মনেরও গোপনে (পর্ব ০৬)


#মনেরও_গোপনে 
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া 
#পর্ব_৬ 



রাহিকে যে কারণে অসহ্য লাগতো তোশার সাথে মেশার পরে বুঝেছে তোশা তারচে বেশি অসহ্য। আসলে মানুষ চাইলেও সুখী হতে পারে না, যদি না সৃষ্টিকর্তা চান। আদ্রিয়ানের বেলায় ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে রিনা বেগম রাহি চলে যাওয়াতে খুশি না হলেও অখুশি হননি। সালমান খুরশিদ সে হিসেবে খুব কষ্ট পেয়েছেন। মেয়েটা একেবারে মায়ের মতো করে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়াতো,খুব খেয়াল রাখতো।

বাবার বাড়ি এসে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল রাহিকে। অবশ্য সবটা বুঝিয়ে বলার পরে তেমন কোনো সমস্যা পোহাতে হয়নি তাকে। শুধু বড়ো ভাইয়ের থেকে ভালোবেসে বিয়ে করার পরিণাম সম্পর্কে কিছু কথা শুনতে হয়েছিল। বাড়ির ছোটো মেয়ে রাহি,সবার বড়ো ভাই তারপরে আরেক বোনের পরে রাহি। মোট তিন ভাইবোন তারা। রাহির মা মুখে কিছু না বললেও মেয়ের জীবনের এরকম পরিণতিতে বেশ চিন্তিত থাকেন সব সময়। তিনি খুব ভালো করে জানেন আদ্রিয়ানকে কতটা ভালোবাসতো মেয়েটা। 
তপ্ত দুপুর,জানালার গ্রিলে হাত দিয়ে দূরের আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছে রাহি। জীবনের হিসাব মিলেনি তার,কত বছরের ভালোবাসার কী পরিণতি হলো সেই নিয়ে ভাবতে ভাবতে বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
" ভরদুপুরে উদাসী হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন রাহি?"
নির্জন ঘরে হঠাৎ বোনের কন্ঠে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো রাহি। সমস্ত ভাবনা মস্তিষ্কের একপাশে রেখে ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি ফুটিয়ে বোনের দিকে ফিরে তাকালো সে। রাহির আসার কথা শুনেই মিথিলা এসেছে বাবার বাড়ি। 
" কই! এমনি আকাশ দেখছিলাম। দুলাভাইকে সাথে নিয়ে আসলে না কেনো আপু?"
মিথিলা রাহির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এরমধ্যেই। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে এখন দুই বোন। মিথিলা কিছু সময় চুপ রইলো। রাহির চোখের দিকে তাকিয়ে কী যেনো বুঝতে চেষ্টা করলো হয়তো।
" পারভেজ অফিসের কাজে ব্যস্ত খুব। রাহি এত কষ্ট পেয়ে কী হবে বোন? যে মানুষটা তোর মূল্য বোঝেনি তার জন্য নিজেকে কষ্টের অনলে জ্বালানো কি বোকামি নয়?"
" আসলে কি আপু আমরা অনেক সময় বুঝি ভুল করছি তবুও নিজেকে সেই ভুল থেকে সরাতে পারিনা। আমি জানি আদ্রিয়ান আমাকে কখনো ভালোবাসেনি,ভালোবাসা এতটা ঠুনকো হতে পারে না। মিহি আমাকে আগেই বুঝিয়েছে এসব। একটু সময় লাগবে শুধু আরকিছুই না। "
" সময় নে সমস্যা নেই। আদ্রিয়ানকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ছিল না? "
" হ্যাঁ কালকেই কুরিয়ার করে দিয়েছি। আশা করি দু-একদিনে পৌঁছে যাবে। "
কথাগুলো বলার সময় আঁখি যুগল ছলছল করছিলো রাহির। মিথিলা বুঝেও কিছু বললো না। আসলেই সময় দরকার, সময় সবকিছু তার আপন গতিতে ঠিক করে দিবে। আর এটা হবেই, আজ যে কারণে খুব কষ্ট হচ্ছে একটা সময় সেই কথা ভেবেই হাসি পাবে। 

দেখতে এক বছর পেরিয়ে গেছে। আদ্রিয়ান আর রাহির ডিভোর্স হয়নি কারণ আদ্রিয়ান শেষমেশ ডিভোর্স পেপারে সাইন করেনি। এরমধ্যে তোশা আদ্রিয়ানের জীবন নরক করে তুলেছে। এমনকি রাহির বাড়িতে গিয়ে তার আর আদ্রিয়ানের সম্পর্কের ব্যাপারে সবকিছু বলে এসেছে। তাতে অবশ্য রাহির একটু কষ্ট হলেও সুবিধা হয়েছে। মানুষ না বুঝে ভুল করলে ক্ষমা করা যায় কিন্তু জেনেশুনে যে বেইমানি করে তার কোনো ক্ষমা নেই। রাহিও ক্ষমা করেনি আদ্রিয়ানকে। গত এক বছরে আদ্রিয়ান তিনবার গিয়েছিল রাহিকে ফিরিয়ে আনতে কিন্তু প্রতিবারই রাহি ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। এমনকি আদ্রিয়ানের দৃষ্টি সীমানার মধ্যেও আসেনি সে। না ঘৃণা করে না আদ্রিয়ানকে কারণ যাকে ভালোবাসা যায় না তাকে ঘৃণা করাও বেমানান। ওই মানুষটা ঘৃণারও অযোগ্য রাহির কাছে। তোশার বলে যাওয়া প্রতিটি কথা দিনে দিনে রাহিকে আরো শক্ত করে তুলেছিলো। আর আদ্রিয়ানকে বারবার ফিরিয়ে দেওয়া তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ। রাহি ইতিমধ্যে পারভেজের অফিসে একটা চাকরি করতে শুরু করেছে। বাড়িতে বসে থাকলে মন মানসিকতা খারাপ লাগবে বলে মিথিলাই রাহিকে চাকরিতে জয়েন করতে বলেছিল। আদ্রিয়ান তোশাকে এখন আর সহ্য করতে না পারলেও রিনা বেগম এতদিনে তোশাকে ছেলের বউ হিসেবে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে গেছেন। মিহির সাথে রিনা বেগমের এ নিয়ে প্রায় কথা কাটাকাটি হয়। এরমধ্যে মিহির গ্রাজুয়েট শেষ হয়ে গেছে। ফলে রিনা বেগম একপ্রকার কোমর বেঁধে নেমেছেন মেয়ের বিয়ে দিবে বলে। অবশ্য এর পিছনে কারণ রয়েছে। এরমধ্যে কয়েকজন পাত্রের ছবি দেখিয়েছে মিহিকে কিন্তু মিহি কারো ছবি না দেখেই বিয়ের জন্য না করে দিয়েছে। 
খাবার টেবিলে বসে আছে আদ্রিয়ান। ইদানীং খাওয়াদাওয়া করতেও অনীহা লাগে তার। মিহি খাবার আদ্রিয়ানকে খেতে দিয়ে নিজেও খেতে বসলো। রিনা বেগম আর সালমান খুরশিদ খেয়েদেয়ে এরমধ্যেই ঘুমানোর উদ্দেশ্যে ঘরে গিয়েছেন। দুই ভাইবোন একসাথে বসে খাচ্ছে অথচ কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। মাঝে মধ্যে পরিস্থিতি এতটা জটিল রূপ ধারণ করে মানুষ পাশাপাশি বসে থেকেও কথা বলতে দ্বিধায় পড়ে যায়। 
" মিহি।"
নীরবতা ভেঙে আদ্রিয়ান ডাকলো মিহিকে। মিহি প্লেটের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো।
" হুম বলো।"
" তোর ভাবির মানে রাহির সাথে কথা হয় তোর?"
" নাহ,প্রথম প্রথম কথা হলেও অনেক মাস হলো কথা হয়নি। কোন মুখে নিজে থেকে কল দিবো বলো তো!"
বোনের প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলার মতো উত্তর আসলেই নেই আদ্রিয়ানের কাছে। মিহি খাবার শেষ না করেই নিজের রুমে চলে গেলো। এরমধ্যেই আদ্রিয়ানের ফোনের স্ক্রিনে তোশার নাম ভেসে উঠেছে। আদ্রিয়ান কয়েকবার কল কেটে দিলেও রিসিভ না করে পারলোনা। কারণ তোশা সব সময় আত্ম**হত্যা করার কথা বলে ব্লাকমেইল করে। 
" কী হয়েছে? বুঝতে পারছিস না আমি বিজি।"
কল রিসিভ করেই রাগী স্বরে বললো আদ্রিয়ান। 
" হ্যাঁ সবকিছুই বুঝি রাহির মতো এখন আমাকেও অসহ্য লাগে তোমার। "
" আজাইরা কথা বলবি না তোশা। তোকে কখনোই আহামরি ভালোবাসতাম না আমি। তুই প্লিজ আমাকে ছেড়ে দে।"
" আমাকে কী তোমার রাহি মনে হয়? আমি আর কয়েকদিন দেখবো। এরমধ্যে যদি কাকির কথামতো আমাকে বিয়ে না করো তাহলে তোমার বাসায় গিয়ে বি*ষ পান করবো।"
আদ্রিয়ানের খুব অসহায় লাগছে। তোশা একা হলে আলাদা বিষয় ছিল কিন্তু সাথে তার মা-ও আছে। মিহিকে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে সরিয়ে তোশাকে ছেলের বউ করে ঘরে তোলাই উনার উদ্দেশ্য। আদ্রিয়ান আরকিছুই বলার সুযোগ দিলো না তোশাকে। কল কেটে দিয়ে প্লেটে হাত ধুয়ে নিজের রুমে গেলো। এই ঘরে এলেও অস্থির লাগে আদ্রিয়ানের। কতশত স্মৃতি দুজনের! 

 ইদানীং বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মুখে না বললেও রাহি চলে যাওয়াতে বড়সড় একটা মানসিক আঘাত পেয়েছেন তিনি। তাই আদ্রিয়ান আগামীকাল ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে সালমান খুরশিদকে।

ইসিজি রুমে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে রুদ্র চৌধুরী। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পরীক্ষা চললো। তারপর চেম্বারে রোগীসহ নিজেও গিয়ে বসলো। ডাক্তারের চেয়ারে বসে আছে রুদ্র আর তার সামনে রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা চেয়ারে বসে আছে আদ্রিয়ান ও তার বাবা। ইসিজি রিপোর্ট নিয়ে চেম্বারে ঢুকলো শরীফ। সবাই চুপ করে আছে। রুদ্র রিপোর্ট দেখলো খানিক সময়। 
" কী দেখছেন ডক্টর? বাবার শরীর ঠিক আছে তো?"
" এই বয়সে যেমন থাকার কথা তার থেকে ভালোই আছেন। তবে অতিরিক্ত চিন্তা করেন উনি,যেটা উনার হার্টের জন্য মোটেও সুখকর নয়।"
" চিন্তা কী এমনি করি বাবা! সরি বাবা বলে ফেললাম, কিছু মনে করবেন না। "
সালমান খুরশিদ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রুদ্র মিষ্টি করে হেসে বললো, 
" আরে না সরি কেনো! আপনি আমার বাবার বয়সী আপনি বরং তুমি করে বলুন আমাকে। আর হ্যাঁ চিন্তা একটু কম করুন। "
" চেষ্টা করবো বাবা। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো।"
" সেইম টু ইউ আঙ্কেল। "
" তাহলে আমরা আসছি ডক্টর।"
" হ্যাঁ দু'টো ঔষধ লিখে দিয়েছি সেগুলো নিয়মিত খাওয়াবেন। "
আদ্রিয়ান বাবাকে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসেছে। নিজেকে নরকের কীটের থেকেও জঘন্য মনে হচ্ছে আদ্রিয়ানের। আজ তার জন্য বাবা এত চিন্তা করেন। কত সুখেই তো ছিল দু'জন! মানুষের কিছু কিছু ভুলের মাশুল সারাজীবন দিতে হয়।

" তাহলে তুই বিয়ে করবি না?"
বসার ঘরে বসে আছেন সালমান খুরশিদ ও রিনা বেগম। মিহি দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। এতদিন ধরে বিয়ের কথা বলেও কোনো লাভ হয়নি। তাই রিনা বেগম আজ বেশ ক্ষেপে গেছেন।
" নাহ মা। আগে মাস্টার্স শেষ হোক তারপর। "
" ততদিনে যদি তোর বাবার কিংবা আমার কিছু হয়ে যায়? আমাদের কী মরার পরেও চিন্তায় রাখবি!"
" মা! এসব কেনো বলছো।"
" তোর বাবাকে ডাক্তার কী বলেছে আদ্রিয়ানের কাছে শুনিসনি? টেনশন কম করতে বলেছেন। আশা করি বাবার কথা ভেবে তোর মতামত বদলাবে।"
বাবার শরীরের কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেছে মিহি। সত্যি তো উনার শরীরের জন্য চিন্তা করা খুব খারাপ প্রভাব ফেলে। মিহি তৎক্ষনাৎ কিছু বললো না। নিঃশব্দে নিজের রুমে চলে গেলো। অস্থির লাগছে খুব, রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে বিছানায় বসলো মিহি। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে শুরু করলো। সে যা করছে সেটা কী ঠিক? অচেনা কোনো এক পুরুষের জন্য নিজের বাবা-মা'কে কষ্ট দেওয়া কী শোভা পায়? নাহ,বাব-মা’র চেয়ে সেই ব্যক্তি মিহির কাছে বেশি নয়। তাছাড়া সারাজীবন খুঁজলেও তাকে পাওয়া অসম্ভব। তাহলে বিয়ে না করে কার জন্য অপেক্ষা করবে সে? তাছাড়া লোকটা তো বিবাহিত হতে পারে! বয়সের কথা না হয় না-ই ভাবলো কিন্তু বউ,বাচ্চা নেই তার গ্যারান্টি কী?



চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন