অন্তর্নিহিত কালকূট - পর্ব ০৫ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


অন্তর্নিহিত কালকূট
পর্ব ০৫
অনিমা কোতয়াল
.
.
.
রুদ্র! নামটার মধ্যেই যেন এক ভয়ংকর তান্ডব লুকিয়ে আছে। শুনলে ক্ষণিকের জন্যে হলেও যেন সব শান্ত, স্থির হয়ে যায়। ঠিক যেমনটা এখন হল। উপস্থিত সকলে অল্প কিছুক্ষণের জন্যে হলেও চুপ ছিল। এমনটাই বোধ হল তুহিনের। মুহূর্তেই নিজেকে একদম স্বাভাবিক করে ফেলল সে। চায়ের কাপে আরও একটা চুমুক দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, 'কে এই রুদ্র আমের?'

কক্ষে উপস্থিত সকলের দিকেই একবার চোখ বুলাশ ইন্সপেক্টর আজিজ। লম্বা এক শ্বাস ফেলে বলল, 'রুদ্র? আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে বড় নাম। দ্যা সোলার সিস্টেম গ্রুপ লিডারের একমাত্র ছেলে। ঐ গ্রুপের সবচেয়ে বড় স্ট্রেন্থ। গুলশানের মোটামুটি সবাই ভয় পেতো ওকে। অন্যসব গ্রুপের জন্যেও রুদ্র ছিল এক আতঙ্কের নাম।'

ব্যপারটা অবাক করল না তুহিনকে। এরকম খু-নের জন্যে প্রথমেই যাকে সন্দেহ করা হয়েছিল; সে ভয়ংকর কেউ হবে এটাই স্বাভাবিক। পরপর সাতটা খু-ন! এতো নিখুঁত পদ্ধতিতে, কোন প্রমাণ না রেখে, এতো সহজেই করাটা সাধারণ কারো পক্ষে সম্ভব না। তমাল জিজ্ঞেস করল, 'এতো বড় একজন আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসী, কিন্তু আমাদের ডেটা রেকর্ডে এখনো নাম নেই? এটা কী করে সম্ভব?'

আজিজ হাসল খানিকটা। যেন তমাল খুব বোকা একটা প্রশ্ন করেছে। কিন্তু সে এটাও জানে, প্রশ্নটা যৌক্তিক। তমাল এটা জানেনা রুদ্র ঠিক কে এবং কী। ইন্সপেক্টরকে হাসতে দেখে বিরক্ত হল তমাল। আশ্চর্য! ও হাসার মতো কী বলল? তুহিন নিজেও ভ্রু কোঁচকাল আজিজের হাসি দেখে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিল ইন্সপেক্টর আজিজ। ধীরেসুস্থে কাপটা রেখে বলল, 'আজ অবধি ওকে অ্যারেস্ট করার সৌভাগ্য আমাদের হয়ে ওঠেনি। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি, প্রাণপণে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছু করতে পারিনি।'

তুহিন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইন্সপেক্টরের দিকে। আজিজ রহমানের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হল। দু হাত একত্রিত করে কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল, 'ওর শরীরের প্রতিটা শিরায় স-ন্ত্রা-সীর র-ক্ত বইছে স্যার। প্রত্যেকটা কাজ এতো নিখুঁতভাবে করতো আমরাও হা করে থাকতাম। ঠান্ডা মাথায় এতো ভয়ংকর অপরাধগুলো অনায়াসেই একটা মানুষ কীকরে করতে পারে!'

তুহিন ঠোঁটে সামান্য তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি ফুটিয়ে বলল, 'একজন সৎ ইন্সপেক্টরের মুখে আরেকজন জাত সন্ত্রাসীর প্রশংসা? ইন্টারেস্টিং!'

কথাটা বলে আবার সেই ফাইলে চোখ বুলালো তুহিন। ফাইলে সেই ঘটনার বিস্তারিত লেখা আছে যার পর অশান্ত গুলশান হঠাৎ করেই শান্ত হতে শুরু করে। আরও একবার ফাইলটা পড়ল তুহিন। পড়া শেষে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল, 'রুদ্রকে এখন কোথায় পাব?'

হতাশাপূর্ণ এক নিঃশ্বাস ত্যাগ করল ইন্সপেক্টর। বলল, 'বললাম না, হঠাৎই গুলশান শান্ত হয়ে গেছে। এখন এখানে নেই ও।'

' আর ওর গ্রুপের বাকিরা?' 

' আমার চেনাজানা কাউকে এখন দেখতে পাইনা। য‍দিও দু একজনকে হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাই। কিন্তু ওদের জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। রুদ্র সম্পর্কে ওরা এখন আর কিছুই জানেনা।'

তুহিন কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ করে খানিকটা ভাবল। কিছু একটা মাথায় আসতেই বলল, 'ওর নাম্বারও নিশ্চয়ই বন্ধ? আচ্ছা, ওর কোন ছবি হবে আপনার কাছে?'

' থাকার কথা। দাঁড়ান দেখছি। ফারুক?'

এসআই ফারুক আজিজের ইশারা বুঝতে পেরেই বেরিয়ে চলে গেল। তুহিন বুঝল ফারুক ছবি খুঁজতে যাচ্ছে। সে আবার ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল, 'প্রথম খু-নটা পিঙ্ক সিটিতে হয়, তাইতো?'

' জি।' 

'এরপর যখন রুদ্রকে সন্দেহ হল, তখন ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন নি? বা নজরে রাখেন নি?'

আজিজ চুপ থাকল। ভেতরে ভেতরে হঠাৎ অস্থির হয়ে পড়ছে লোকটা। বুঝতে পারছে তুহিন। তবুও তাড়া দিলোনা। চুপচাপ বসে রইল ইন্সপেক্টরের উত্তরের অপেক্ষায়। আজিজ রহমান নিজের গোঁফে ডান হাতের বৃদ্ধা আর তর্জনী আঙুল বুলিয়ে বলল, 'ওকে আমি খুঁজে পাইনি। ইভেন ওদের বাংলোতে এখনো তালা দেওয়া।'

হেসে ফেলল তুহিন। যেন ইন্সপেক্টর কৌতুক বলেছে। এরপর টেবিলে রাখা পেপার ওয়েট টা নিজের দিকে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, 'আর আপনি বলছেন খু-নগুলো ও করেনি?'

আজিজ রহমান আবারও অস্থির হয়ে উঠল। কপালের রেখা গভীর হওয়ার সাথেসাথে হালকা ঘামও বের হচ্ছে। যেন ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে সে। সবটাই সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে তুহিন। আজিজ চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, 'হ্যাঁ বলছি। গোটা পুলিশ টিমের ধারণা খু-নগুলো কানেক্টেড। দুদিনের তদন্তে আপনারাও বলছেন খু-নগুলো কোন না কোনভাবে কানেক্টেড। কিন্তু আমি বলছি দ্বিতীয় এবং মীরপুরে হওয়া খু-নটা রুদ্রের পক্ষে করা সম্ভব না। অর্থাৎ খুনগুলো যদি একজনই করে থাকে তাহলে রুদ্র খু-ন করেনি।'

তমাল এবার খানিকটা রেগে গিয়ে বলল, 'বারবার একই কথা বলছেন। সম্ভব না, সম্ভব না। কেন সম্ভব না? ওরা স-ন্ত্রা-সী। স্বার্থের জন্যে নিজের পরিবারকেও খু-ন করে ফেলতে পারবে। আর আপনি_'

' তমাল!'

কথাটা শেষ করার আগেই তুহিনের নির্দেশে থেমে যেতে হল তমালকে। তুহিন এবার পেপার ওয়েটটা হাতে চেপে ধরে বলল, 'আচ্ছা ঠিকাছে। কিন্তু খু-নটা কে করেছে সেটা জানাও তো জরুরি তাইনা? আমার কাজই সেটা।'

মাথা নাড়ল আজিজ রহমান। এরমধ্যেই ফারুক চলে এলো। আজিজ রহমানের দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল, 'স্যার রুদ্রের কোন ছবি পেলাম না। অনেক আগে রাখা ছিল। এরমধ্যেই হয়তো কয়েকবার সব জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করা হয়েছে _'

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আজিজ রেগে গিয়ে বলল, 'এতো ইরেস্পন্সিবল কেন তোমরা? এগুলো যেকোনো মুহূর্তে যে কারো প্রয়োজন হতে পারে, এটা তোমাদের অজানা?' 

ফারুক মুখ কাঁচুমাচু করল। কিছু বলতে যাবে তার আগেই তুহিন বলল, 'আচ্ছা, কোন সমস্যা নেই। রুদ্রকে আপনারা খুব ভালো করেই চেনেন। এসআই সাহেব একজন প্রফেশনাল আর্টিস্টকে ডাকুন। রুদ্রের একটা স্কেচ বানানোর ব্যবস্থা করুন। যত দ্রুত সম্ভব।'

এসআই মাথা নেড়ে চলে গেল। আজিজ রহমান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুহিনের দিকে। এখানে এসে থেকে কত ঠান্ডা মাথায় কথা বলছে ছেলেটা। এতক্ষণে বিরক্তি ফুটে ওঠার কথা ছিল তার মুখে। রাগের বহিঃপ্রকাশ হওয়াটাও অস্বাভাবিক ছিলোনা। কিন্তু কী শান্ত ভাবেই না সবটা হ্যান্ডেল করছে। এটাই কী তবে ইনভেস্টিগেটর তুহিনের বিশেষত্ব? আজিজের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে তুহিন বলল, 'তো ইন্সপেক্টর? ওনারা রুদ্রের স্কেচটা বানাতে বানাতে বেশ অনেকটা সময় লেগে যাবে। এদিকে আমার হাতে এমন কোন ক্লু ও নেই যেটা ধরে এগোবো। তাই ভাবছি অন্যকিছু করা যাক। আপনি ফ্রি তো?' 

আজিজ রহমান কিছু বুঝল না। সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, 'আপনাকে সবরকম সাহায্য করাটাও আমার ডিউটির মধ্যে পড়ছে। কিন্তু আপনি কী করতে চাইছেন?'

তুহিন খানিকটা আলসেমি ঝেড়ে বলল, 'গল্প শুনতে চাইছি। এই অবসর সময়টা কাটাবো কীকরে? তাই ভাবলাম গল্প শুনে কাটাই?' 

বলে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাল তুহিন। ফারিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। তমাল ঠোঁট চেপে হাসল। তুহিনের এরকম অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের সাথে ও কিছুটা হলেও পরিচিত। আজিজ রহমান হালকা গলা ঝেড়ে বলল, 'গল্প?'

তুহিন সোজা হয়ে বসল। মুখে চমৎকার এক হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, 'হ্যাঁ গল্প। আমার কেইসের মধ্যে আচমকাই ঢুকে পড়া রুদ্র নামক এই নতুন চরিত্রের গল্প শুনতে চাই আমি। তার সাথে দ্যা সোলার সিস্টেম গ্রুপের গল্পও জানা প্রয়োজন। এবার আপনি আমাকে বলবেন, একদম শুরু থেকে এই গল্প কে শোনাতে পারবে।'

'এই কেইসের জন্যে আপনি সেই শুরু থেক‍ে গল্প শুনতে চাইছেন? তাও রুদ্রর? ওয়েস্ট অফ টাইম মনে হচ্ছেনা?'

তুহিন মাথা নুইয়ে হাসল। কৌতুকের স্বরে বলল, 'মেই বি, ওর মেই বি নট।' 

আজিজ হতবাক। তুহিন আবার বলল, 'আছে এমন কেউ?'

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল আজিঢ। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট ধরে রেখে বসে রইল কিছুক্ষণ। 
তমাল বিরক্ত হচ্ছে, ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। এই লোক সাথেসাথে কথা বলতে পারেনা? একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার পর এরকম দু-তিনমিনিটের মৌনব্রত রাখার মানে কী? তুহিন স্যার কীকরে এতো ঠান্ডা মাথায় সামলাচ্ছে একে? তবে ফারিয়া ভাবলেশহীন। যেন সারাদিন ওকে এভাবে বসিয়ে রাখলেও কোনো সমস্যা নেই। তমাল আড়চোখে ফারিয়ার দিকে তাকাল। বিড়বিড় করে বলল, 'টিউবলাইট একটা।'

ফারিয়া শুনতে পেলেও কোন প্রতিক্রিয়া করল না। এই মানকি ম্যানকে নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় ওর নেই। এরমধ্যেই তুহিন নিজের হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, 'লাঞ্চ টাইম হয়ে এসেছে। বড্ড খিদেও পেয়েছে। আশেপাশে ভালো কোন রেস্টুরেন্ট নেই ইন্সপেক্টর সাহেব?'

এতক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভাবছিলো আজিজ। তুহিনের কথায় ধ্যান ভাঙল তার। ইতস্তত করে বলল, 'কিছু বললেন?'

তুহিন আবার বলল, 'ভালো রেস্টুরেন্ট নেই আশেপাশে? খিদে পেয়েছে।'

আজিজ রহমান একবার ঘড়ি দেখে বলল, 'লাঞ্চেরও সময় হয়ে গেছে। আমার খেয়ালই ছিলোনা। সো স্যরি। আমি আপনাদের খাওয়ার ব্যবস্হা করছি।'

তুহিন ইন্সপেক্টরের ব্যস্ততা দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, 'ব্যস্ত হবেন না। আমরা থানায় খাবোনা, বাইরেই খাবো। আপনিও আমাদের সাথে আসলে ভালো হয়। সময় নষ্ট না করে খেতে খেতে বাকি কথা হোক?'

আজিজ রহমান কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল তুহিনের দিকে। বারণ করা সম্ভব নয় এখন আর। তাই মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল, 'আপনার গিয়ে গাড়িতে বসুন, আমি আসছি।'

তুহিন উঠে দাঁড়াতেই তমাল আর ফারিয়াও উঠে দাঁড়াল। থানা থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে দাঁড়াল ইন্সপেক্টরের অপেক্ষায়। রোদ পড়েছে, তাই রোদচশমাটা চোখে পরে নিল তুহিন। ফারিয়া আড়চোখে একবার লক্ষ্য করল ব্যাপারটা। তমাল বলল, ' স্যার, ইন্সপেক্টরের কথাগুলো অদ্ভুত লাগল না? একেতো প্রতিটা উত্তর দিতে এতো সময় নিচ্ছিলেন। তারওপর কীরকম অদ্ভুত কথা বলছিলেন।'

তুহিন বলল, 'আমি খেয়াল করেছি ব্যাপারটা। লোকটার পেট থেকে একপ্রকার জোর করেই কথা বের করছি। দ্যাটস্ ফাইন, এটা করতে আমার মন্দ লাগেনা। দেখা যাক পরে কী হয়।'

হঠাৎই বেজে উঠল তুহিনের ফোন। তমাল আর ফারিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে দূরে সরে গেল তুহিন। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠল, ' গোয়েন্দা সাহেব, সারাদিন ঘুরে ঘুরে কাজই হচ্ছে নাকি খাওয়া দাওয়াও কিছু হয়েছে?'

তুহিন হেসে ফেলল, 'খাওয়া এখনো হয়নি ইরাবতী। এইতো খেতেই যাচ্ছিলাম আর ম্যাডামের ফোন। তো ম্যাডাম নিজে কী খেয়েছেন?'

' না খাননি, এখন খাবে। তো স্যার কোথায় আছে এখন?'

' গুলশান থানা।'

' সাথে কে কে আছে?'

' তমাল আর ফারিয়া।'

ফারিয়া নামটা শুনেই কপাল কুঁচকে গেল ইরার। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, 'ঐ ফরেনসিকের মেয়েটা না? তোমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে?'

তুহিন একপ্রকার বিষম খেল যেন। অবাক কন্ঠে বলল, 'ছিঃ ইরা? এসব কী ধরনের কথা?'

ইরা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল, 'দেখ, একদম সাধু সাজতে আসবে না। ঐ মেয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে সেটা তুমি নিজেও বোঝ। ন্যাকা সাজছো? নাকি ইনজয় করো ব্যাপারটা? হ্যাঁ? সব পুরুষই একরকম। চরিত্রহীন! ওকে কেন এনেছো সাথে?'

তুহিন এতক্ষণ বোকার মতো শুনছিল কথাগুলো। মেয়ে মানুষের মধ্যে হিংসে নামক বস্তুটা একটু বেশিই কাজ করে। কোন অনুষ্ঠানে কারো সাথে পোশাক মিলে গেলে ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলার জোগাড় হয়। আর ব্যপারটা বয়ফ্রেন্ড বা স্বামী সংক্রান্ত হলেতো কথাই নেই। একটা লম্বা শ্বাস ফেলল তুহিন। নরম কন্ঠে বলল, 'দেখ, ও এখানে শুধুমাত্র ওর কাজেই এসেছে। আর আমিও কাজ ছাড়া ওর সাথে কোন কথা বলছিনা। ট্রাস্ট মি।'

'না বললেই ভালো। আচ্ছা লাঞ্চ কর তুমি। রাখছি, বাই।'

তুহিন নরম কন্ঠে বলল, 'বাই।'

ফোনটা রেখে পেছনে ঘুরে দেখল, আজিজ রহমান চলে এসেছে। ওর জন্যেই অপেক্ষা করছে হয়তো। ও দ্রুত পায়ে গাড়ির কাছে গিয়ে বলল, 'সরি ফর দ্যা কল ইন্সপেক্টর। যাওয়া যাক?'

ওরা সবাই মাথা নাড়ল। চারজনেই গাড়িতে ওঠে বসার পর গাড়ি ছুটল তার নিজের গন্তব্যে। 

*

গুলশান শাখার সুলতান'স ডাইন নামক রেস্টুরেন্টের এক কর্ণারের টেবিলটাই বসার জন্যে বেছে নিয়েছে তুহিন। ঐদিকে লোকজন কম। টেবিলের একপাশে তুহিন আর ফারিয়া আরেক পাশে তমাল আর আজিজ রহমান বসেছেন। খাবার অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে আরও আগেই। শুধু আসা বাকি। তুহিন, তমাল, আজিজ তিনজনেই মোরগ পোলাও অর্ডার করেছে আর ফারিয়া নিয়েছে মাটন তেহারি। খাবার আসতে বেশি সময় লাগল না। ওয়েটার টেবিলে খাবার রেখে যাওয়ার পর, তুহিন কোনদিকে না তাকিয়ে চুপচাপ খেতে থাকল। বাকিরাও তাই করল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চারজনের জন্যেই কোমলপানীয় অর্ডার করল তুহিন। তারপর আজিজ রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল, 'ইন্সপেক্টর সাহেব, বললেন না যে কার কাছ থেকে গল্পটা শুনতে পারব?'

আজিজ বলল, 'আসলে এই সোলার সিস্টেম গ্রুপের কাহিনী অনেকটা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। কেউই এই কাহিনী ফার্স্ট টু লাস্ট বলতে পারবেনা আপনাকে। যারাই জানে, কোন না কোন অংশ জানে, পুরোটা না। তাই রুদ্রর পুরো গল্পটা আপনি যেকোন একজনের মুখে শুনতে পারবেন না। একমাত্র রুদ্র ছাড়া।'

' এই খন্ড খন্ড অংশগুলোই কে কে জানে?'

' অনেকেই আছে। তারমধ্যে আমিও একজন।'

অবাক হল তুহিন। চামচটা প্লেটের ওপর রেখে বলল, 'আপনি জানেন?'

' কিছুটা। কেইসের জন্যে জানতে হয়েছিল।'

তুহিন একবার তমাল আর ফারিয়ার দিকে তাকাল। এরপর আবার আজিজ রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল, 'আমি সেই কিছুটাই শুনতে চাই।'

আজিজ রহমান টেবিলে হাত রেখে নিজের হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে বলল, 'রুদ্র নামক ঐ ছেলেটার স্বভাব অদ্ভুত ছিল। যতটা নির্ভীক ছিল, ততটাই হিংস্র। শুধু আন্ডারওয়ার্ল্ডেই না, এর বাইরেও যারা ওকে চিনতো সবাই ওকে হার্টলেস বলতো। হৃদয়হীন! যদিও ঐ লাইনের সবাই হৃদয়হীনই হয়। কিন্তু ও সম্ভবত একটু বেশিই ছিল। জোয়ান ছেলে, র-ক্ত গরম ছিল। এতো অল্পবয়সে এতো ক্ষমতা হাতে পেলে যা হয় আরকি।'

এরমধ্যেই কোমলপানীয় চলে এলো। ওরা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কথাগুলো। ওয়েটার আসায় তাতে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটল। ওয়েটার চলে যেতেই আজিজ আবার বলতে শুরু করল, 'কিন্তু এই বেপরোয়া, নির্ভিক, অবাধ্য ছেলেটা একমাত্র একজনেরই বাধ্য ছিল। একজনেরই কথা শুনতো।'

তুহিন অনেকটা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কে সে?'

' রুদ্রর জন্মদাতা। রাশেদ আমের।'

-

প্রায় দুই বছর আগে- গুলশান 

গুলশান, যার মানে ফুলের বাগান। রাজধানীর চাকচিক্যপূর্ণ এই আধুনিক শহর একসময় পরিচিত ছিল 'ভোলা গ্রাম' নামক একটি গ্রাম হিসেবে। করাচির একটি শহরের অনুকরণে গ্রামটি তৈরি করতে গিয়েই এর নামকরণ হয় গুলশান। শোনা যায় গত শতকের মাঝামাঝি সময়ের দিকেও এই এলাকা ছায়াঘেরা নির্জন ছিল। কিন্তু এখন গুলশান একের পর এক উঁচু উঁচু দালানে পূর্ণ এক চমৎকার শহর। তবে প্রদীপের নিচেও যেমন অন্ধকার আছে, তেমনই এই জনবহুল ঝলমলে রাজধানীতেও রয়েছে অন্ধকার বিষাক্ত জগৎ। সেসব জগৎ কারো চেনা, কারো অচেনা। কারো কাছে কেবলই সিনেম্যাটিক কল্পকথা, কারো কাছে প্রত্যক্ষ দর্শন করা নির্মম বাস্তবতা। এ অন্ধকার জগতের কিছু অংশ প্রকাশিত, কিছু অংশ সুপ্ত। কিছু অংশকে সবাই দেখে, চেনে, ভয়ও পায়। কিন্তু সাহস বা উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারেনা। আবার কিছু অংশের শুধুই নাম আর নৃশংসতার কথা কানে শোনা যায়; কিন্তু দর্শন পাওয়া যায়না। গুলশানও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানেও অন্ধকার আছে, অন্ধকার জগৎ আছে, কিংবা আছে অন্ধকারের নামে কোন এক গোপন সৌরজগত।

আমের ভিলা। বাড়ি নয়, যেনো এক ছোটখাট সম্রাজ্য। আর এই সম্রাজ্যের একমাত্র রাজা, রাশেদ আমের। কিছুক্ষণ আগেই মাগরিবের আযান দিয়েছে। নিজের শয়নকক্ষের ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছেন রাশেদ। গা ছেড়ে রেখেছেন একদম। বয়স পঞ্চান্নর কিছু এদিক-ওদিক হবে। পড়নে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় মাঝারি আকারের চুল, গালে চাপ দাড়ি। এখনো একটা চুল বা দাড়িও সাদা হয়নি, কিংবা সাদা হতে দেননি। চোখ বন্ধ রেখেই কিছু একটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছিল সে। 
তখনই কাপের ওপর চামচ দিয়ে মৃদু ভাবে আঘাত করার শব্দ এলো। পরপর তিনবার। সেই আওয়াজ শুনে চোখ বন্ধ রেখেই মৃদু হাসলেন রাশেদ। আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালেন। তার ঠিক পায়ের কাছে হাঁটু ভেঙ্গে বসে আছে এক মেয়ে। কুহু। রাশেদ আমেরের একমাত্র মেয়ে। মুখে ঝুলে আছে এক দারুণ মিষ্টি হাসি। এই হাসির মতো মেয়েটার মুখটাও ভীষণ মিষ্টি। বয়স বিশ হলেও দেখতে একদম বাচ্চা। জন্মের পর শখ করে রাশেদের স্ত্রী মেয়ের নাম রেখেছিলেন কুহু। তার দুদিন পরেই ইহকালের মায়া ত্যাগ করে সে। নাম কুহু হলেও কোনদিন কথা বলার ক্ষমতা হয়ে ওঠেনি কুহুর। কানে শুনতে পেলেও কথা বলতে পারেনা সে। তবে এ নিয়ে কোন আফসোস নেই কুহুর। যেটুকু পেয়েছে, তা নিয়েই ভীষণ খুশি সে। ওর হাসিখুশি মুখ আর চঞ্চলতা তারই প্রমাণ। রাশেদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, 'কী ব্যপার কুহু মা? আজ তুমি চা নিয়ে এসেছো? জ্যোতি আপু কোথায়?'

কুহু হাতের ইশারায় বোঝালো, জ্যোতি এখন ব্যস্ত আছে। রাশেদ বুঝতে পেরে বলল, 'আচ্ছা, যাও নিজের ঘরে যাও। রাতের খাওয়ার সময় দেখা হবে।'

ঠোঁট ফুলিয়ে না বোধক মাথা নাড়ল কুহু। আবার ইশারায় কিছু বলল। রাশেদ হেসে বলল, 'ভাইয়া কোথায়?'

কুহু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। রাশেদ স্নেহমাখা হাতে মেয়ের গাল ছুঁয়ে বলল, 'ও যখন আসবে তখন তোমার ঘরে পাঠিয়ে দেব। এখন যাও।'

কুহু আবার সেই মিষ্টি হাসি দিল। এরপর উঠে চলে গেল নিজের ঘরে। কুহু সাইন ল্যাঙ্গুয়েজেই কথা বলে। রাশেদ ছাড়া আর দুজন এ বাড়িতে এই ভাষা পুরোপুরি বুঝতে পারে। রাশেদ চায়ের কাপ হাতে তুলে নিতেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কেউ বলল, 'ভাইজান আসব?'

রাশেদ তাকাল। তার ছোট ভাই জাফর আমের দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। রাশেদ চায়ের চাপে চুমুক দিয়ে বলল, ' আয়।'

জাফর দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করল। বসে পড়ল রাশেদের সামনে রাখা চেয়ারটাতে। রাশেদ কাপটা টি-টেবিলে রেখে বলল, ' কী খবর?'

জাফর একটু ইতস্তত কন্ঠে বলল, ' খবর ভালো না ভাইজান।'

রাশেদ ভ্রু কুঁচকে বলল, ' কেনো? কী হয়েছে?'

জাফর এবার উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ' তিনজনের মধ্যে দু-জন টাকা দিতে রাজি হলেও একজন বেঁকে বসে আছে। সে কিছুতেই টাকা বের করছেনা। ঐ কোম্পানি থেকে টাকা না পেলে নেক্সট ডিলটা করতে সমস্যা হয়ে যাবে।'

জাফরকে যতটা চিন্তিত হয়ে কথাটা বলতে দেখা গেল; রাশেদের মুখ ততটা চিন্তিত বলে মনে হলো না। সে বেশ আয়েশ করেই আবার চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বললেন, 'কোন কোম্পানি?'

' রিপন গ্রুপ।'

' রুদ্র জানে?'

নির্বিকারভাবে জানতে চাইল রাশেদ। জাফর হতাশ হয়ে বলল, ' আমিতো বলতে পারিনি ওকে। কিন্তু দুপুর থেকে ছেলের খবর নেই। ফোনটাও লাগছেনা।'

ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন রাশেদ। আরাম করে চেয়ালে হেলান দিলেন। রাশেদকে এমন নির্বিকার দেখে জাফর অবাক হল। কিন্তু রাশেদের সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। সে জানে তার মাথাব্যথার প্রয়োজন নেই।
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন