অন্তর্নিহিত কালকূট
পর্ব ০৪
অনিমা কোতয়াল
.
.
.
মাঘের কনকনে শীত। রাতের শহর যেন পরিণত হয়েছে ঘুমন্তপুরীতে। বাধ্যবাধকতা ছাড়া বাইরে নেই একটি প্রাণিও। লেপ-কম্বলের নিচে গড়ে নিয়েছে নিজের উষ্ণ আশ্রয়। শীতের প্রোকোপে নেতিয়ে পড়েছে জীবজন্তুও।
কুড়িলের রেইলনাইনের পাশে বিশাল ফাঁকা জায়গা। নুইয়ে যাওয়া নিস্তব্ধ প্রকৃতির মধ্যে শক্ত-দৃঢ় পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেই যুবক। পরনে পাতলা একটা টিশার্ট। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। শীত-গরম নামক এই অনুভূতি যেন অনেক আগেই নিঃশেষ হয়েছে। অক্ষিযুগল স্থির হয়ে আছে দূরের সোডিয়ামের আলোতে। এলোমেলোভাবে গজিয়ে ওঠা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল, যেন তার নিজের প্রতিই তীব্র বিতৃষ্ণার প্রতিক।
হঠাৎ রিংটোনের আওয়াজে বাঁকা হাসল যুবক। এই ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল সে। অলস ভঙ্গিতে ফোনটা বের করল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত কন্ঠে কেউ বলে উঠল, 'সুজন! জায়গাটা ছেড়েছিস? দেখ, তোদের সবার লাইফ কিন্তু এখন মারাত্মক রিস্কে। একজনের সামান্য ভুলের জন্যে সবগুলো মরব। আমার ভাই কোথায়? কোথায় আছিস তুই? কথা বলছিস না কেন? সুজন!'
সেই যুবক শীতল কন্ঠে বলে উঠল, 'দুবাই বসে বসেই ভাইয়ের খবর নেবেন? এবারতো দেশে আসুন! ভাইয়ের লা-শ দাফন করবেন না? তবে সঙ্গে আরও তিনজন নিয়ে আসবেন। খাটিয়া ধরতেতো চারজন লাগে। ওহ্ না, চারজন নিয়ে আসাই ভালো। নয়তো আপনাকে তোলার জন্যে একজন কম পড়ে যাবে।'
অনাকাঙ্ক্ষিত এই কন্ঠস্বরের হুমকি শুনে থমকে গেল ওপাশের ব্যক্তি। স্থির হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। এরপর ফোন কাটার শব্দ। কৌতুকময় ভঙ্গিতে হাসল সেই যুবক।
হঠাৎই চোখ তুলে তাকালো মুক্ত আকাশের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বুকটা ভীষণ ভারী মনে হল। কান ঝিঁ ঝিঁ করে উঠল। আপনাআপনি দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখের কার্নিশ বেয়ে। মুছে ফেলল সাথেসাথেই। জায়গাটা ছাড়ার জন্যে দ্রুত পা বাড়ালো সে। ঘুমোতে হবে এখন। কাল সকাল থেকে পুনরায় কাজে নামতে হবে তাকে। শরীর টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন।
-
সকাল আটটা বাজলেও চারপাশটা কুয়াশাচ্ছন্ন। বেশিদূর দেখা যাচ্ছেনা। তীব্র শীতের মধ্যেও ঢাকা নামক ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ততা একটুও কমেনি। সকলেই বেরিয়ে পরেছে নিজ নিজ কাজে। বিভিন্ন স্ট্যান্ড আর রাস্তার ধারে মানুষের ভীড়। কেউ নিজের সন্তান নিয়ে স্কুল বাসের জন্যে অপেক্ষা করছে, কেউ নিজের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্যে। রাস্তায় নিজ গতিতে ছুটে চলেছে যানবাহন। গরম পোশাক গায়ে জড়িয়ে যথাসম্ভব উষ্ণ থাকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেই একেকজন পৌঁছে যাচ্ছে নিজ নিজ গন্তব্যে।
সকাল সকালই গাড়ি নিয়ে তুহিনের ফ্ল্যাটের সামনে এসে হাজির হয়েছে তমাল। এখান থেকে প্রথমে অফিসে যাবে। শাফায়াত হোসাইনের সাথে কথা বলে যাবে ফরেন্সিক ল্যাব। এরপর সোজা গুলশান। যেখানে এই জটিল হ-ত্যাকান্ডের শেকড় লুকিয়ে আছে।
বাদামি রঙের জ্যাকেট গায়ে জড়াতে জড়াতে বিল্ডিং এর নিচে নেমে এলো তুহিন। অপেক্ষমান গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। পেছনের সিটে বসে ফ্রন্ট সিটে বসা তমালকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'চলো।'
তমাল ড্রাইভারকে বলল গাড়ি স্টার্ট করতে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলল, 'স্যার, কাল এতো রাত হয়ে গিয়েছিল তাই আর ফোন করে ডিস্টার্ব করিনি। হঠাৎ গুলশান যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন যে?'
তুহিন নিজের ঘড়ি ঠিক করতে করতে বলল, 'কারণ খু-নের শুরুটা সেখানেই। শুধু তাই নয়, প্রথম তিনটে খু-নই সেখানে হয়েছে।'
'কিন্তু স্যার ঐ খু-নগুলোর সাথেতো সাজ্জাদ আর সুজনের খুনের সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। যেহুতু আমরা কালকেই দেখলাম, সুজন আলাদা দলের লোক। তাহলে বাকিগুলো_'
তুহিন জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কুয়াশাঘেরা রাস্তার ওপর গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, 'সেটাইতো সমস্যা তমাল। কালকের ভিক্টিমের আইডেনটিটিই আমাদের ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে। এখন অনেকগুলো প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে। যার উত্তর না পাওয়া অবধি বলা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে খুনগুলো কানেক্টেড কি-না। আর খু-নি কে।'
তমাল কিছুটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, 'স্যার আমার আর মনে হয়না খু-নগুলো কোনভাবে কানেক্টেড। নাহলে এভাবে আলাদা আলাদা _'
এইটুকু বলে থামল তমাল। আর কী বলা যায় বুঝে উঠতে পারছেনা। তুহিনের কিছু একটা মনে পড়তেই ও বলল, 'তিনতলা বিল্ডিং এর মালিক কে এখনো ফোনে পাওনি?'
তমাল বিরক্তি নিয়ে বলল, 'না স্যার, ফোন সুইচড অফ। না জানি কোথায় গিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু স্যার খু-নটাতো পাঁচতলা বিল্ডিংটাতে হয়েছে তাইনা? পাশের তিনতলার মালিককে দিয়ে আমাদের কী কাজ?'
তুহিন খানিকটা হেসে বলল, 'জামাল সাহেবের নিজের রুম থেকে ছাদে এসে পৌঁছাতে লেগেছে চার মিনিট তেতাল্লিশ সেকেন্ড। আর উনি গু-লির আওয়াজ শোনার সাথেসাথেই বেরিয়েছিলেন। খু-নি অবশ্যই গু-লি চালানোর পর নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে যে সুজন মরেছে কি-না। আর সেটা করতে মিনিমাম এক মিনিট অবশ্যই লেগেছে। তাহলে কত বাকি রইল?'
' তিন মিনিট তেতাল্লিশ সেকেন্ডের মতো, স্যার।'
' কারেক্ট! কিন্তু ঐ বিল্ডিং এর উত্তর দিক ঘেষে একটা দশতলা বিল্ডিং আছে। ওঠার জন্যে কোন পাইপ বা অন্যকিছু ওদিকে নেই। অন্যকোন পদ্ধতিতে যদি ওঠেও তাহলেও তিন মিনিটে অসম্ভব। আর পূর্ব দিকে কোন বিল্ডিং নেই। নিচে রাস্তা আর দোকান। গুলি চলার পর দোকানে বা রাস্তায় থাকা সবার চোখ ঐ বিল্ডিং এর দিকেই ছিল। যেহেতু কেউ দেখেনি খুনিকে তাই ওদিক দিয়ে পালানোর প্রশ্নই ওঠেনা। দক্ষিণ দিকের বিল্ডিং টা ছয়তলা। কিন্তু ওটার ছাদের দরজা আটকানো ছিল যা আমি টর্চ দিয়ে খুব ভালোভাবে দেখেছি। আর অন্য সাইডে ছিল বাজার। অর্থাৎ ঐ জায়গা দিয়েও পালানোর কোনরকম চান্স নেই। বাকি রইল কোন জায়গা তমাল?'
তমাল এতক্ষণ অবাক হয়ে তুহিনের কথা শুনছিল। তুহিনের প্রশ্নে হুশ ফিরল ওর। গলা ঝেড়ে বলল, 'ঐ তিনতলা বিল্ডিং স্যার।'
তুহিন এবার সোজা তমালের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল, 'আর ঐ বিল্ডিং এর ছাদটাও খোলা ছিল। আশপাশ দিয়ে নামারও উপায় ছিলোনা। কারণ একটাই, বাজার। তারমানে খু-নি সোজা ঐ বিল্ডিং এর ভেতরে ঢুকেছিলো। আর আমি ঐ বিল্ডিং এর সবগুলো ফ্ল্যাট চেক করেছি। যতগুলো পরিবার আছে তারমধ্যে সন্দেহভাজন কেউ নেই। তবে বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাট ছাড়াও দুটো ফ্ল্যাট ফাঁকা। আমার মনে হয় খু-নি ঐ দুটো ফ্ল্যাটের কোন একটা ফ্ল্যাটে ছিলো। ওখান থেকেই নজর রাখছিল পাশের বিল্ডিং এ। কিন্তু ওখানকার ওসিকে ব্যাপারটা বুঝতে দেওয়া যাবেনা। সেইজন্যই ওনার সামনে বলেছিলাম ছাদ ঘুরে দেখতে যাচ্ছি। আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেইস। তাই কাউকেই বিশ্বাস করা যাবেনা। পুলিশের লোক হলেও না।'
তমাল একপ্রকার হা করে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। কতক্ষণই বা ছিল তুহিন ওখানে! এইটুকু সময়ের মধ্যে এতকিছু একটা লোকের মাথায় কীকরে আসতে পারে! এতো অল্প সময়ে এতকিছু খেয়াল করা মোটেও সামান্য কথা নয়। যদিও আগের দুটো কেসে তুহিনের বুদ্ধির অসাধারণ নমুনা দেখেছে তমাল। এমনি এমনি তো তুহিনকে সবাই একনামে চেনেনা। এই বুদ্ধির জোরেই তো অল্প বয়সেই একজন দক্ষ ইনভেস্টিগেটর হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে সে। তুহিন তমালকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা ধমকের সুরে বলল, 'তমাল! আমার কথা শুনছো?'
তমাল চমকে উঠল। দ্রুত সামলে নিল নিজেকে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, 'স্যরি স্যার। আমি শুনছি।'
তুহিন ভ্রু কুঁচকে একবার দেখল তমালেকে। পুনরায় জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, 'পুলিশের সাথে তখন বেরিয়ে গেলেও, ওনারা চলে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পরেই আমি আবার গিয়েছিলাম ঐ তিনতলা বিল্ডিংয়ে। সবার সাথেই কথা হয়েছে। ঐ বিল্ডিং এর তিনতলারই একটা ফ্ল্যাটে নাকি একজন ছেলে দুদিন যাবত ছিল। সম্ভবত খু-নি ঐ ছেলেটাই। কিন্তু কেউই ছেলেটার চেহারা সেভাবে দেখেনি। সে নাকি তেমন বেরই হতোনা ফ্ল্যাট থেকে। তাই স্কেচ করানোটা টাফ। এইজন্যই ঐ বিল্ডিং এর মালিককে প্রয়োজন।'
তমাল খানিকটা চিন্তা করল। বলল, 'কিন্তু স্যার, আমার মনে হয়না ঐ খুনি নিজের আসল নাম, নাম্বার দিয়ে ভাড়া নিয়েছে বলে।'
'নাম, ঠিকানা, নাম্বার যে সত্যি বলে ঐ বাড়িতে ওঠেনি সেটা আমিও জানি। কিন্তু আমার বিশ্বাস, বাড়ির মালিক অবশ্যই ঠিকভাবে দেখেছে খু-নিকে। ওনাকে দিয়েই খু-নির স্কেচ তৈরি করা যাবে।'
' তারমানে স্যার, আমাদের খুনির চেহারা অবধি পৌঁছাতে বেশি দেরী নেই। বাড়িওয়ালাকে পেলেই হবে?'
' আমারও সেটাই ধারণা।'
আবারও গভীর ভাবনায় ডুব দিল তুহিন। ও জানে সবটা এতো সহজ হবেনা। খুনি বেশ চালাক, সেটা নিয়ে আর কোন সন্দেহই নেই। নাম, ঠিকানা, চেহারা সব জেনে গেলেও যে এই খুনি ওদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর ক্ষমতা রাখে; সেটা যেন এখনই বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছে তুহিন। তবে এখন ও পুরোপুরি নিশ্চিত; এই কেসের তদন্ত এখন অবধি ওর সেরা তদন্ত হতে চলেছে।
-
শাফায়াত হোসেইনের সঙ্গে মিটিংটা অল্প সময়েই সেড়ে নেয় তুহিন। কতটুকু এগিয়েছে আর পরবর্তী পদক্ষেপ কী সেসব নিয়েই আলোচনা করেছে। সময় বেশি নেই। তাই দ্রুতই দ্রুত সব কাজ সেরে নিতে হবে।
ফরেনসিক ল্যাবে ঢুকে দেখল, ডিপার্টমেন্ট হেড মহিউদ্দিন শেখ টেস্টটিউবে কিছু একটা নিয়ে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আশেপাশে কাজ করছে বিভিন্ন গ্রুপের অপারেটর। মহিউদ্দিন এর সহকারী ফারিয়া। তার পাশেই কম্পিউটারে কাজ করছে। তুহিন আর তমাল ভেতরে ঢুকতেই মহিউদ্দিন শেখ টেস্টটিউবে চোখ রেখেই বলল, 'কী ব্যপার বস! এতো সকাল সকাল আমার কথা মনে পড়ল যে?'
তুহিন মিষ্টি হেসে বলল, 'কী করার বলুন। আপনার কাজটাই এরকম। আমার কাজ শেষ করতে আপনাকে দরকার পড়ে। আর আমার কাজ শেষ করতেই আপনার হাতে কাজ আসে। চাইলেও একে ওপরকে এভয়েড করতে পারিনা।'
মহিউদ্দিন শেখও সমানতালে হাসল। বলল, 'যা বলেছো। দাঁড়াও, হাতের কাজটা সেরে কথা বলছি।'
এদিকে তুহিনের গলার আওয়াজ পেয়েই আড়চোখে তাকাল ফারিয়া। বাদামি রঙের জ্যাকেটে বেশ মানিয়েছে লোকটাকে। যদিও যা পরে তাতেই ভালো লাগে তুহিনকে। এমনটাই ধারণাই ফারিয়ার। তুহিন চারপাশে দেখছিল। ফারিয়ার দিকে চোখ পড়তেই চোখাচোখি হয়ে গেল ওদের। তুহিন মুচকি হেসে বলল, 'গুড মর্নিং ফারিয়া।'
মিষ্টি হেসে ফারিয়া বলল, 'মর্নিং স্যার।'
কিন্তু তবুও চোখ সরালোনা মেয়েটা। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হল তুহিন। গলা ঝেড়ে, চোখ ফিরিয়ে নিল। মনোযোগ দিল অন্যদিকে।
গোটা ব্যপারটা ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে তমাল। ধীরপায়ে আস্তে করে ফারিয়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল ও। সামান্য ঝুঁকে; ফিসফিসিয়ে বলল, 'এতো ওপরে চোখ রাখতে নেই। চোখ উল্টে যাবে।'
ফারিয়া বিরক্ত হল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল তমালের দিকে। তমাল দাঁত বের করে হাসল। ফারিয়া একটা ভেংচি কেটে পুনরায় মনোযোগ দিল নিজের কাজে।
হাতের কাজ শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল মহিউদ্দিন। তুহিনের উদ্দেশ্যে বলল, ' শোন, মৃত্যু মাথায় লাগা ঐ গু-লিতেই হয়েছে সেটা নিশ্চিত। হাতাহাতি হয়েছে; তবে বেশিক্ষণ নয়। খু-নির স্ট্রেন্থ অনেক বেশি ছিল। আর বু-লে-টের ইনফরমেশনতো কালকেই দিয়েছি।'
ফারিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'আর স্যার, শুধুমাত্র সুজনেরই আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গেছে। মানে খুনি হাতে গ্লাভস বা এ জাতীয় কিছু পড়ে ছিল।'
তমাল কৌতুকের স্বরে বলল, 'ওও আচ্ছা, গ্লাভস বা এ জাতীয় কিছু পড়লে হাতের ছাপ পাওয়া যায়না। ভাগ্যিস আপনি বললেন, না হলে তো জানতেই পারতাম না।'
কথাটা বলে শব্দ করে হাসল তমাল। ফারিয়া দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল। তুহিন ধমকের সুরে বলল, 'তমাল!'
তমাল হাসি থামাল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, 'স্যরি স্যার।'
তুহিন দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইল। সুজনের ফোনটাও খু-নি সাথে করে নিয়ে গেছে। সেটা থাকলেও কোন ইনফরমেশন পাওয়া যেতো। সুজনের রুমে তেমন কিছু পায়নি। না ঐ তিনতলা বিল্ডিং এর রুমে। এসব ভাবতে ভাবতেই মহিউদ্দিন বলে উঠল, ' তবে বস, সুজনের হাতের নখে সামান্য র-ক্ত পেয়েছি আমরা। যেটা খুব সম্ভবত খু-নির। হাতহাতির সময় খামচে দিয়েছিল হয়তো। এটার দ্বারা খু-নির ডিএনএ শনাক্ত করা গেছে।'
হঠাৎ খুশিতে চকচক করে উঠল তুহিনের চোখদুটো। এসময় এইটুকু পাওয়া মানে অনেক। ফারিয়া বলল, 'তবে স্যার, সেটা আমাদের ডেটা ব্যাংকের কারো সাথে ম্যাচ করেনি।'
তুহিন হতাশ হলোনা। যেটুকু পেয়েছে আপাতত তাই যথেষ্ট। ও মহিউদ্দিন এর দিকে তাকিয়ে বলল, 'ধন্যবাদ মিস্টার শেখ। আজ আমাদের একটু গুলশান যেতে হবে। ফারিয়া, তুমি আজ আমাদের সাথে যাবে। ওখানে তোমাকে প্রয়োজন হতে পারে।'
ফারিয়া দ্রুত হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। তমাল একবার ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে সকৌতুকে বলল, 'কী বলেন কী স্যার! ম্যাডাম টিউবলাইট আমাদের সাথেই যাবেন?'
ফারিয়া জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল তমালের দিকে। তুহিন কিছু বলার আগেই মহিউদ্দিন বলল, 'মানকি ম্যান যখন যাচ্ছে, টিউবলাইট গেলে দোষ কোথায়?'
কথাটা বলে, ঠোঁটে চাঁপা হাসি রেখেই নিজের কাজ করতে লাগল মহিউদ্দিন। তমাল ফারিয়ার দিকে একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল, 'উনি কী আমায় মানকি ম্যান বলল?'
ফারিয়াও এবার দাঁত বের করে একটা হাসি দিল। সন্তুষ্ট চিত্তে বলল, 'আপনার সন্দেহ আছে?'
আঙুল দিয়ে নিজের নাক ঘষে হাসি নিয়ন্ত্রণ করল তুহিন। গম্ভীর আওয়াজে বলল, 'অনেক কথা হয়েছে চলো এবার। ফারিয়া ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুলো সব নিয়ে নাও। আসছি, মিস্টার শেখ!'
মহিউদ্দিন কাজ করতে করতেই হাত উঠিয়ে বিদায়ের জানাল। তুহিন, তমাল আর ফারিয়া বেরিয়ে গেল। উদ্দেশ্য গুলশান।
*
গুলশান থানা। ধীরেসুস্থে কিছু ফাইল দেখছে ইন্সপেক্টর আজিজ। এখন কিছুটা নিশ্চিন্তে আছে সে। তার ধারণাই ঠিক ছিল। এখানকার কেইসটা এখন গোয়েন্দাদের হাতে। কিছুটা হলেও চাপ কমলো। ফাইলে চোখ রেখেই চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল সে। হঠাৎ কেউ বলে উঠল, 'আসব ইন্সপেক্টর?'
দরজায় তাকিয়ে অবাক হল আজিজ। কিন্তু সাথেসাথেই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, 'আরে আসুন, আসুন।'
তুহিন, তমাল, ফারিয়ার সাথে এই থানার এসআই ফারুকও ঢুকলো আজিজের কেবিনে। তুহিন এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, 'আমি ইনভেস্টিগেটর_'
কথাটা শেষ করার আগেই আজিজ হাত মিলিয়ে বলল,
'স্যার, আমি চিনি আপনাকে। আপনার কথা অনেক শুনেছি। পত্রিকাতেও অনেক পড়েছি আপনার কথা। বসুন।'
তুহিন সরাসরি একটা চেয়ারে বসল। তমাল আর ফারিয়াকেও বসতে দেওয়া হল। আজিজ হাসি মুখে বলল, 'কী খাবেন স্যার? চা কফি? না ঠান্ডা কিছু বলব?'
তুহিন হেসে বলল, 'শীতের মধ্যে ঠান্ডা খাবোনা। চা হলেই হবে।'
ফারুক হাক ছেড়ে পিয়ন কে ডাকল। বলল আরও তিন কাপ চায়ের কথা। তুহিন বলল, 'চা আসতে আসতে কাজের কথাটা সেড়ে নেই।'
'জি অবশ্যই।'
'নিশ্চয়ই জানেন হঠাৎ শহরে যে খু-নগুলো হচ্ছে তার তদন্তের দায়িত্ব আমায় দেওয়া হয়েছে। যেহুতু খু-নের শুরুটা এখানে। এবং প্রথম তিনটে খু-নই এখানে। আমি আপনাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করব। যদিও আমি রিপোর্টগুলো দেখেছি। কিন্তু সরাসরি আপনার সাথে কথা বলাটা প্রয়োজন।' এরপর টেবিলে থাকা চায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, 'আপনি চা খেতে খেতেই উত্তর দিতে পারেন। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।'
আজিজ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলল, 'হ্যাঁ বলুন স্যার। আমরা যেটুকু জানতে পেরেছি সবটাই বলব।'
তুহিন আজিজের হাতে থাকা ফাইলে চোখ রেখে বলল, 'যখন প্রথম খু-নটা হল। তখন নিশ্চয়ই আপনারা স্পটে গিয়েছিলেন। এবং সবটা খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টাও করেছিলেন। প্রথম খু-ন হওয়া লোকটা নিশ্চয়ই চেনা আপনার? যেহুতু আপনার এলাকায় থাকা একজন সন্ত্রাসী।'
আজিজ কিছু বলার আগেই ফারুক বলল, 'অবশ্যই চিনি। ব্লাক হোল গ্রুপেরই এক কুত্তা শালা!'
ফারুকের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল আজিজ। তুহিনও চোখ ছোট ছোট করে দেখল ফারুককে। ফারুক ইতস্তত করে বলল, 'সরি স্যার।'
এরমধ্যেই চা চলে এলো। তমাল আর ফারিয়া চা উঠিয়ে হাতে নিলেও তুহিন নিল না। ও আবার প্রশ্ন করল, 'তারমানে আপনারা বেশ ভালোভাবেই চিনতেন প্রথম ভিক্টিমকে?'
' হ্যাঁ চিনতাম। এই এলাকাতেই কম আতঙ্ক ছড়ায় নি সে। শুধু প্রমাণের অভাবে দু-বার অ্যারেস্ট করেও ছেড়ে দিতে হয়েছে। এই গ্রুপ আর দ্যা সোলার সিস্টেম গ্রুপের মধ্যকার দন্দ্ব তো লেগেই থাকতো।'
তুহিন মাথা নাড়ল। ব্যাপারটা কিছুটা হলেও ওর জানা। তমাল বলল, 'তাহলে প্রথম খু-নটা হওয়ার পর আপনাদের সোলার সিস্টেম গ্রুপের কারো ওপর সন্দেহ হয়নি? কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন নি?'
উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে থেকে তুহিনও চায়ের কাপ হাতে তুলে নিল। আজিজ নিজের চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বলল, 'অদ্ভুত ব্যাপার তো এটাই! হঠাৎ করে এই দুই গ্রুপের মানুষ; আচমকাই যেন গুলশান ছেড়ে দিল। খুবই রহস্যজনকভাবে। একদম শান্ত হয়ে গেছে এলাকাটা। আগে এতো শান্তি ছিলোনা। '
তুহিন কৌতূহলী কন্ঠে বলল, 'হঠাৎ এমন হওয়ার কারণ?'
আজিজ উত্তর না দিয়ে কিছু একটা খুঁজতে শুরু করল। খানিকক্ষণ খুঁজে একটা ফাইল বের করল। সেটা নিয়ে তুহিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'এই ঘটনার পরেই এরকমটা হচ্ছে। পড়ে দেখুন।'
তুহিন চা খেতে খেতে ফাইলটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ল। পড়তে পড়তেই চমকে উঠল তুহিন। এতো মারাত্মক ঘটনা। ভয়ংকর রহস্য! আর ও যে এই রহস্যের জালে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলতে চলেছে, সেটাও বুঝতে পারল। আজিজ বলল, 'কিন্তু, প্রথম খু-নটা হওয়ার পর আমার একজনের ওপরেই সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু ঠিক পরেরদিনই যে খু-নটা হয়েছিল, তরপর আমার আর মনে হয়নি সে খু-নটা করেছে।'
ফারিয়া বলল, 'কেন?'
' কারণ পরেরদিন খু-নটা যার হয়েছে, আর যাই হোক সে তাকে মা-র-বেনা। এরপর মীরপুরের বাংলোতে খু-নটাও ও কোনদিনও করবেনা। সুতরাং খুনগুলো যদি কানেক্টড হয়, মানে একজনই করে থাকে তাহলে খুনগুলো সে করেনি। সম্ভবই না।'
তুহিন এবার ফাইল থেকে চোখ তুলে বলল, 'আর এই সন্দেহটা কার ওপর হয়েছিল আপনার?'
আজিজ যেন তলিয়ে গেল গভীর ভাবনায়। সেখানেই মগ্ন থেকে বলল, 'রুদ্র। রুদ্র আমের।'
উপস্থিত সবাই কিছুক্ষণের জন্যে চুপ হয়ে গেল। এই নামের ব্যক্তিকে যে ওরা চেনে, ঠিক তা-না। কিন্তু নামটা শুনে এমনিতেই সবাই নিরব হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্যে। তুহিন নিজের অজান্তেই খানিকটা বিড়বিড় করে বলে উঠল, 'রুদ্র?'
.
.
.
চলবে.............................