আষাড়মাস অর্থাৎ, এই ধবধবে নীলাসাদাটে আসমান ফের পরমুহুর্তেই মেঘলাটে হয়ে নামে অঝোরে বর্ষণ। রাত্রির একপ্রহরে হয়ত অর্ধখণ্ডিত চাঁদের উদয়ন ঘটে। সেই চাঁদ কালো মেঘে ঢেকে যেতে সময় নেয় মিনিটখানেক। আজ ভরসন্ধ্যাতে ফকফকে পরিষ্কার আকাশের দেখা মিলেছিল। এমুহূর্তে কালো কালো মেঘে ঢাকা পরিপূর্ণ আসমান। বজ্রপাত পড়ছে উচ্চ ধ্বনি তুলে। এহেন ধ্বনিতে খোলা আসমানের নিচে দাঁড়ালে, সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠা সাধারণ বিষয়। সেক্ষেত্রে ধরা যায় তন্ময় ভিন্ন বটে। তার না কাঁপছে শরীর আর না বুকের ভেতরটা। বেশ সাবলীল দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা। দাঁড়িয়েছ ছাঁদের এককোণ ঘেঁষে। দৃষ্টি অদূর ছাঁদের দরজায়। যেন অদৃশ্য কোনো হিসেব-নিকেশের ছন্দপতন ঘটাচ্ছে। ফিনফিনে পাতলা আলোতে চারিপাশটা আঁধারে। এযাত্রায় বড়ো ধাঁচের একফোঁটা তীক্ষ্ণ বৃষ্টি পড়ল ডান হাতের ওপর। পরপর একেক করে পড়তে থাকল। জানান দিচ্ছে ঝুম বর্ষণে মাতাল হবে পৃথিবী ক্ষণিকের মাঝে। এমুহূর্তে নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে এলো নূপুরধ্বনি। কর্ণগোচর হতে হেসে ওঠে তন্ময়। আঁধারে মিলিয়ে যেতে কর্নারের দিকটায় এগুল। অরু উঠে এসেছে ছুটে। এদিক-ওদিক ছুটছে ছাঁদের প্রান্তরে। মিউজিকবক্স কোথায়! সে তো মিউজিকবক্সের জ অবদি দেখছে না আশেপাশে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, খোলামেলা ছাঁদ। আঁধারে হলেও তো সে এতটা অন্ধ নয় যে মিউজিকবক্স দেখতে পাবে না! আশ্চর্য! পইপই করে শাবিহা বলেছে বক্সদুটো যত্নসহকারে নিয়ে আসতে। অরু আরও দু'তিনটে ঘুরপাক দিতে চাইল। সেই চাওয়া পূরণধারার একপর্যায়ে মানবছায়া দেখে চমকে ওঠে। ভয়ে শিরা-উপশিরা বেয়ে ঘাম ছুঁটে। চিৎকার দেবার পূর্বে দেখতে পায় মানবছায়ার মুখমণ্ডল। তন্ময় এগিয়ে আসছে। অরু যেন এক সেকেন্ড ভাবলও না। পূর্বে পা'জোড়া কাজ শুরু করে দিয়েছে নিজ গতিতে। পালাবে-পালাবে ভাব। ছুটন্ত অরুকে ধরতে পলকও ফেলতে হয়নি তন্ময়ের। এতটুকুন মেয়ে একটা! তন্ময়ের মত বড়ো-বড়ো দুটো পায়ের মালিকের সঙ্গে পারার কথা নাকি? অরু ঘাবড়াল না। পূর্বের ন্যায় লজ্জিত কিংবা চমকাল না। উলটো বড়ো-বড়ো নয়নযুগল ছোটো করে, কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ রাঙাল। দারুণ তো! তন্ময়ের মনে হলো অরুর চোখ রাঙানোও এক অন্যরকম আর্ট, ভিন্নরকমের স্বাদ। কী তেজস্বিনী রূপ! এরূপ সে পূর্বে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না!
অরুর কণ্ঠেরও চমৎকার পরিবর্তন হলো। কণ্ঠে যেন ক্রোধ ঝরনাধারা ঝরছে,
'ছাড়ুন।'
ওর কাঠখোট্টা কথাটুকুতে, তন্ময়ের দুপাশের ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হতে চাচ্ছে। তবে সেটা এখন করা যাবে না। তার গাম্ভীর্যতার ইমেজ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাবে। তখন অরুটা আর ভয় পাবে না। ওকে হাতে রাখার কৌশল হচ্ছে তার এই গম্ভীরমুখটা। সেই গম্ভীরমুখটায় ভ্রুদ্বয় উঁচিয়ে বলল,
'কথা আছে। দাঁড়া সামনে।'
'শুনব না।'
জবাবটা যেন জিহ্বাতে রাখা ছিল অরুর। হাতটাও ছাড়ানোর প্রয়াস সে কম করছে না। তাতে কী? নিত্য ব্যায়াম করা তন্ময়ের শক্তির সঙ্গে আদতেও পারবে? প্রশ্নই আসে না। বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই সেটার। অরুর নরম হাতটা টেনে নিজের সামনে এনে দাঁড় করাল তন্ময়। কণ্ঠ নামিয়ে শুধাল,
'এই তোর বিশ্বাস? এতটুকু চিনিস আমাকে?'
অরুর ক্রোধ অভিমানে রূপান্তরিত হলো চোখের পলকে, একটি নিশ্বাসে পূর্বে। শুকনো মুখটুকুতে বিচিত্রিত, অমাবস্যাজনিত মেঘ জমল মুহূর্তেই। পলক ফেলল অন্যপাশ চেয়ে। বিড়বিড়িয়ে জবাবে বলল,
'আমার বিশ্বাস আর চেনা দিয়ে কার কী!'
তন্ময় মাথা নুইয়ে ফেলল। অরুর মাথা বরাবর, চোখ বরাবর নিজের চোখমুখ আনার বৃথা চেষ্টা চালাল। নরম তুলতুলে হাতটা গভীরভাবে ছুঁলো। কণ্ঠে নম্রতা এনে প্রশ্নবাণ ছুঁড়ল,
'কিছু নয় তোর? তাহলে এমন আচরণ কেন করছিস? আমাকে এভয়েড করার রিজন কী দাঁড়াচ্ছে?'
বৃষ্টির মাত্রা বাড়ল। রিমঝিম ধ্বনি তুলে ভিজিয়ে তুলেছে চারিপাশটা। তন্ময়ের টি-শার্ট ভিজে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লেপ্টে। অরুর আরও করুণ অবস্থা! সেদিকে একপ্রকার দৃষ্টি তন্ময় নিচ্ছেই না। একচিত্তে চেয়ে ওই মুখপানে। চোখের ওপরে এসে ভীড় জমানো ছোটো ভেজা চুলগুলো, তার মুখের নম্রতা, কণ্ঠের নম্রতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলল।
অরু চোখ তুলে চাইল। নাকের পাটা দুটো ফুঁলেফেপে উঠছে। অভিমানী রূপে বলে ওঠে,
'আমি একটা বেহায়া আর বড়ো রকমের ছ্যাঁচড়া। নাহলে কী এভাবে অন্যের ভবিষ্যত জামাইয়ের পেছন ঘুরে বেড়াই? আমার আত্মসম্মান নেই, ঘেন্না নেই…….'
অরুর বাকিটুকু কথারা আর পূর্ণতা পেলো না। কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে বৃষ্টি আর অতি নিকটে দাঁড়ানো তন্ময়ের তপ্ত শ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্বনি। আগামবার্তা বিহীন একজোড়া ওষ্ঠদ্বয় এসে ছুঁয়ে দেয়াতে সে স্তব্দ না হয়ে পারল না। বড়ো-বড়ো চোখে চেয়ে থাকল আঁখিদুটির সামনে থাকা মুখপানে। তন্ময়ও চেয়েই। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল অরুর। টালমাটাল হলো শিরা-উপশিরা। চেতনা সহ, এভাবে চেয়ে থেকে এহেন কাজ করতে পারল তন্ময়? অরু না পারল সরতে আর না পারল চেয়ে থাকতে। ঝট করে বুঝে নিলো চোখজোড়া। তন্ময় নিমিষেই কোমর ছুঁয়ে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। সেদিনের মত শুধু ওষ্ঠ ছোঁয়াতে সীমাবদ্ধ থাকল না। আজ মত্ত হলো, মাতোয়ারা হলো। স্বাদ পাবার নৃত্যে মজল। বারংবার নড়েচড়ে ওঠা ছোট্টখাট্টো দেহখানা সে যত্নে নিজের সঙ্গে লেপ্টে নিলো। চুলের নিচে গলিয়ে ঘাড়ের নরম অংশটুকু শক্ত করে ধরল। নিজের আওতায় এনে উঁচু করে নিলো। অরুর হাত দুটো ঠিক তন্ময়ের বুকের মধ্যিখানের টি-শার্টের অংশভাগ তীব্র শক্তিতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। ওষ্ঠধর স্পর্শনের তীব্রতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে, মুশলধারা বর্ষণের গতি, তন্ময়ের বুকের কাছটায় থাকা হাত দুটোর শক্তি। অনাকাঙ্ক্ষিত, অনিবার্য এই মুহূর্তটিতে অরুর উঁচু করে রাখা পা'জোড়া এযাত্রায় শক্তি হারাল। নিথর হলো। বেসামাল ধাঁচে পেছন চলে এলো দুপা। এতে চুম্বনে বাঁধা সৃষ্টি হয়নি। সঙ্গে-সঙ্গে, সেকেন্ডের মধ্যে অরুর পায়ের তালে তাল মিলিয়ে তন্ময়ও পিছু এসেছে। অনুরাগের বশে পরস্পরের ওষ্ঠাধর স্পর্শনে বাঁধা হয়ে বেয়ে চলেছে বৃষ্টির ঠাণ্ডা জলের একেকটি ফোঁটা। দীর্ঘতম চুম্বনদৃশ্য থামে সবে। তন্ময় ওষ্ঠদ্বয় ছাড়ল তবে সরল না। অরুকে ছাড়ল না। নিজের কাছে, অতি নিকটে যত্নে রাখল। ওর বন্ধ চোখের পাতাতে আঙুল বোলাল। সাগরের থেকেও গভীরতম হলো তার কণ্ঠের সুর,
'আমি… আমি তোর ছাড়া অন্যকারো নই। হতেই পারি না।'
অরু চোখ মেলে চাওয়ার সাহস, স্পর্ধা কিংবা হৃদয়ের তাড়না পেলো না। শক্ত করে বুজে রাখল আঁখিপাতা। তিরতির করে কাঁপছে তার বৃষ্টির জলে ভেজা অতি রক্তিম ওষ্ঠদ্বয়। পুনরায় ওই ওষ্ঠে মত্ত হওয়া থেকে নিজেকে দমন করল তন্ময়। দৃষ্টি ফের নিলো অরুর বন্ধ চোখে। ধীরতম কণ্ঠে আবদার ধরে,
'তাকা। চোখ মেল।'
অরু মাথা নাড়ায়। যার অর্থ দাঁড়ায় 'না'। তন্ময় ওর ফোলাফোলা গাল ছুঁয়ে বলে,
'কেন না? আমিত শাহজাহান আরাবীর সুগভীর চোখের ভেতরটা দেখতে চাচ্ছি।'
অরু চট করে চোখ মেলে চাইল। যেন নিশ্চিত হতে ; এই কণ্ঠ, এই বাক্যের মালিক আদতেও তার তন্ময় ভাই কিনা! যে ব্যক্তি সর্বদা তাকে কাছে রেখেও দূরে ঠেলে দিয়েছিল। যত্নে গড়ে অযত্নকৃত প্রত্যাখ্যান করে চলেছিল। তন্ময় ওই সুগভীর নয়নে চেয়ে বিড়বিড়িয়ে ওঠে, 'এইত সেই চোখ যেখানে চাইলে আমি সাতসমুদ্র দেখতে পাই, প্রেম সাগরের সাতসমুদ্রের অতলে ডুবে যাই।'
.
.
.
চলবে...........................