#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১
" তুমি কি ঠিক করেই নিয়েছো রাহিকে সত্যি ডিভোর্স দিবে?"
আদ্রিয়ানের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো তোশা। যে মেয়ের জন্য তাকে এত বছর দূরে সরিয়ে রেখেছে আজ হঠাৎ করে তাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা কীভাবে বললো আদ্রিয়ান!
" ডিভোর্স মিথ্যে মিথ্যে দেওয়া যায় না তোশা।"
মুখে গাম্ভীর্যের সঙ্গে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো আদ্রিয়ান। একটা কফিশপে সামনাসামনি বসে আছে তোশা ও আদ্রিয়ান। তোশা সম্পর্কে আদ্রিয়ানের চাচাতো বোন, প্রায় সমবয়সী দুজনেই। কলেজ জীবন থেকেই আদ্রিয়ানকে পছন্দ করতো তোশা। কিন্তু আদ্রিয়ান জুনিয়র রাহির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো ততদিনে। অবশেষে প্রেমের সম্পর্কে প্রণয় এসেছিলো দুই পরিবারের সম্মতিতেই।
" ঠিক আছে তাহলে তোমার যা ইচ্ছে সেটাই করো। দেখো কাকি যেনো আবার আমাকে দোষারোপ না করেন।"
তোশার মনে মনে যে কী পরিমাণ আনন্দ হচ্ছে সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু সেসব আড়াল করে আদ্রিয়ানের সামনে এমন ভাবসাব দেখাচ্ছে যেনো এ বিষয় একেবারে কোনো আগ্রহ নেই তার। আদ্রিয়ান কফি শেষ করলো। তারপর ফোনের স্ক্রিনে তাকালো সময় দেখার জন্য। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
" তোকে এতকিছু ভাবতে হবে না তোশা। আমি যাচ্ছি, এরপর আর যখন-তখন ডেকে পাঠাবি না আমাকে।"
আদ্রিয়ান মুখের বাক্য শেষ করেই হনহনিয়ে স্থান ত্যাগ করলো। তোশা কিচ্ছু বললো না শুধু তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি। রাহি সরে গেলেই তোশার রাস্তা পরিষ্কার!
দুপুরের কড়া রোদের কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ।জোহরের আজান হলো মাত্রই। রাহি প্রেশারকুকারের ঢাকনাটা খুলে একবার পরখ করে নিলো মাংস সেদ্ধ হলো কি-না। আজকে মিহির সাথে গল্পগুজব করতে গিয়ে রান্নায় কিছুটা দেরি হয়ে গেছে তার। মিহি রাহির একমাত্র ননদ। রান্না দেরি হওয়াতে না জানি কখন আবার শ্বাশুড়ি রিনা বেগম এসে বকাঝকা শুরু করেন!
" রাহি! রান্না কতদূর হলো? তোমার শ্বশুরকে খেতে হবে সময়মত মনে নেই না-কি! "
" হ্যাঁ মা হয়ে গেছে। "
মনে মনে যার ভয় পাচ্ছিলো এতক্ষণ সেটাই হবে এখন। রাহি তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরের সবকিছু গোছগাছ করে খাবারগুলো দ্রুত ডাইনিং টেবিলে পরিবেশন করার জন্য উদ্ধত হলো। রাহির শ্বশুর সালমান খুরশিদ ডায়াবেটিসের রোগী। খাওয়াদাওয়া সব নিয়মমাফিক করেন। এরমধ্যেই সালমান খুরশিদ ডাইনিং টেবিলে এসে খেতে বসেছেন। এমনিতে রিনা বেগম ভালোই কিন্তু মাঝে মধ্যে কেমন রুক্ষমূর্তি ধারণ করেন। রাহি এ বাড়িতে এসেছে প্রায় পাঁচ বছর হলো তবুও শ্বাশুড়িকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।
" বাবা আপনার কি আর কিছু লাগবে? "
" না ঠিক আছে। তুমি তোমার কাজে যাও, খাওয়া শেষ হলে সব গুছিয়ে রেখো।"
" জি।"
সালমান খুরশিদ শান্ত স্বভাবের মানুষ। আদ্রিয়ান হয়েছে একেবারে তার বিপরীত। সব সময় মেজাজ চটেই থাকে তার। তবে ইদানীং একটু বেশিই খিটখিটে হয়ে গেছে আদ্রিয়ান। ভাবতেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো রাহির। আদ্রিয়ানের কথা মাথা থেকে বের করে ডাইনিং টেবিল পেরিয়ে বসার ঘরে গেলো মিহিকে ডাকতে। মিহি সোফায় বসে ফোন ঘাঁটছে। মিহি অনার্স তৃতীয় বর্ষে লেখাপড়া করে। তবে এরমধ্যেই বাসায় প্রায় বিয়ে-শাদির কথা হয়। অবশ্য মিহি মোটেও বিয়ে করে সংসার করতে ইচ্ছুক নয় এখনই।
" মিহি তোমার কাছে শ্যাম্পু আছে? আমার শ্যাম্পু শেষ হয়ে গেছে, তোমার ভাইকে বললাম কিন্তু ওর মনেই থাকে না। "
" হ্যাঁ ভাবি আছে। তুমি আমার রুমে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর তাকালেই পেয়ে যাবে। "
" ওকে মিহি।"
রাহি দোতলায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। মিহির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাহি সে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতে ব্যস্ত। তাই নিজেই গেলো দরজা খুলতে। আদ্রিয়ান ফিরেছে, কিন্তু আদ্রিয়ানের শরীর থেকে লেডিস পারফিউমের সুভাস এসে নাকে ঠেকলো রাহির। মুহুর্তেই রাহির মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু মিহির সামনে সেসব প্রকাশ করলোনা মোটেও। আদ্রিয়ান কোনো কথা না বলে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। রাহি সালমান খুরশিদের খাওয়া শেষে এঁটো থালাগুলো জড়ো করে রেখে নিজের রুমে গেলো। আদ্রিয়ান তখন চক্ষু মুদে বিছানায় শরীর এলিয়ে ছিলো। এখনও বাইরের পোশাক পরিহিত সে। রুমে ঢুকে সশব্দে দরজা আঁটকে দিলো রাহি। আদ্রিয়ান সম্ভবত অন্য কোনো চিন্তায় নিমজ্জিত ছিল তাই বোধকরি টের পায়নি।
" এখন বুঝলাম ইদানীং কেনো আমার ধারেকাছেও আসো না।"
হঠাৎ রাহির ত্যাড়া কথায় চোখ মেলে তাকালো আদ্রিয়ান। চেহারায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো।
" রাহি সব সময় এধরণের কথাবার্তা ভালো লাগে না। "
" এখন তো আমাকে ভালো লাগবেই না,পুরনো হয়ে গেছি। এজন্য অন্য কারো সাথে লটরপটর করে এসেছো।"
" চুপ করো,মুখের ভাষা ঠিক করো।।"
মুহুর্তেই রেগে হুংকার দিয়ে উঠলো আদ্রিয়ান। তড়িৎ গতিতে রাহির কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফের বললো,
" সমস্যা কী তোমার? শরীরে জ্বালা হয়েছে? কাছে যাই না বলে আজাইরা কথা বলতেছো?"
রাহি চোখের জল ফেলে চুপ করে থাকার মেয়ে নয়। বরং উল্টো তেজ দেখিয়ে বললো,
" জ্বালা শরীরে যতটা তার তিনগুণ বেশি অন্তরে। তুমি সেটা বুঝবে না এখন।"
আদ্রিয়ান রাহিকে ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে সজোরে একটা ঘুষি মারলো। ফলস্বরূপ ব্যথা পেলো সে। রাহি দ্রুত গিয়ে আদ্রিয়ানের হাতটা ধরতে চাইলে আদ্রিয়ান রাহিকে সরিয়ে দিলো।
" অতিরিক্ত ভালোবাসা তোমাকে ঈর্ষান্বিত ও সন্দেহপ্রবন করে তুলেছে রাহি। এখুনি এসব বন্ধ না করলে চিরতরে হারাবে আমাকে,মাইন্ড ইট।"
কথা শেষ করেই ওয়াশরুমের ভেতর চলে গেলো আদ্রিয়ান। আসলেই কি মিছে সন্দেহ করছে রাহি? না-কি নিজের দোষ লুকাতে উল্টো রাহিকে কথা শুনিয়ে গেলো!
শহরের বুকে রাত নেমেছে অনেকক্ষণ। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে একবার সময় দেখে নিলো মিহি, রাত এগোরাটা বেজেছে। আকাশের দিকে তাকাতেই মিহির ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠেছে। পূর্নিমার আলোয় অপার্থিব সুন্দর লাগছে সবকিছুই। মিহি চাঁদ দেখতে ভীষণ পছন্দ করে। তাই মাঝে মধ্যে ছাদে একা আসে চাঁদের আলো গায়ে মাখতে। আজও তেমনই এসেছে চাঁদ দেখতে। মিহির মনটা আজ বিশেষ ভালো না। হেতু ভাই-ভাবীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে সেটা ভালোই বুঝতে পেরেছে মিহি। আসলে মিহির পাশের রুমটাই আদ্রিয়ান ও রাহির। তাই না চাইতেও মাঝে মধ্যে ঝগড়াঝাটির আওয়াজ শুনতে পায় সে। এসব নিয়ে ভাবনায় ডুবে ছিলো মিহি। কিন্তু আশেপাশ থেকে হঠাৎ গানের সুর ভেসে এলো মিহির কর্ণকুহরে। ভাবনার ছেদ ঘটলো মিহির। কান খাঁড়া করে শুনলো...
এই রাত তোমার আমার
ওই চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের,
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কূজনের,
এই রাত তোমার আমার....
মিহি চারদিকে তাকিয়ে গানের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে। এদিক-সেদিক তাকাতে তাকাত হঠাৎ চোখ গেলো দক্ষিণ দিকের একটা বাড়ির ছাদে। একদল ছেলেমেয়ে আগুন জ্বেলে গোল হয়ে বসে গান গাইছে। যদিও তেমন ঠান্ডা পড়েনি ঢাকা শহরে কিন্তু এঁরা সম্ভবত সময় উপভোগ করার জন্যই এমনটা করেছে। কিন্তু এপাশ থেকে যে একটা মেয়ে তাদের গান শুনে তাকিয়ে আছে সেটা কী আদৌও ভাবতে পারবে তারা? না সেটা সম্ভব না। মিহি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছাদ থেকে নেমে নিজের রুমে গেলো। এই শহরে রাতের আঁধারে কতশত মানুষ স্মৃতি পোড়ায়, সাথে পুড়ে যায় হৃদপিণ্ড। রাতের আঁধারে শক্তপোক্ত মানুষটাও নিজেকে ভেঙেচুরে আবারও জোড়ায়।
" এখন কিন্তু এরকম পুরনো আমলের গান চলবে না সাইকি।"
আগুনের পাশে গোল হয়ে বসা ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে সবচেয়ে সুদর্শন ছেলেটা সামনে থাকা ছোটো চুলের শ্যামবতী মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো। সাইকি হাসলো কিছুটা। মোট ছয়জন বসে আছে, চারজন ছেলে আর দু'জন মেয়ে।
" ঠিক আছে। তোদের তো হিন্দি গানই বেশি পছন্দ তাই সেটাই কর তাহলে। আমি আছি সাথে। "
" ওকে। তাহলে রুদ্র গান ধর এবার। মেরে ম্যাহেবুব গানটা দিয়ে শুরু কর। "
সাইকির পাশ থেকে সালান বলে উঠলো রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে। "
চলবে............................