শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ২৭ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


আঁধারে আসমানে ভেসেছে এক গোলাকার ধবধবে সাদা চাঁদ। চাঁদের সৌন্দর্য দ্বিগুণ করতে জ্বলে উঠেছে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র নক্ষত্র। তারা অপরূপ চাঁদ জুড়ে স্থায়ীভাবে বসে। জানালার পাশে আরামদায়ক চেয়ারে বসে আছে তন্ময়। পরনে কালো-সাদার সংসৃষ্ট টি-শার্ট। ছোটো চুলগুলোতে এখনো হালকা-পাতলা ভেজাটে ভাব রয়েছে। ঊরূর ওপর অ্যাপল ল্যাপটপ রেখে, দু'হাতের আঙুল গুলো ব্যস্ত ভঙ্গিতে কি-বোর্ড চেপে চলেছে। নিস্তব্ধ ঘর জুড়ে কি-বোর্ডের ধ্বনি। খোলা জানালা দ্বারা প্রবেশ করছে, মৃদু হিমশীতল হাওয়া। কিছু একটা ভেবে তন্ময় মাথাটা ডান পাশে ফেরায়। দৃষ্টি গিয়ে ঠেকেছে ওই সুদূরে অবস্থিত চাঁদের পানে। অল্পসময় ওই আসমানের সৌন্দর্য দেখে তন্ময়ের তৃষ্ণা পেলো। প্রেয়সীকে একনজর দেখবার তৃষ্ণা। ল্যাপটপ শব্দ করে বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে বারোটা বিশে। দু'একবার রুম জুড়ে ব্যস্ত চরণে পায়চারি করল। আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল তো! ওই চাঁদের দিকে তাকানোই উচিত হয়নি। এখন ভেতরটা অদ্ভুত শিহরণে ছটফট করছে। গলা শুঁকিয়ে মরুভূমি। ত্রিশ সেকেন্ডের মতো থমকে পড়ল তন্ময়। ভাবল স্থির মস্তিষ্কে। পরমুহূর্তেই ওয়ালেট জিন্সের পেছন পকেটে পুরে, সেলফোন হাতে কামরা ছাড়ল। লিভিংরুমে জবেদা বেগম কাঁথা সেলাই করছেন। দু'নয়নের পাতায় কালো ফ্রেমের পাওয়ার চশমা। তন্ময় মুখ্য দরজায় পৌঁছে জুতো জোড়া পরতে-পরতে অসন্তোষ কণ্ঠে বলল,
 'তোমাকে না বলেছি কাঁথা সেলাই করবে না?'
 'কাঁথা সেলাই করব না। কাপড়চোপড় ধুব না। কোমর বেঁকিয়ে মুছামাছি করব না। তাহলে করব কী?'
 'কিছু করতে হবে না।'

 ছেলের কপালের চামড়ায় চার-পাঁচেক ভাঁজ দেখে, জবেদা বেগম আলগোছে কাঁথাটা কোল থেকে সরিয়ে রাখলেন। বোঝালেন আপাতত কাঁথাটা সেলাই করবেন না। চোখের সমস্যাজনিত কারণে মাথায় প্রায়শই যন্ত্রণা হয়, এরজন্যই তো ছেলেটা এভাবে রাগে। চশমা খুলে শুধালেন,
 'তুই কি বেরোচ্ছিস?
  'হ্যাঁ। '
  'এই, এতো রাতে?'
   'উম, যাব আর আসব।'
   'আচ্ছা। চটজলদি ফিরিস।' 

অলিতে-গলিতে মানবছায়া মাত্র নেই। নিস্তব্ধ, নির্জন চারিপাশ। কুকুরদের চেঁচামিচির ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে থেমে-থেমে। শাহজাহান বাড়ির লোহার সদরদরজায় তালা মেরে রাখা। সম্পূর্ণ বাড়ির বাতি নেভানো। চওড়া দেয়াল লেপ্টে অবস্থিত ফুল গাছটার পেছনে নিজেকে আড়ালে রেখে দাঁড়াল তন্ময়। দোতলার চেনাপরিচিত ওই বারান্দায় নজর রাখল। রাত নেই দিন নেই, এই মেয়ে বারান্দায় ভ্যাবলার মতো বসে থাকতে পারে। আদোও আছে কী? তন্ময় আঁধারে বারান্দায় এক মানবছায়া লক্ষ করল। রেলিঙয়ে কনুই রেখে, হাতের মুঠোয় মাথা চেপে সুদূর আসমানের চাঁদে পানে চেয়ে। চাঁদের পানে চেয়ে নিশ্চিত তার কথা ভাবছে। নাহলে তখন চাঁদ দেখা মাত্রই তন্ময়ের শক্তপোক্ত হৃদয়টা ব্যাকুল হয়ে উঠবে কেন? কেন হৃদয় আন্দোলন করে চলবে ওকে একবার দেখবার ইচ্ছেতে? 

ঠিক এমন সময় সেলফোনের স্ক্রিন জ্বলে ওঠে। ম্যাসেজ আসে টুং শব্দের মাধ্যমে। লক স্ক্রিনে ভাসছে নিউলি সেন্ড ম্যাসেজ। 'আজকের চাঁদ সুন্দর।' ম্যাসেজটি এতটুকু শব্দের। মাত্রই পাঠিয়েছে অরু। তন্ময়ের ঠোঁটের দীর্ঘতা প্রসারিত হল। ম্যাডাম সেলফোন হাতে নিয়েই বসেছে তাহলে! তন্ময় ঝটপট কল করে। এক রিঙে রিসিভ হয় সবসময়ের মতো। অরুর চমকিত, আবেগে আপ্লুত কণ্ঠে মেঘের জোয়ার বসেছে যেন,
 'হ্যালো। হ্যালো, তন্ময় ভাই!'

ওর এমন হুটহাট চিৎকারে অল্পবয়সে আড়কালা হবে তন্ময়। কান একটা কিছুদিনের মধ্যে কাজ করবে না নিশ্চিত। ফোন কান থেকে কিছুটা দূরত্বে রেখে কণ্ঠের গম্ভীরতা বজায়ের ভঙ্গিমায় বলে,
'ঘুমাসনি কেন?'
 'ঘুম তো ঘুমাচ্ছে। আমি ঘুমের পাহারা দিচ্ছি।'
  'বড্ড কাজের মানুষ।'
  'অবশ্যই! তা আর বলতে? আমাকে যে পাবে তার ভাগ্য খুলে যাবে।'

তন্ময় হাসল। দৃষ্টি উঁচিয়ে দেখল ওই আবছায়ার উড়নচণ্ডী রূপের মোহ। একদণ্ড শান্তিতে দাঁড়িয়ে নেই। পুরো বারান্দা জুড়ে তার পদচারণ। দুহাতে কানে ফোন চেপে কী অদ্ভুত মুগ্ধতা বয়ে বেড়াচ্ছে। এখন ওর মুখশ্রীর আবির্ভাব কেমন? হাসি-হাসি নাকি লাজুক? তন্ময় গলার স্বর নামিয়ে শুধায়, 
 'ইউ শিয়র? ভাগ্য বন্ধ হবে না তো আবার?'
 'কে পাবে তার ওপর নির্ভর করছে। আমার মনের মানুষ পেলে নিশ্চিত ভাগ্য খুলবে। খুলেই থামবে না, ভাগ্যের প্রমোশন হবে।'
      
 ঠোঁটের হাসিটুকু দমিয়ে, কণ্ঠের মুগ্ধতা গিলে তন্ময় বলে, 
 'একটা কাজের জন্য কল করেছিলাম।'
 'কী কাজ?'
 'আমার কাবার্ডে ল্যাপটপ আছে। আর্জেন্ট দরকার ওটা। আর্জেন্ট বলতে, রাইট নাও। নিয়ে আসতে পারবি?'

অরুর কণ্ঠে ব্যস্ততা, 'আপনি আসবেন বাড়ির সামনে? এখন?'
'দরকারের জন্য তো আসতেই হয়।'
'আসুন তাহলে। আমি এক্ষুনি নিয়ে নামছি।'

অরুর এক্ষুনি বলতে, এক্ষুনি। পাঁচ মিনিট নেয়নি নিচে নামতে। চাবি দিয়ে সদরদরজা খুলে ঝটপট সামনে এসে দাঁড়াল। চাঁদের আলোয় মুখটা স্পষ্ট। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমেছে। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। বুকের দ্রুততম ওঠানামার গতি তার চোখের সামনে। নজর সরাতেই অরু রুদ্ধস্বরে
শুধাল,
 'এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে চলে এলেন!'
 'পায়ে হেঁটে।'
  'এরজন্য এতো ফাস্ট! এইযে নিন ল্যাপটপ।'

তন্ময় নিলো। হাত ঘড়ি দেখে, চলে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, 'আচ্ছা, যা তাহলে ভেতরে।'

অরু শ্বাসপ্রশ্বাসের অস্বস্তিজনিত অস্থিরতা দেখিয়ে শুধাল, 'চলে যাবেন?'
'তো? দাঁড়িয়ে থাকব?'
 'না মানে... বলছিলাম.... '
  'হু?'

অরু চুপসে রয়। অসহায় মুখটুকু লুকোতে থুতনি বুকে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তন্ময়ের মায়া হয়। হৃদয়ে অনুভূতির জোয়ার নামে। নরম গলায় প্রশ্ন করে,    
'কিছু বলবি?'
'বলব। বলতে চাই।'
'শুনছি।'
'বলছিলাম..ওইযে, সেদিন ওভাবে ক..করলেন যে। ওটা কেন করলেন!'
 'কী করেছিলাম?'

অরু মাথা তুলে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই লজ্জিত হয়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বাকিটুকু আর বলতে পারে না। গলাটা কেউ যেন চেপে ধরেছে। তন্ময় অগচোরে হাসে। মুখে বলে,
 'ভেতরে যা।'
 'যাব না। আপ..আপনি জবাব দিচ্ছেন না কেন!'
  'কীসের কথা বলছিস? আমিতো বুঝতে পারছি না।'

অরু বিড়বিড়িয়ে ওঠে, 
'ওসব করে এখন বুঝতে পারছে না।'

তন্ময় অন্যপাশে তাকিয়ে না শোনার ভঙ্গিতে শুধায়,
 'কিছু বলছিস?'
  'না তো।'
  'ভেতরে যাচ্ছিস না যে?'
  'একটা কাজ বাকি।'
   'কী কাজ?'

তন্ময় আগ্রহী চোখে ফিরে তাকাতে নেয়, পূর্বেই আচমকিত নরম তুলতুলে ঠোঁটের বর্ষণ নামে তার বা'গালে। শুধু একবার নয়, দু'দুবার। এবং ভীষণ দ্রুত গতিতে। মধু খেয়ে আর মেয়েটা দাঁড়ায় না। ছুটে ভেতরে ঢুকে পড়ে। থেমে সদরদরজা লাগানোর সাহসটুকুও নেই যেন ওর। তন্ময় স্তব্ধীভূত। পাথরের ন্যায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অন্তরাত্মা যেন কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে। আত্মা ফেরত আসতে সময় নিলো বড়ো। তন্ময় মিটিমিটি হেসে গালে হাত ছুঁয়ে দেয়। এক দুষ্টুখিধে যে তার ও পেয়েছে, সেটি হৃদয়ে চেপে নেয়। শেষবারের মতো সদরদরজার পানে তাকাতেই, রুহু বেড়িয়ে আসার সূত্রপাত ঘটে। মোস্তফা সাহেব এসে দাঁড়িয়েছেন গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে। ঠিক কতটুকু কী দেখেছে তন্ময় বুঝতে পারছে না। 

পিতাপুত্র নিশ্চুপ। সমানতালে ধীর পায়ে গলিতে হাঁটছেন। কথা শুরু করলেন মোস্তফা সাহেব, 
 'কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে? আদোও তা মানছ?' 

তন্ময় রাতবিরেতে চোখ খুলে মিথ্যে বলল,  
'আমি কিছু করিনি। ল্যাপটপ নিতে এসছিলাম।'
  'ও বাচ্চা। অবুঝ।'

তন্ময়ের মুখশ্রীর পরিবর্তন ঘটে। গম্ভীর হয়ে ওঠে চেহারা। থেমে যায় চলন্ত পা-জোড়া। থমকে থেকে সময় নিয়ে বলে, 
'ও আর বাচ্চা নেই। যা হচ্ছে, বোঝার মতো বয়স হয়েছে।'

মোস্তফা সাহেব ত্যাড়া গলায় বলেন,
'বুঝলে কী আর এমন করত? তোমার থেকে বহুগুণ ভালো পাত্র পাব। ও...'
'তুমি পুরো দেশজুড়ে পাত্র দেখ বাবা! তবুও আমার থেকে ভালো পাত্র ওর জন্য পাবে না। আর যদিও মনে হয় পেয়েছ, সে আমার থেকে ভালো ওকে বুঝবে না। আমার থেকে অধিক ভালো বাসবে না।আমার মতো যত্নে রাখবে না। ওর জন্য আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে বহুগুণ ভালো কিংবা পারফেক্ট কেউ হতেই পারে না। আমিই একমাত্র ওর পারফেক্ট।'

তন্ময় থামে। বাঁকা হেসে বলে,
'তুমি বুঝবে কীভাবে? তোমার তো বউ নেই। ছেড়ে চলে গেছে। '
'চলে গেছে না নিয়ে গেছ?'
  'সময় হলে ফিরিয়ে দিব। গুড নাইট।'

তন্ময় সোজা হাঁটা ধরে। মোস্তফা সাহেব আরও দু'চারটে কথা গলা তুলে বলেন। তবে জবাব পাননা। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বাড়ির দিক হাঁটা ধরেন। এই ছেলে-মেয়ে দুটো নিজ রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে। তার আর লম্বা নাক গলানোর মানে আছে?
 
____

আষাড়মাসের ব্যস্ত বর্ষণের ন্যায় বর্ষিত হলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ। তন্ময়ের নানি জয়তুন নেছা সিলেট হতে বড্ড আচমকা ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি শাহজাহান বাড়ির লিভিং রুমে বসে আছেন। হাতে চায়ের কাপ তুলে, বাড়ির সকলের গর্দানের ওপর তলোয়ার চেপে রেখেছেন। উনিশ নাবলে বিশ বললেই গর্দান কেঁ টে নেবেন নিশ্চিত! আনোয়ার সাহেব ভাইপোকে কল করে, এই চিরন্তন সত্যগুলো স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে বলে চলেছেন। সারাবছর এভাবেই জয়তুন বেগম মেয়েজামাইয়ের ভুল খুঁজে বেড়ান। এখন তিনি বিনা ঘোষণায় পদার্পণ ঘটিয়েছেন। যদি কোনোভাবে জানতে পারেন, তার একমাত্র আদরের কন্যা এবং নাতি ঘরদুয়ার ছাড়া, তাহলে কী ধরনের মসিবত দাঁড় করাবেন তা আর বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আনোয়ার সাহেব বলেন,
 ভাইয়াকে বাঁচাতে দ্রুত ফেরো বাবা। নাহলে শাহজাহান বাড়ি আর শাহজাহান বাড়ি থাকবেনা। কেরামত বাড়ি হয়ে যাবে।'

তন্ময় চিন্তায় পড়ে। অফিস থেকে বেরোতে-বেরোতে বলে, 'ব্যস্ত রাখো চাচ্চু। আমি এক্ষুনি ফিরছি মা'কে নিয়ে।'
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন