শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৩০ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


তন্ময়ের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জড়ানো কালচে পেলো শার্ট। বুকের দিকের কিছু বোতাম পরিপূর্ণ লাগানো হয়নি। হাত ঘড়ি পরতে নিয়ে রুম ছাড়ল ত্বরান্বিত। অ্যাশ রঙের গাড়িটা বের করল গ্যারেজ হতে। সদরদরজার বাইরে গাড়ি পার্ক করল অনেকক্ষণ। এঁচড়ে পাকা মেয়েটা এখনো নামেনি। তৈরি হতে এতটা সময়ের প্রয়োজন পড়ে নাকি? অবশ্য মেয়েমানুষ মানেই সাধ্যসাধনা মূলক সময়ব্যায়। গুণে-গুণে বিশ মিনিট পর নেমেছে। তাও সাদা পাজামা সেট পরে। বৃষ্টির দিন ওর সাদা কাপড়চোপর পরা নিয়ে যেই নিষেধাজ্ঞা সে দিয়েছিল, তা কী ভুলে বসেছে? ভুলেছে বলেই তো সাহস করেছে। যদি ভুলবশত ভিজে তাহলে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে? অরু দরজা খুলে তন্ময়ের পাশে বসল। হেসেহেসে বলতে নিচ্ছিল, 

'বড়ো ভাইয়া… '
'চুপ।' 

তন্ময় গম্ভীর কণ্ঠে ধমকে ওঠে। 'বড়ো ভাইয়া' ডেকে-ডেকে বিষাদ করে তুলেছে তার রুহ। 
ওদিকে ধমকটুকু অরুর অন্তরাত্মা নিতে পারল না। অভিমানে ঝলসে গেল বুকের ভেতরটা। গাল ফুলিয়ে অন্যপাশে মুখ পেতে থাকল। জানালার কাচটা নামাল পরপর। আসমানে একগুচ্ছ কালো মেঘ। সকালবেলার বাইরেটা সন্ধ্যার ন্যায় আঁধারে ভাব। ঝুমঝুমিয়ে নামছে বর্ষা। মুহূর্তে একঝাঁক বর্ষণ পোটলাপুটলি বেঁধে অরুর কোলে এসে বসল। হাওয়ায় বৃষ্টির একেকটি ফোঁটা মিলেমিশে, তোরজোড়িয়ে ভিজিয়ে দিল তাকে দৃশ্যমান রূপে। বজ্রপাতের তুমুল শব্দ হলো! আশেপাশেই কোথাও হয়ত বজ্রপাত পড়েছে। সুরেলা আওয়াজে স্থিরচিত্তে বর্ষণ হয়ে যাচ্ছে। থামা-থামির নামধাম নেই বললেই চলছে। তন্ময়ের নয়নযুগল বেহায়ার মত অরুতে চলে গেল। ফোঁটা জলে ভেজা গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় দেখতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ডান হাতে হুইল ধরে, বা-হাতে চটপট অরুর পাশের কাচটা উঠিয়ে দিল বিনাবাক্যে। গাড়ির ভেতরে এখন নিস্তব্ধতা শোভমান। বৃষ্টির শব্দ আর কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। গাড়ির সামনের গ্লাসে ব্যস্ত হয়ে আছে রেইন উইপার্স, ক্ষণে-ক্ষণে সেটি বৃষ্টি মুছছে। তন্ময় আড়চোখে চাইল অরুর দিক। মুখখানা ভাড় করে চেয়ে আছে কাচের পানে। কাচ তুলে দেওয়াটা পছন্দ হয়নি হয়ত। না হোক, সবকিছু কী ওর মর্জি মোতাবেক চলবে নাকি? 
তবে, পরমুহুর্তেই মনটা খচখচ করে উঠল। ধমকটুকু দেয়া তার ঠিক হয়নি। ইচ্ছে করছে কাচটা নামিয়ে দিয়ে, ওকে নিজ ইচ্ছেমত ভিজতে দিতে। আবার ভিজলে ওর সর্দি লাগবে, জ্বর হওয়ার সম্ভাবনাও থাকছে। দোটনায় পড়া হৃদয়টা লুকিয়ে তন্ময় সাধারণ গলায় শুধাল,

'কোথায় যেতে ইচ্ছে হচ্ছে?'
'লণ্ডন।'

অরুর ত্যাড়ামো জবাবেও তন্ময়ের কণ্ঠের স্বর সমুদ্রের শান্ত স্রোতের ন্যায় শোনাল,

'এই সপ্তাহে কিংবা মাসে তো সম্ভব না। পড়ে ভেবে দেখব। এর আগে শুনলাম হাতিরঝিল যেতে চাচ্ছিলি। সেদিকে যাচ্ছি তাহলে। হু?'

অরু মুখ ভেঙাল, 'ঠিকাছে, বড়ো ভাইয়া।'

তন্ময় চুপসে গেল। মেঘ জমল মুখশ্রীতে। চেয়েও ঠিকঠাক 'বড়ো ভাইয়া' সম্বোধনটি তার হজম হলো না। হজম না হওয়ার কারণ অবশ্যই রয়েছে। ও কখনো ঠিকঠাক 'তন্ময় ভাই' টুকুও বলত না। আপনি- আপনি বলেই ডেকে যেত। আর এখন উঠতে-বসতে 'বড়ো ভাইয়া' সম্বোধন সে কীভাবে পেটের ভেতর চালান করবে? মাটন খেয়ে কেউ কী আর চিকেন পছন্দ করবে? তন্ময়ের চেহারায় দৃশ্যগত হয়েছে 'অপছন্দ' নামক শব্দটি। অরু নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছে নাহলে বারংবার কেন বলে যাবে? সেয়ানা মেয়েটা তাকে বিরক্তির চরম পর্যায়ে নিতে চাচ্ছে। কিছুক্ষণ খামোশ থেকে তন্ময় অনড় কণ্ঠে বলে,

'নর্মালি কথা বল।'
'নর্মালি কথা বলছি, বড়ো ভাইয়া। এর থেকে নর্মাল কথাবার্তা হয় বলে আমার জানা নেই।'

তন্ময়ের কণ্ঠ নেমে আসলো, 'শেখাব?'

অরুর হৃদয় তড়িৎকৌশলে স্তব্দ হয়। দৃষ্টি হয় ছন্নছাড়া, এলোমেলো। আঁখিপাতায় ভেসে এলো মাওয়াঘাটে ঘটে যাওয়া দৃশ্যটুকু। ওই ওষ্ঠদ্বয় তার ওষ্ঠ ছোঁয়ার পূর্বে বলেছিল 'ভয় সারাব?' 
বুকের ওঠানামার গতি বেগতিক হলো অরুর। ঘুরে গেল জানালার দিক। তন্ময় হাসে শব্দহীনতা বজায় রেখে। ঠোঁটের নিচ অংশটুকু দাঁতে চেপে কোণচোখে চায়। অরু ভুলবশতও তার দিকে তাকাচ্ছে না। বেশ কাবু হয়েছে! নির্লজ্জের মত তার ওমন কথাটা বলা উচিৎ হয়নি। মুখ কী আর উচিত-অনুচিত ভেবে চলে? যা হৃদয়ে আসে তাই মুখে! ওভারব্রিজের রাস্তাটা ধরতেই গাড়ির গতি কমাল তন্ময়। কাচটা নামিয়ে দিল দুপাশ থেকেই। আসুক বৃষ্টি, ভিজিয়ে দিক সর্বশ। অরু এবার নড়েচড়ে ওঠে। ওষ্ঠে ঘেঁষেছে স্মিত হাসি। উপভোগ করছে হিমশীতল বাতাস, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ। হাতটা বের করে ঠাণ্ডা বৃষ্টির জল হাতের মুঠোতে জমাচ্ছে। তন্ময়ের চোখে হাস্যজ্বল অরুকে পড়ন্ত বিকেলর একচিলতে রোদ লাগে,
একচিলতে আদর। 

মানুষজন বিহীন হাতিরঝিল এখন শান্ন্ত, স্থিরচিত্তে মজে। বৃষ্টির স্পর্শে আশপাশ ভেজাটে, নতুন রূপে। তন্ময় ব্রিজের একপাশে থামাল গাড়িটা। ব্রিজের নিচে নদী ছুটেছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল অরুর পানে। অরু তখনো বাইরে তাকিয়ে দেখছে, অদূরে দুজন কপোত-কপোতীর বৃষ্টি বিলাস। অন্যদের এত দেখার কী আছে?

 'কী দেখছিস?'

অরু ফিরে তাকাল। একপল চেয়ে বলল, 

'বাইরে বৃষ্টি।'
'হু। ওয়েদার ঠাণ্ডা। বাতাসও ছেড়েছে। বৃষ্টির একেকটা ফোঁটা ঠাণ্ডা। ভেজার দরকার নেই। ঠাণ্ডা লাগবে আর জ্বর তো মাস্ট!'
'উম…..আচ্ছা। ভিজব না। তবে ঘুরব, ঠিকাছে?'

অরুর এখুনি ঠাণ্ডা অনুভব হচ্ছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ভিজলে কেঁপে-কেঁপে অস্থির হবে সর্বাঙ্গ। না ভেজাই উত্তম হবে বলে মনে করল।
তন্ময় বেশিক্ষণ সেখানে গাড়ি থামিয়ে রাখল না। কিছুক্ষণ থেকেই পুনরায় গাড়ি চলতে শুরু করল। উল্টোপথ ধরে এগুচ্ছে এবার। 

_______

পরদিন রাতে, জয়তুন বেগম রাতের খাবার সেরে, সবাইকে লিভিংরুমে উপস্থিত হতে বলেন। তিনি চাচ্ছেন মেয়ে-মেয়েজামাই, নাতিপুতিদের নিজের সঙ্গে সিলেট নিতে। একটু ঘুরেফিরে নাহয় আসবে সবাই। সেই কত বছর পূর্বে একবার গিয়েছিল। শাশুড়ি মায়ের আবদার ফেলতে পারছিলেন না মোস্তফা সাহেব। আবার সে পুরোপুরিভাবে ব্যস্তও আছেন। তাও তিনি ভাবার সময় নিলেন। আড়ালে-আবডালে বাড়ির অন্য সদস্যদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে এলেন। অরু, দীপ্ত, শাবিহা, রুবি ওরা একপায়ে রাজি। যাবেই যাবে! পারছে না এক্ষুনি ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে। মোস্তফা সাহেব ছেলের মতামত চাইলেন। তন্ময় তখন অরুর খুশিতে উজ্জ্বল মুখখানা দেখছে। ঘুরাফেরার সম্পর্কে মেয়েটা সদাই মঁই হাতে দাঁড়িয়ে! গলায় থাকা শ্বাসটুকু ফেলে, শেষমেশ বলে,

'যাওয়া যায়।'

পরদিন মোস্তফা সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা সবাই সিলেট যাবেন। কিছুদিন ঘুরে আসবেন পরিবার নিয়ে। মস্তিষ্ক সতেজ হবে। তারপরদিনই গোছগাছ শুরু হয়। সন্ধ্যার পরপর রওনা দেবেন। তন্ময় অফিসে ছিল সেদিন। কাজকর্ম যতটুকু পেরেছে গুছিয়ে ফিরেছে। ইতমধ্যে সকলে তৈরি হয়ে, নিজস্ব ল্যাগেজ হাতে লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে। তারজন্যই যত অপেক্ষা সবার। তন্ময় দ্রুত ফ্রেশান-আপ হতে ওপরে ওঠে। নিজের রুমে ফিরতে-ফিরতে শার্টের হাতার বোতাম খুলতে ধরেছে। দু'হাতার বোতাম খুলে হাত বাড়ায়, বুকের দিকের সবগুলো বোতাম খুলতে। ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লেপ্টানো শার্ট পরিপূর্ণ ভাবে খুলে নিয়েছে। হঠাত পদচারণ স্তব্ধ হয়। দৃষ্টি ঠেকে অরুতে। অরু দাঁড়িয়ে তার কাবার্ডের সামনে। হাতে সাদাটে রঙের শার্ট। ভাঁজ করে ল্যাগেজ গোছাচ্ছিল। ও নিজে পরিপাটি ভাবে তৈরি। সাজগোছ করেছে সামান্য। চুলগুলো আধখোলা বিনুনিতে বেঁধে, এককাঁধে ফেলে রেখেছে। আপাতত ওর দৃষ্টি তন্ময়ের ওপর পড়ল। ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে সামান্য ফাঁক হয়ে গেল মুহূর্তে। আঁখিদুটি বড়সড় আকারে রূপান্তরিত হলো। দৃষ্টি তন্ময়ের উন্মুক্ত বুকে নিবদ্ধ। তন্ময় সেসময় এক'ভ্রু উঁচু করে চায়। লজ্জাজড়িত অরু নজর ফিরিয়ে নেয়। অপ্রস্তুত সে হৈচৈ ফেলে দ্রুত পদক্ষেপ ফেলে বেরিয়ে গেল। তন্ময় ওর যাওয়ার পথটা দেখে নিঃশব্দে হাসে। শার্ট বিছানায় ছুঁড়ে ল্যাগেজের দিক এগোয়। সবকিছুই পরিপাটি করে গোছানো।

তাদের এই সিলেট ভ্রমণপথ ছিল অতুলনীয় আনন্দের, বিশেষ কিছু মুহূর্তের। তন্ময় চব্বিশঘন্টাই অরুকে পাশে পেয়েছে, দেখেছে। তাদের আলাদাভাবে, একান্তভাবে ; এক অনুভব প্রকাশের রীতিনীতি চলছিল যেন! সব ঠিকঠাক ছিল, একদম যেন মেঘের দেশে স্বপ্নের বাড়ি। তারপর হঠাৎ করে অরু ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হলো। জ্বর ছুঁতেই ওর আঁখিদুটিতে ভর করে অন্যরকম চাউনি। যেই চাউনিতে তন্ময় পরিচিত নয়। সে কখনো এই অন্যরকম অরুকে দেখেনি, জানেনি। বিষণ্ণতা ওর মুখশ্রীতে লেপ্টে। মনে হচ্ছে ওর ভেতরে বসবাস করা আদুরে আত্মাটা আর নেই। ডাকলে শুনে না, কথাবার্তা বলে না। তন্ময় ওর এইরূপে চিন্তিত হয়, ব্যথিত হয়। হৃদয় জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে শুরু করে। অসহ্যরকমের যন্ত্রণা তার সর্বাঙ্গ জুড়ে। তারপর..তারপর হুট করে, কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে ঢাকা ফিরে গেল। একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে। কেন এমন করল? কী কারণ! তন্ময় কী অজান্তে ওকে কষ্ট দিয়েছে, নিরাশ করেছে? নাহলে তার অরু এমন করার মেয়ে নয়। তন্ময় তখন দিশেহারা পথভ্রম! মোস্তফা সাহেব ছেলের এমতাবস্থা দেখে অস্থির হোন। কাঁধ ছুঁয়ে শুধান,

'কী হয়েছে আব্বা? এমন করতেছ কেন?'
'অরুর কী হয়েছে বাবা? ও….
'চিন্তা হচ্ছে খুব? চলো আজই রওনা দেই। আমি গাড়ি রেডি করতে বলি। চিন্তা করে না।'

অত্যন্ত চিন্তিত মোস্তফা সাহেব বেরিয়ে পড়েন। আজই ঢাকা ফিরবেন সিদ্ধান্ত নেন। তন্ময় মাথা নুইয়ে বসে রইল। চক্ষু দুটো লালচে। হাতে সেলফোন। পঁয়তাল্লিশটি কল ইতোমধ্যে দিয়েছে। বিশের অধিক ম্যাসেজ। একটা কলও রিসিভ হয়নি। ম্যাসেজের কোনো জবাব আসেনি। উলটো ফোন বন্ধ করে ফেলেছে। তন্ময়ের চোয়াল শক্ত হয়। হাতের ফোনটা আছড়ে ফেলে ফ্লোরে। ভেঙেচুরে লণ্ডভণ্ড হয় ফোনটি। দাঁতে দাঁত পিষিয়ে বিড়বিড়িয়ে ওঠে, 

 'এই কাহিনীর উপযুক্ত কারণ তুই দেখাতে না পারলে, তোকে আমি খেয়ে ফেলব। জাস্ট খেয়ে ফেলব।'
.
.
.
 চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন