মনেরও গোপনে (পর্ব ০৮)


#মনেরও_গোপনে 
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া 
#পর্ব_৮ 



এতক্ষণে রহমান চাচার দিকে খেয়াল করেছে রুদ্র।
" উনাদের সামনে আগ বাড়িয়ে বিয়ের কথা বললেন কেনো আপনি? আপনার যদি আরেকটা বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে তো বলুন চাচীকে গিয়ে বলে আসছি।"
"এসব কী বলছো তুমি? তোমার চাচি ভুলেও এসব শুনলে আমার গর্দান নিবে।"
কিছুটা হতাশ কন্ঠে বললেন রহিম চাচা। সারাদিন রুদ্র চেম্বারে যখন থাকে রহিম চাচাও বাড়িতে থাকে। রুদ্রর বাসা থেকে কয়েক মিনিটের পথ উনার বাসা। নিঃসন্তান দম্পতি উনারা,কিন্তু ভালোবাসার কমতি নেই। রুদ্র তো দুপুরে বাসায় ফেরে না তাই একেবারে সন্ধ্যায় আসেন রহমান চাচা। তারপর রান্নাবান্না শুরু করেন,মাঝে মধ্যে রাতে রুদ্রর সাথেই থাকে। রুদ্র অবশ্য কয়েকবার বলেছিল স্ত্রী'সহ তার বাসায় থাকতে কিন্তু রহমান চাচা গরীব হলেও আত্মসম্মান প্রচুর। 
" আহারে! তারমানে চাচী কিছু না বললে আপনি ঠিক আরেকটা বিয়ে করতে রাজি ছিলেন?"
" তা ঠিক আরকি, না মানে না।"
রহমান চাচার মুখখানা দেখে রুদ্র আর নিজের হাসি চেপে রাখতে পারলোনা। রুদ্রকে এরকম হাসতে দেখে রহমান চাচা আরকিছু বললো না। রাতের খাবার রান্না করার জন্য রান্নাঘরে গিয়ে তরকারি কাটতে শুরু করেছেন তিনি। আজকের খাদ্য তালিকায় আছে পুটিমাছ আর বাঁধাকপি। 

রাতের আকাশে একফালি চাঁদ কেমন আলো ছড়িয়ে আছে। চারপাশে তার কতশত তারাদের ভীড়! উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে আজকাল। এই যে এখনও ঠান্ডা বাতাস বইছে। মিহি বরাবরের মতোই চাঁদ দেখার জন্য ছাঁদে এসে উপস্থিত হয়েছে। চাঁদের সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে গেছে মেয়েটা। মাঝে মধ্যে কয়েক টুকরো কালো মেঘেরা ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। মেঘের আড়ালে চাঁদ! হঠাৎ করে রাহির কথা খুব মনে পড়ছে মিহির। মানুষ দূরে চলে যায় কিন্তু তার স্মৃতিগুলো রেখে যায় খুব কাছে। 
" এত রাতে ছাঁদে কী করছিস তুই? "
হঠাৎ ভাইয়ের আগমনে কিছুটা হকচকিয়ে গেলো মিহি। এমন সময় কখনো সে ব্যাতিত অন্য কেউ ছাঁদে আসেনা।
" আমি প্রতিদিন এমন সময় এখানে আসি। তুমি এলে কেনো?"
" ভালো লাগছিল না ঘরে, এজন্য ভাবলাম একটু খোলা আকাশের নিচ থেকে ঘুরে আসি।"
" ভালো করেছো। তোশা আপুর সাথে না-কি মা তোমার বিয়ে দিতে চান?"
" আর বলিস না! জীবনে আমার মাঝে মধ্যে এমন ভুল করে বসি পরে আর সেই ভুল শোধরাবার কোনো পথ খোলা থাকে না। "
" কথায় আছে না কর্মফল? এসবকিছু তোমার কর্মফল। ভাবির মতো স্ত্রী পেয়েও হেলায় হারালে। "
আদ্রিয়ান বোনের কথায় কিছু বলার মতো কথা পেলো না। আজ খুব কষ্ট হচ্ছে তার। বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। মনে হচ্ছে একবুক তৃষ্ণা জমেছে হৃদয়ে। এ তৃষ্ণা রাহির ভালোবাসা পাবার তৃষ্ণা! ভাইয়ের নিরবতা দেখে নিজে থেকেই আবারও কথার খেই ধরলো মিহি।
" আমি তো বেশি দিন থাকবো না বাসায় তুমি বরং ভাবিকে ফেরানোর চেষ্টা করো তার আগেই। বাবা-মা উঠেপড়ে লেগেছেন আমাকে পরের ঘরে পাঠানোর জন্য। "
বোনের কন্ঠে স্পষ্ট অভিমানী সুর খেয়াল করলো আদ্রিয়ান। 
" বোকা মেয়ে বিয়ে তো করতেই হবে তাই না? আজকেও গিয়েছিলাম রাহির অফিসের গেটের সামনে। ও দেখেও আমার জন্য একটু দাঁড়ালো না মিহি।" 
কথাগুলো বলার সময় আদ্রিয়ানের গলা কেমন ভারী হয়ে এসেছে। মিহি এবার বেশ আগ্রহের সহিত ভাইয়ের দিকে আরো মনোযোগ দিলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার আদ্রিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো নোনাজলে চিকচিক করছে গাল। ভাগ্যিস জোছনার আলো খুব প্রখর নয়তো ভাবির জন্য ভাইয়ের অশ্রু বিসর্জন দেওয়ার বিষয়টা দেখতো না সে। মিহি ভাইয়ের দু'হাত ধরলো।
" ভাইয়া তুমি যতই অপরাধ করো না কেনো আমি তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। চোখের পানি মুছে ফেলো। "
আদ্রিয়ান নিঃশব্দে নিজের চোখের পানি মুছে ফের বোনের হাতে হাত রাখলো। বোন হলো মায়ের মতো, তারকাছে সবকিছু নিরদ্বিধায় বলা যায়। 
" আমি চেষ্টা করবো মিহি। যতটা অন্যায় করেছি রাহির সাথে তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করবো। কিন্তু তোশার থেকে রেহাই চাই আমি। ঝোঁকের বশে তোশাকে লাই দিয়ে মাথায় তুলে যে কতটা ভুল করেছি সেটা এখন হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি। "
" কিন্তু ভাইয়া তোশা আপু একা তো নয় সাথেও মা-ও আছে। মা'কে কীভাবে বোঝাবো বলো তো? "
" সবকিছু আমার জন্য। আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই বোন। আজ বেঁচে থেকেও আমি প্রতি দিন, প্রতি মুহুর্তে ম*রে যাচ্ছি। "
" এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। কীভাবে ভাবির মন জয় করবে সেটা ভাবো বুঝলে? একবার ভাবি চলে এলে তোশা এমনি আউট হয়ে যাবে। "
" ঠিক আছে মিহি। ধন্যবাদ বোন,একটু হালকা লাগছে এখন। "
" ধন্যবাদ লাগবে না, পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করো। কাল আইসক্রিম আর চকলেট খাবো তারপর তোমার জন্য দোয়া করে দিবো ওকে।"
মিহির কথা শেষ হতেই দু'ভাই বোন একসাথে হেসে উঠে। আদ্রিয়ান মিহিকে টাকা দিয়ে দেয়। আসলে ছোটো থেকেই মিহি আদ্রিয়ানের কাছে এরকম চকলেট আর আইসক্রিম কেনার টাকা চেয়ে নিতো। কিন্তু বড়ো হওয়ার পর আজ আবারও টাকা চাওয়াতে দুজনেই শৈশবের সুখকর স্মৃতি রোমন্থন করলো।

দেখতে দেখতে কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে। এরমধ্যে রিনা বেগম তার নিজের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে মিহির। ছেলে ব্যবসায়ী, বাবামায়ের একমাত্র সন্তান। টাকাপয়সার কোনো অভাব নেই তাদের। একবার নিজের পছন্দের ছেলের কাছে গিয়ে খালি হাতে ফিরেছেন বলে সালমান খুরশিদ নিজের স্ত্রীকেই মেয়ের জন্য ছেলে দেখতে বলেছিলেন। তাই তিনিও সেই মতো কাজ করেছেন। মিহিকে একবার ছবি দেখাতে গিয়েছিলেন রিনা বেগম কিন্তু মিহি ছবি না দেখেই হ্যাঁ বলে দিয়েছে। আদ্রিয়ান বেশ বুঝতে পারছে মিহির মন অন্য কোথাও আছে। তাই মনে মনে ভেবেছে মিহির সাথে সরাসরি কথা বলবে। কিন্তু সেটা একান্ত নিরিবিলিতে। 

ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ঘাসের উপর বসে আছে মিহি,অহনা। এরমধ্যে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে মিহি। অহনার সাথে সবকিছুই শেয়ার করে মিহি। বিয়ের কথা শুনে অহনা চুপ করে আছে। ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছে না। যদি কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক থাকতো কিংবা সেই ছেলেটাকে যদি চোখেও দেখতো তবুও না হয় তার কথা বলা যেতো বাসায়। কিন্তু এরকম পাগলামির কথা কে শুনবে? আর যার কোনো খোঁজ নেই তার জন্য অপেক্ষা করা তো আসলেই বোকামি ছাড়া কিছু না। কিন্তু মনটা এমন কেনো? কারো সামান্য স্পর্শ কিংবা সাহায্যেও তার প্রতি ভালোলাগা সৃষ্টি হতে হবে! 
" মিহি তুই যা ঠিক করেছিস তাই কর। তবে হ্যাঁ মনের মধ্যে অন্য কাউকে আগলে রেখে আরেকটা লোকের সাথে কীভাবে সংসার করবি!"
" তবুও সংসার করতে হবে অহনা। সংসার করবো,তার শয্যাসঙ্গী হবো,তার বাচ্চার মা-ও হবো অথচ আমার মনটা থাকবে অন্য কোথাও। "
" এরকম করে বলিস না। বড্ড খারাপ লাগছে।"
" আরে বাদ দে,তা তোর খবর বল। আসমান ভাই দেশে ফিরবে কবে?"
" সামনের বছর ফেরার কথা বলেছে। তারপর বিয়ের কথা বলবে বাসায়। "
" দোয়া করি আল্লাহ তোর মনের মানুষের সাথে মিল করে দিক।"
" আমিও দোয়া করি সব পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো ধৈর্য যেনো তোর হয়।"

দুই বান্ধবীর কথা শেষ হওয়ার আগেই হুট করেই বৃষ্টি শুরু হলো। নভেম্বর রেইন! অসময়ে সবকিছুই খারাপ লাগে অহনার। তাই দৌড়ে ভার্সিটির ভিতরে ঢুকলো অহনা। কিন্তু মিহি কেবল উঠে দাঁড়ালো কিন্তু কোথাও গেলো না। অহনা ইশারায় বারকয়েক ডাকলো তাকে। কিন্তু মিহি সেদিকে খেয়াল করলো না। বৃষ্টির মধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। গুনগুনিয়ে গান ধরলো মিহি, 
আজকেও বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরবে বলে সিন্ধান্ত নিয়েছে মিহি। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে অটোতে চড়ে বসলো। সেদিনের মতোই অর্ধেক গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলো মিহি। সেদিনের ঘটনাটা কী আরেকবার পুনরাবৃত্তি হতে পারে না? কিন্তু না তেমন কিছু ঘটলো না সারা রাস্তায়। ভিজতে ভিজতে বাসায় গিয়ে পৌঁছুলো মিহি। দরজা খুলে মিহিকে ভেজা দেখে বেশ চটে গেলেন রিনা বেগম। 
" তোকে কতবার বলেছি অসময়ে যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছে ছাতা নিয়ে বের হ। কিন্তু না আমার কথাই কানে যায় না তোর। "
মিহি মায়ের কথায় কোনো জবাব দিলো না শুধু পাশ কাটিয়ে বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো। তারপর সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। রিনা বেগম আরো কিছু সময় একা একাই বকাবকি করলেন। যার সারমর্ম ছিল সামনে বিয়ে এখন অসুস্থ হয়ে চেহারা নষ্ট করলে কী ভালো দেখায়?

জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে শহরের ব্যস্ত সড়কের দিকে তাকিয়ে আছে রুদ্র। বৃষ্টি হলে না ছুঁয়ে পারে না সে। মনে হয় কোনো সম্মোহনী শক্তি তাকে বৃষ্টির দিকে অনবরত টানে। আজকে বৃষ্টির কারণে রোগী কম এসেছে অন্য দিনের তুলনায়। তাছাড়া দুপুর হয়ে গেছে এখন খাওয়ার সময় বটে। শরীফ এরমধ্যেই দুজনের খাবার নিয়ে চেম্বারে এসেছে। 
" ভাইয়া আসেন খেয়ে নিন।"
" তুমি খাও আমি একটু পর খাবো। "
" ভাইয়া আপনি কী কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছেন? "
শরীফ রুদ্রর সাথে থাকতে থাকতে ভালোই বুঝতে পারে তাকে। রুদ্রকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসে তাই কখনোই কোনো কিছু লুকায় না রুদ্র। জানালা পাশ থেকে সরে এসে নিজের চেয়ারে বসে টিস্যু দিয়ে হাত মুছে শরীফের দিকে মনোযোগ দিলো রুদ্র। শরীফও রুদ্রর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। 
" আসলে শরীফ গত মাসে যে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন না? সালমান খুরশিদ নামে,সাথে উনার ছেলে ছিলো?"
শরীফ কিয়ৎক্ষণ ভেবে মনে পড়ার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললো,
" হ্যাঁ মনে পড়েছে। ভদ্রলোক খুব ভালো, দেখেই বোঝা যায়। "
" হ্যাঁ উনি দিন পনেরো আগে হঠাৎ একদিন রাতে আমার বাসায় একটা অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন।"
" আমার কাছ থেকেই তো বাসার ঠিকানা নিয়েছিলেন উনার ছেলে। তারপর বলো ভাইয়া।"
" সাথে উনার স্ত্রীও ছিলেন বুঝলে। উনি উনার একমাত্র মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছিলেন। আমি সেখানেই কৌশলে না বলে দিয়েছিলাম।"
" তাহলে কী হয়েছে আবার? "
" উনি আমার অসম্মতির কথা শুনে সেখানে বসেই একটু অসুস্থ ফিল করেছিলেন। বুঝতে পারছিস কতটা আশাবাদী ছিলেন?"
" আসলেই খারাপ লাগছে। কিন্তু এরকম হুটহাট কী বিয়ে ঠিক হয়!"
" সেটাই তো। তাছাড়া তুমি তো জানোই বিয়ে নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। "
" জানি বলেই বলছি মানুষ একা বাঁচতে পারে না। শেষ বয়সে পাশে থাকার জন্য হলেও একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ভাইয়া। "
" কিন্তু আমি তো অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবোনা শরীফ।"
" সংসার করতে গেলে ভালোবাসা আপনাআপনি চলে আসবে। ভালোবেসে বিয়ে করা জরুরি নয়,বিয়ের পরও ভালোবাসা যায়। "
" ও আচ্ছা! তা তোমার কী বিয়ের শখ হলো না-কি? "
" কী যে বলো ভাইয়া! বড়ো ভাই এখনও বিয়ে করেনি,আমি কীভাবে করবো।"
" আচ্ছা ভদ্রলোকের নাম আর ফোন নম্বর আছে না?"
" হ্যাঁ সব রোগীদের থাকে, উনারও আছে। খুঁজে বের করবো?"
" হ্যাঁ দেখো তো একবার। ভাবছি সন্ধ্যায় উনার বাসায় যাবো। ভদ্রলোক যদি এখনো রাজি থাকেন তাহলে উনার মেয়েকে মেয়েকে জানাবো, আমি তাকে বিয়ে করলেও তাকে ভালোবাসতে পারবোনা। এসব শুনেও যদি সে রাজি হয় তাহলে বিয়ে করবো তাকে। "
এরমধ্যে শরীফ রোগীদের তথ্যের খাতা থেকে খুঁজে সালমান খুরশিদের ফোন নম্বর বের করেছেন। ভালো কথা হচ্ছে সাথে উনার বাড়ির ঠিকানাও আছে!



চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন