মাগরিবের আজান দিয়েছে গুনেগুনে আধঘণ্টা পেরিয়েছে। তন্ময় প্রস্তুত বেরোনোর জন্য। ইতোমধ্যে তার সেলফোন কিছুসংখ্যক মিসডকলের আগামবার্তা পাঠিয়েছে। এইমুহূর্তে পুনরায় ভাইব্রেট হতেই আপিকামিং কল'টি রিসিভ করল। নিজ কামরা ছেড়ে পেরুতে-পেরুতে, ফোন খানা কানের কাছটায় তুলল। কলের মালিক সৈয়দের কণ্ঠ ওপাশ হতে উত্তেজিত, প্রবণতায় জর্জরিত। একপ্রকার আবোলতাবোল বকছে। সিঁড়ি ভেঙে নামতে-নামতে তন্ময় শুধাল,
'কী এমন হয়েছে?'
সৈয়দ হুড়মুড়িয়ে বলে ওঠল, 'আয় দ্রুত, সিনেমা নাহলে মিস করবি। আপাতত স্লো পেসডে আছে। ক্লাইম্যাক্স শুরু হওয়ার আগেই চলে আয়।'
অরু লিভিংরুমে বসে শাবিহা-রুবির সঙ্গে। তিনজন একসঙ্গে লেপ্টে টেলিভিশন দেখছে। ভীষণ উত্তেজিত তাদের অঙ্গভঙ্গি। তন্ময় অদূর হতেই যতটুকু বুঝতে পারল; ওরা নাটক দেখছে। একটি ড্রামাটিক হিন্দি সিরিয়াল। যা প্রায় দৈনন্দিন সময় করে দেখে। এই অপ্রয়োজনীয় সব গানবাজনা ভর্তি সিরিয়ালে মেয়েগুলো কী পায়? শব্দ দূষণ বৈ আর কিছু নয়। প্যান্ট পকেটে সেলফোন ঢুকিয়ে, লিভিংরুমে পৌঁছে বিনাবাক্যে টেলিভিশন বন্ধ করে দিলো। গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃশ্য চলছিল তখন। টানটান উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে ব্যাঘাত ঘটাতে; অরু তক্ষুনি মাথা তুলে চাইল। পরিপাটি, লম্বাটে দেহের–গম্ভীরমুখের ভ্রু তুলে তাকানো তন্ময়কে দেখে স্বভাবসুলভ ভীরু হলো। পরমুহুর্তেই ভীরু হৃদয়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দাপিয়ে উঠে দাঁড়াল। কণ্ঠে তেজস্বিনী রূপ আনার বৃথা চেষ্টা চালাল,
'কেন বন্ধ করলেন, তন্ময় ভাই?'
অরুর মতোন বিদঘুটে সাহস আবার শাবিহা রুবির নেই। বড়ো ভাইকে দুজন এহেন প্রশ্ন করবার সাহস পেলো না। এখন তাদের বই নিয়ে টেবিলে বসার সময়। তা না করে টেলিভিশন দেখে হাসছে, এইতো তাদের বড়ো অপরাধ। ধমক যে এখন অবদি দেয়নি তাই অনেক! দুজন আড়চোখে অরুকে একপল দেখে; আলগোছে মাথা নত করে এখান থেকে কেটে পড়তে উদ্যত হলো। নিঃশব্দে ত্বরান্বিত পদচারণ ফেলে লিভিংরুম পেরিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে নিজেদের ঘরে চলে গেল। অরু তখনো জবাবের প্রত্যাশায় চেয়ে আছে। তন্ময় নির্বিকার গলায় জানতে চায়,
'তোর পড়াশোনা নেই?'
মুহূর্তে অরু চুপসে যায়। পড়াশোনা সম্পর্কিত ব্যাপারে এই বাড়িতে কোনোপ্রকার ছাড় নেই। বাবা হতে চাচ্চু কেউই এই বিষয়ে তাকে আহ্লাদিপনা দেখাবে না। বরঞ্চ গম্ভীরকণ্ঠে বলবে, 'পড়াশোনা ইজ ইম্পরট্যান্ট, আম্মু। তন্ময় তোমার ভালোর জন্য বলছে।' অযাচিত পড়াশোনা নিয়ে সকলের এতো মাথা ব্যথা কেন? অরু কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলে,
'আমি তো একা দেখছি না। আপুরাও সঙ্গে আছে।'
তন্ময় ঈষৎ হাসিটুকু গিলে শুধায়, 'কোথায় তোর আপুরা?'
অরু রাগান্বিত চোখে চেয়ে থাকে। পেছনে দৃষ্টি না ফেলে আঙুল তাঁক করে বলে,
'আপনি কী অন্ধ?'
তন্ময় ভ্রু তুলে হতাশ গলায় জানায়, 'তাইতো মনে হচ্ছে। নাহলে কাউকে দেখব না কেন?'
অরু কিঞ্চিৎ ভ্রুদ্বয় কুঁচকে বসে। সন্দিহান ভঙ্গিতে মাথা বেঁকিয়ে পিছু ফিরে চায়। ফাঁকা সোফাটা দেখে নির্বাক হয়। আশেপাশেও পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে, তার আপুদের চুল অবদি কোথাও নেই। দুজন তাকে ফেলে পালাতে পারল? অরু
গাল ফুলালো। চোখমুখে আঁধার নামল। মাথা ঘুরিয়ে বুক ফুলিয়ে শুধাল,
'বেশ করেছি একা-একা টিভি দেখেছি। কী করবেন?'
তন্ময় হাত ঘড়িতে নজর বোলাল। কাঁটা ঘুরছে সাতটা দশে। বেরোনা প্রয়োজন এক্ষুনি। বন্ধু-বান্ধব সব লেকের পাড়ে ইতোমধ্যে উপস্থিত।
সে ত্বরান্বিত পায়ে যাবার জন্য উদ্যত হলো। যেতে-যেতে বলল,
'এসে দেখছি তোকে কী করা যায়! আপাতত রুমে গিয়ে পড়তে বোস।'
তন্ময় দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। গাড়িটা বের করে ড্রাইভিং সিটে বসেছে। চাবি ঢুকিয়ে গাড়ি স্টার্ট করতেই দেখল অরু জানালার সামনে দাঁড়িয়ে। চোখমুখে প্রত্যাশা, সাথে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। কাঁচ নামিয়ে দিতেই আগ্রহী গলায় জানতে বলল,
'কোথায় যাচ্ছেন?'
তন্ময় ওই সুশ্রী মুখপানে চেয়ে থমকাল। থেমে-থেমে জানাল, 'একটু কাজ আছে।'
অরু ইনিয়েবিনিয়ে চলেছে। সে সঙ্গে যেতে চাচ্ছে হাবভাবে স্পষ্ট। ঘুরতেফিরতে এই মেয়ে পটু! তবে আজ তন্ময় নরম হবে না। অরু যেতে চায় বললেও– তার কাঠকাঠ জবাব হবে, 'না।' সে মোটেও চায় না অরু সঙ্গে আসুক। নাইবা সে সঙ্গে নেবে। তার বন্ধুবান্ধব একেকটা ঠোঁট কাঁটা স্বভাবের। মুখ অশ্লীলের চূড়ান্তে। বলেকয়েও ওদের থামানো সম্ভব নয়। গড়গড় করে উলটপালট সব বলবে; যা এই মুহূর্তে তন্ময় চাচ্ছে না অরু শুনুক, জানুক। তাই অবলীলায় বলল,
'ঘরে যা।'
দারোয়ান চাচা দরজা খুলে দিয়েছে। তন্ময় একটানে বেরিয়ে গেল। ক্ষণিকের জন্য আয়নাতে দেখতে পেলো অরুর উদাসীন মুখশ্রী। ওই উদাসীন মুখপানে চাইতেই ইচ্ছে করল ফিরে গিয়ে ওকে সঙ্গে নিতে। তবে না, সেটা অবশেষে সে করল না। ব্যস্ত সড়কপথ ধরে যেতেযেতে অন্যমনস্ক হলো। এই একটা বাজে স্বভাব তার।
অরুকে কোনো বিষয়ে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। যদি কারণবশত করেও, তার মন তখন আনচান করতে থাকে। জাদুটোনা কী অতিরিক্ত করেছে তার ওপর? নাহলে এমন বিচ্ছিরি ভাবে ভালোবাসার জালে ফাঁসবে কেন? এমন ফাঁসা ফেঁসেছে যে ছোটবার সাধ্য এই জনমে হবে বলে মনে হচ্ছে না! দীর্ঘশ্বাস ফেলে–ভাবনাচিন্তা করে সবশেষে ঠিক করল, ফিরে এসে অরুকে লং ড্রাইভে নিয়ে যাবে। এতে নিশ্চয়ই খুশিতে আধপাগল হবে! উদাসীনতা মনখারাপ ছুটে পালাবে।
____
মাহিন পায়ের ওপরে পা তুলে বসেছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। যা সে ক্ষণে ক্ষণে ঠোঁটের ফাঁকে পিষে ধরছে। সম্মুখে রিয়ান উদ্দেশ্যহীন পদচারণা চালাচ্ছে। মুখমণ্ডল জুড়ে অসহায়ত্বতা। ভীরু-ভীরু হাবভাব। টি-শার্ট ভিজে পুরুষালি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লেপ্টে আছে। সৈয়দ চোখমুখ বুজে তৃপ্তি নিয়ে চিপস খাচ্ছে। খাওয়ার ফাঁকে রিয়ানকে গুনেগুনে চারবার খেতে সেধেছে। এতে রিয়ান রাগান্বিত হয়েছে। শক্ত হয়ে এসেছিল তার চোয়াল। চোখে দুবার শাসিয়েছে সৈয়দকে! তাতে কী থেমেছে সৈয়দ? একদমই নয়। উল্টো সে সুর তুলে গাইতে শুরু করল,
'একবারে খেতে না চাইলে, সাধো শতবার।'
ইব্রাহিম দু'পা ছড়িয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। মাথাটা সৈয়দের পিঠে। বাদামের খোসা ছাড়িয়ে ওপরে ছুঁড়ে মেরে খেয়ে নিচ্ছে অবলীলায়। এযাত্রায় সৈয়দের সুরে তাল মিলিয়ে গেয়ে ওঠে,
'না জানিয়া না বুঝিয়া বন্ধু
পিরিত কইরো না,
সুজন দেইকা কইরো পিরিত,
মরলে জেন ভুলে না,
প্রেমের মরা জলে ডুবে না।'
রিয়ান একেক করে বন্ধু নামক শ ত্রুদের মুখমণ্ডল দেখে নিলো। ফোঁসফোঁস করে সাপের মতোন ফেনা তুলল। আঙুল তুলে শাসাতে গিয়েও পারল না। তার হৃদয় ছিঁড়ে তর ল র ক্ত গরগর করে বইছে। কণ্ঠ আটকে এসেছে। মাহিন এবারে মুখ খুলল,
'আহা, চুপ কর তোরা। দেখছিস না রিয়ান ফ্রাস্ট্রেইটেড? ওকে মানসিক শান্তি দিবি তা না।'
রিয়ান কৃতজ্ঞতা নিয়ে চাইল মাহিনের পানে। চোখজোড়া উজ্জ্বল হলো। মুখ খুলেছে কিছু বলবে ওসময় মাহিন সুর উঠিয়ে গেয়ে ওঠে,
'বিচ্ছেদ তো লেখাই ছিলো পিরিতি করে লাভ কী হলো সখা? ও সখা গো, পিরিত করো না।'
সৈয়দ আর ইব্রাহিম উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসির তালে দুজন শুয়ে পড়ল। রিয়ান চোখমুখ ভোঁতা করে ফেলল। মাহিন তখনো অদ্ভুত গানটি গেয়ে চলল। তন্ময় উপস্থিত হলো এযাত্রায়। অদূর হতে তাকে দেখে রিয়ান যেন নিজের প্রাণপাখি হাতে পেয়েছে। এক দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে ধরল তন্ময়ের কাঁধ। বিষণ্ণ মুখেতে কাঁদোকাঁদো হাবভাব,
'দোস্ত, আমারে বাঁচা।'
তোন্ময় অবুঝ, নির্বোধ। সে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে শুধাল,
'কী হয়েছে?'
ইব্রাহিম হাসতে-হাসতে দাঁড়িয়ে বলল, 'কী আর হবে? ওর জীবনে ব্রেকাপ ছাড়া আর কিছু কি হবার আছে?'
তন্ময় নির্বাক, হতভম্ব, 'আমাকে এতটা তাড়া দিয়ে, এই ছোটো বিষয়ে ডেকে নিয়ে আসছিস?'
রিয়ান বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে বলল, 'তুই এভাবে বলতে পারলি, আমার প্রাণের দোস্ত? এবার কিন্ত খুব সিরিয়াস ব্যাপারস্যাপার। ও শুধু আমাকে ব্লক করেনি, লক করেছে। ওর বাসা চেঞ্জ। ওর নাম্বার চেঞ্জ। ও কাজেও যাচ্ছে না। আজকে চারটা দিন ধরে আমি হৃদরোগের পেসেন্টের মতো ছটফট করে চলেছি। আয়ু-বায়ু সব কমে গেছে।'
মাহিন শরীর কাঁপিয়ে হাসল। চোখের কোণের জলটুকু মুছে; রিয়ানের পানে চেয়ে তন্ময়ের উদ্দেশ্যে বলল,
'তন্ময় ওরে জিজ্ঞেস কর, ও কী কুকাজ করছে যে ওকে এভাবে এভয়েড করবে শুহানি? যুক্তিসংগত কারণ দেখাতে না পারলে ওর প্রেম আমি প*** দিব। তখন বারবার বলছি, বন্ধুর সাথে প্রেম করিস না। কিছু একটা হলে পুরো বন্ধুদের গ্রুপটা নষ্ট হবে। কিন্তু না! গাধাটা বলেই গেল, ও নাকি পাগলের মতো ভালোবাসে। কখনো কষ্ট দেবে না এটসেট্রা!'
রিয়ান নাক ফুলালো। তিরতির করে কম্পিত ঠোঁট নাড়িয়ে জানাল, 'আমি কিছুই করিনি। আমার কোন আমলের কোন বা**র এক্স গার্লফ্রেন্ড নাকি এসেছে ওর কাছে। এসে তখনকার বা ল সাল দেখিয়েছে। এই নিয়ে এমনটা করতে পারে আমার সাথে ও? ওসব তো পাস্ট। ও তো জানে আমি কেমন! তখন খারাপ ছিলাম, আই এডমিট। কিন্তু এখন তো আমি ওসবে নেই। ও ছাড়া কোনো নারীতে আমি দুবার তাকাতে পারি না।'
সৈয়দ টুপ করে একটি মন্তব্য ছুড়ল, 'পাস্টে হাজারবার করে নারীদের পানে তাকানোর ফলাফল এখন বেরুচ্ছে। খেসারত দে লু চু।'
রিয়ান চেঁচাল, 'সৈয়দ, আম গনা কিল ইউ–শা লা!'
তন্ময় অশান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল। বসতে বসতে বলল, 'চুপ কর তোরা। থাম এবার।'
রিয়ান থামল না। কাতর চোখে তন্ময়ের পানে চেয়ে থেকে বলল, 'প্লিজ কিছু কর। আমি মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যে মা রা যাব।'
তন্ময় কপাল দুটো আঙুল ঘষে নির্বিকার গলায় জানতে চাইল, 'তুই তোদের বাড়ি খুঁজেছিস?'
রিয়ান বিমুঢ় মুখে শুধাল, 'আমাদের বাড়ি?'
তন্ময় হতাশ, 'তোর মায়ের সাথে শুহানির ভালো সম্পর্ক। গিয়ে দেখ আমোদেই আছে।'
রিয়ান দাঁড়িয়ে পড়ল। হনহনিয়ে ছুটল। পরপর দৌড়াতে লাগল। মাহিন আর সৈয়দ ওর যাওয়ার পানে চেয়ে উচ্চস্বরে হাসে। ধীর গলায় মাহিন বলে ওঠে,
'কেন বলে দিলি? হারামজাদাটা আরেকটু ছটফট করতো নাহয়!'
তন্ময় বিনাবাক্যে নিঃশব্দে হাসে। মুখে কুঁলুপ এঁটে বন্ধুদের চক্করে একটি সিগারেট ধরায়। আড্ডাবাজে ঘড়ির কাঁটা এসে দাঁড়ায় নটার দোরগোড়ায়। তন্ময় তক্ষনি উঠে দাঁড়ায়। বলে,
'আমি চলে যাচ্ছি।'
সৈয়দ সন্দিহান স্বরে দুষ্টুমি ভঙ্গিতে বলে ওঠে, 'আজ এতো তাড়া কীসের মাম্মা? ব্যাপার কী? তোর প্রেয়সী ওরফে প্রিয়তমা বুঝি অপেক্ষাতে আছে?'
বন্ধুদের মশকরাটুকু দুদণ্ড দাঁড়িয়ে থেকে; শোনার সময় তন্ময়ের হলো না। সে ততক্ষণে গাড়িতে উঠে বসেছে। গাড়ি স্টার্ট করে একটানে বেরিয়েছে সড়কপথে। বন্ধুর শেষ কথাটুকু কানে ভাসতেই হেসে ফেলে। বিড়বিড়িয়ে বলে,
'বলো, কোন প্রিয় নামে ডাকি?
প্রেয়সী, প্রিয়তমা নাকি জোনাকি?'
.
.
.
চলবে.................................