বর্ষণ যেভাবে বিনা নিমন্ত্রণে হুটহাট নেমে আসে? জয়তুন বেগমের শাহজাহান বাড়িতে পদার্পণের বিষয়টা একই কাতারে পড়ে। নিমন্ত্রণ বিহীন তুমুল ঝড়ো বর্ষণ। তার বয়স এবার সত্তরের ঘরে। মুখশ্রীতে লেপ্টেছে বৃদ্ধতা। তারুণ্যের ছাপ না থাকলেও জোশ রয়েছে। কালো মণির নয়নযুগল এখন আর পরিষ্কার দেখতে পায় না। পাওয়ার চশমার প্রয়োজন পড়ে। আজকাল মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা ক্ষীণ। ছোটোখাটো বিষয় ভুলে বসেন। তাই গলায় মুঠোফোনের থলি ঝুলিয়ে রাখেন। ফোনটা বড়ো কাজের কি-না! যখন তখন দরকারের! এইযে আপাতত নাকের ওপর সাদাকালো ফ্রেমের চশমা ঝুলিয়ে, মুঠোফোন থলি হতে বের করেন। বাংলায় সেভ করা তার নাতির নাম্বারটি খুঁজছেন। খুঁজতে খুঁজতে শুধান,
'জবু দূরে কোথাও গেল কি? ও তো বাসাতেই থাকে। ঘন্টা হইলো এখনো ফিরতেছে না। মোস্তফা কই, ও জানে কিছু? একটা কল দাও।'
নাতির নাম্বারটি খুঁজে পেলেন। পেতেই কল দিলেন জয়তুন বেগম। রিং হচ্ছে তবে রিসিভ হয়নি। অফিসের কাজে ব্যস্ত ভেবে আর দ্বিতীয়বার কল করলেন না। মুঠোফোন থলিতে রেখে, সামনে কাঁচের টেবিলে কেটে টুকরো করে রাখা ফলের প্লেট হাতে তুলে নিলেন। কাঁটা চামচে ফলের টুকরো তুলে ধীরেসুস্থে মুখে প্রবেশ করালেন। মুফতি বেগম বাড়ির সবাইকে ইতিমধ্যে কল করে ফেলেছেন। কেউ বাদ নেই! তারপরও ফের কল করেন মোস্তফা সাহেবকে। ওপাশটায় মোস্তফা সাহেব কল রিসিভ করেই জানান,
'আমি আসছি।'
মোস্তফা সাহেব উপস্থিত হোন আধঘণ্টার মধ্যে। দুয়ার দাঁড়িয়ে জুতোজোড়া কোনোমত খুলেছেন। বাসার চপ্পল জোড়া যে পরবেন, ততটুকু সময়ও নেননি। গাড়ি থেকে নামতে যতটুকু সময় লাগল তার। তড়িৎ ভেতরে ঢোকেন। তাকে দেখতে পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেলেন মুফতি বেগম। জান হাতে নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠলেন। একনাগাড় কতগুল শ্বাসপর্ব ঘটালেন। একেক প্রশ্নের সম্মুখীনে পড়ে তিনি ভয়ে কাঁপছিলেন। আম নাবলে যদি জাম বলেন ভুলবশত, তাহলেই তো মসিবত। একপাশে চুপচাপ দাঁড়ালেন। মোস্তফা সাহেব ঘনঘন শ্বাস নিয়ে, বুকের ওঠানামার গতি ধাতস্থ করলেন। সালাম দিলেন। শাশুড়ি মায়ের পাশে বসে নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করেন,
'কেমন আছেন মা? শরীর ভালো?'
'কেমন দেখতেছ বাবা? যেমন দেখতেছ তেমনি আছি। তুমি কেমন আছো?'
'আলহামদুলিল্লাহ। আমাকে একটা কল করতেন। আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম।'
'হঠাৎ মনটা আনচান করতেছিল। মাইয়াডারে দেখিনা কতদিন হইলো! ভাবতে ভাবতে চইলা আসলাম। তুমি যাবা আবার আসবা, ঝামেলা না?'
'কীসের ঝামেলা মা। কিছু ঘন্টার ব্যাপার মাত্র।'
'তা আমার নাতি আসে নাই তোমার সাথে? ও কই!'
মোস্তফা সাহেব নিশ্চুপ রইলেন। কপালে এখনো বিন্দু বিন্দু ঘামের উপস্থিতি। সবটা সত্যি বলে দেবেন তিনি। মিথ্যে বলার তো প্রয়োজন নেই। পড়ে তো এভাবেই জানবেন। এরথেকে ভালো এক্ষুনি বলে দেওয়া। জয়তুন বেগম চিন্তিত গলায় ফের বলেন,
'জবু কই গেল? তোমারে বলে যায় নিই?'
'মানে, মা! হয়েছে এমন...... '
তন্ময় মায়ের হাত ধরে ত্বরান্বিত পদচারণে প্রবেশ করল তখম। চমক দিলো উপস্থিত সকলকে। জবেদা বেগমের চোখে জল ঠোঁটে মৃদু হাসি। জয়তুন বেগম দুহাত মেলে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মাথায় ক্রমাগত হাত বুলিয়ে বিড়বিড়িয়ে বললেন,
'কোথাও গেলে বলে যাবি না? তুই কি ছোটো? এখনো না বলেকয়ে এদিক-ওদিক যাওয়া কেমন স্বভাব।'
'আশেপাশেই ছিলাম মা।'
মেয়ের থেকে নজর সরিয়ে নাতির পানে ফেললেন। তন্ময় এগিয়ে এলো। মা উঠে পড়তেই তার জায়গায় বসল। স্বভাবসুলভ নানির কোলে মাথা পেতে শুয়ে পড়ল সোফায় টান হয়ে। চুলে আঙুল বুলিয়ে জয়তুন বেগম বলেন,
'এত শুকনো লাগতেছে কেন! ঠিকমত কী খাওয়াদাওয়া করিস না?'
'কোন জনমে আমাকে তোমার স্বাস্থ্যবান মনে হয়েছে বলোত?'
'স্বাস্থ্য থাকলে না বলব।'
তন্ময় গম্ভীর স্বরে শব্দ করে হাসল। কোলে শুয়ে চোখ জোড়া বুঝে নিলো। অদ্ভুত শান্তি হৃদয় গ্রাস করে নিচ্ছে। নিজের বাড়ির ঘ্রাণ বুঝি আলাদা! এই ঘ্রাণের স্বাদ আর কোথাও নেই, আপন বাড়িটা ছাড়া।
ওসময় শাবিহা দ্রুত পায়ে বাড়িতে প্রবেশ করল।
সে জবে ছিল। চাচীর কল পাওয়া মাত্রই চলে এসছে। মা, ভাইয়া, নানি কাকে ধরে কাঁদবে সে? সবটাই স্বপ্ন লাগছে। শব্দ করে কেঁদেকেটে শাবিহা মা, ভাইয়া আর নানিকে একসাথে জাপ্টে ধরল। জয়তুন বেগম পড়লেন মহা চিন্তায়,
'এমন ভাবে কাঁদতেছিস যেন জবু আর তন্ময় তোর সাথে থাকে না, ওদের প্রতিদিন দেখিস না!'
লিভিংরুম জুড়ে নিস্তব্ধতা বয়ে গেল। শব্দ করে হাসার সামান্য প্রয়াস চালায় শাবিহা। বোকার মত বলে ,
'তোমাকে দেখে ইমোশনাল হয়ে পড়লাম যে।'
'তাই বল। মুখটা এইটুকুন হইয়া আছে। কোথায় ছিলি? ভার্সিটি বুঝি!'
'হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক ধরছ।'
তন্ময় উঠে দাঁড়াল সোফা ছেড়ে। মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
'নানিকে রুমে নিয়ে যাও। টায়ার্ড হয়ে আছে। বিশ্রামের প্রয়োজন।'
নিচ তলাতে গেস্টরুম পরিষ্কার করে ফেলেছে সুমিতা বেগম। সেই রূমের দিক জয়তুন বেগমকে নিয়ে যাচ্ছে শাবিহা আর জবেদা বেগম। মোস্তফা সাহেব এখনো দাঁড়িয়ে। তন্ময় তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হলো। ঠোঁটে ঘেঁষে আসতে চাওয়া হাসিটুকু গিলে নিলো তন্ময়। গম্ভীর মুখে বাবার সাথে বেরোল। দুজন গার্ডেনের দিকটায় হাঁটছে। হিমশীতল বাতাস স্পর্শ করছে। কালো রঙের কিছু চেয়ার পেতে একজোড়া টেবিল বসানো আছে। চা পানের জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা এটি। তন্ময়ের অভ্যাস ছিল, অফিসের ফাইলস আর কফির মগ নিয়ে সাতসকালে এখানে বসা। রাতবিরেত অফিস শেষ করে এসেও প্রায়সময় বসে থাকত! তার দেখাদেখি মোস্তফা সাহেব ও বিশ্রামের জন্য এখানেই বসতেন। একসাথে হলে বাপ-ছেলে মিলেমিশে ব্যবসা জনিত আলাপ-আলোচনা করত! আগের দিনগুলো ফিল্মের মতো তন্ময়ের চোখের মণিতে ভেসে উঠছে।
বড়ো নিশ্বাস টেনে চেয়ারে বসল। পায়ের ওপর পা তুলে চারিপাশে নজর বোলাল। অরু ছোটোছোটো যেই ফুলগাছ গুলো লাগিয়েছিল সেগুলো এখন বড়ো হয়েছে। তন্ময় নিজেই তো এনে দিয়েছিল। মেয়েটা জানপ্রাণ লাগিয়েছিল গাছগুলো বড়ো করতে। ও কী এখন ঘুমাচ্ছে? নাহলে কোথায়?লিভিংরুমে তো দেখতে পায়নি। নিশ্চয়ই কিছুই জানে না। ভালো চমক দেওয়া যাবে। দৃষ্টি গার্ডেন ঘুরে বাবার ওপর পড়ল। মোস্তফা সাহেব চেয়ে আছেন। ওই দৃষ্টিতে মায়া, মমতা, স্নেহ মিশে আছে যেন! তন্ময়ের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টা করল। মোস্তফা সাহেবের কণ্ঠে গম্ভীরতা নেই,
'বাবার ওপর রাগ কমেছে!'
মুহূর্তেই উঠে দাঁড়াল তন্ময়। দ্রুত পা চালাল বাবার দিক। মোস্তফা সাহেবও দাঁড়িয়ে পড়লেন। ছেলেকে বুকে নিতেই প্রশান্তিতে বুক ভরে আসলো। চোখে কোণ ভিজে উঠল। তন্ময় বাবার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে ওঠে,
'আমি কখনো রাগ করিনি বাবা।'
'অভিমান তো করেছিলি। কষ্ট তো পেয়েছিস।'
'আমি তোমার ওপর কখনো অভিমান করতে পারিনি। পারবোও না। কষ্টও পায়নি। পেতে দিলে কোথায়? কষ্ট হবে ভেবে আগ বাড়িয়ে লুকিয়ে নিজেই তো সবকিছু গুছিয়ে দিলে। নাহলে কে প্রথম ইন্টারভিউতে ম্যানেজমেন্টের জব পায়? তাও হাই স্যালারিতে? আমার বন্ধুবান্ধবদের কল করে বলেছ বলেই তো তারা এক ফ্ল্যাট প্রয়োজনীয় সব জিনিসপাতি উঠিয়ে দিয়ে গেছে।'
'ওরা.. ওদের বলার প্রয়োজন ছিলো না। ছেলেগুলো আগেই কেনাকাটা করে নিয়েছিল। সবকিছু! ভাগ্যকরে এমন ফ্রেন্ডস পেয়েছিস।'
তন্ময় বাবাকে ছেড়ে দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বলল,
'আমি আমার জীবনে সব ভাগ্য করে পেয়েছি বাবা।'
কথাটুকু বলে থামে সে। নিশ্বাস নিয়ে, পুনরায় নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল। পুরনো গাম্ভীর্যতা মুখশ্রীতে লেপ্টে বলল,
'তোমার বউ এনে দিয়েছি। তাকে মানানোর দায়িত্ব তোমার একার। নানি যেতেই মা যদি এসে আমায় বলে, 'চলে যাব' আমি কিন্তু নিয়ে যাব।'
মোস্তফা সাহেবের বুকে তখনো ছিল এক সমুদ্র অনুভূতি। যেগুলো ছেলের কথিত বাক্যে গিলে নিতে বাধ্য হলেন। চোখা রাঙালেন,
'কার জন্য এসব হয়েছে হ্যাঁ? ঝগড়া আমাদের কার জন্য লেগেছে?'
'ঝগড়া লাগতে তো বলিনি আমি। যা চেয়েছি তা দিয়ে দিলে কাহিনী এতদূর এগোত না।'
তর্ক এগোনোর ভাষা খুঁজে পেলেন না মোস্তফা সাহেব। তিনি ছেলের সঙ্গে যক্তিতে কোনোকালেই পেরে ওঠেনি। অফিসে যখন মিটিং বসে। তখন শেয়ারহোল্ডার থেকে চেয়ারম্যান সবাই উপস্থিত রয়। তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে যখন প্রেজেন্টেশন দেয় তার ছেলেটা, ওর কথার ধরন, যুক্তির সামনে কেউই মুখ চালাতে পারে না। গর্ব হয় তখন কিন্তু এখন? এখন তিনি চোখ রাঙালেন।
______
সূর্যাস্তের সময় হয়েছে। হলদেটে আসমানের বুকে সুর্য অর্ধখণ্ডিত রূপ নিয়ে বসে। সন্ধ্যা লুকিয়ে রাত নামবে বলে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে ছটায়। তন্ময় সকলের থেকে ছাড় পেলো মাত্রই। দোতলা চলে এলো তক্ষুনি। নিজের রুমের পাশের ঘরটার দরজা ভেড়ানো। সুমিতা বেগম থেকে শুনেছে, অরু ঘুমোচ্ছে! বিকেলবেলা ঘুমিয়েছে এখন অবদি ওঠেনি। তন্ময় নিজের রুমে প্রবেশ করল। পরিপাটি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা। সে যেমন রেখে গিয়েছিল তেমনটাই। পেনহোল্ডারটিও টেবিলের কর্নারে আছে আগেরমত। এগিয়ে জানালাটা খুলে দিলো। পর্দা সরিয়ে দিতেই হিমশীতল বাতাস প্রবেশ করল। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জড়ানো শার্ট খুলে বাথরুম ছুটল। একটা গোসল নিয়ে বেরোল। চুল মুছতে নিয়ে খেয়াল করল, দরজাটা হালকা শব্দহীন ভঙ্গিতে খুলছে। একটা মাথা চট করে ঢুকল। মাথার মালিক দৃষ্টি উঠিয়ে তাকাতেই তন্ময়ের সঙ্গে দৃষ্টি আদানপ্রদান হলো। ওমনি মাথাটা তড়িৎ চলে গেল।
তন্ময় নিঃশব্দে হাসল। তোয়ালে চেয়ারে ছুঁড়ে দরজার দিক এলো। দরজাটা খুলে দিতেই অরুকে দেখা গেল। কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে। মুখ জুড়ে লেপ্টে 'মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছি'। তন্ময় হাত বাড়িয়ে ওর ফোলা গাল টেনে দিল। কফির মগ নিজের হাতে নিয়ে শুধাল,
'লুকোচুরি করছিস কেন?'
অরু হাসে, 'দেখছিলাম। কখন এসেছেন?'
'উম, ঘন্টা।'
'আমাকে ডাকলেন না যে!'
'কেন ডাকব?'
অরুর চোখজোড়া ছোটো হলো। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,
'আমিতো অপেক্ষায় ছিলাম এই দিনের।'
তন্ময় শুনেও শুনল না। কফিতে চুমুক বসিয়ে ভেতরে চলে গেল। ওর সাথে কথাবার্তা না বাড়ানো শ্রেয়। কথা বাড়ানো আর নিজের ধৈর্যের পরিক্ষা নেওয়া একই বিষয় দাঁড়াচ্ছে। এভাবেও সেদিনকার চুমুটা তার মস্তিষ্ক দখল করে আছে। নয়নযুগলে ফিল্মের ন্যায় ভেসে ওঠে। ভেতরের শয়তান গর্জন করে বলে, 'তন্ময় তুই চুমুটা খা। তোরই তো অরু। ছুঁয়ে দিলে কী হবে? নিজের মানুষকে ছোঁয়া চুমু খাওয়া তোর একান্ত কর্তব্য।'
তন্ময় ভাবে ধৈর্যের পরিক্ষা তার অরু নেয় নাকি হৃদয়, মস্তিষ্ক? তিনটে সমান ভাবে অপরাধী। অরুও পিছুপিছু ভেতরে এলো। মুখশ্রী জুড়ে আনন্দ, উচ্ছ্বাস। গলার স্বরে একরাশ আশা,
'আজ থেকে আমি পড়তে আসি তাহলে? দীপ্ত ও আসবে।'
তন্ময়ের বলতে ইচ্ছে করল, 'তুই পড়বি নাকি ভ্যাবলার মতো আমাকে দেখবি? আর আমি তোকে পড়াব নাকি তোকে দেখব কোনটা?'
বাক্যগুলো গিলে নিয়ে মাথা দোলায়। ওমনি অরু ছুটে বেরিয়ে যায়। তন্ময় ফাইলস গুলো দেখতে বসল। এসব মোস্তফা সাহেব দিয়ে গিয়েছেন। কাল থেকে নিজেদের অফিসে যাওয়ার আদেশ আছে। আদেশ না করলেও তন্ময় নিজেদের অফিসেই যেত।
দীপ্ত ব্যাগ নিয়ে ঢুকল। কোঁকড়া চুলগুলতে ঝুটি বাঁধা। তন্ময়কে জাপ্টে ধরল ছুটে গিয়ে। ফাইল টেবিলে রেখে তন্ময় ওকে কোলে তুলল,
'আমার চ্যাম্পের পড়াশোনার কী অবস্থা?'
'ফার্স্টক্লাস। তুমি তো জানো, আমি বেস্ট।'
'আম প্রাউড অভ ইউ।'
অরু কিছু বইপত্র বুকে জড়িয়ে ঢুকল, 'আর আমি?'
তন্ময় দীপ্তকে কোল হতে নামায়। আবারো ফাইল হাতে নেয়, 'তুই কী?'
দীপ্ত হেসে ওঠে, 'অরুপু বসো।'
অরু দীপ্তর পাশে বসে। বইপত্র সামনে রেখে আড়চোখে তাকাল। এবং এই চাওয়া কেবলই শুরু। ওর এতবার তাকানোর কারণে তন্ময় ভালোভাবে নিজেই ওর আদুরে মুখটা দেখতে পারে না। সে আনন্দ অনুভব করবে নাকি দুঃখ, দোটানায় আছে।
তন্ময় নজর তুলে চায়,
'বই খুলছিস না যে?'
'এইতো খুলছি।'
আবারো লম্বা সময় গেল। তন্ময় ফাইল থেকে নজর সরিয়ে দেখল শুধু বইটা খোলা। যেমনটা সে বলেছিল! তারপর আর কিছুই করছে না। তন্ময় শুধায়,
'তুই কী পড়বি? নাকি বসে থাকবি এভাবে।'
'পড়ছি তো।'
তন্ময় আর কিচ্ছুটি বলল না। নজর ফাইলে রেখে ওকে মন মত দেখতে দিল নিজেকে।
_____
রাতের খাবার জবেদা বেগম রান্না করছেন আজ। বছর পর নিজের রান্নাঘরে প্রবেশ করে অনুভূতির চাদরে স্তব্ধ তিনি। মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক রকমের রান্না করেছেন। রান্নাঘর, ডাইনিং, লিভিংরুম জুড়ে ঘ্রাণে চারিপাশ ম ম করছে। ডাইনিংয়ে খাবার পরিবেশন হতেই সকলে নিজেদের চেয়ারে বসল। তন্ময় বসেছে পরপর অরুও বসল পাশে। ব্যস্ত হাতে তন্ময়ের কাঁচের প্লেটটা উলটে দিলো। কাঁচের গ্লাস, কাঁচের পানির জগ এগিয়ে দিল। তন্ময় খেয়াল করল শাবিহা, রুবি মিটিমিটি হাসছে। অথচ যাকে নিয়ে হাসছে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই!
তন্ময়ের তখনকার কথাগুলো ভালো প্রভাব ফেলেছে মোস্তফা সাহেবের ওপর। তিনি খেতে বসে সবকিছুর জন্যই স্ত্রীকে ডাকছেন। এটা দাও, ওটা দাও, রান্না ভালো হয়েছে ইত্যাদি। লজ্জায় জবেদা বেগমের মুখশ্রী লালাচে ,গরম হয়ে উঠেছে। মাথা তুলে তাকানোর সাহসটুকু অবশিষ্ট নেই। বাচ্চাকাচ্চা ভরতি ডাইনিংয়ে এমন করার কোন মানে আছে?
খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকিয়ে অরু সবাইকে ছাঁদে নেওয়ার বায়না ধরল। কতদিন একসাথে হয়নি তারা। আজ যেহেতু হয়েছে, ছাঁদে আড্ডা দিবে। কারোই আপত্তি নেই। উলটো শাবিহা একপায়ে রাজি। রুবি, শাবিহা, আকাশ, দীপ্ত ওরা ছাঁদের সিঁড়ি বাইছে তড়তড়িয়ে। অরু নয়নযুগলের পাপড়ি ঝাপ্টে তন্ময়ের পানে চাইল। শুধাল,
'যাবেন না?'
'যা আসছি।'
'আসুন তাহলে। তাড়াতাড়ি আসবেন।'
তন্ময় গেল জয়তুন বেগমকে তার রুমে রেখে এসে। সে যখন ছাঁদে উঠেছে তখন অরু সবাইকে গোল করে বসিয়ে গল্পের আসর জমিয়েছে। খেয়াল করল অয়ন ও আছে। কাছাকাছি হতেই অয়ন উঠে দাঁড়াল। হেসে বলল,
'আর যাবে না তো ভাই?'
'না।'
'যাক। তাহলে আমাদের আগের মত দেখা হবে। একসাথে কফি খাইনা বছর হতে চলল।'
তন্ময় হাসল, 'সেদিন না দাঁড়িয়ে চা খেলাম?'
'এক হলো নাকি? কফি আর চা কী এক?'
'যুক্তি আছে।'
অরুর আর গল্প করতে ইচ্ছে হলো না। তার গল্পের রাজা সামনে, তাকে দেখে কি ওই গল্পে আর মন বসে? তন্ময় আলগোছে অরুর পাশের জায়গায় বসল। এতে যেন ও ভীষণ খুশি। হাসি ওই গোলাপি ঠোঁট থেকে নড়ছেই না। অগোচরে বেশ কয়েকবার তাকাল। অয়নকে একটা গান গাইতে অনুরোধ করা হলো। অয়ন হেসে গাইতে শুরু করল,
'এই পৃথিবীর যত সুখ, যত ভালোবাসা।
সবই যে তোমায় দেব, একটাই আশা।
তুমি ভুলে যেও না, আমাকে।
আমি ভালোবাসি, তোমাকে।'
তন্ময়ের গানটা পছন্দ হলো। মন দিয়ে শুনছিল। খেয়াল করে শুনল পাশে অরুও ধীর গলায় গাইছে। ওর গানের গলা সুন্দর। চিকন মেয়েলী স্বর। যখন বলল, 'আমি ভালোবাসি তোমাকে' তন্ময়ের হৃদয় ব্যকুল হয়। সেথায় ভালোবাসার আন্দোলন চলে।
.
.
.
চলবে............................