মাথার ওপরে মেঘে ঢাকা বিদঘুটে আসমান হতে অঝোরে বর্ষণ নামছে। পাগলা ঝড়ো হাওয়ায় সর্বত্র আঁধারে এবং অপরিষ্কার। বাতাসের তোড়ে নৌকার বেগতিক অবস্থা! কেন্দ্রাংশ হারিয়ে প্রতিনিয়ত উলটোদিক অগ্রসর হচ্ছে নৌকা। যেকোনো সময়ে নদীতে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা আছে। ঘাট এখনো বহুদূর। এমতাবস্থায় মাঝি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে, নৌকা পাশেই কোথাও ভিড়ানোর প্রচেষ্টা করছে। বাম দিকে বাঁশবন বাগান। বাঁশবন পেরলে মেইনরোড। তন্ময় ব্যস্ত গলায় বলল,
'চাচা। বামদিক নেওয়ার চেষ্টা করুন।'
তন্ময়ের সেলফোন বেজে চলেছে লাগাতার। ইতোমধ্যে ফোন ভিজে পকেটে পড়ে আছে। অরুকে একহাতে ধরে অন্যহাতে ফোন বের করে। শাবিহা, আকাশ, রুবি সবার কল। তন্ময় কল রিসিভ করে। তবে কথা শোনা যাচ্ছে না। নেটওয়ার্ক প্রব্লেম। কোনোরকম জানাল তারা ঠিক আছে। কল কেটে তাকাল শান্তশিষ্ট চুপচাপ বসে থাকা অরুর পানে। বৃষ্টিধারা পড়ছে ওর সর্বশরীরে। রেশমি কালো ঘন চুলগুলো কাঁধপিঠে পড়ে আছে। চুল থেকে ঝরছে সীমাহীন জল। সেই জল বেয়ে চলেছে টানা হরিণী চোখের পাপড়িতে, পাপড়ি থেকে নাক, গাল, গোলাপি ঠোঁট এবং অবশেষে গলা বেয়ে দু- কাঁধের মধ্যস্থান ধরে জামার ভেতরে চলে গেল। তন্ময় একদৃষ্টিতে ওই আবেদনময়ী সৌন্দর্যসৃষ্টি দেখল। চোখ ফিরিয়ে গলার স্বর নরম করে শুধাল,
'ভয় লাগছে?'
অরু পিটপিট নয়নে অদূরের জঙ্গলটা দেখে নিলো। ঢোক গিলল। দু'ঠোঁটের ভাঁজে বৃষ্টির জল নিয়ে বলল,
'লাগছে না।'
আবহাওয়া খারাপের দিক। ঝড়ের মাত্রা বাড়ছে বলে। তন্ময় দেখল নৌকা বাঁশবনের দিকে চলে এসেছে। উঠে দাঁড়াল অরুর হাত ধরে। পেছন থেকে হাত ধরে ওকে আগে নৌকা থেকে নামাল। তারপর নিজে নামল। টাকা নৌকা ভাড়া নেওয়ার সময় দিয়ে দিয়েছিল। মাঝিকে বিদায় জানিয়ে অরুকে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর ধরে হাঁটা ধরল। বড়ো-বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা এতো গাছপালা ভেদ করে তাদের শরীর আগের মতো ছুঁতে পারছে না। তবে ঠাণ্ডাবোধ বেশি করছে। বাতাসের গতিপথ ও বেশি। শরীরের পশমগুলো শীতল অনুভূতিতে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
অরুকে দৃশ্যমান রূপে কাঁপতে দেখে তন্ময় দাঁড়িয়ে পড়ল। ওকে আগাগোড়া দেখে বলল,
'ওড়নাটা জড়িয়ে নে।'
অরু কথা শুনল। গলা থেকে ওড়না সরিয়ে মেলে নিজের সর্বশরীরে জড়িয়ে নিলো। ফ্যালফ্যাল চোখে চারিপাশ দেখে মন্তব্য করল,
'খুব নির্জন আশপাশ। কেমন গা ছমছম একটা ব্যাপার।'
'রাত দশটার দিক এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে, এমন বাঁশবন নির্জন লাগবে না তো কী কোলাহলময় হবে?'
অরু ঠোঁট বাঁকাল, 'আমিতো জাস্ট কমেন্ট করলাম।'
'আমিতো জাস্ট রিপ্লাই করলাম।'
অরুর ভয়ার্ত মুখখানা চুপসে যায়। তন্ময় শব্দ করে হাসে। অরুর কাঁধ ধরে নিজের সাথে লেপ্টে শুধায় , 'ভয় করছে? চোখ বন্ধ কর। আর একটু রাস্তা। মেইনরোড গেলে সিগনাল পাব। কল দিলে গাড়ি নিয়ে চলে আসবে।'
অরু চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে রাখে। বন্ধ চোখে তন্ময়ের ইশারায় চলে। পরমুহুর্তেই চোখ মেলে তাকায়। ভাবে, সে যেহেতু এতটা ভয় পাচ্ছে নিশ্চয়ই তন্ময়ও ভয় পাচ্ছে? এমনটা ভেবে ভীতিগ্রস্ত নয়নে চেয়ে রয়। তন্ময় ভ্রু উঁচু করে তাকালে বলে,
'আমি চোখ বন্ধ করে থাকলে আপনি ভয় পাবেন।'
'আমি ভয় পাব?'
'হু।'
'কেন ভয় পাব?'
'আমি যে কারণে ভয় পাচ্ছি।'
'তুই কী কারণে ভয় পাচ্ছিস?'
'এখানে অন্ধকার। অনেক গাছপালা, জঙ্গলের মতো। কেউ নেই। আবার ঝড়বৃষ্টি।'
'তো?'
'ভুতপ্রেত থাকে তো এসব জায়গায়।'
'তাতে কী?'
'তাতে কী মানে? তারা মানুষের ওপর ভর করে।'
'তাই নাকি। শুনেছিলাম ভুতপ্রেত সুন্দরী মেয়েদের বেশ পছন্দ করে। তাদেরকেই চোখে রাখে, তাদের ওপর ভর করে।'
অরুর বুকের ওঠানামার গতি বাড়ল। চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। দুহাতে শক্ত করে ধরল তন্ময়ের বলিষ্ঠ হাত। মিহি গলায় বলল,
'আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন!'
তন্ময় গাঢ় দৃষ্টিতে ওর মুখখানা দেখে। নির্বিকার কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
'ভয় লাগছে?'
'ভয় দেখিয়ে আবার এমন বলছেন কীভাবে!'
'ভয় সারাব?'
অরু মাথা তুলে তাকায়, 'বললেই ভয় সারানো যায়? এই জায়গা ভীষণ ভয়ানক। নর্মাল মানুষ ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক।'
'তারমানে দাঁড়ায় আমি নর্মাল মানুষ নই? নিশ্চিত ভুতপ্রেত আমার ভেতর ঢুকেছে।'
এবার অরু থমকে পড়ে। সাংঘাতিক ভয়ে স্থির হয়ে আসে পা-জোড়া। ওসময় আসমান কেঁপে বজ্রপাত হতেই, চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে। অমাবস্যা নামে আদুরে মুখখানায়। ভয়ে এইটুকুন হয়ে আছে গোলগাল মুখটা। তন্ময় পুনরায় জিজ্ঞাসু সুরে বলে,
'ভয় সারাব?'
অরু তোতলানো গলায় শুধাল,
'কী...কীভাবে!'
তন্ময় বড্ড আচমকা মাথা নামিয়ে আনে অরুর সমান। বৃষ্টির জলে ভিজতে থাকা রসালো কম্পিত ঠোঁট জোড়ায় শব্দ করে এক চুমু বসায়। এতটাই দ্রুত ঘটে গিয়ে শেষ হয় যে অরু হতবাক, বিস্মিত। ভেতর থেকে রুহ চলে গিয়েছে যেন! মূর্তির মতো অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে লোহার মতো দাঁড়িয়ে। তন্ময় নিচু হয়ে এক হাত ওর পিঠে রাখে এবং অন্যহাত গোড়ালির নিচে। টানটান ভঙ্গিতে পাঁজাকোলে তুলে ফেলে। বড়ো-বড়ো পায়ের ধাপে সামনে অগ্রসর হয়।
আড়ালে-আবডালে খেয়াল করে অরুর হতভম্ব নজর।
_____
গাড়িটা এসে থামল মাত্র। তন্ময় দ্রুত অরুকে ঠেলে ভেতরে বসিয়ে দরজা লাগায়। নিজে ড্রাইভিং সিটের পাশে গিয়ে বসে। শাবিহা নিজের গায়ের ওড়না খুলে অরুকে পেঁচিয়ে নেয়। রুবি অরুর চুলগুলো মুছে দিচ্ছে। মেয়েটা শীতে কাঁপছে তবে জবান বন্ধ। কেমন হতভম্ব হয়ে আছে। তবে কারো সন্দেহ হলোনা কিছু। ও তো গিয়েছিল এভাবেই। একদম নিশ্চুপ হয়ে। দীপ্ত অরুর ঠান্ডা হাত দুটো চেপে বসে আছে।
আকাশ টি-শার্টের ওপর চ্যাক-শার্ট পরেছিল। ওপরের শার্ট খুলে তন্ময়ের দিক এগিয়ে দিল। তন্ময় সময় নিয়ে খুলল সাদা শার্ট খানা। দুহাতে ভেজা চুলগুলো কপাল থেকে উঠিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া শার্ট নিলো। আকাশ গাড়ি স্টার্ট করল। একটানে চলতে লাগল তীব্র বর্ষণময় রাস্তায়।
শাবিহা ধীর গলায় অরুকে ডাকল,
'এই অরু! খারাপ লাগছে? ভীষণ ভয় পেয়েছিলি বুঝি?'
অরু মাথা তুলে তাকাল। তন্ময় লুকিং গ্লাসেই তাকিয়ে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো। অরু চোখ বড়ো করে বলল,
'আপু, আমাকে একটা বড়ো করে চিমটি কাট। এক্ষুনি।'
শাবিহা বোকা অরুর মুখটা ভালোভাবে দেখে হাতে চিমটি কাটল। সামান্য ব্যথায় 'উহু' শব্দ করল মেয়েটা। বিড়বিড়িয়ে কীসব বলতে লাগল। শাবিহা ধাক্কা দিয়ে প্রশ্ন করল,
'কিররে, কী হয়েছে?'
'কি..কিছুনা। মাথা ভাড় লাগছে।'
'নে কাঁধে মাথা পেতে ঘুমা। শীঘ্রই বাসায় ফিরব।'
অরু কাঁধে মাথা রেখে চুপ রইল। বাকিটা রাস্তা নীরবতায় গেল। তন্ময় ফোনটা টিস্যু দিয়ে মুছতে লাগল। আকাশের হুটহাট প্রশ্নে টুকটাক জবাব দিতে থাকল। ঘন্টাখানেক লাগল শাহজাহান বাড়ির সামনে আসতে। গাড়িটা আর ভেতরে ঢোকাল না। ইতোমধ্যে অরু ঘুমিয়ে ঢোল। কোনো হদিস নেই দিনদুনিয়ার। শাবিহা ডাকল অরুকে ধীর গলায়। অরু সময় নিয়ে জাগে। চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকাতেই তন্ময়কে দেখে, ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রয়। রুবি বলে,
'তাড়াতাড়ি চল। তুই তো আজ জ্বর বাঁধাবি।'
অরু ধীরেসুস্থে বেরোতে-বেরোতে শাবিহা, রুবি ওরা দৌড়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। তন্ময় ছাতাটা মেলে অরুর মাথার ওপর ধরে। ধীর গলায় বলে,
'যাচ্ছিস না কেন?'
অরু ঠোঁট নাড়ায়। কিছু একটা বলতে চায় যেমন। তবে বলা হয়না। তন্ময়ের ধরে রাখা ছাতার নিচে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। শাবিহা পুনরায় ফিরে আসে অরুকে নিতে। তবে দুজনকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আর এগোয় না। হেসে অগোচরে ফিরে যায়।
অরু কিছু একটা বলতে নেয়, 'আপ..আপনি...'
'আমি?'
অরু মাথা তুলে তাকায়। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে আচমকা এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। তন্ময় নির্নিমেষ চেয়ে রয় ওর যাওয়ার পথে। হৃদয় বলে ওঠে,
'প্রিয়তমা আমার, প্রেয়সী আমার। দূরে না থেকে কাছে এসে দেখ। বুকে মাথা পেতে শোনো কী ধরনের অসুখ তুমি, কী নিদারুণ ব্যথিত সুখে আছি আমি!'
.
.
.
চলবে.............................