তীব্র বর্ষণ থেমেছে অনেকটা সময় হলো। মেঘেদের রাজ্য ছুটে কোথায় যেন পালাল। আঁধারে আসমানে ফকফকে সাদা অর্ধখণ্ডিত চাঁদখানা কেমন নিশ্চুপ, নিস্তব্ধতার গান গাইছে। হালকা-পাতলা শান্তস্থির বাতাস বইছে। জানালার গ্লাস দুপাশ দিয়ে মেলে রাখা। বাতাসের স্পর্শ আরামে ছুঁয়ে চলেছে। ধবধবে শুভ্র রঙের দেয়াল ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা ঘুরছে দুটোয়। মিনিটের কাঁটা চারে আর সেকেন্ডের কাঁটা অনিমেষ ছুটছে। ১০৩° জ্বরে তন্ময় অচেতন হয়ে বিছানায় পড়ে। জবেদা বেগম ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে। হাতে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার। সেটি কপালের সামনে ধরে জ্বরের তাপমাত্রা জেনে নিলেন। ১০৩° জ্বর। চোখজোড়া মুহূর্তে লালচে হলো। ভেজা ভাঁজ করা রুমাল খানা কপালে ভালোভাবে জাপ্টে দিল। তন্ময় অস্পষ্ট গোঙাল। মাথা ভারী। সর্বশরীর আগুনের ন্যায় গরম। দেহের ওপর অদ্ভুত চাপ পড়ছে। চোখের ওপর বুঝি বড়ো পাথর রাখা? নাহলে মেলে তাকানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে কেন?
এতটা তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কারণ কী? বৃষ্টিতে খানিকক্ষণই তো ভিজেছিল মাত্র। এতটা জ্বর হওয়ার তো কথা নয়। নাকি প্রথম চুমুর ছোঁয়াতে এই রাজ্যের কঠিন জ্বর উঠেছে শরীরে? হয়তো। ওই আবেদনময়ী কেশ, টানা হরিণী চোখ, নেশাগ্রস্ত অধর তার ধৈর্যের পরীক্ষা নেয় প্রতিনিয়ত। দুএকবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে বসলে ক্ষতি কী? মস্তিষ্ক সচল হলো বুঝি। তন্ময় বহু প্রচেষ্টায় চোখ মেলে তাকাল।
জবেদা বেগম পাশেই বসেছে। নীরবে কাঁদছে। তার কান্নার কারণ বুঝল না তন্ময়। কোনোমতে গভীর, ভাঙা পুরুষালী গলায় শুধাল,
'কাদছ কেন মা?'
জবেদা বেগম কান্নারত নয়নে, ঝাঁজাল গলায় বলেন,
'কান্না করতে মন চাইল তাই কান্না করছি।'
তন্ময়ের সরু ফ্যাকাসে অধর ঘিরে ছুটল সাময়িক হাসির রেখা,
'ঠিক আছি আমি। সামান্য জ্বর। রাতের মধ্যে সেরে যাবে।'
'সামান্য জ্বর বলছিস? ১০৩° জ্বর। কী এমন করেছিস যে এতো জ্বর এসছে!'
তন্ময় আনমনা হলো। ভাবুক নয়ন জোড়া দেয়ালে সেঁটে। মস্তিষ্ক নেড়েচেড়ে উঠে জানাল, কিছু একটা তো সে করেছে। ওই করনীয় কাজটির সম্পর্কে তো আর মা'কে বলা যাবে না। জবেদা বেগম উঠলেন। বিড়বিড়িয়ে বলে গেলেন,
'আদা রসের সাথে মধু মিশিয়ে আনছি। শুয়ে থাক।'
তন্ময় শুয়ে থাকল না। হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসল। জানালার পানে নজর রাখল মর্ধখণ্ডিত চাঁদটা মেপে দেখল অনিমেষ। জবেদা বেগম সময় নিলেন না। শীগ্রই কাঁচের গ্লাস হাতে ফিরে এলেন। আদার রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে এনেছেন। জ্বর-ঠান্ডা-কাশির জন্য উপকারী বেশ। তন্ময় অভ্যস্ত আদা-মধু খাওয়ায়। জ্বর তো আর তার কম হয়না! হলেই তো খেতে হয়। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে গ্লাস নিয়ে একটানে শেষ করল। গ্লাস ফিরিয়ে নিয়ে জবেদা বেগম নরম গলায় শুধালেন,
'কিছু কী খেতে মন চাচ্ছে আব্বা?'
তন্ময় ইতস্ততভাবে চুপসে গেল। খেতে তো ইচ্ছে করছে। তবে খাবার নয়। সিগারেট। এটা তো আর মা'কে বলা যাবেনা। তাই মাথা নাড়ায়। মুখে বলে,
'এখন ভালো লাগছে। রাত হয়েছে। শুয়ে পড়ো মা।'
'তোকে রেখে শুয়ে পড়ব? তুই ঘুমা। দেখি, শুয়ে পড়।'
তন্ময় অগ্যত শোয়। চোখ বুঝে নেয়। জবেদা বেগম ঘরের বাতি নেভান। পাতলা কম্বলটা আরেকটু গভীর ভাবে ছেলের শরীরে মেলে দেন। দরজাটা ভিড়িয়ে লিভিংরুমে বসেন।
_______
সূর্যের রশ্মি ভীড় জমিয়েছে বিছানার মাথায়। ঠিক তন্ময়ের মুখশ্রীর ওপর। ভ্রু-দ্বয়ের মধ্যিখানে ভাঁজ পড়েছে কিছু। ঘুমের ঘোরে বড়ো অসন্তোষ সে। পুরুষালী ডান হাতের কবজি বিরক্ত ভঙ্গিতে চোখের ওপর রাখল। দরজা খোলার সামান্য আওয়াজ এলো। জানালার গ্লাস লাগিয়ে, পর্দা আটকে দেওয়া হলো। মুহূর্তে আলোকিত রুমটি আঁধারে-আলোয় ডিম হয়ে এলো। ঘুমন্ত তন্ময়ের ভ্রু-দ্বয়ের ভাঁজ মিইয়ে গেল। সাথে ঘুম ও। নুপুরের রিনঝিন শব্দ ধ্বনির শ্রোত বইছে। কানে গানের ন্যায় বাজছে। নাকে ভেসে আসছে চেনাপরিচিত মেয়েলী সুঘ্রাণ।
তন্ময়ের ইচ্ছে করল চোখ মেলে চেয়ে, মায়াবী মুখটা সাতসকালে দেখতে। তবে ইচ্ছেদের সবসময় পূর্ণতা পেতে নেই। ইচ্ছের পূর্ণতা যদি এই ঘনিষ্ঠতা অদূরে ঠেলে দেয়, তাহলে ওই ইচ্ছের পূর্ণতা নাহওয়া শ্রেয়।
'কেন করলেন ওমন! কেন কিছু বলেন না। আর কতকাল অপেক্ষায় থাকব।'
মিনমিনে গলার মেয়েলী স্বরে অভিমান লেপ্টে। কেমন ধীর, স্থির শোনাল। এভাবে অরুকে কথা বলতে শুনেনি তন্ময়। কথাটুকু শুনে মেরুদণ্ড বেয়ে হিমশীতল বয়ে গেল যেন। ধড়ফড়িয়ে উঠল ব্যাকুল হৃদয়। অশান্ত, অবিন্যস্ত হলো মস্তিষ্ক। এই কণ্ঠের গতি জানান দেয়, তার অরু আর বাচ্চা মেয়েটি নেই। সে বড়ো হয়েছে। বুঝতে শিখেছে। তন্ময় ভাবল চোখ মেলে চাইবে। ওসময় দরজা ঠেলে শাবিহা প্রবেশ করে। অরুকে বলে,
'মা ডাকছে। শুনে আয়।'
অরু বেরিয়ে গেল। শাবিহা ভাইয়ের পাশে বসল। হাত বাড়িয়ে কপাল ছুঁয়ে মিহি কণ্ঠে ডাকল,
'ভাই? ওঠো। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে নাও।'
তন্ময় হাত সরিয়ে চোখ মেলে তাকায়। বসে যাওয়া গলার স্বরে শুধায়,
'কখন এলি?'
'ঘন্টা হবে। উঠো, একসাথে ব্রেকফাস্ট করব।'
'যা, আসছি।'
শাবিহা যেতেই তন্ময় উঠে দাঁড়ায়। এলোমেলো চুলগুলো কপাল থেকে তুলে পেছনে গুটিয়ে নেয়। ডান হাতের আঙুলের সাহায্যে চোখ ডোলে বাথরুম ঢোকে। গোসল নিয়ে বেরিয়ে দেখে দীপ্ত বসে চুপটি করে। তন্ময়কে দেখে লাফিয়ে দাঁড়ায়। ছুটে কাছে এসে বলে,
'এখন কেমন লাগছে ভাইয়া?'
'ভালো।'
'ভালো হলেই ভালো। চাচ্চু সারারাত জেগে ছিলেন তোমার চিন্তায়।'
তন্ময় স্মিত হাসে। ভেজা চুল তোয়ালেতে মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চুলগুলো মুছে কাবার্ড থেকে টি-শার্ট বের করে। গায়ে জড়িয়ে নিতে নিয়ে আড়চোখে দেখে অরু ঢুকছে রুমে। মাথা নিচু করে এসে বিছানা গোছাতে ব্যস্ত। দীপ্ত কী ভেবে চলে গেল কে জানে! অরু কম্বল ভাঁজ করে, কোমর বেঁকিয়ে বিছানার চাদর ঝেড়ে দিলো। ঝাড়ুটা এনে মেঝে ঝাড়ু দিতে শুর করল। তন্ময় অবাক হলো না বটে। ও সবসময় তার কাজকর্ম জড়িত কাজ করতে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তা রুম গোছানো হোক কিংবা কাপড় কাঁচা। ওপাশটা ঝাড়ু দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তন্ময়ের জায়গাটা ঝাড়ু দিবে বলে। তবে তন্ময় সরছে না। দাঁড়িয়ে চুল স্যাট করছে। অগোচরে আয়নায় অরুকে দেখছে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললে মেয়েটা চোরের মতো দৃষ্টি লুকিয়ে ফেলছে। চুমুটা বেশ কাবু করেছে ওকে! ভেবেই তন্ময় তাকাল ওই অধর পাবে। অরু নিচের অধরে দাঁত চেপে। তন্ময় দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। দুয়ারের দিক পা বাড়াল। অরুর পাশ দিয়ে যেতে নিয়ে থামল। অরু সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে তাকায়। তন্ময় থেমে থেমে বলে,
'রোগী দেখতে এসছিস নাকি প্রেমিক? এতো সাজগোছ করার মানে কী!'
আতঙ্কে অরুর চোখজোড়া বড়ো হয়। হতভম্ব ভঙ্গিতে মুখ খুলে। বেশ সময় নিয়ে বলে,
'কী! একটুমাত্র কাজল দিয়েছি। এখানে সাজগোছের কী দেখলেন তন্ময় ভাই?'
'অনেক কিছু।'
অরু আরও কিছু বলতে চায়। পূর্বেই তন্ময় পা বাড়িয়ে বেরিয়ে আসে। ওর ধ্যানজ্ঞান ওই রাতের দৃশ্য থেকে সরাতে এরথেকে ভালো ব্যাপার হয়না। ঠিক অরুর ধ্যান সরেছে। ঝাড়ু দিতে দিতে আনমনে বকবক করতে থাকল,
'কোথায় সাজগোছ করলাম। তন্ময় ভাই দেখি সাজগোছে এবিসিডি ও জানে না।'
______
সামনে ঈদুল আজহা। কোরবানির ঈদে শাহজাহান সাহেবরা গরু আনেন তিনটা। তিন ভাইয়ের তিনটা, একসাথে আনেন। ঠিক ঈদের সাতদিন পূর্বে। আজ বাদে আর নয়দিন বাকি ঈদের। মোস্তফা সাহেব চিন্তায় পড়লেন। ছেলে ছাড়া কোরবানি কীভাবে হবে! কোরবানিতে গরু আনা থেকে ধরে কাটা পর্যন্ত তার ছেলেই দেখাশোনা করে। তার ওপর স্ত্রী নারাজ! রোজার ঈদ গেল তার মাটি হয়ে। এবার কি কোরবানির ঈদ ও তেমন হবে? সম্পূর্ণ পরিবার ছাড়া কি ঈদের আনন্দ আছে? বড়ো ভাইকে চিন্তিত দেখে আনোয়ার সাহেব প্রশ্ন করলেন,
'কী ভাবছেন ভাই?'
'কিছুনা।'
'ভাই! হাটে যাব যেদিন আগেই তন্ময়কে বলে রাখব।'
'ও যাবে?'
'কী বলেন ভাই! যাবে না আবার? ও জানে না আপনি কেমন? ও না গেলে যে আপনার ভাত হজম হবে না, ঠিক জানে। দেখবেন চলে এসেছে সময় মতো।'
মোস্তফা সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। সরু চোখে ছোটো ভাইকে আগাগোড়া দেখে নিলেন। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
সূর্যাস্ত হলো মাত্র। অফিস থেকে বেরোনোর ঘন্টাখানেক পূর্বে কল করল মাহিন। ধানমণ্ডির লেকের পাড়ে আছে সবগুলো। ওখানেই চলে আসতে তাকে। অফিস শেষ করে তন্ময় বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বেরোল। বাইকের গতি মাঝামাঝিতে। আবহাওয়া আজ শান্ত। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবন ক্ষীণ।
পৌঁছাতে সময় লাগল না। বাইক থেমেছে চেনাপরিচিত জায়গায়। অদূরে এদিক-ওদিক ছিটকে বসে তার বন্ধুবান্ধব। ভার্সিটির ক্লাসমেট কিছুও উপস্থিত। তাকে দেখেই হৈচৈ পড়ে গেল। তন্ময় তাদের কাছাকাছি আসতেই, মাহিন একটা সিগারেট হাতে ধরিয়ে দিলো। পাশে বসতেই মাহিন বলে ওঠে,
'দোস্ত! রনিতা কী বলে দেখ! স্টিল শি'জ ক্রাশড ওন ইউ।'
তন্ময় মাথা তুলে তাকায়। রনিতা তার দিকেই চেয়ে।
ভদ্রতাসূচক মাথা নাড়ায় সে। দৃষ্টি সরিয়ে সিগারেট ধরায়। কথায়-কথায় আড্ডাবাজিতে সময় গিয়ে ঠেকে এগারোটা নয়ে। তন্ময় হাত ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ায়। বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে বাইকে চড়ে বেরিয়ে পড়ে।
মাত্রই লিভিংরুমে এসে বসেছে তন্ময়। জবেদা বেগম ছুটে এলেন। ছেলের হাতে ঠান্ডা পানির গ্লাস ধরিয়ে শুধালেন,
'গরু আনতে যাবি না?'
'যাব।'
'কখন?'
'যখন সময় হবে।'
'বাবার মতো ত্যাড়া কথা শুধু।'
মুখ বেঁকিয়ে চলে গেলেন তিনি। তন্ময় সেলফোন তুলে স্ক্রিনে নজর বোলাল। অরু ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ওর সাজগোছ করা একটি ছবি দিয়ে। সুন্দর একটা কাজ করা কামিজ পরে, শুভ্র রঙের। চুল কার্ল করে। স্মোকি ম্যাট মেক-আপ করেছে। ছবির নিচে লেখা,
'এটাকে বলে সাজগোছ।'
তন্ময়ের হাসি পেলো এবং সে হাসল ও। ছবিটি সেভ করে হোমস্ক্রিনে স্যাট করল। সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল।
'মায়াবিনী এক যাকে দেখতে দেখতে সময় ফুরোয়, দেখার সাধ নয়।'
.
.
.
চলবে..............................