকা ছেড়েছে। নদীর বুকে হেলেদুলে এগোচ্ছে। জলের স্রোতের আওয়াজ ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে। নদীর বুকে, আসমানের নিচে বসা চাঁদের স্পর্শী অরুকে আবেদনকারী, মায়াবিনী লাগছে। তন্ময়ের হৃদয়টা কেঁপে উঠল। দৃষ্টি মোহিত হলো। লম্বাটে শ্বাস টেনে নিলো। অরু ওসময় তাকাতেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। তন্ময় তাকিয়ে থাকলেও অরু নজর ফিরিয়ে নেয়। তন্ময়ের ঠোঁট জুড়ে ঢেউ খেলানো হাসি এসে ভীড় জমায়। মিহি কণ্ঠে ডাকে,
'আরাবী।'
অরু চমকায়। চটজলদি ফিরে তাকায়। সচরাচর তন্ময় ওর পুরো নাম ধরে ডাকে না। হঠাৎ করে নামটা শোনবার ভাগ্য হয়। মোহনীয় ওই আঁখিদুটি দেখে জবাব দিবেনা ভেবেও শেষমেশ দিলো,
'হু।'
'রাগ, অভিমান কমেছে!'
'অভিমান করার আমি কে!'
তন্ময় হাসে। নিদারুণ কোমল চোখে চেয়ে থেকে বলে,
'কিছুতো একটা।'
'কিছুই না। আমাকে যে দেখতে চায়না, পছন্দ করে না তাকে আর জ্বালাব না। কাছেও যাব না, কথাও বলব না।'
'এই তো ভারী কঠিন শাস্তি।'
'আমি কাছে না গেলে, কথা না বললে বরং সে খুশি। সে বেঁচে যাবে।'
তন্ময়ের দৃষ্টি অশান্ত হয়। হৃদয় অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে। ভীষণ আদুরে স্বরে, ক্ষীণ গলায় সে বলে,
'বরং সে মরে যাবে।'
অরু এবারো চমকায়। ছলছল নয়নে চেয়ে রয়। অভিমানী মন গলতে শুরু করে। এই সুদর্শন, আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্ববান পুরুষটির সামনে যে সে সর্বদাই অসহায় এবং বেহায়া। তন্ময় হাত বাড়িয়ে ওর অবিন্যস্ত চুলগুল কানের পেছনে গুঁজে দেয়। এসময় বাতাসের তোড়ে, নদীর ঝড়ে নৌকা অস্বাভাবিক ভাবে হেলেদুলে ওঠে। অরু ভয় পেয়ে সরে আসে। তন্ময়ের শক্তপোক্ত পুরুষালি হাত জোড়া অরুকে ইতোমধ্যে জাপ্টে ধরে, বাহুতে সুরক্ষিত রাখে। আসমান হতে নামে একফোঁটা জল। অরু মাথা তুলে আসমানের পানে চায়। জ্বলজ্বল করা চাঁদ মেঘে ঢেকে গিয়েছে। আলোকিত ভাব আর নেই। আঁধারে তলিয়েছে প্রকৃতি। তন্ময় বলল,
'চাচা, দ্রুত ঘাটে নিন।'
'আচ্ছা।'
ঘাট থেকে বেশ দূরে আছে তারা। কিছু পথ যেতে না যেতেই ঝুম বৃষ্টি নামল। ভিজিয়ে দিল মুহূর্তে।
.
.
.
চলবে.............................