শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৩৩ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


দীপ্তর উচ্চকণ্ঠ ভেসে বেড়াচ্ছে দেয়ালে-দেয়ালে। বাচ্চা-বাচ্চা কণ্ঠটি কর্ণগোচর হতে মুষড়ে ওঠে অরু। একঝটকায় সরে আসে তন্ময়ের উচ্চতাপ জনিত দেহখানা ছেড়ে। শীতলতার চাদরে লেপ্টানো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এযাত্রায় ভয়ের বিচরণ ছেয়ে গেল। আতঙ্কে ছোটোখাটো মুখমণ্ডল এইটুকুন হয়ে এসেছে। তাড়াহুড়ো পদচারণ ফেলে চতুর্দিক ছুটছে। আত্মগোপনের অপ্রাণ প্রয়াস।তন্ময় ব্যাকুলতম প্রেয়সীর চঞ্চলতা নিত্যকার মত নিশ্চুপ মুখে, নির্নিমেষ চোখে দেখল। অগোচরে বিশেষ ভঙ্গিতে হাসল। এতটা ভয় পাবার মানে আছে কী? শাহজাহান তন্ময় দাঁড়িয়ে অর্থাৎ সে নিজে উপস্থিত থাকতে মেয়েটা কীনা এক বাচ্চা ছেলেকে ভয় পাচ্ছে? এও তাকে দেখতে হলো এই চোখে? অরু ইতোমধ্যে ছাঁদের এক কোণে আঁধারেতে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে। শ্বাসপর্ব নেওয়া-দেওয়া বন্ধ প্রায়। দীপ্ত গুনগুন সুরে গান গাইতে-গাইতে ওঠে এসেছে এযাত্রায়। ঝাঁকড়া চুলের মাথাটা ঢোকাল ছাঁদের দরজা চিড়ে। তন্ময় মানব ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে নিজের লম্বাটে দেহ নিয়ে। দীপ্ত বিচক্ষণ নয়নে একপল তন্ময়ের পানে চেয়ে নিলো। পরমুহুর্তেই পরিপূর্ণ ভাবে সম্পূর্ণ ছাঁদে দৃষ্টি ঘোরাল। অরুকে দেখতে না পেয়ে প্রশ্ন করল,

'অরুপি কোথায় ভাইয়া?'
'বাগানে।'

দীপ্ত সন্দিহান বড্ড। পুনরায় একপল ছাঁদের আনাচেকানাচে নজর ঘুরেফিরে থামল তন্ময়ের ওপর। বোকাঝোকা চোখে চেয়ে বলল,

 'বাগানে? বৃষ্টির মধ্যে বাগানে? তবে আমি তো থার্টি মিনিটস পূর্বে ছাঁদে আসতে দেখলাম। নামলে নিশ্চয়ই খেয়াল করতাম। লিভিংরুমেই তো বসেছিলাম। আর্ট করছিলাম।'
'আর্টে কনসেন্ট্রেশন ছিল। তাই দেখিস নিই।'

দীপ্ত বয়স্ক বৃদ্ধার মত হিসেব-নিকেশ করে ভাবল। বোঝার ন্যায় মাথাটা দোলাল। নাক দিয়ে 'হম' ধ্বনি তুলল, 

'হতে পারে। এক্ষুনি চাচ্চুকে গিয়ে জানাচ্ছি অরুপি বৃষ্টিতে ভিজছে। দিবে বকা। বেশ হবে তখন। জ্বর বাঁধলে বুঝবে ঠ্যালা।'

দীপ্ত যেন এই সুযোগটিকে হাতেনাতে ধরতে চাইছে। বিচার দিতে ততক্ষণাৎ ছুটে চলে গিয়েছে। তন্ময় ঘুরে তাকায় অরুর আত্মগোপনের জায়গাটিতে। অন্ধকারে দেখতে চায় মেয়েটার মুখের একেকটি পরিবর্তন। অরু বেরিয়ে এলো তক্ষুনি। আড়ে-আড়ে দুবার চাইল তন্ময়ের মুখ পানে। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ আঁখিদুটির ঘনঘন পাপড়ি ঝাপটে নিচ্ছে। ওষ্ঠতে ওষ্ঠ চেপে রেখেছে নিবিড়ভাবে। তন্ময় এগুল ওর দিকে। দু'পা এক'পা ফেলে অগ্রসর হচ্ছে। অরু চেঁচাল এমুহূর্তে। ধড়ফড়িয়ে ওঠা বুকখানা চেপে বলল,

'আমাকে ডাকা হচ্ছে।'

বলে সে দৌড় লাগাল। দৌড়ের গতি এতটাই দারুণ যে, এই দৌড়ে নিশ্চিত স্কুলকলেজের দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হত। আগে-পেছনে কিংবা ডানে-বামে তাকানোর প্রয়োজনবোধটুকু অবদি করেনি। তন্ময় মুচকি হেসে মাথা নত করে। তাকায় ডান হাতটার পানে। এই হাতেই তো ওই প্রফুল্লবদন ছুঁয়ে ছিল এযাবৎ। আর এই ঠোঁট দ্বারা…তন্ময়ের আফসোস লাগল এযাত্রায়! সেত ওই রক্তিম ওষ্ঠদ্বয় দেখতে পারল না। পূর্বেই মেয়েটা পালিয়েছে। অভিমান, রাগ, ভুল বোঝাবুঝি কী ভেঙেছে ওর? অরুর অভিমান যে বড্ড ভয়ংকরতম! হঠাৎ করে ছাঁদের দরজার সামনে অরু এসে হাজির হলো। শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার গতি দ্রুত। কোনোমতে ঝটপটে কণ্ঠে বলল,

'ঠান্ডা লাগবে। চলে আসুন।'

কথকটুকু বলে পুনরায় ছুটে চলে গেল। তন্ময়ের 'শোন' শব্দটি বাতাসে ভেসে বেড়াল। যার উদ্দেশ্যে ছোঁড়া হলো সে ব্যক্তি শোনার সময় পেল না। তন্ময় আরেকদফায় হাসল। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যাক, প্রেয়সীর অভিমান ভেঙেছে তাহলে!

______

রাতভর বর্ষণ চলল। হিমশীতল হাওয়ারা একচিত্তে বইতে থাকল। রিমঝিম মাতোয়ারায় মত্ত বৃষ্টির ধ্বনি শাহজাহান বাড়িটা জুড়ে। আকস্মিক আঁধারে আসমান চমকে সাদা হয়ে উঠছে। বজ্রপাত হচ্ছে ক্ষণেক্ষণে শব্দ তুলে। জানালাটা সম্পূর্ণরূপে খোলা। শুভ্র রঙের পর্দাগুলো উড়ছে নৃত্যের চিত্তে। বাতাসে বাতাসে লেপ্টে ঘরে প্রবেশ করছে বৃষ্টির জল। ফ্লোর অনেকাংশে ভিজে গিয়েছে। সেদিকে ধ্যান নেই তন্ময়ের। সে অবলীলায় বুকের দিকটায় বিছানায় লেপ্টে উবুড় হয়ে শুয়ে। কোমরে পড়ে আছে পাতলা কম্বলটা। উদোম দেহখানা দৃশ্যমান। দেয়াল ঘড়িতে ভোরের ছটা। বাইরেটা অন্ধকারে আচ্ছন্নভাব। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধততা সবটা জুড়ে। মাথার ওপরের ফ্যানটাও বন্ধ। রাতের শেষভাগে নয়নযুগলে তন্দ্রারা ধরা দিয়েছে তন্ময়ের। এই কারণ বসত আজ আর সকাল-সকাল ঘুম ভাঙবে না তার। হলোও তাই। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে এলো নটাতে। এযাত্রায়ও তন্ময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হবে না? টানা কিছুদিন তার ঘুম হয়নি। চিন্তিত, বিদ্রোহ হৃদয় নিয়ে উদাস, হতাশ হয়ে ঘুরেফিরেছে। কাজকর্ম উঠেছে লাটে।
কোনোকিছুতেই মন বসেনি, বসাতে পারেনি। তার ব্যক্তিত্ব, তার ধৈর্য সবকিছু অরুর সামনে বৃথা হয়ে দাঁড়ায়। এই একটা পুচকে মেয়ের সামনে সে স্তব্দ, স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা দেখে না। দেখবে কীভাবে? তাকে এমন ভাবে নিজের ছোটো হাতের ছোট্ট পাঁচটা আঙুলে পেঁচিয়ে নিয়েছে যে, এজীবনে তার মুক্তি নেই। অবশ্য তন্ময় মুক্তি চায় না। সে এভাবে চিরজীবন আটকে থাকতে চায়। আশ্চর্যজনক বিষয়টা হলো, আজ তাকে কেউ ডাকেনি। ঘুম ভাঙানোর প্রয়াস করেনি। কেন? তন্ময়ের তন্দ্রের ঘোর সামান্য কেটে গেছে আপাতত। সে আধশোয়া হয়ে বসেছে। তাকাল দেয়াল ঘড়ির দিকে। মস্তিষ্ক এখনো স্লো পেসডে চলছে যেন। দরজাটায় ছোট্টখাট্টো একটা করাঘাত পড়ল। তন্ময় ঘুমে বসে যাওয়া গম্ভীর কণ্ঠে সাঁড়া দিবে পূর্বে একটি বড়ো কালো চুলের মাথা ঢোকে আচমকা। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিত হয়। মিলতেই মাথাটা মুহূর্তে বেরিয়ে যায় একশো ডিগ্রি গতিতে। তন্ময় হেসে ওঠে। গলা উঁচিয়ে ডাকে,

'আয়।'

অরু ঢুকল না। ধীর কণ্ঠে বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকে জানায়,

'বড়ো মা, কফি পাঠিয়েছে।'
'রেখে যা।'

অরু তখনো বাহিরে দাঁড়িয়ে। ভেতরে আসছে না। তন্ময় আগ্রহী চোখে চেয়ে। সে ভেবে রেখেছিল অরু আজ সারাদিন হয়ত তার ত্রিসীমাতে আসবে না। লজ্জায় লাল-নীল-বেগুনি হয়ে পালিয়ে বেড়াবে। তবে তাকে ভুল প্রমাণ করে সাতসকালে সুশ্রী মুখখানা নিয়ে হাজির। এত মেঘ না চাইতেই জলের হদিস পাওয়া। তন্ময় আর ডাকল না। অরুকে সময় দিলো। ঠিক মিনিট খানেক সময় নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল অরু। মিনমিনে পদচারণ ফেলে আসছে। এদিক-ওদিক অর্থাৎ ডানে-বামে, ওপরে-নিচে তাকানো হচ্ছে শুধু তন্ময়ের পানে দৃষ্টি ফেলছে না। তন্ময় হাত বাড়াল। বলল,

'কফি দিবি না?'

অরু ততক্ষণাৎ এগিয়ে ধরল। তন্ময় কফির মগটা নেয়ার সময় অনুদ্দেশ্যমূলক স্পর্শ করল অরুর কম্পিত হাত জোড়া। কাঁপতে থাকা নরম হাত দুটো এযাত্রায় ঠকঠক করে কেঁপে উঠল যেন। ঠাণ্ডা কফির মুগ ছুঁয়ে তন্ময় নির্বাক। এক চুমুক খেয়ে বাকশক্তিহীন। এ কফি নাকি শরবত? অরু লুকিয়ে, অগোচরে বারংবার চাইছে। তন্ময়ের বুঝতে আর বাকি রইল না কফিটা কে করেছে! সে সেই কফি নামক শরবতটুকু পান করতে থাকল। অরুর মুখশ্রী সূর্যমুখী ফুলের ন্যায় ফুটে ওঠেছে। ঝিলিক মারছে কালো মণি যুগল। তন্ময় বহুকষ্ঠে গিলল আরেক চুমুক। অরুর দিক তাকাল। শুধাল,

'কফি নিয়ে লুডু খেলতে বসেছিলি?'

অরু ফ্যালফ্যাল করে চাইল, 'লুডু কীভাবে খেলে কফি নিয়ে?'
'তাহলে এত ঠাণ্ডা কেন?'

অরু জিহ্বা কামড়াল। হাত বাড়াল দ্রুত, 'আমি গরম করে এনে দিচ্ছি। দিন।'

তন্ময় ফেরত দিলো না। পান করতে থাকল। একফাঁকে বলল,

'এখন থেকেই ঠাণ্ডা কফি খাওয়া শিখি। ভবিষ্যতে তো ঠাণ্ডা কফিই খেতে হবে মনে হচ্ছে!'

অরু বুঝল না যেমন। সরু চোখে চেয়ে। পরপর মুখের রঙ বদলাল। বলদটা কী ভাবল কে জানে! মুখে ওড়নার একাংশ চেপে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। তন্ময় দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কফিটা দেখল। চোখমুখ খিঁচে একটানে গিলে ফেলল। 
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন