আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে গল্প সম্বন্ধে আপনার মতামত অবশ্যই প্রকাশ করবেন। আপনাদের মতামত আমাদের এই ছোট প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। শীঘ্রই আরও নিত্য নতুন গল্প আপডেট আসছে, সঙ্গে থাকুন। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখক/লেখিকা'র নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত গল্পের ডায়েরি’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখক/লেখিকা'র কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় গল্পের ডায়েরি কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

অন্তর্নিহিত কালকূট - পর্ব ০২ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


অন্তর্নিহিত কালকূট
পর্ব ০২
অনিমা কোতয়াল
.
.
.
ইরার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মিথ্যা বলেনি। আজ সকাল সকালই অফিস থেকে ডাক এসেছে তুহিনের। কল করেছিল ওর সহকারী। মনে হলো সিরিয়াস কিছু। গতপরশু-ই এতো ভয়ানক এক স্মাগলিং কেইসের সমাধান করল। আজই এতো সিরিয়াস কেইসের ডাক পড়বে ভাবেনি তুহিন। ইরা ভেবেছিল। দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্কের অভিজ্ঞতা বোধ হয় একেই বলে। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে আনমনেই হাসলো তুহিন। রেডি হয়ে ফোনটা তুলে নিল হাতে। দ্রুত গতিতে টাইপ করল-

'অফিস থেকে কল চলে এসেছে। তোমার সিক্সথ সেন্স ভীষণ স্ট্রং। তবে পরের ছুটিতে আমরা নিশ্চিত বাইরে যাচ্ছি। এবার দূরে কোথাও যাবো, পাক্কা। লাভ ইউ।' 

মেসেজটা পাঠিয়ে আরও একবার হাসল তুহিন। আয়নায় নিজেকে দেখে নিল কালো শার্ট, ডার্ক ব্রাউন প্যান্ট। ফর্মালি ইন করা। হেয়ারব্রাশ দিয়ে চুলগুলো সেট করল। নিজের বেরেটা এম এন নাইন পি-স্ত-লটা রাখল হোলস্টারে। শেষবার নিজেকে চেইক করে বেরিয়ে পড়ল নিজের গন্তব্যে। মেসেজটা পাওয়ামাত্র মনে মনে ভীষণ রাগ করবে ওর ইরাবতী। তুহিন তা জানে।

-

উত্তরা, ঢাকা। গোয়েন্দা বিভাগের হেড অফিস। করিডরে কফির মগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সহকারী ইনভেস্টিগেটর তমাল আহমেদ। শাফায়াত স্যারকে বেশ চিন্তিত মনে হয়েছে আজ। আর শাফায়াত হোসেইন কপালে চিন্তার রেখা ফেলে যখনই ইনভেস্টিগেটর তুহিন আহমেদকে ডাকে; তখনই কোন না কোন ধামাকাদার কেইসের জন্ম হয়। মানে আবার একটা রোমাঞ্চকর তদন্তের সাক্ষী হতে যাচ্ছে ও। ভাবতেই উত্তেজনায় বসে থাকা মুশকিল বোধ করছে ও।

অফিসে ঢুকতেই রিসিপশনের মেয়েটা মিষ্টি এক হাসি উপহার দিল তুহিনকে। নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখেই হনহনে পায়ে ভেতরে ঢুকল তুহিন। প্যাসেজে তমালকে দাঁড়িয়ে ছটফট করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এগিয়ে যেতে যেতে তমালও দেখে ফেলল ওকে। দেখামাত্র দ্রুতপদে এগিয়ে এসে সালাম দিল। সালামের জবাব দিল তুহিন। কিন্তু হাঁটা থামালো না। এগোতে এগোতেই বলল, 'ফোন করার পর থেকে এখানেই দাঁড়িয়ে আছো নাকি?'

তুহিনের পেছনে হাঁটছিল তমাল। ঝোঁকের মধ্যে বলে ফেলল, 'হ্যাঁ স্যার।'

তুহিন হাঁটা অবস্থাতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল তমাল। কোনমতে বলল, 'না মানে, না স্যার।'

উত্তরে কিছু বলল না তুহিন। সোজা হাঁটতে থাকল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, 'কী হয়েছে? কিছু বলেছে স্যার?'

তমাল মুখ ছোট করে বলল, 'না স্যার। শুধু আপনাকেই বলবেন।'

'তুমি একটু আমার রুমে যাও। ওখানে থার্ড ড্রয়ারে একটা পেনড্রাইভ আছে। ওটা ল্যাপটপে ইনসার্ট করো, আমি আসছি।'

তমাল দাঁড়িয়ে গেল। মাথা নাড়িয়ে পা বাড়াল তুহিনের কেবিনের উদ্দেশ্যে। তমাল যেতেই মুচকি হাসল তুহিন। ভীষণ ছটফটে ছেলেটা। নতুন নতুনই জয়েন করেছে। এসে মাত্র দুটো কেসই ভাগে পেয়েছে সে। ছিপছিপে গড়ন। দেখতে-শুনতে ভালো। বয়স খুব বেশি নয়। তারওপর নতুন। তাই এতো উত্তেজনা। ছেলেটাকে বেশ ভালো লাগে তুহিনের। কিন্তু সেটা তমালের সামনে প্রকাশ করেনা। জুনিয়রদের সামনে নিজের ইমেজ যতটা গম্ভীর রাখা যায়; ততই ভালো। এমনটাই ধারণা তুহিনের। 

বসের রুমের সামনে চলে এলো তুহিন। নক করে বলল, 'স্যার আসব?'

বেশ গভীর ভাবনায় মগ্ন ছিলে গোয়েন্দা বিভাগের হেড শাফায়াত হুসাইন। নিজের ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে চৌকস আর সাহসী ইনভেস্টিগেটরের আসার অপেক্ষা করতে করতে বর্তমান কেইসটা নিয়ে ভাবছিল। এরমধ্যেই পরিচিত সেই কন্ঠস্বর শুনে ভাবনায় ছেদ ঘটল তার। দরজার দিকে না তাকিয়েই বলল, 'এসো।'

তুহিন ভেতরে গিয়ে দাঁড়াল। শাফায়াত হোসাইন ওর দিকে না তাকিয়েই ল্যাপটপে চোখ রেখে বলল, 'বসো।'

তুহিন বসল। শাফায়াত হোসেইন এখনো ল্যাপটপে মগ্ন। তুহিন ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছে তার কিছু বলার। কিছুক্ষণ পর ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি তুহিনের দিকে তাকাল সে বলল, 'সোজা কাজের কথাতেই আসি?' 

তুহিন দ্রুত সোজা হয়ে বসল। মনোযোগী হয়ে বলল, 'জি স্যার। আপনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কোন সমস্যা হয়েছে?'

শাফায়াত নিজের দুই হাত একত্রিত করে বললেন, 'গত পরশু রাতে বনানীর একটা ফ্ল্যাটে খু-ন হয়েছে। খু-নি খু-ন করে জায়গা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।'

তুহিন বলল, 'ফ্ল্যাটের সামনে সিসি ক্যামেরা ছিলোনা স্যার?'

'ছিলো। কিন্তু হুডি দিয়ে অর্ধেকের মতো ঢাকা ছিল খু-নির মুখ। বাকিটা ঢাকার কাজ ছায়া করেছে। সুতরাং কোনভাবেই আইডেন্টিফাই করা যায়নি তাকে'

তুহিন কিছু বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল শাফায়াতের দিকে। হয়তো পরের কথা শোনার অপেক্ষা করছে। শাফায়াত একটু থেমে বলল, 'এবার তোমাকে শুরু থেকেই বলছি। গত বারোদিনে ঢাকা বিভাগে অনেক খু-নই হয়েছে। তার মধ্যে ছয়টা খু-ন বিশেষভাবে আমাদের নজর কেড়েছে। প্রথম খু-নটা ঠিক বারোদিন আগে হয়, গুলশানে। তার ঠিক পরেরদিন গুলশানেই আরও দুটো খু-ন হয়। তার ঠিক দুদিন পরে মীরপুরের ছোট্ট একটা বাংলোতে আরও একটা খুন হয়। তার ঠিক এক সপ্তাহ পরে কিশোরগঞ্জের একটা গোডাউনে আরও একটা লাশ পাওয়া যায়। কিন্তু কোন থানার পুলিশই এই ছ'টা কেইসের একটা কেইসও সলভ করতে পারেনি।'

তুহিন এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ডিজির কথাগুলো। ডিজির কথা শেষ হতেই বলল, 'কিন্তু স্যার, খু-নগুলো সব আলাদা আলাদা জায়গায়, আলাদা আলাদা সময়ে হয়েছে। সবগুলো কেইস একসঙ্গে বলার কারণ কী? আর এই ছয়টা খু-নকে বাকি সবগুলো খু-নের চেয়ে আলাদা করে দেখার কারণ?'

'কারণ প্রতিটা থানা থেকে যতগুলো রিপোর্ট এসেছে; তার থেকে পুলিশের মনে হয়েছে খুনগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটার সম্পর্ক থাকতে পারে।'

'এমনটা মনে হওয়ার কারণ স্যার?'

মুখে জবাব দিল না শাফায়াত হোসেইন। ল্যাপটপটা তুহিনের দিকে ঘুরিয়ে দিল। অর্থাৎ পড়ে দেখো। টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে দু ঢোকের মতো গিলল সে। তুহিন বেশ সময় নিয়ে দেখল কেইসের ডিটেইলসগুলো। দেখা শেষ করে তার দিকে তাকাতেই সে বলল, 'কিছু বুঝলে?'

তুহিন অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিল কিছু একটা। শাফায়াতের কথা শুনে মৃদু চমকে উঠল। সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে বলল, 'কিন্তু স্যার, এমনও তো হতে পারে ব্যপারটা কাকতালীয়?'

মাথা ঝাঁকালেন শাফায়াত হোসেইন। বললেন, 'এই ইনফরমেশন অনুযায়ী আপাতত আমাদের দৃষ্টিতে খু-নগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা কানেক্টেড। সেভাবেই এগোতে হবে। আমাদের কাজটা নিশ্চয়ই জানো?'

'জ্বি স্যার' আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল তুহিন। 'আমাদের কাজ হল খু-নের কানেকশন, মোটিভ এবং খু-নিকে খুঁজে বের করা।'

মৃদু হাসল শাফায়াত। আবার খানিকটা মাথা দুলিয়ে বলল, 'গুড। আর কাজটা তোমাকেই করতে হবে।' 

তুহিন এবার একটু চুপ করে রইল। খু-নের জায়গাগুলো আর সময়গুলো নিজের মনের মধ্যে আওড়ে নিল একবার। বলল, 'স্যার, আমার মনে হয় আমাদের আজই কাজে নেমে পড়া উচিৎ। কারণ যদি খু-নগুলোর পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত হয়; আমার ধারণা এখানেই শেষ নয়। শীঘ্রই আরও খু-ন হতে চলেছে।'

শাফায়াত পুনরায় ল্যাপটপে চোখ রেখে বলল, 'আমিও সেটাই ভাবছি। এইজন্যই সকাল সকালই ডেকে পাঠালাম তোমাকে। আজই বেরিয়ে পরো। আশা রাখছি খুব দ্রুতই ভালো খবর পাব। তোমায় এই ছ'টা খু'নের ডিটেইলস পাঠিয়ে দিয়েছি। বেস্ট অফ লাক।' 

' থ্যাংকস স্যার। আসছি?'

কোন জবাব দিলেন না শাফায়াত। ওনার চোখ টেবিলে রাখা ল্যাপটপে। যার অর্থ "হ্যাঁ যেতে পারো"। সেটা ভালোভাবেই জানে তুহিন। তাই আর কিছু না বলে উঠে বেরিয়ে এলো। সোজা চলে গেল নিজের কেবিনে। শাফায়াত হুসাইন ডিপার্টমেন্টের মধ্যবয়স্ক গম্ভীর ডিরেক্টর-জেনারেল। তবে এই কঠিন মানুষটি বাইরে প্রকাশ করেনা, তবে মনে মনে তুহিনকে খুব স্নেহ করে। সেটা তুহিনও জানে। 

-

ইনভেস্টিগেটর তুহিন রুমে আসতেই দাঁড়িয়ে গেল তার সহকারী তমাল। এতক্ষণ বসের অপেক্ষাই করছিল সে। নতুন কেইসটা সম্পর্কে জানার জন্যে ছটফট করছে মনটা। তুহিন নিজের চেয়ারে বসল। বলল, 'নতুন কেইসের সব ডিটেইলস পাঠিয়ে দিয়েছে ল্যাপটপে। দ্রুত পড়ে নাও।'

তমাল যেন এই আদেশটারই অপেক্ষাই করছিল এতক্ষণ। তুহিন কথাটা শেষ করতেই দ্রুত ডিটেইলস চেক করতে বসে পড়ল। হালকা হাসল তুহিন। তবে সেটা তমালের আড়ালে। বেশ সময় নিয়ে, বুঝে বুঝে পুরোটা পড়ল তমাল। পড়া শেষ হতেই তাকাল তুহিনের দিকে। কাগজ ঠিক করতে করতে তুহিন বলল, 'কিছু বুঝতে পারলে?'

'স্যার, আপনার কী মনে হয় কেসগুলো কানেক্টেড? আমার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে।'

তুহিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'এটা খুঁজ বের করাইতো কাজ এখন। চলো!'

তমাল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'কোথায় স্যার?'

'বনানী। কারণ শেষ খু-নটা ওখানেই হয়েছে।'

*

মাঘের তীব্র শীত। ঠান্ডা মৃদু হাওয়া শরীর জমিয়ে দিচ্ছে একপ্রকার। আকাশে পূর্ণ চাঁদ রূপালি থালার মতো জ্বলজ্বল করছে। চারপাশটা অদ্ভুত শান্ত। ক্ষণে ক্ষণে অতিথি পাখির ডাক, গাছের পাতা থেকে শিশিরের ফোঁটা পড়ার শব্দ; চারপাশটা যেন স্বর্গীয় করে তুলছে।
নিজের প্রশস্ত বুকে প্রেয়সীকে আগলে নিয়ে বসে আছে এক যুবক। পরম শান্তিতে উপভোগ করছে তার শরীরের উষ্ণতা। ক্ষণে ক্ষণে চুলে নাক ডুবিয়ে মৃদু সুবাস উপভোগ করছে। রমনীও এই প্রশস্তবুকে যেন স্বর্গসুখ খুঁজে পায়। পরম নিশ্চিন্তে লেপটে আছে প্রিয়তমের বুকে। বেশ কিছুক্ষণ সময় অমনভাবেই কাটল। চোখ বন্ধ রেখেই রমনী বলল, 'সারাজীবন এভাবে বুকে আগলে রাখবেন আমায়?'

যুবক মৃদু হেসে বলল, 'তোমার কী মনে হয়?'

রমনী চোখ খুলল। মাথা হালকা ওপরে তুলে বলল, 'আপনাদের কোন ভরসা নেই। এই বিষয়ে তো একদমই না। আপনারাতো হৃদয়হীন হন।'

আবার হাসল যুবক। রমনীর খোলা চুলে আঙ্গুল গলিয়ে দিয়ে বলল, 'আগে ছিলাম। হৃদয়হীন-ই ছিলাম। কিন্তু এই হৃদয়হীনের হৃদয় হয়ে এসেছো তুমি। কথা দিচ্ছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই বুকেই থাকবে তুমি।'

লজ্জা পেয়ে যুবকের বুকে লেপ্টে গেলো রমনী। সেও পরম শান্তিতে প্রেয়সীকে আগলে নিল নিজের সাথে। কিন্তু আচমকাই খেয়াল করল ওর বুকে কেউ নেই। শূন্য হয়ে আছে বক্ষ। পাশে তাকাল। পাশেও নেই তার প্রেয়সী। দ্রুত উঠে দাঁড়ালো সে। 
আকাশের সেই পূর্ণ গোল চাঁদ আর নেই। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পূর্ণিমা রাত যেন মূহুর্তেই আমাবস্যা রাতে পরিণত হল। চারপাশে এতো সুন্দর গাছপালা আর নেই, নেই কোন পাখির গুঞ্জন। দূর দূর পর্যন্ত শুধুই অন্ধকার। উন্মাদের মতো সেই অন্ধকারে মেয়েটিকে খুঁজে বেড়াল যুবক। কিন্তু পেলোনা! কোথাও খুঁজে পেলোনা সে তার প্রেয়সীকে। খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হল সে। ব্যর্থ হয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ল শুষ্ক ভূমিতে। সে যেন নিঃস্ব বোধ করল নিজেকে। একদম নিঃস্ব।
-
একপ্রকার লাফিয়ে উঠে বসল যুবকটি। ঘুমিয়ে পড়েছিল। লক্ষ্মীবাজারে আছে সে এখন। এক পুরোনো বিল্ডিং এর তিনতলায়। কাল প্রায় সারারাত জেগে নিজের পরিকল্পনা সাজিয়েছে। শেষরাতেই হয়তো লেগে এসেছিল চোখটা। সারা শরীর ঘেমে গেছে তার। পাশের পানির বোতলটা হাতে নিল সে। একবারেই অর্ধেক বোতল খালি করে ফেলল। জোরে জোরে শ্বাস ফেলল নিজেকে স্বাভাবিক করতে। না, দুর্বল হলে চলবে না। এখন তার অনেক কাজ। 
দ্রুত উঠে ব্যালকনিতে চলে গেল সে। তার দৃষ্টি এখন পাশের সেই পাঁচতলা বিল্ডিং এর দিকে। পরবর্তী লক্ষ্য তো সেখানেই!

_

বিকেল চারটা পনেরো। বনানী থানার ওসির সাথে কথা বলে নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে তুহিন আর তমাল। এরপর একসঙ্গে লাঞ্চ করেছে দুজন। এরপর চলে আসে শেষ খু-ন হওয়া সাজ্জাদের স্ত্রীর কাছে। পুলিশ যদিও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু তুহিনের নিজেরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। 

একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে তুহিন। ঠিক তার মুখোমুখি বসে আছে সাজ্জাদের তৃতীয় স্ত্রী শায়লা। সাজ্জাদের খু'নের একমাত্র সাক্ষী। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে তমাল। তুহিন তীক্ষ্ম চোখে দেখছে শায়লাকে। শায়লার চোখে-মুখে ভয় স্পষ্ট। তুহিন বলল, 'লোকটা ঠিক রাত সাড়ে বারোটায় আসে ফ্ল্যাটে। তাইতো?'

শায়লা মাথা নাড়ল। তুহিন আবার বলল, 'আপনি কিছু শুনেছেন? আই মিন আপনার স্বামীকে খু-ন করার সময় ঐ লোকটা কিছু বলেছে? কেন মারছে? কোন জায়গা? কোন নাম? এনিথিং?'

শায়লা মাথা নেড়ে না করল। তুহিন চোখ ছোট ছোট করে তাকাল তার দিকে। শায়লা একটা ঢোক গিলে বলল, 'আমি ভয় পেয়ে পাশের রুমে চলে গিয়েছিলাম। তেমন কিছুই শুনতে পাইনি। তবে এপাশ থেকে শুধু শুনছিলাম; লোকটা কারো ঠিকানা জানতে চাইছিল।'

তুহিন, তমাল দুজনেই চমকে উঠল। তুহিন ব্যস্ত স্বরে বলল, 'কার ঠিকানা? কোন নাম বলেছে?'

'শুনিনি। শুধু আমার স্বামীকে একবার লক্ষ্মীবাজার বলতে শুনেছিলাম।'

মাথা নাড়ল তুহিন। তমাল কিছু একটা ভেবে বলল, 'আপনি জানতেন আপনার স্বামীর তৃতীয় স্ত্রী আপনি?'

শায়লা মাথা নিচু করেএ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। বলল, 'জেনেছি। বিয়ের পর।'

'তারপরেও সংসার করলেন?' আশ্চর্য হল তমাল।

তাচ্ছিল্যের হাসি দিল শায়লা। গলায় কান্না আটকে বলল, 'এছাড়া আর কোন উপায় ছিলোনা স্যার। গরীব পরিবারের মেয়ে আমি। স্বামীর ঘর না করতে পারলে বাপের বাড়িতেও জায়গা হয়না আমাদের। যেতাম কোথায়? খেতাম কী?'

কিছুক্ষণ নীরব রইল ঘরটা। তুহিন বলল, 'খু-নির চেহারা দেখেছেন নিশ্চয়ই?' 

শায়লা চমকে তাকাল। মনে পড়ে গেল খুনির সেই ভয়াবহ হুমকি। জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে শায়লা বলল, 'দেখেছি। কিন্তু চেহারাটা আমার পুরোপুরি মনে নেই।'

তুহিন ভ্রু কুঁচকে বলল, 'আপনার সাথে এতক্ষণ ছিল। এতোকিছু ঘটালো। চেহারা একটুও মনে নেই?' 

'বেশিরভাগ সময় সে হুডি পড়া ছিল স্যার।'

তুহিনের চোখে চোখ রাখতে পারছেনা শায়লা। বারবার হাত কচলে যাচ্ছে। তুহিন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে শায়লার গতিবিধি। 
'ধন্যবাদ। প্রয়োজনে আমরা আপনাকে আবার ডাকব। আসছি।'

কথাটা বলে উঠে চলে এলো তুহিন। পেছন পেছন তমালও এলো। বাইরে এসে লিফ্ট ব্যবহার না করে সিঁড়ির দিকে এগোলো তুহিন। পেছনে হাঁটতে হাঁটতে তমাল বলল, 'স্যার, আমার মনে হয়না মহিলা পুরোপুরি সত্য বলল।'

তুহিন হেসে বলল, 'আমি নিশ্চিত সে পুরোপুরি সত্যি বলেনি।'

অবাক হল তমাল। কিছু একটা ভেবে বলল, 'এমনতো হতে পারে স্যার, মহিলা নিজেই নিজের স্বামীকে খু-ন করেছে?'

' হতে পারে। তবে সেটা হলে ওনার সাথে কেউ অবশ্যই ছিল। কানে আর ঠোঁটে শক্ত কিছু প্রচন্ড জোরে আঘাত করা হয়েছে। সাজ্জাদের সাথে গায়ের জোরে উনি পেরে উঠবেন না সেটা নিশ্চিত। তবে স্বামীর মৃত্যুতে মহিলা বিন্দুমাত্র কষ্ট পাননি।' 

 'প্রেমিক হতে পারে স্যার? হয়তো পরকীয়ার কেস?'

'কিছুই অসম্ভব না তমাল। যা কিছু হতে পারে। তুমি _'

এরমধ্যেই বেজে উঠল তুহিনের সেলফোন। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল ইরার কল। কিছুটা ঘাবড়াল তুহিন। প্রেমিকার বকুনী হজম করার জন্যে প্রস্তুত করল নিজেকে। কিছুক্ষণ হাসফাঁস করে তবেই কলটা রিসিভ করতে পারল। ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে ইরা বলল, 'কোথায় আছো?'

তুহিন ইতস্তত করল, যথাসম্ভব কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, 'এখন বনানীতে আছি। সকালের মেসেজ দেখেছো তো?'

ইরা কঠিন গলায় বলল, 'না দেখিনি। দেখতে চাইও না। আর দেখবোও না। থাকো যেখানে খুশি। শুধু আমার কাছে না আসলেই হল। আসলে তোমাকে আমি খু-না করব তুহিন। মাথায় রেখো।' 

তুহিন কিছু বলার আগেই কল কেটে দিল ইরা। মুখ কাচুমাচু করে কান থেকে ফোনটা নামাল তুহিন। ঠোঁট চেপে হাসল তমাল। একমাত্র এই নারীর ফোন এলেই তুহিনের এমন মুখ দেখার সৌভাগ্য হয় তার। তমালকে হাসতে দেখে চোখ রাঙিয়ে তাকাল তুহিন। তমাল খুব কষ্টে নিজের মুখ স্বাভাবিক করল। তুহিন গলা ঝেড়ে বলল, ' হ্যাঁ, যা বলছিলাম। তুমি কেইসের ডিটেইলস চেক করে দেখেছ? সাজ্জাদ আন্ডারওয়ার্ল্ডের ' ব্লাকহোল গ্রুপের' একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী।' 

তমাল মাথা নেড়ে বলল, 'জ্বি স্যার। এই গ্রুপটা সম্পর্কে কমবেশি সবাই শুনেছে। কিন্তু আজ অবধি এর বিরুদ্ধে কোন সলিড প্রমাণ পাওয়া যায়নি। না কাউকে ধরা গেছে। ধরা পড়লেও কোন না কোনভাবে ছাড়া পেয়ে গেছে সব। দলের নাম কোনভাবেই মুখে আনেনি।'

নিচে নেমে গাড়িতে উঠতে উঠতে তুহিন বলল, 'এক্সাক্টলি! আর বাকি যে খু-নগুলো হয়েছে প্রত্যেকের মধ্যে একটাই মিল। সবার ব্যাকগ্রাউন্ড একটাই। আন্ডারগ্রাউন্ড। আর এটাই আমায় ভাবতে বাধ্য করছে যে সবগুলো মার্ডার হয়তো কানেক্টেড। কিন্তু সমস্যা হল ছ-জনেই আলাদা আলাদা দুটো গ্যাং এর স-ন্ত্রা-সী। যেকোনো একটা পক্ষ হলে বোঝা যেতো আরেকপক্ষ কাজটা করছে। কিন্ত শিকার দুই পক্ষ থেকেই হচ্ছে। তাহলে শিকারী টা কে? '

তমাল ফ্রন্ট সিটে বসে বলল, 'তৃতীয় পক্ষ?'

' হতে পারে। তবে অন্যকিছুও হতে পারে।'

' কী স্যার?'

তুহিন বাইরে তাকিয়ে কিছু ভাবতে ভাবতে বলল, 'সর্ষের মধ্যে ভূত। কথাটা শোননি তমাল?'

তমাল বুঝল ব্যাপারটা। ও নিজে কিছুটা চিন্তা করে বলল, 'স্যার যদি খুনগুলো কানেক্টেড হয়। তাহলে?'

' তাহলে পরবর্তী খুন খুব তাড়াতাড়ি হতে চলেছে। অথবা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা কোথায়?'

হঠাৎ করেই তুহিনের মাথায় এল শায়লার বলা কথাটা। ঐ আগন্তুককে সাজ্জাদ লক্ষ্মীবাজারের কথা বলছিল। 'লক্ষ্মীবাজার!' কথাটা বিড়বিড় করে বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠল তুহিন। মনে মনে কিছু একটা ক্যালকুলেট করল। তমাল অবাক হয়ে দেখল তুহিনের অস্থিরতা। ক্যালকুলেশন শেষ করে হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতেই মুখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে এলো, 'শীট!'
.
.
.
চলবে............................
Author, Publisher & Developer

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উফ!
মনে হচ্ছে আপনার ইন্টারনেট সংযোগে কিছু সমস্যা আছে। অনুগ্রহ করে আগে আপনার ইন্টারনেটের সংযোগ ঠিক করুন এবং তারপর আবার ব্রাউজিং শুরু করুন৷
AdBlock সনাক্ত করা হয়েছে!
আমরা শনাক্ত করেছি যে আপনি আপনার ব্রাউজারে অ্যাডব্লকিং প্লাগইন ব্যবহার করছেন৷ আমরা আপনাকে আপনার অ্যাডব্লকিং প্লাগইন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি, কারন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরা যে রাজস্ব আয় করি তা এই ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়।