শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৩১ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


তন্ময় নির্বোধ নয়। বরঞ্চ বলা যায় জ্ঞানী মানুষ সে। যার রীতিমত ম্যাথম্যাটিকস পছন্দের সাবজেক্ট ছিল। যে সারাদিন কষে-কষে অঙ্কের একেকটি সূত্র মনে রেখে অঙ্কের মিলন ঘটাত। যার হায়ারম্যাথমেটিক্সে সর্বোচ্চ নাম্বার উঠত। অবশ্যই সে বুঝে নিয়েছে অরুর বিদ্বেশী হৃদয়। নাহলে তার অরু এমন কেন করবে? এহেন আচরণ অরুর পার্সোনালিটিতে নেই। সে বৈরাগী হবে তবুও তন্ময় থেকে কিঞ্চিৎ দূরত্বে যেতে রাজি নয়। তাহলে কী এমন ঘটল যার কারণ ধরে এতটা দূর এগিয়েছে? এযাত্রায় মোস্তফা সাহেব ফিরলেন গাড়ির বন্দবস্ত করে। পুত্রের চিন্তিত মুখমণ্ডল দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মস্তিষ্কের জটিলতার দড়ি খুলতে বলেন,
'রাতের খাবার খাবি আয়। বেরোব কিছুক্ষণের মধ্যেই।'

তন্ময়ের কণ্ঠ চমৎকার দৃঢ় শোনাল, 
'শুনুন বাবা, আপনি আমাকে দুহাতে গলা টিপে মে রে ফেলুন। তারপর সব শান্তি। আপনিও চরম শান্তি পাবেন! স্ফূর্তিতে, আমোদে ঘুমাবেন।'

কথাটুকু শেষ করে আর একমুহূর্ত দাঁড়াল না। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। পুত্রের এহেন কার্যকলাপে, বাক্যে মোস্তফা সাহেবের পিতা নামক অনুশোচনাকারী হৃদয়টা এবার চুপসে এইটুকুন হয়ে গেল। সরল মুখটুকু নেতিয়ে এলো। পুত্রের আপনি সম্বোধন জানান দিচ্ছে, আজ তাদের পিতাপুত্রের মধ্যে ভ য়া বহ যুদ্ধ নামক সংঘর্ষ হবে। পুত্র তার রেগেমেগে অস্থির একপ্রকার। এখানে মোস্তফা সাহেবের দোষ কোথায়? সে শুধু চেয়েছে সারাটি জীবন যেন তাদের পুরো পরিবারের সম্পর্ক অনড় রয়। কোনো ভাঙ্গন যেন ছুঁতে না পারে। এতটুকু চেয়েই তো পুত্রের নিকট আবদার রেখেছেন অরুর চারিপাশে না ঘুরতে! অরুটা ছোটো, অবুঝ। এখন হয়ত ওর তন্ময়কে পছন্দ, বুঝদার হয়ে যদি পছন্দ না হলো? বয়সের ব্যবধানে দুজনের বোঝাপড়াতে যদি কমতি রয়ে যায়? তখন কী হবে! বিয়ে দিয়ে তারপর যদি বিয়েটা না টিকে? শুধু ওদের সম্পর্ক নয় সঙ্গে তার যত্নে গড়ে তোলা সংসার খানা চুরমার হয়ে যাবে। তারওপর সে জানে না ছোটো ভাইয়ের মতামত। কন্যার মাতা হিসেবে সুমিতা বেগমেরও তো সম্মতি প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে মোস্তফা সাহেব এখুনি অনুভব করতে পারছেন, সুমিতা বেগম খুব করে চাচ্ছে নিজ ভাইয়ের ছেলের হাতে অরুকে তুলে দিতে। অবশ্য সেটা তিনি কখনোই হতে দেবেন না। বেঁচে থাকতে তো নয়ই। এযাত্রায় এসে খুব করে বুঝে নিয়েছেন পুত্রের অনুভূতি। অরুকে না পেলে পুত্র তার সন্ন্যাসী হয়ে উঠবে নিশ্চিত। আর যাইহোক মোস্তফা সাহেব নিজের একমাত্র পুত্র হারাতে চান না। ধীরেসুস্থে সব হাতের মুঠোয় আনবেন তিনি। পূর্বে অরুটা একটু বড়ো হোক। মেয়েটা বড্ড ছোটো। তার মেয়ে শাবিহা এই বয়সে এসেও পড়াশোনা চালাচ্ছে স্বাধীন ভাবে। এখনো নিজ মেয়ের বিয়েশাদির কথা ভাবছেন না। তাহলে তিনি কোন মুখ নিয়ে ছোটো ভাইয়ের সম্মুখীনে ওর ওইটুকু মেয়েটাকে চাইবেন? লজ্জাবোধ বলতে তো তার কিছু আছে নাকি! সে তো নিজ পুত্রের মত পাতলা চেহারার নন। 

খাওয়া-দাওয়া বড়ো দূরের বিষয়, তন্ময় কাপড়চোপড়ও পরিবর্তন করেনি। সেভাবেই ড্রাইভিংয়ে বসেছে। একেএকে সকলে উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়েছে। সম্পূর্ণ রাস্তা খামোশ রূপে রইল। মুখে টু'শব্দও করেনি। বসবার ভঙ্গিমা এতগুল ঘন্টায় একবারও পরিবর্তন হয়নি। না হয়েছে নড়চড়। গাড়িটিও একমুহূর্তের জন্য থামেনি। একনাগাড়ে ছুটছে। অহর্নিশ। মোস্তফা সাহেব উদাস, হতাশ। ওদিকে স্ত্রি তার সবকিছু থেকে অবুঝ। কী সুন্দর ভাবে বেশ আমোদে ঘুমিয়ে চলেছে। আহারে! মোস্তফা সাহেবের নিজের জন্য নিজের ভালো ধরনের মায়া হলো।

তখনো সূর্যোদয় হয়ে ওঠেনি। আঁধারে আঁধারে হাবভাব। পাখিদের উড়োউড়ি না হলেও কিচিরমিচিরের ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে। সবেমাত্র গাড়িটা এসে পৌঁছাল শাহজাহান বাড়ির দোরগোড়াতে। নীরবতা ছিন্নভিন্ন করে উচ্চ শব্দে সদরদরজা পেরিয়ে ভেতরে চলে এলো। গাড়ি থামতে দেরি তন্ময়ের নামতে নয়। দ্রুততম গতিতে একেকটি নিঠুর পদক্ষেপ জমিনে ফেলে ভেতরে ঢুকল। আনোয়ার সাহেব বসে লিভিংরুমে। তন্ময়কে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। মেয়েকে নিয়ে ফিরে তিনি আর ঘুমাতে যাননি। তন্ময় সিঁড়ির দিক ছুটল। পদচারণ না থামিয়ে বলে উঠল তাগাদা সহিত,
'কী অবস্থা এখন! ওর জ্বর কমেছে চাচ্চু? ডক্টর আঙ্কেলকে আসতে বলেছিলে?'
'এসছিল। দেখে গেছে। জ্বর আছে এখনো। আগের থেকে কম।'
'আমি দেখে আসি।'

তন্ময় পলকের মধ্যে সিঁড়ি গলিয়ে করিডোর ধরে চলে এলো অরুর কক্ষের সামনে। দরজা লাগানো। আলগোছে শব্দহীনতা অবলম্বন করে খুলল। আঁধারে কক্ষে বাতি জ্বালাল। অরু ঘুমিয়ে। শরীরে বেবি কম্বল মেলে দেয়া। দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে বিছানার সামনে অগ্রসর হলো। কোমর ঝুঁকিয়ে চাইল প্রেয়সীর কান্নারত মুখপানে। চোখের জল গালে লেপ্টে শুঁকিয়ে আছে। ফ্যাকাসে মুখখানা দেখে তন্ময়ের হৃদয় যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল। হাত বাড়িয়ে এলোমেলো কেশ গুলো যত্নসহকারে মুখমণ্ডল থেকে সরাল। ঘুমের মধ্যেই মুখ ফসকে আর্তনাদ করছে অরু। তন্ময় শক্ত করে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। কেন করছে এমন মেয়েটা? নিজেকে এভাবে কষ্ট কেন দিচ্ছে? মাথা থেকে হাত সরে এবার গাল ছুঁল। পরপর বন্ধ নয়নযুগল। নিষ্পাপ, প্রাণহীন মুখপানে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে নিলো। কপালে চুমু খেতেই পদচারণে ধ্বনি কর্ণগোচর হলো। চটপট সোজা হয়ে দাঁড়াল। ভদ্রতাসূচক দূরত্ব বাড়াল বিছানা থেকে। সকলে চলে এসেছে একসাথে। শাবিহা অরুর বিছানায় উঠে গেল। জানাল অরুর সাথেই থাকবে। জবেদা বেগম পাশে বসে অরুর মাথা বোলালেন। মোস্তফা সাহেব অদূর হতে দেখে পরপরই আনোয়ার সাহেবের সাথে বেরিয়ে এলেন। তন্ময় সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। নিখুঁত দৃষ্টিতে দেখল সয্যাগত অরুকে। জবেদা বেগম সহ রুবি বেরিয়ে যেতে রয়ে গেল তন্ময়, শাবিহা। দু ভাইবোন। শাবিহা ঢোক গিলল। বড়ো ভাইয়ের গম্ভীর মুখখানা দেখে তোতলানো সুরে প্রশ্ন করল,
'ত.. তুমিও কি থাকতে চ.. চাচ্ছ ভাইয়া?'

তন্ময় ডান ভ্রু উঁচু করে চাইল। শাবিহা বোকাঝোকা হাসিটা হাসতে গিয়েও ব্যর্থ। তন্ময় চোখা রাঙাল। ত্বরিত বেরিয়ে এলো। নিজ কক্ষে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। সর্বোচ্চ শক্তিতে একচিত্তে খুলতে থাকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জড়ানো টি-শার্ট। নিদ্রালু মস্তিষ্কে, অশান্ত মনে এক সাংঘর্ষিক রাত পেরিয়েছে আজ সে। 
_______

তিন'চারদিন টানা প্রেয়সীর আদুরে মুখখানার দেখাসাক্ষাৎ মিলল না। কণ্ঠখানাও শোনা হয় না। ওর উচ্চকণ্ঠের হাসিঠাট্টা, নূপুরধ্বনি সবকিছু আবছায়া। দরজাতে করাঘাত করে ডেকেও লাভ হলো না। শুক্রবার ছিল সেদিন। বাসাতেই তন্ময়। অফিস নেই আজ, ছুটির দিন বলে কথা। বেলা করে উঠেছে ঘুম ছেড়ে। ইদানীংকাল রাতে ঘুম হয় না। নির্ঘুম কাটিয়েছে প্রত্যেকটি রাত। সিগারেটও ভালোরকমের খাওয়া হয়েছে। বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় না পড়লে এত সিগারেট খাওয়া হয় না তার। এযাত্রায় ঠিক কী কারণে সিগারেট টানছে তন্ময় নিজেও জানে না! নিজ কক্ষ ছেড়ে বেরোতেই নজর ফেলল অরুর কক্ষে। দরজাটা খোলা আগের মত। তন্ময়ের হৃদয় উশখুশ করল ভেতরে ঢুকতে। ঢুকবে পূর্বেই চিরচেনা মেয়েলি কণ্ঠের স্বর কর্ণগোচর হলো। ধ্বনি ভেসে আসছে নিচ থেকে। তন্ময় দ্রুত নামল সিঁড়ি বেয়ে। দুয়ারের সামনে মোস্তফা সাহেব বড়ো ধাঁচের দুটো ইলিশ মাছ দুহাতে দাঁড়িয়ে। এতবড় জলজ্যান্ত মাছ দেখে সকলে উৎফুল্ল। অরুও আগেকার ন্যায় বেশ চঞ্চল। মাছ একটা নিজ হাতে নিতে এগিয়ে গিয়েছে। মোস্তফা সাহেব হেসে এগিয়ে দিলেন একটি মাছ ধরতে। একহাতে নয় অরুকে দুহাতে ধরতে হলো। এতটা ভারী যে সে একটাই তুলতে ব্যর্থ প্রায়! তন্ময় নিশ্চুপে নিচে নেমে এলো। দাঁড়াল অরুর পেছনে। আগোচরে দেখে নিচ্ছে অরুর প্রফুল্লবদন, খুশিতে আটখানা মুখশ্রী। তার বুকে এমন ভয়াবহ রকমের যন্ত্রণা দিয়ে এখন দিব্বি আছে! মাছটা মোস্তফা সাহেবকে ফেরত দিয়ে ঘুরল অরু। মুহূর্তে মুখোমুখি হলো তন্ময়ের। তন্ময় মুখ খুলবে কিছু বলবার জন্যে পূর্বে অরু
একপল চেয়ে অন্যদিক চলে গেল। এহেন কাণ্ডে তাজ্জব না বনে পারল না তন্ময়। আশ্চর্য!

সন্ধ্যার পড়ের ছাঁদপার্টি আজ শাবিহা আয়োজন করেছে। ছাঁদে বড়ো রকমের দুটো কার্পেট বিছিয়ে নিয়েছে। একেক করে নিয়ে আসছে হরেকরকমের খাবারদাবার, ড্রিংকস। দুটো মিনি মিউজিক বক্স সঙ্গে গিটার। অয়ন হাজির হয়েছে সন্ধ্যার পরপরই। সেও হাত লাগিয়েছে। রুবি, আকাশও বসে নেই। এটাওটা করছে। তন্ময় দীপ্তর ডাকে বেরুল। অরুর কক্ষের দাঁড়াতেই দীপ্ত ছুটল অরুকে ডাকতে। অরু পরিষ্কার কণ্ঠে বলল,
'যাব না। তুই যা।'

তন্ময় পা বাড়াল অরুর কক্ষের ভেতর। অরু বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদাস মনে। তন্ময়কে অনুভব করেও ফিরে চাইল না। তন্ময় রাগ সংবরণ করল। ক্ষিপ্ত মেজাজ লুকিয়ে যথাসম্ভব শান্ত গলায় শুধাল,
'কেন যাবি না?'
'মন চাইল তাই।'

তন্ময়ের বলতে ইচ্ছে করল 'তোর মন কী আমাকে খু ন করতে চাইছে? সেটাই কর তাহলে। তোরা মিলেমিশে আমাকে মে রে নদীতে ফেলে দে।' মুখে বলল,
'তাড়াতাড়ি আয়। দ্বিতীয় বার যেন বলতে নাহয়।'

তন্ময় বেরিয়ে এলো। ছাঁদে এসে দেখল শাবিহা সবকিছু পরিপাটি করছে। বড়ো ভাইকে দেখে শাবিহা শুধাল,
'কই অরু?'

তন্ময় গম্ভীরমুখে জবাবে বলল,
'ঘরে।'

শাবিহা আর প্রশ্ন করল না। ছুটল অরুকে আনতে। অয়ন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তন্ময়ের। দুজনের এটাওটা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হলো। তন্ময় অন্যমনস্ক হয়ে উঠছে। আড়চোখে চাইছে দরজার দিক। এযাত্রায় দেখা মিলল শাবিহার। পেছনে অরু। দুজন আসতেই সোরগোল আরম্ভ।
অরু এককোণে বসল ঠিক রুবির পাশে। তার পাশে দীপ্ত। তন্ময় বসেছে আকাশ, অয়নের পাশে। সে সকলের কীর্তিকলাপ দেখছে মনে হলেও আড়চোখে ধ্যানজ্ঞান একজনেতেই সীমাবদ্ধ। অরু চুপচাপ বসে। হুটহাট অনিচ্ছুক ভাবে দু'একটা বাক্য ছুঁড়ছে। তন্ময়, অরুর আনন্দের ছিটেফোঁটা অনুভব হলো না। দুজনেই অন্যদেশে বিরাজ করছে। অয়ন মুখে জিজ্ঞেসও করে নিয়েছে, আজ অরুর কী হলো! অরু কোনোমতে হেসে বলেছে, শরীর খারাপ। ব্যস এতটুকুই। রাত নটা পর্যন্ত গানবাজনা হলো। আরও ঘন্টাখানেক চলত তবে বাঁধা হলেন মোস্তফা সাহেব। তিনি গম্ভীরমুখে আদেশে ছুঁড়েছেন এসব থামিয়ে নিচে নামতে। অরু যেন তাই চাচ্ছিল। মোস্তফা সাহেবের সঙ্গেই নেমে গেল চটজলদি। দৃশ্যমান রূপে আঁধার নামল তন্ময়ের সুদর্শন মুখমণ্ডল জুড়ে। শাবিহা এযাত্রায় আর নিশ্চুপ রইতে পারল না। সকলে নিচে নামলেও সে দাঁড়িয়ে থাকল। অগ্রসর হলো একা দাঁড়িয়ে থাকা বড়ো ভাইয়ের দিক। তন্ময় পকেটে হাত নিয়েছিল, সিগারেট ধরাবে বলে। শাবিহাকে দেখে সে ভাবনা মস্তিষ্ক হতে বাদ দিলো আপাতত। প্রশ্নবোধক চোখে চাইতে শাবিহা দৃঢ় কণ্ঠে জানাল,
'বড়ো মামা চাচ্ছিলেন তোমাকে মেয়েজামাই করতে। মা একদফাতে মুখের ওপর না করতে পারেনি। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেছে তোমার সময় প্রয়োজন। কিন্তু তারা একপ্রকার ভেবেই নিয়েছে বিয়েটা হবে। সেসুত্রে হয়ত অরুকেও বলেছে।'

তন্ময়ের গা রাগে রিরি করে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত করল চোয়াল। মুঠোবন্ধি হলো হাত জোড়া। ফুঁলেফেপে উঠল কপালে নীলচে শিরা-উপশিরা। বাড়িঘর ভেঙে ঝলসে দিতে পারলে হয়ত শান্তি মিলত। বুকের ওঠানামার গতি অস্বাভাবিক দ্রুত। শ্বাসপ্রশ্বাসও চঞ্চল। শাবিহা বড়ো ভাইয়ের এরূপ দেখে চুপসে দাঁড়িয়ে রইল। তন্ময় বড়ো বড়ো পদচারণে ছাঁদ থেকে নেমে এলো। সোজাসাপটা এসে দাঁড়াল লিভিংরুমে। মোস্তফা সাহেব সংবাদ দেখছেন। আমোদে টেলিভিশন দেখতে থাকা পিতার মুখে বাক্য ছুঁড়ল,
'বাগানে এসো, কথা আছে।'

কথাটুকু শেষ করে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। মোস্তফা সাহেব আশ্চর্যের সপ্তম হতে নেমে পিছু চললেন। তার আসতে দেরি পুত্রের ক্রোধান্বিত কন্ঠ ভেসে আসতে দেরি হয়নি,
'এই বিয়ের বিষয় কই থেকে আসলো? এই কলিপলি কোন আসমান ভেদ করে নামল? আমার শান্তস্থির জীবন তছনছ করে তুমি আরাম করে টেলিভিশন দেখছ! আমাকে কে টে টুকরো টুকরো করে টেলিভিশনে স্যাট করে দেখলে বেশি আনন্দ পেতে না?'

মোস্তফা সাহেব অবুঝ সাজলেন,
'কী সম্পর্কে বলছ? আমি বুঝতে পারছি না।'

তন্ময়ের লম্বা, সরু নাকের পাটা ফুঁলেফেপে উঠছে। মোস্তফা সাহেব হাল ছাড়লেন। দীর্ঘনিশ্বাস টেনে নিয়ে বলেন, 
'তোর মামা চাইছিলেন নিজেদের মধ্যে বিয়েশাদি হোক। তোর মা তাই আমার সাথে আলাপ করছিল এই বিষয়ে। সে মুখের ওপর না করেনি। ভদ্রতা বজায় রাখতে বলেছে তোর মতামত জেনে জানাবে।'
'তোমার স্ত্রীর ওই সামান্য ভদ্রতা এখন আমার গলায় দড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিষ্কার কণ্ঠে ওই বাড়িতে পাকাপোক্ত ভাবে জানাও এসব ড্রিমস না দেখতে। তুমি না পারলে বলো আমি গিয়ে বলি।'

মোস্তফা সাহেব বোঝানো স্বরে বলেন,
'আমিই বলব। শোন…

তন্ময় শুনল না। বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। হৃদয়টা অশান্ত হয়ে আছে। মেয়েটা ভীষণ ব্যথিত হয়েছে নিশ্চয়ই! ও কী চেনে না তাকে? এখনো কী বোঝেনি বিন্দুমাত্র! বোঝেনি বলেই ওসব থার্ডক্লাশ কথা মেনে নিয়ে অভিমান করে বসে। তন্ময় এলো শাবিহার কক্ষের সামনে। দরজায় করাঘাত করতে বেরিয়ে এলো শাবিহা। তন্ময় বলল, 

'মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি হবে। ছাঁদে মিউজিক বক্স দুটো রয়ে গেছে। অরুকে গিয়ে বল এক্ষুনি নিয়ে আসতে। ভিজে যেতে পারে।'

শাবিহা বিহ্বল না হয়ে পারল না। তার দুষ্টুমি ভঙ্গিতে বলতে ইচ্ছে করল,
'তুমি গিয়ে নিয়ে এসো। অথবা আমি গিয়ে নিয়ে আসি। অরুকেই কেন যেতে হবে?' 
তবে তা প্রকাশ করা অসম্ভব। মনে থাকা বাক্যগুলো মনেতেই রেখে দিলো। চুপসে মাথা দোলায় কোনোমত। তন্ময় চলে গেল অন্যদিক। শাবিহা লুকিয়ে হাসল। ঘুরেফিরে ভাই তার নিশ্চিত ছাঁদে যাবে।
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন