খুঁত - স্পৃহা নূর - অনু গল্প


হাতের বেশখানিকটা পুড়ে গেছে। আয়েশা দাঁতে দাঁত চেপে বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে হাতে পানি ঢালছে। এখনো অনেক রান্না বাকি। কিভাবে কি হবে কে জানে! 
এদিকে আসিফের আসবার সময় হয়ে আসছে। আজ অফিস থেকে ফেরার সময় শুধু আসিফই আসবে না, আসিফের সব কলিগরাও আসবে। নতুন বিয়ের পর ওর কলিগরা বায়না ধরেছে নতুন বৌয়ের হাতের রান্না খাবে। আসিফ অফিস থেকেই একটু পর পর অয়েশাকে টেক্সট করছে। রান্না কতদূর, কি কি আইটেম রান্না হচ্ছে, বাড়ি ঠিক মতো গোছানো হয়েছে কি না.. এসব হাজারো প্রশ্ন।
সেসব টেক্সটের উত্তর দিতে গিয়েই অন্যমনস্ক হয়ে আয়েশার হাতটা পুড়লো। বাড়িতে এমন কেউ নেই যে এ অবস্থায় তাকে একটু সাহায্য করবে। এদিকে আসিফ ভীষণ জেদি আর গোছানো মানুষ। কোন কিছু উনিশ-বিশ দেখলেই হুট করে রেগে যাওয়া তার আর একটি বদ অভ্যাস। অগোছালো কোন কিছুই তার পছন্দ না। এইত বিয়ের দিন, 
আসিফের সাথে সবে পা দিয়েছে শশুর বাড়িতে আয়েশা। বেখায়েলে হুট করে দরজার চোকেটে আটকে গেল তার বেনারসি শাড়িটা। টান পড়তেই কাধের কাছে, ব্লাউজের সাথে সেফটিপিন লাগানো আচলের কিছু অংশ হালকা ভাবে ছিড়ে গেল বোধহয়। সাথে সাথেই পাশে দাড়ানো আসিফ কি করে যেন তা টের পেল।চট করে আয়েশার কাধে হাত রাখলো। এত অচেনা মানুষের মাঝে আয়েশার মনে হলো, হ্যা, আসিফই এখানে তার একমাত্র ভরসার মানুষ। অপ্রস্তুত হয়ে অসহায় চোখে আসিফের দিকে তাকালো সে।
আসিফ তার কাধে হাত রাখলো ঠিকই কিন্তু আয়েশার চোখে চোখ রাখলো সরু চোখে অদ্ভুত এক ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে। এমন রুঢ় দৃষ্টি দেখেই আয়েশার চোখে পানি চলে এলো৷ সে কি নিজের ইচ্ছেতে এমন করেছে নাকি! বেখায়ালে হঠাৎ হয়ে গেছে। 
আসিফ রুমে আসার সঙ্গে সঙ্গে কোমরে হাত গুজে কিছুটা বিরক্তি আর রাগ মেশানো গলায় আয়েশার সামনেই, আসিফ তার বড় ভাবিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
" এই জন্য বাচ্চা মেয়েছেলে বিয়ে করতে চাই নি। কোন আক্কেলে এই মেয়ে এমন একটা কান্ড ঘটালো? "
অয়েশা মাথা নিচু করে কাদো কাদো হয়ে বলল," আমি তো ইচ্ছে করে এমন কিছু করি নি।"
অসিফের রাগ যেন আরও দ্বিগুন বেড়ে গেল। বলল," তোমাকে কিছু বলেছি আমি? আমার আর অর্পা ভাবির মধ্যকার কথায় কেন নাক গলাও তুমি? "
বিছানায় বসে আয়েশার দিকে তাকিয়ে আসিফ রাগে গোজ গোজ করতে থাকলো। অর্পা ওর মাথা থেকে পাগড়ি খুলে নিয়ে বেড সাইডের টেবিলে রাখলো। সেখানে রাখা এক গ্লাস পানি আসিফের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, 
"আসিফ এত মাথা গরম করলে চলে? এত রাগ করার মতোও কিন্তু কিছু হয় নি৷ "
আসিফ কোন উত্তর দিলো না৷ পুরোটুকু পানি এক নিশ্বাসে খেয়ে নিলো। 
অর্পা আরো বলল, " তুমি যতটা ছোট আয়েশাকে ভাবছো ও কিন্তু এতটাও ছোট নয়। তোমার চেয়ে মাত্র তো ছয় বছরের ছোট। তোমার ভাইয়াও তো আমার চেয়ে বয়সে কত বড়।"
"আর সেজন্যই তো আপনি.." আসিফ বলতে গিয়ে থেমে গেল। মৃত ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। অর্পা আসিফের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে আয়েশার পাশে বসিয়ে দিলো৷ তারপর আয়েশার কানে কানে কিছু বলল। আয়েশা সে সব শুনে আসিফের দিকে তাকাচ্ছিলো আর মিটি মিটি ভাবে হাসছিলো । অর্পা যাবার সময় আয়েশার হাতে একটা পানও গুজে দিলো।
অর্পা যাবার সাথে সাথেই আয়েশাকে আসিফ বেশ জোরে একটা ধমক দিলো।
" সমস্যা কি তোমার? পাগল ছাগলের মতো আমার দিকে তাকিয়ে তখন থেকে হেসেই যাচ্ছ।" 
আয়েশার এবার একটু জোরেই হাসি পেলো। বলল, 
 পাগল তো আমি না। পাগল তো হলেন আপনি। চৈতা পাগল। চৈত্র মাসে যে পাগল হয়। ভাবি বলল এই এক মাস এই জন্যই নাকি আপনার মাথা গরম থাকবে।চুলের প্রতিটা ডগায় রাগ থাকবে। আপনি রেগে গেলেও আমি যেন কিছু মনে না করি৷ এক মাস পর নাকি আপনি আবার পানির মতো ঠান্ডা হয়ে যাবেন? সত্যি এমন করেন আপনি? আচ্ছা পাগল তো আপনি!"
কথা শেষ হবার সাথে সাথে আসিফ রুম থেকে চলে গেল।কিছুক্ষন পর পাশের রুমে চেচামেচি শুনে আয়েশা ধীর পায়ে কিছুটা এগিয়ে গেল।
সে শুনতে পেল আসিফ চেচাচ্ছে। সম্ভবত তার মাকে বলছে ," আম্মা এই মেয়েকে আমি তালাক দেবো। অদ্ভুত রকম বেয়াদব এই মেয়ের সাথে আমি থাকবো না।"
আসিফের চেচামেচিতে আয়েশা তার শাশুড়ী মায়ের কথা তেমন শুনতে পাচ্ছে না। সে শোনার চেষ্টায় দরজার কাছে এগিয়ে যেতেই হুট করে আসিফের বাহুর সাথে খেলো নাক বরাবর ধাক্কা। আসিফ আবারও তাকে কিছু বলল না। বাইরে বেরিয়ে আবার চেচিয়ে বলল,
" আই কান্ট লিভ উইথ দিস চাইল্ডিশ গার্ল।"
আসিফের দাদী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো , "তাইলে আমার মতো বুড়ি কাউরে বিয়া করবি?" 
আসিফ রুমে ঢুকে সমস্ত রাগ যেন দরজার ওপর ঝারলো। প্রথমে সজোরে একটা লাথি দিলো৷ তারপর অতি রাগে ছিটকিনি আটকাতে গিয়ে নিজের হাত কেটে ফেললো।
আয়েশা আস্তে করে বলল," লাগলো বুঝি?"
" আমি তো পাগল।পাগল ছাগলদের মধ্যে ব্যাথা বেদনার অনুভূতি নাই। " দাত কেলিয়ে উত্তর দিলো সে।
আয়েশা এবার আর কোন কথা বলল না। ওয়াশরুম থেকে শাড়ি চেঞ্জ করে এসে দেখে আসিফ কাটা নখে ব্যান্ডেজ লাগাচ্ছে। আয়েশার ইচ্ছে করলো এই কাটা নখে একটা গুতো দিয়ে বলতে, " সামান্য ব্যাপারে এত চেচামেচি করার এনার্জি কই পান শুনি? আপনার গলা কি কোন পাওয়ার হাউজ? আপনার তো কোম্পানির চাকরি না করে ভন্ড কোন রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়া উচিত ছিল। সারাদিন কাকের মতো কা কা করে ভাষন দিতেন। সেই ভাষন আমি টিভিতে শুনতাম। " 
আয়েশা যখন এসব ভাবছিলো অসিফ তার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন সে আয়েশার মনে মনে বলা সব কথা শুনতে পেয়েছে। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, 
" এই আয়েশা একটু আগে যে শাড়িটা পড়ে ছিলে সেটা দাও তো।"
আয়েশা ভাবলো আসিফ হয়ত তাকে বিয়ের শাড়ি গোছাতে হেল্প করবে বলে চাইছে শাড়িটা। কিন্তু না! আসিফ শাড়িটা নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে কাচি দিয়ে কাটতে শুরু করলো। 
" এই শাড়ির জন্য এত ঝামেলা। শাড়ি রেখে লাভ কি! আর খুঁত ওয়ালা জিনিস আমার একদম পছন্দ নয়।"
আয়েশা ভাবির কথা শোনার পর থেকে আগের সব ঘটনা হালকা ভাবে নিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু এবার তার সত্যিই কান্না পেয়ে গেলো। নিজের বৌয়ের বিয়ের শাড়ি বিয়ের রাতেই কেউ এভাবে কুচি কুচি করে কাটে বুঝি?  
সে রাতের কথা আর মনে করতে চায় না আয়েশা৷ তবুও আজ হাত পুড়ে যাবার পর থেকে তার আবার ভয় হচ্ছে। আসিফ বাড়ি এসে কি না করে ফেলে আবার! রান্নাগুলোও এখনো শেষ হয় নি। সারা বাড়ি গোছানো বাকি। এদিকে পোড়া হাতটাতেও বুঝি খুঁত লেগে গেলো।
_____________
আয়েশা নিজে নিজেই কোন মতো ফোস্কা পড়া হাত আপাতত কিছু সময়ের জন্য ব্যন্ডেজ করলো। ফোস্কা পড়া জায়গাটুকু আড়াল করতে। রান্না না হোক অন্তত ঘরদোর গোছাতে হবে। আসিফ এসে সব কিছু এলোমেলো দেখলে মানুষজন না মেনে তাদের সামনেই চেচামেচি শুরু করতে পারে।আর রান্নার ব্যপারটা অন্য ভাবে সামলাতে হবে ভেবে নিলো আয়েশা।
আসিফের অন্য সব কিছু ভালো কিন্তু এই খুতখুতে আর বদ মেজাজী স্বভাব একটা মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে যথেষ্ট। ইদানিং বিরক্ত লাগে আয়েশার এসব।
___________
কলিং বেল বাজতেই স্বাভাবিক ভাবে দরজা খুললো আয়েশা। দরজায় আসিফ হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে হাতে এক তোড়া ক্যালেন্ডুলা ফুল নিয়ে। আয়েশার এটা পছন্দ সে জানে। আয়েশাকে হালকা বেগুনি রঙের জামদানী শাড়ির সাথে মুক্তোর জুয়েলারি বেশ মানিয়েছে। বিপত্তি বাধলো ঠিক তখন, আসিফের হাত থেকে আয়েশা যখন বা হাতে ফুল নিলো। 
আসিফ ওর লুকানো ডান হাত দেখার চেষ্টা করল। তারপর ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল, " এই তোমার ডান হাতে কিছু হয়েছে?"
"ওই সামান্য একটু... " 
আসিফ আরো কিছু জিজ্ঞেস করত।কিন্তু ততক্ষণে গেস্টরা এসে গেছে। আয়েশা লক্ষ্য করল শুধু আসিফের কলিগই আসে নি তার পেছনে আরো কিছু মানুষ আছে সম্ভবত। সে কি! অয়েশার বাবার বাড়ির সব লোকজনও আছে। তার সাথে ওর শাশুড়ী, অর্পা ভাবি আর তার দুই মেয়ে। আসিফ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ফিসফিসসিয়ে বলল,
" হ্যাপি বার্থডে আয়েশা।"
 আসিফ ওর জন্মদিন মনে রেখেছে! আয়েশা ভাবতেই পারে নি ওর জন্মদিনেও কেউ ওকে এভাবে সারপ্রাইজ দেবে কোনদিন। আসিফের পিছু পিছু রুমে গিয়ে আয়েশা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে। বলল, "মাঝে মাঝে আপনাকে এত ভালো লাগে কেন বলুন তো?"
আসিফ ওকে নিজ থেকে সরালো। এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলল," ইউ আর সো মাচ চাইল্ডিশ আয়েশা।"
তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, 
" এই তোমার হাতে কি হয়েছে বললে না?"
আয়েশা কি বলবে বুঝতে পারলো না। সে আরেকটা অঘটন ঘটিয়েছে। হাত পোড়ার কথা বললে সেটাও বলতে হবে। কিন্তু এতে এতগুলো মানুষের মাঝে আসিফ কি রিয়াক্ট করবে কে জানে!
আয়েশা শুধু বলল, "হুট করে ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি। ব্যাথা করছে তাই ব্যান্ডেজ করে রেখেছি।"
" খুব বেশি ব্যাথা পেয়েছো নাকি? হাড় টাড় মচকে গেল না তো?" বেশ উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল।
" না না। হালকা লেগেছে।তুমি খেতে এসো। সবাইকে খাবার বেড়ে দেই।" আয়েশা কথা কাটানোর চেষ্টা করলো।খাবার টেবিলে বাধলো আসল বিপত্তি। আসিফ দু এক বার খেয়েই খাবার আর মুখে তুলছে না। রাগে কটমট করছে বোঝাই যাচ্ছে। আয়েশা ব্যাপারটা লক্ষ্য করার পর থেকে ভুলেও আর তার দিকে তাকানোর সাহস করছে না। 
এর মধ্যে আয়েশার ছোট ভাই ইরাম হুট করে হাসতে হাসতে বলে বসলো, " আপা বিয়ের পর দেখি তোর রান্না একদম মেসের খালাদের মতো হয়ে গেছে। মুখে তোলা যাচ্ছে না, কিন্তু খেতে হচ্ছে।"
আয়েশা ইশারায় ইরামকে চুপ করতে বলল। এই ছেলেটা এখনো শিখলো না কোথায় কি বলতে হয়। তাও আবার এমন একজন দুলাভাই এর সামনে এসব ইয়ারকি করেই যাচ্ছে।
আসিফের কিছু কলিগ ইরামের কথা শুনে মুখ টিপে হাসতে শুরু করলো। কলিগদের একজন আবার আসিফের ভার্সিটি লাইফের ফ্রেন্ড।সে তো বলেই বসলো,
" খেতে এলাম ভাবির রান্না। আর তোর শালা তো দেখি তোর বৌ কে মেসের খালা বানায়ে ছাড়লো। "
আসিফ রাগ সংবরণ করতে না পেরে শাশুড়ীর সামনেই ইরামকে বলল," কোথায়, কখন কি বলতে হয় বাসা থেকে শেখায় নি বুঝি? তুমি তো এতটাও ছোট নও ইরাম।"
 আয়েশা বেশ বুঝতে পারলো আসিফ এবার একটা হুলুস্থুল কান্ড ঘটাবে। শুনেছে ঝড় ওঠার আগে আকাশ থমথমে থাকে৷ এই জন্য হয়ত আসিফ খেতে বসে সব কিছু টের পেয়েও থমথমে হয়ে ছিলো। এরই মাঝে ইরাম দিলো বাতাসের এক ঝটকা। ব্যাস এবার আসিফকে আর কে থামায়!
আসিফ থমথমে স্বরে বলল," রুমে এসো কথা আছে।"
ভীষণ ভয় পেলো আয়েশা। রেগে গেলে তাকে দেখতে ভীষণ ভয় লাগে যে! মাঝে মাঝে তো মনে হয় এবার বুঝি মেরেই ফেলবে। কেমন চোখ সরু কিরে দাত কিড়মিড় করে। আয়েশা ওর পিছু না গিয়ে সেখানে দাঁড়িয়েই বলল,
" একটা ভুল হয়ে গেছে। আমি আপনাকে একটা মিথ্যা বলে ফেলেছি আপনি রাগ করবেন তাই । রান্নাটা আসলে আমি করি নি। পাশের বাড়ির বুয়াকে বলেছিলাম একটু হেল্প করতে আর কি! কিন্তু উনার রান্না যে এত খারাপ তা তো জানতাম না। এরপর থেকে আর এমন কিছু করব না প্রমিস। "
সবার সামনে আয়েশার এমন উত্তর আসিফকে আরও বেশি করে যেন চটিয়ে তুললো।  
"এই মেয়েটা তার কলিগ আর বন্ধুদের সামনে এসব বলে তাকে কতটা ছোট করছে তা কি সে বুঝতে পারছে না। রান্না করতে পারে নি ঠিক আছে কিন্তু মিথ্যের আশ্রয় নিতে গেলো কেন! আর সবার সামনে এভাবে কাচুমাচু হয়ে সব স্বীকার করে কি প্রমাণ করতে চায় আয়েশা? সে তাকে খুব অসহায় বানিয়ে রেখেছে? সবাই কি তাকে কতটা নীচ ভাববে এখন? এসব ভেবে ক্রোধে আসিফের শ্বাস প্রশ্বাসের বেগের সাথে বাড়তে থাকে রাগের মাত্রা। 
রাগ সংবরণ করতে না পেরে আয়েশার গালে হাতই তুলে ফেললো সবার সামনে। আসিফের বন্ধু উঠে এসে না থামালে আজ বাড়াবাড়ি কিছু একটা হয়ত হয়েই যেত।
আয়েশার মা নির্বাক হয়ে তার একমাত্র জামাইয়ের এসব কর্মকান্ড দেখছে। তবে কি আয়েশা ভালো নেই? কখনো কিছু মুখ ফুটে বলে না মেয়েটা।আসিফের মা তার দিকে চেয়ে শুধু বলল," বেয়াইন কিছু মনে করবেন না। ছেলেটাকে ছোট থেকে এত শাসন করেছি তবুও এমন কেন করে বুঝতে পারি না। "
আয়েশার মা বলল," শাসনই শুধু করেছেন হয়ত। সঠিক শিক্ষাটা দেয়া হয় নি।শাসন আর শিক্ষা দেবার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আর ছোট থেকে শাসন করলে এমন হবারও কথা ছিলো না। " উনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েকে আর এখানে রাখবেন না।  
 ইরাম দৌড়ে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। বলল, " আপা চল বাড়ি যাই৷ তোর আর এখানে থাকতে হবে না।"

আয়েশা এ কথার কোন উত্তর দিলো না। রুমে গিয়ে মূর্তির মতো শান্ত কিন্তু শক্ত ভাবে বসে রইলো। চোখ দিয়ে পানি পড়লেও মুখে কান্নার কোন প্রতিক্রিয়া জানান দিলো না । 
গেস্ট চলে যাবার পর আসিফ রুমে এসে শান্ত গলায় বলল,
" আয়েশা তুমি ঠকাতেও শিখে গেছো? তোমার কি মনে হয় আমি তোমার হাতের রান্না চিনি না? আমার গেস্ট এর জন্য রান্না করতে তোমার ঝামেলা মনে হলে আগেই বলে দিতে পারতে। আমি বাইরে থেকে খাবার কিনে আনতাম দরকার হলে। এতটা ছোট করলে আমায় তুমি?"
আয়েশা শুধু বলল, " আমার পুরো কথা শোনা উচিত ছিলো আপনার। "
"আরও কিছু বলার বাকি আছে তোমার?"
আয়েশা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হাতের ব্যান্ডেজ খুলে বলল, " আমার হাত পু'ড়ে গেছে। গরম তেল পড়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। গেস্ট আসবে তাই এর মধ্যে এসব বলে ঝামেলা বাড়াতে চাই নি। বিয়ের দিন থেকে মনে করে আসছেন আমি চাইল্ডিশ। কিচ্ছু করতে পারি না। আপনার সংসার সামলাতে পারব না। ঠিকমতো গুছিয়েও রাখতে পারি না সব।এখন আমার সত্যিই মনে হচ্ছে আমি আমার পক্ষে হয়ত সম্ভবও না। এতটা পারফেক্ট এতটা গোছানো হওয়া। অনেক তো চেষ্টা করলাম। আর কত? "
আসিফ নিজের হাত আয়েশার দিকে বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো," দেখি কতটা পু'ড়িয়ে ফেলেছো? "
" যতটা আপনি আমার মন পু'ড়েছেন তার চেয়ে অনেক কম।"
" এত আবেগের কথা আমি বুঝি না আয়েশা। আমি সব কিছু প্র‍্যাক্টিক্যালি ভাবতে পছন্দ করি। " 
তারপর আসিফ আবার গম্ভীর হয়ে বলল,"হাত পু'ড়িয়ে ফেলেছো সেটা আগে বললে সমস্যা কি ছিলো? "
" বললে আপনি আবার আমাকে খোটা দিতেন।বলতেন 'ইউ আর সো মাচ চাইল্ডিশ আয়েশা'। তারপর হয়ত বলতেন সামান্য রান্না পারে না এমন মেয়েকে তালাক দেবো। ভয় পাই আমি আপনাকে কেন বোঝেন না? আর এভাবে আমার গায়ে হাত তুলে আপনি আমাকে না নিজেকে ছোট করেছেন সবার সামনে।" কথা শেষে আয়েশা নাক ফুলিয়ে ফোপাঁতে শুরু করলো। 
" আমাদের হয়ত আর এক সাথে সাথা সম্ভব নয় আসিফ। আমি গত এক বছরে অনেক ধৈর্য ধরেছি নিজেকে অনেক পাল্টানোর চেষ্টা করেছি। আপনার জন্য নিজেকে এভাবে পাল্টাতে পাল্টাতে হয়ত আমি আর নিজেকেই খুঁজে পাবো না। "
আসিফ কি যেন ভেবে জানালার দিকে তাকিয়ে শুকনো ভাবে হাসলো। তারপর আবার বলল," সিরিয়াসলি আয়েশা, ইউ আর সো মাচ চাইল্ডিশ। এমন আর করবে না,এসব আর বলবেও না।চলো, ওঠো ডাক্তার দেখাতে হবে। হাতের অবস্থা তো বারোটা বাজিয়েছ।"
আয়েশা আসিফের সাথে যাবে না বলে দিলো। ইরামকে নিয়ে সে নিজেই গেল ডাক্তার দেখাতে। আসিফ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না এ বিষয়ে। কিন্তু আয়েশার পিছু পিছু ঠিকই গেলো। সেখানে ইরাম বা আয়েশা কেউই তার সাথে কোন কথা বললো না৷  
ডাক্তার যখন আয়েশাকে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছিলো আসিফও পাশে ছিলো। সে বার বার ডাক্তারকে বলল, " বাচ্চা মানুষ একটু সাবধানে ব্যান্ডেজ করুন না।" 
আয়েশা বিরক্ত হয়ে বলল," ইরাম তোর দুলাভাইকে বলে দে, আঠারো বছরের পর সরকারি মতে কেউ বাচ্চা থাকে না। সেখানে আমি আঠারো পার করেছি পাচ বছর আগেই। আর আমাকে ছোট বলে সে নিজে যে বুইড়া ব্যাটা সাজতে চান। সরি তার এই উনত্রিশ বছরের কচি চেহারায় তা সম্ভব না।"
আসিফ কোন উওর দিলো না। আয়েশার এই স্বভাবটা তার বিরক্ত লাগে কোথায় কার সামনে কি বলতে হয় বুঝতে চায় না। তবে আজ বাড়িতে বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে বলে এখন আর কোন কথা বাড়াতে চায় না সে। মাঝে মাঝে কিভাবে যে এত রাগ উঠে যায় কে জানে।  
আয়েশা লক্ষ্য করলো, আসিফ বার বার ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করছে
"এই পো'ড়ার দাগ কত দিনের মধ্যে ঠিক হবে? দাগ থেকে যাবে না তো? ডান হাতে এমন দাগ থাকলে কেমন বিশ্রি দেখায়। যেমন করে হোক দাগটা যেন ঠিক হয়। চোখের সামনে এমন খুঁত! "
আয়েশার ইচ্ছে করলো জিজ্ঞেস করতে," খুঁতওয়ালা শাড়ির মতো খুঁতওয়ালা হাতও কেটে ফেলবেন?" 
তবে তার আসিফের সাথে আর কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। হসপিটাল থেকে ইরামের সাথে নিজের বাড়ি চলে গেলো। আসিফ শুধু বলল, " একেবারে চলে যাচ্ছ?"
আয়েশা বলল," আমার হাতে খুঁত হয়ে গেছে। আমি আর থেকে কি করব? আপনি বরং নিখুঁত কাউকে নিয়ে নতুন করে.... " 
কথা শেষ করার আগেই আসিফ বলল," এবার বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে আয়েশা।"
" বাড়াবাড়ি কে বেশি করে তা সবাই জানে।"

এর মধ্যে প্রায় দেড় মাস কেটেও গেলো।আয়েশার হাতও ঠিক হলো। আসিফও রইলো সেই একই। তবে দু মাসে আসিফ বেশ কয়েক বার তাকে নিতে গিয়েছে। শেষ বার আয়েশা নিজের রুমের দরজা পর্যন্ত খোলে নি। 
তবে এসবের পরিবর্তন এলো প্রায় দেড় মাস পর আয়েশার যখন সে জানতে পারলো সে আর একা নেই। তার মাঝে আসিফের ছোট্ট একটা অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে। 
আয়েশা কেমন চুপচাপ হয়ে গেলো। মাঝে মধ্যে অজ্ঞানও হয়ে পড়ে। সে মনে মনে আসিফকে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে সে,
" আমাদের বেবি কোন খুঁত নিয়ে জন্মালে কি করবেন আসিফ? ওকে রাখবেন না? নাকি মেরে ফেলবেন?"
___________
সব কিছুর পরিবর্তন এলো প্রায় দেড় মাস পর আয়েশার যখন সে জানতে পারলো সে আর একা নেই। তার মাঝে আসিফের ছোট্ট একটা অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে। 
আয়েশা কেমন চুপচাপ হয়ে গেলো। মাঝে মধ্যে অজ্ঞানও হয়ে পড়ে। সে মনে মনে আসিফকে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে সে,
" আমাদের বেবি কোন খুঁত নিয়ে জন্মালে কি করবেন আসিফ? ওকে রাখবেন না? নাকি মেরে ফেলবেন?"

এই একটা পরিস্থিতি দুটো পরিবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে দিলো। আর যাই হোক এ অবস্থায় কোন মুসলিম পরিবারে ডিভোর্স তো আর সম্ভব নয়। এদিকে আয়েশার ডিভোর্সের ব্যাপারে কী মত সে ব্যাপারেও সে মুখ ফুটে কিছু বলেও নি। আয়েশার বাবা নেই। অভিভাবক বলতে এখন মা আর বড় বোন আশা। যা সিদ্ধান্ত নেবার তাদেরই হয়ত নিতে হবেতার যে মেয়েটা বড্ড চাপা স্বভাবের। এই চাপা স্বভাবের জন্যই এত দিন আসিফের ব্যাপারে বাড়িতেও কিছু বলে নি। তবে আয়েশার মায়ের মাঝে মাঝে মনে হয় এই সমাজে মেয়েদের ' ডিভোর্স' মানেই তো সব চেয়ে বড় খুঁত। কথায় কথায় শুনতে হয় ডিভোর্সি, সংসার করার মুরোদ নেই আরও কত কি! বাচ্চা সমেত ডিভোর্সি মেয়েটার না জানি আবার কত কথা শুনতে হয়। কিন্তু কথার চেয়ে মেয়ের শান্তিপূর্ণ জীবন অবশ্যই বেশি দামী। কিন্তু এসব কথা কানে এলে আয়েশা আসলেই ভালো থাকতে পারবে তো? আর বাবা ছাড়া বাচ্চাটারই বা কি হবে! এই সমাজে ছেলেদের খুঁতগুলো খুব ছোট, শিশির বিন্দুর চেয়েও ছোট কিন্তু মেয়েদের খুঁতগুলো হিমালয়ের চেয়েও বড়। 

দুই পরিবার মিলে যদি কিছু একটা সুরাহা করা যায়! বড় মেয়ে আশার সাথে আলোচনা করলেন তিনি। আশার স্বামী রেদোয়ানেও এই বিষয়ে এক মত। হুটকারিতে হয়ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। সমস্যাটা যেহেতু আসিফের ওর সাথে আলাদা ভাবে কথা বলা উচিত।
তবে আয়েশা এসব শোনার পর স্পষ্ট ভাবে বলল, " আমি চাই না,বেবি পৃথিবীতে আসার আগ পর্যন্ত৷ কারো সাথে কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোন কথা হোক। সেটা বেবির বাবা হোক বা অন্য কেউ। "
আয়েশা এই জেদে নাওয়া খাওয়া ছাড়ল। আসিফ যেন কিছু না জানে তার বাচ্চার ব্যাপারে।বাচ্চাটা আসিফের মনের মতো না হলে আসিফ হয়ত শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটাকেই মেরেই ফেলবে এই ভয় আয়েশার মনের ভেতর কেমন করে যেন ঢুকে গেল। বাড়ির সবাই বাধ্য হয়ে আসিফদের বাড়িতে আপাতত কিছু জানালো না। তারা ভাবলো আয়েশা হয়ত কিছু দিন পর নিজেকে সামলে নেবে তখন বলা যাবে সব কিছু। আসিফ বেশ কিছু দিন আয়েশাকে ফিরিয়ে নেবার জন্য এলেও শেষ দিকে আয়েশা যখন রুমের দরজা পর্যন্ত খুলতো না তারপর থেকে আসিফও আসা বন্ধ করে দিলো এক সময়। 
সে এতটা ছোট হয় নি কখনো। রাগের মাথায় একটা ভুল হয়েই গেছে। গায়ে একটা হাত উঠেই গেছে। তার জন্য আয়েশার এতটা করা বাড়াবাড়ি মনে হলো আসিফের। প্রচন্ড রাগ হয় তার। আয়েশাকে ছাড়া এত দিন তো দিব্যি চলত তার। তবে এখন ক্রন চলবে না? জীবন কি কারো জন্য থেমে থাকে নাকি? 

কিন্তু জীবন একেবারে থেমে না গেলেও কিছুটা তো থমকে গেলো তার। প্রথম প্রথম খুব রাগ হলো আয়েশার ওপর। কিন্তু দিন যত গড়াতে থাকলো আয়েশার শূন্যতা তাকে অন্ধকারের মতো গ্রাস করতে শুরু করল। আফিস থেকে ক্লান্ত শরীরে ফেরার পর কেউ আর হাসিমুখে দরজা খোলে না, কেউ তার ফেরার অপেক্ষায় থাকে না, কেউ দিনে একবারও টেক্সট করে না, কখন ফিরবেন? দুপুরে খেয়েছেন তো? আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবেন? আফিসে না খেয়ে গেলে কেউ জোরটুকু করে না অন্তত একবার খাবার মুখে তোলার জন্য। 
সারাদিনের গল্পগুলো করার মতো অন্ধকার ঘরে যখন কাউকে পায় না আসিফ বেলকনিতে গিয়ে সিগারেট ধরায়। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তার ব্যাস্ত মানুষগুলোকে দেখে, মানুষগুলোর বাড়ি ফেরার কত তাড়া, সবার জন্যই হয়ত বাড়িতে কেউ আছে আপেক্ষা করে। কিন্তু তার আর এখন কোন তাড়া নেই। কেন তাড়া থাকবে? কেউ কি অপেক্ষা করে নাকি? ইদানিং সিগারেট একটু বেশিই খাওয়া হচ্ছে। চাকরি হবার পর এই অভ্যাসটা একদমই ছেড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু আয়েশা চলে যাবার পর আবার কি করে যেন অভ্যাসটা আবার শুরু হলো।
 
মাঝে মধ্যে একেবারেই সহ্য না হলে বড় ভাইয়ার বাড়ি যায়। ভাইয়া নেই। কিন্তু ভাবি আর মা সেখানে আছে। ভাবি চাকরি করে, মা বাচ্চাদের দেখাশুনা করে। ভাইয়ের দুই মেয়ের সাথে গল্পগুজব করে যতক্ষণ, ততক্ষন বেশ ভালো সময় কাটে আসিফের। কিন্তু বাড়ি ফিরে আবার রাজ্যের নিরবতা। কেউ নেই,কোথাও নেই।
আসিফের মা ছেলেকে প্রায়ই বলে, " আমি না হয় যাই,তোর শশুর বাড়িতে। আয়েশা শান্ত মেয়ে বোঝালে বুঝবে। ফিরে আসবে হয়ত। এভাবে কত দিন থাকবি? আর তোর সাথে একেবারেই থাকতে না চাইলে ওরা সেটাও বলুক। তুই ওই মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে নতুন কিছু শুরু করতে চাইলে কর। "
" সব তো শেষ, আবার কি শুরু করব? সে তার মতো ভালো থাকলে, আমিও আমার মতো ভালো আছি।" ____________
আসিফের এই আভিমান কাটল। সেদিন সন্ধ্যায় যখন হসপিটালে প্রায় মাস পাঁচেক পর আয়েশার সাথে তার দেখা হলো। আসিফের মায়ের শরীর বেশ কিছু দিন ধরে ভালো যাচ্ছিলো না। মাকে চেকআপের জন্য যখন ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলো। হঠাৎই চোখ পড়লো আয়েশা তার বোনের সাথে পাশের ডক্টরের চেম্বার থেকে বেরোচ্ছে । ওর দিকে চোখ পড়তেই আসিফ অদ্ভুত এক মন্ত্রাবেশে উঠে দাঁড়ালো। ঘোর লেগে গেছে যেন। মনে হচ্ছে কত শত যুগ পরে জলাধারের সন্ধান পেলো চাতক।
আসিফ কিছুক্ষন ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। পা উঠতে চাইছে না। আয়েশার তার হাতে কিছু ফাইল গোছাতে ব্যস্ত। সম্ভবত প্রেসক্রিপশন, কিছু টেস্টের রিপোর্ট এগুলো। আয়েশার বেশ পরিবর্তন এসেছে মাত্র কয়েক মাসেই৷ ওজন বাড়ার জন্য অদ্ভুত রকম সৌন্দর্যের আভা ঠিকড়ে পড়ছে যেন। বলা হয়, প্রেগন্যান্সির সময় যে কোন মেয়ের মাঝেই স্বর্গীয় এক আভা দিয়ে দেন সৃষ্টিকর্তা। 
আসিফ কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকল, " আয়েশা।"
আয়েশা পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখলো আসিফ দাঁড়িয়ে। আয়েশাকে দেখে সম্ভবত হালকা কাঁপছে, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আয়েশা কিছু বলার আগেই আসিফ আবার বলল,
" গায়নোকলিজিস্টের কাছে কেন তুমি? কে অসুস্থ? আপা নাকি তুমি? "
উওরের অপেক্ষা না করেই আসিফ শস্যব্যাস্ত হয়ে আয়েশার হাত থেকে ফাইলগুলো নিলো। উলটে পালটে দেখবার পর আসিফের হাত থরথর করে কাপতে শুরু করলো৷ কাপা কাপা গলায় বলল, 
" আমায় জানানোর প্রয়োজনটুকু বোধ করলে না? আমি বাচ্চার বাবা আয়েশা ওর প্রতি আমার অধিকার আছে !" আসিফ মূহুর্তেই চেঁচিয়ে উঠলো। ওয়েটিং রুমে থাকা সবাই অবাক হয়ে ওদের দিকেই তাকালো। 
আয়েশা শান্ত ভাবে বলল," আস্তে কথা বলুন। বেবি ভয় পাবে। সে জানে না তার বাবা কেমন। তাকে আমি তার বাবার গল্প বলি না। ও খুব ছোট, এত চেচামেচিতে ভয় পাবে।।"
আসিফের চোখে বিন্দু বিন্দু পানি জমতে শুরু করেছে। আয়েশার হাত টেনে ধরে বলল," বাড়ি চলো আয়েশা।"
আয়েশা উত্তর দিলো না। আয়েশার বোন আসিফকে বলল তাদের সাথে আয়েশার বাবার বাড়ি যেতে। হসপিটালে তো সব কথা সম্ভব নয়। বাড়ি গিয়ে কথা বলতে চায় তারা। দুই ফ্যামিলি এক সাথে। 
সেদিন রাতেই দু ফ্যামিলি বসলো। আসিফ কেমন কয়েক মূহুর্তেই হুট করে ভীষণ রকম ভেঙে পড়েছে। ওর ভাবি আর মা দুজনেই আয়েশাকে তার ফ্যামিলির অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করছে আয়েশা যেন ফিরে যায়। আয়েশার ঘুরে ফিরে একটাই কথা, " বেবি তার বাবাকে ভয় পাবে সেখানে গেলে৷ "
তারপর বলল, "বাচ্চা যদি আসিফের পছন্দ মতো না হয় তাহলে কি আসিফ বাচ্চাকে মেরে ফেলবে? সেটা আগে ওকে বলতে বলুন।"
" আর ইউ ক্রেইজি? " আসিফ উঠে দাঁড়িয়ে চেচাতে শুরু করল,
"আমি আমার নিজের বাচ্চাকে কেন মারবো? বাবা মায়ের কাছে নিজের সন্তান কখনো অপছন্দের হয়? আমার বেবি আমার পছন্দ হবে না কেন?"

আয়েশার দুলাভাই আসিফকে থামিয়ে বলল," দ্যাখো আসিফ তোমার এই মাত্রাতিরিক্ত রাগের জন্যই কিন্তু আজ এ অবস্থা। আয়েশা যে নিজের সেন্সে এসব বলছে না তা বুঝতে পারছ না? মেয়েটা তোমাকে ভয় পেতে পেতে মেন্টালি ডিস্টার্ব হয়ে গেছে।একদিনে নিশ্চই এমন হয় নি৷ দিনের পর দিনেই এমন হয়েছে। নিজেকে না শোধরালে দিন হয়ত আরো খারাপ আসতে পারে।"
আয়েশা শান্ত ভাবে সোফায় বসে আছে তখনও। আসিফ ওর দিকে এক বার তাকালো। এগিয়ে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে ওর কোলে মুখ গুজে ডুকরে কেঁদে উঠলো। বলল," বাড়ি চলো আয়েশা। কথা দিচ্ছি বেবির কিছু করব না। আমি তো তার বাবা নাকি?আমি ওকে কেন কিছু করতে যাব? "
আয়েশা বলল," প্লিজ ছাড়ুন তো। বেবি ব্যাথা পাবে।"
আয়েশার বড় বোন আশা বলল," দ্যাখো আসিফ সোজাসুজি বলি, বাচ্চাটা পেটে না আসলে আমরা অনেক আগেই তোমাদের ডিভোর্স করাতাম। ডিভোর্স এর সিদ্ধন্ত নিয়েও ফেলেছিলাম। এখন পরিস্থিতি অন্য। বাচ্চাটা হতে দাও। তারপর তুমি বা আয়েশা চাইলে ডিভোর্স করানো যাবে। আমরা আমাদের মেয়েকে আর অসুস্থ দেখতে পারব না। পাগল করে দিয়েছো, আর কি চাও?"
আসিফ রেগে গিয়ে বলল," ডিভোর্স করানোর আপনারা কারা? আমরা দুজন নিয়েছি এমন কোন সিদ্ধান্ত? অয়েশা কিছু বলেছে এ ব্যাপারে? নাকি আমি বলেছি? আপনারা আমার সংসারটা জোড়ার বদলে ভাঙার জন্য কেন উস্কে দিচ্ছেন?"
" ভাংতে তো আপনিই চাইতেন। এখন সবাই আপনার চাওয়াটাই পূর্ণ করতে চাইছে।"আয়েশা উত্তর দিলো। 
আসিফ অবাক হয়ে তাকালো। বলল,"আমি কখন এসব চেয়েছি?"
" বিয়ের দিন থেকেই।"
" তুমি আমার রাগের মাথায় বলা কথাগুলোকে সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছো? তুমি জানো না রেগে গেলে আমার মাথা ঠিক থাকে না? আমি কি বলি, কি করি আমি নিজেও জানি না। কন্ট্রল থাকে না আমার নিজের ওপর।"
" রাগ খুব খারাপ জিনিস আসিফ। প্রথম প্রথম সিরিয়াসলি নিতাম না বলেই এতদূর গড়ালো সব কিছু। আপনি রাগের বশে বেবির কোন একটা ক্ষতি করে বলবেন রাগের বশে করেছি। সিরিয়াসলি নিও না? ও যখন কাঁদবে,চেঁচাবে, ঘর বাড়ি নোংরা করবে আগের মতো পরিপাটি থাকবে না সব কিছু মেনে নিতে পারবেন? নাকি কাদলে জিভ কেটে ফেলবেন কাচি দিয়ে? গলা টিপে ধরবেন? ঘর নোংরা করলে হাত কেটে ফেলবেন? আর আসল খুঁত তো আপনার মধ্যে। অতিরিক্ত রাগ একটা মানুষের সব চেয়ে বড় খুঁত। আপনি নিজের খুঁত ঢাকতে আশেপাশের সব কিছুর খুঁত খুজে বেড়ান তারপর সেগুলো জোর করে নিখুঁত করবার চেষ্টা করেন।"

আসিফ এসব শুনে কেমন যেন চুপ করে গেলো। তার শরীর থরথর করে কাপতে শুরু করেছে। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। সোফায় থাকা ফুলদানিটা আয়েশার পায়ের কাছে ছুড়ে মারলো। ভেঙে টুকরো টুকরো হলো সেটা।
আয়েশা ভয়ে আবার কেপে উঠলো। এই না বুঝি কী করে ফেলে আবার! আসিফ আর কোন কথা বাড়ালো না। আয়েশাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো সে।
__________
সেদিনের পর আসিফ আর কোন যোগাযোগ রাখলো না আয়েশার সাথে। তবে ওর মা বা ভাবি আয়েশাকে দেখতে গেলে তাদের কাছ থেকে ওর ব্যাপারে খোজ খবর নেয়। আয়েশার পছন্দের সব জিনিসগুলোও তাদের হাতে মাঝে মাঝে পাঠায়। আয়েশা সেগুলো নেয় নাকি ফেলে দেয় তা সে জানতেও চায় না। 
নিজের ভুল বোঝার ক্ষেত্রে জীবনের কোন কোন সময় প্রচন্ড রকম একটা ধাক্কার প্রয়োজন হয়। এই ধাক্কাটা আয়েশা নিজের অজান্তেই আসিফকে বেশ ভালো ভাবেই দিয়েছিলো। আসিফের হঠাৎ কি যেন হলো। নিজের এক্সেসিভ এ্যাংগার ম্যানেজমেন্ট এর জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো শুরু করলো। সেই সাথে মেডিটেশন। ডক্টর বলেছে তার দুটো সমস্যা রয়েছে বর্ডার লাইন ডিজিজ যার জন্য চাইলেও রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না সে। আর ওসিডির জন্য খুতখুতে স্বভাব থেকেও বেরোতে পারে না। 
এসবের মাঝেও আয়েশায় ওপর বেশ রাগ হয় তার। আয়েশা কেন বোঝে না সে তো এমন আচরণ ইচ্ছে করে করেনি। আবার মনে হয় আয়েশা হয়ত ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। সত্যিই যদি রাগের বশে বেবির কোন ক্ষতি হয়ে যায় তার দ্বারা!

দূরেই থাক, তবুও ভালো থাক।

আষাঢ়ের ঝুম বৃষ্টির এক দুপুরে আয়েশার লেবার পেইন উঠলো। আয়েশার দু চোখ খুব করে চাইলো মানুষটাকে দেখবার জন্য। তবে ওটিতে যাবার আগে তার সেই সাধ মিটলো। আসিফ এসেছে। ওটির সামনের দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচুপে কাক ভেজা হয়ে পকেটে দু হাত গুজে শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে। কাধে আফিসের ব্যাগটা পর্যন্ত নামাতে ভুলে গেছে। ওটিতে ঢোকার আগে আয়েশা কিছু বলতে চাইলো কাছে ডাকলো। আসিফ কাছে না গিয়ে চোখের ইশারায় ভরসা দিলো," আছি তো। "
জ্ঞান ফেরার পর, কিছুটা সুস্থ বোধ করবার পর আয়েশা দেখলো বাচ্চা তার দাদীর কোলে। আসিফ চুপ করে কেবিনের দরজায় সেই একই ভংগীতে দাঁড়িয়ে আছে। চুল উস্কোখুস্ক, চোখে রাজ্যের অনিদ্রা নিয়ে তার মায়ের কোলে থাকা বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়েশা জানে আসিফ আর আগের মতো নেই। ভাবির কাছে শুনেছে তার নাকি অনেক পরিবর্তন এসেছে। অন্তত চেষ্টাটা করে আসিফ। এত দিনের সমস্যা তো আর দুদিনেই দূর করা সম্ভব নয়। এজন্য একার চেষ্টা জরুরি আশেপাশের মানুষগুলোর পাশে থাকা সাপোর্ট করাটাও অনেক বেশি জরুরি। অর্পা ভাবি শুরু থেকেই তাদের সম্পর্কটায় সমঝোতার মাধ্যম হিসেবে থাকার চেষ্টা করে গেছে। মাঝে হয়ত আসিফ নিজের নিয়ন্ত্রণের বেশিই বাইরে চলে গিয়েছিলো। 
 আয়েশা তাকে কাছে ডাকলো।
আসিফ প্রথমে আসতে চাইলো না। দূর থেকে হাসিমুখে বোঝালো," না ঠিক আছি।"

কিছু সময় পর আয়েশা বাচ্চাকে নিজের কোলে তুলে নিলো। ইচ্ছে করে কাঁদিয়ে বলল," এই আসিফ দেখুন আপনার মতো চেঁচাচ্ছে। ছেলে একদম আপনার কার্বন কপি হয়েছে দেখুন। আপনার মতোই ভাঙা টেপ রেকর্ডার এর মতো অহেতুক চেঁচায়। "
আসিফ এবার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। হেসে ফেললো তারপর এগিয়ে এলো। পাশে বসে বাবুকে কাছ থেকে দেখতে লাগলো। 
আয়েশা বলল," কোলে নিতে ইচ্ছে করে না?"
"আমি কোলে নিলে ব্যাথা পাবে না?"
 আয়েশা অভিমান করে বলল,"ওর বয়স এক দিন হয়ে যেতে চলল। অথচ আপনি একবার কোলে তো নেয়া দূর কাছেও এলেন না।"
" তুমি তো বিশ্বাস আমি ওকে ব্যাথা দেবো,কেটেকুটে মেরে ফেলবো। কি দরকার কাছে আসার, দূর থেকেই দেখি। তবুও তো দেখার অধিকার পাচ্ছি। হঠাৎ আমি বাড়াবাড়ি কিছু করে ফেললে এই অধিকারটুকুও হয়ত আবার কেড়ে নেবে।"
আয়েশা আসিফের চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল, " ওকে ভালো করে দেখুন। আমাদের ছেলেটা কি সুন্দর না?একদম নিখুঁত। "
আসিফ ওকে কোলে নিয়ে কেঁদে ফেললো। 
আয়েশা হঠাৎ হেসে বলল," ইউ আর সো মাচ চাইল্ডিশ আসিফ। নতুন বেবির সাথে নতুন বাবাও বুঝি এভাবে কাঁদে কখনো? " 
 আসিফ বাবুকে কোলে নিয়ে বলল," বাড়ি চল আয়েশা। আমার অনেক গল্প জমা আছে। বাবুকে নিয়ে স্বপ্ন জমা আছে।"
" বাবুর নাম কি রাখা যায়?"
"স্বর্গ"
__________
সময়গুলো উড়ছিলো। সুখের সময় নাকি উড়তে থাকে, দুঃখের সময় ধীর পায়ে চলতে থাকে।এর মাঝে আসিফ আয়েশা দুজনকেই আর এক বার স্তব্ধ করে দিলো,ডাক্তারের বলা ছোট্ট একটা কথা। কিছুদিন পর তারা যখন জানতে পারলো তাদের বাচ্চা আর দশটা সাধারণ বাচ্চার মতো না, স্পেশাল চাইল্ড। আয়েশা আসিফের দিকে তাকালো। তার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু আসিফ কথাটা শোনার পর কেমন পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল।
ডক্টরের কোন কথা না শুনেই উঠে গেলো চেম্বার থেকে। রাতে আসিফ বাবুর সাথে খেলা করছিলো। আয়েশা তখন তাকে জিজ্ঞেস করল,
 " আমি আপনাকে একটা নিখুঁত, সুস্থ বাচ্চা দিতে পারলাম না তাই না? সমাজের সবার চোখে আমাদের বাচ্চাটা অবহেলা, নিগ্রহের শিকার হবে তাই না? ও অন্যরকম বলে সবাই হাসবে। ওকে নিয়ে ঠাট্টা করবে,বুলিং করবে। বুঝতে শিখলে ও এসবে অনেক কষ্ট পাবে।আমি মা হয়ে এসব কি করে সহ্য করব? আমি কি করে ওকে বোঝাবো ও আমাদের কাছে কত স্পেশাল,গড গিফটেড?"
আসিফ বাবুকে কোলে নিয়ে উঠে গেল। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তার ব্যাস্ত গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, 
" তুমি জানো না আয়েশা সৃষ্টিকর্তা স্পেশাল কিছু সবাইকে দেন না। যাদের সব চেয়ে বেশি ভালোবাসেন তাদের দেন। কারন তিনি জানেন স্পেশাল যে কোন জিনিসই সবাই যত্নে রাখতে পারে না, আগলে রাখতে পারে না। স্পেশাল কিছু লালন করতেও যোগ্যতা থাকতে হয়, তাকে পাবার সৌভাগ্য থাকতে হয়। আর সৃষ্টিকর্তার সব সৃষ্টিই নিখুঁত। খুঁত তো আমরা নিজেরা তৈরি করি। আসল খুঁত তো থাকে আমাদের মনে, আমাদের চোখে (চোখের দৃষ্টিভঙ্গিতে)। আমরা অনেক সৌভাগ্য করে আমাদের বাবাটাকে পেয়েছি আয়েশা। লোকে কি বলবে এসবে আর আমার কিছু যায় আসে না। আমরা আমাদের ছেলেকে খুব সুন্দর একটা চাইল্ডহুড গিফট করব দেখবে।"
ছেলের চিন্তায় আয়েশা ভেঙে পড়লেও আসিফ এবার ভেঙে পড়লো না। সে বুঝতে শিখেছে সংসারে দুজন একসাথে রাগ করতে নেই। কোন পরিস্থিতিতে একজন আগুন হলে অন্যজনকে যেমন জলের ভূমিকা পালন করতে হয়। তেমন বিশেষ পরিস্থিতিতে একজন ভেঙে পড়লে অপর জনকে হতে হয় মাটির মতো শক্ত কিন্তু ধারণ ক্ষমতা যোগ্য।যেন ভেঙে পড়া মানুষটি শিকড় বিছিয়ে আকড়ে ধরে বাচতে পারে। 
আসিফ জানে তাকে শক্ত মাটি হতে হবে, পাহাড় হতে হবে, পাহাড়ের ঢাল হতে হবে। সব কিছুতে খুঁত ধরতে অভ্যস্ত এই সমাজে অনেক কিছু সইতে হবে, অনেক জবাব দিতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন