মনেরও গোপনে (পর্ব ১০)


#মনেরও_গোপনে 
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া 
#পর্ব_১০ 



" ঠিক আছে তাহলে বাবাকে গিয়ে বলুন আমরা রাজি। বিয়ে যখন করতেই হবে তখন না বলে লাভ নেই। আপনাকে না হলেও অন্য কাউকে করতেই হবে, তারচে আপনার একাকীত্বের বন্ধু হবো না হয়।"
" আচ্ছা মিহির দানা। "
" আমি মিহি,শুধু মিহি। কোনো দানাপানি নয়।"
মিহি মুখ ভেংচি কেটে বললো রুদ্রকে। বিনিময়ে রুদ্রও এক টুকরো মিষ্টি হাসি উপহার দিলো।

দু'জন কথাবার্তা শেষে সালমান খুরশিদকে তাদের মতামত জানিয়েছে। মিহি দাঁড়িয়ে আছে একপাশে আর রুদ্র সালমান খুরশিদের পাশের সোফায় বসেছে। রিনা বেগম স্বামীর আদেশে মিষ্টি আনতে রান্নাঘরে গিয়েছেন। 
" তাহলে তোমার কোনো আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে এসো, আনুষ্ঠানিকভাবে দিন-তারিখ ঠিক করবো।"
" আসলে আমার তেমন কোনো আত্মীয় নেই আঙ্কেল। আপনারা আমার বাসাতেই না হয় সবাইকে নিয়ে গেলেন তারপর কথাবার্তা বলবেন। "
" ঠিক আছে বাবা।"
" আজকে আসছি আঙ্কেল। মিহির কাছে ফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছি আপনি সুবিধামতো কল করে নিবেন।"
" সাবধানে যেও। "
রুদ্র সালমান খুরশিদকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। কেনো জানি লোকটার প্রতি কেমন মায়া কাজ করছে মিহির। হয়তো পৃথিবীতে তার কেউ নেই বলেই এই মায়া!

গভীর রাত। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে রাত ঠিক কতটা গভীর হয়েছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করলো রাহি। তিনটে বিশ বেজেছে, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। ইদানীং মনটা কোনো কথা শুনতে চায় না। আদ্রিয়ানকে দেখলে খুব কষ্ট হয়। হবেই না কেনো? আদ্রিয়ানের মতো তো রাহি নয়। রাহির প্রথম ও শেষ ভালোবাসা আদ্রিয়ান। গতকাল রাহির দুলাভাই পারভেজ রাহিকে আদ্রিয়ানের কাছে থেকে ডিভোর্স পেপার চাইতে বলেছেন। এভাবে অহেতুক সম্পর্ক ঝুলিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না তার মতে। কিন্তু রাহি কিছু বলেনি তখন। মনটা বড্ড ছটফট করছে। বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর বদলে শুধু এপাশ-ওপাশ করছে । ভাবনারা যেনো কিছুতেই শেষ হবার নয়। কিছুক্ষণ পরে শোয়া থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো রাহি। ঠান্ডা বাতাস বইছে বাইরে। বিছানার পাশ থেকে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ফের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো রাহি। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে পুরো শহর। কোথাও কেউ নেই। মাঝে মধ্যে নেড়ি কুকুরের আওয়াজ ভেসে আসছে দূরে কোথাও থেকে। হঠাৎ কারো গলার স্বরে কেঁপে উঠলো রাহি। কেউ চাপা স্বরে গান গাইছে। সামনের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে আছে এক ছায়ামানব। কিন্তু তার গলার স্বর চিরপরিচিত রাহির। কান খাঁড়া করে ছায়ামানবের কন্ঠস্বর আরো ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করলো সে। 

 পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।

ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।

আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।

মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।

মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়

 বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।

হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়

আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়।

গান থেমেছে, ল্যাম্পপোস্টের নিচ থেকেও যে ছায়ামানব রাহির দিকে দৃষ্টিপাত করেছে সেটা রাহির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে জানান দিচ্ছে। আদ্রিয়ান! এই শীতের রাতে রাস্তায় কেনো বসে আছে সে? তা-ও আবার রাহির বাসার সামনে! অনুভূতি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে রাহির। এই মুহুর্তে সব প্রতিজ্ঞা, সব অবহেলা, সকল অভিমান যেনো ভুলতে বসেছে সে। ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে একবার বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করতে। দোটানায় পড়ে বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলো। রাহি আলমারি থেকে পুরনো সিম বের করে ফোনে ঢুকিয়ে আদ্রিয়ানের নম্বরে কল দিলো। রিং হতেই আদ্রিয়ান রিসিভ করেছে। 
" হ্যালো রাহি!"
কতদিন পরে! রাহি ফোনটা বুকে আঁকড়ে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। অন্যদিকে আদ্রিয়ান পাগলের মতো হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে । কিয়ৎক্ষণ বাদেই রাহি নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় ফোন কানে ধরলো। 
" এত রাতে বাড়ির সামনে কেনো এসেছো তুমি? "
" কেমন আছো রাহি?"
" প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন পছন্দ না। "
" বদলে গেছো অনেক। "
" বদলে দিয়েছো নিজেই।"
" ক্ষমা করা যায় না একবার? "
" বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ক্ষমা হয় না। "
আদ্রিয়ান চুপ করে গেলো। কী করবে সে? বোনকে যে কথা দিয়েছে তার বিয়েতে ভাবিকে উপস্থিত করবেই। 
" একবার বাইরে আসবে প্লিজ! "
" না।"
" কথা দিচ্ছি আর কখনো এভাবে এসে বিব্রত করবোনা তোমাকে। "
" ঠিক আছে, আসছি।"
আদ্রিয়ান খুশিতে গদগদ হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো রাহির জন্য। ঠিক পাঁচ মিনিট পরে রাহি এসে দাঁড়ালো আদ্রিয়ানের সামনে। অথচ বাসা থেকে এখানে আসতে নয় - দশ মিনিট সময় লাগার কথা! আদ্রিয়ান মুগ্ধ নয়নে কিছু সময় দেখে নিলো রাহিকে। রাহিও নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা মানুষের দিকে। কিন্তু রাহি কিছু বুঝে উঠার আগেই আদ্রিয়ান হুট করে বক্ষে জড়িয়ে নিলো তাকে। রাহি তড়িৎ গতিতে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো একবার। কিন্তু আদ্রিয়ানের বাহুডোর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হলো না। আদ্রিয়ান রাহির মাথায় হাত বুলিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
" আগে বলো ক্ষমা করেছো নয়তো শেষ নিঃশ্বাস অবধি এমন করে জড়িয়ে রাখবো।"
রাহি কিছু বললো না, কেবল হুহু করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। এতদিনের রাগ,অভিমান, সব যেনো মিইয়ে গেলো ভালোবাসার মানুষের স্পর্শে। অবশ্য আদ্রিয়ানকে কম অবহেলা করেনি এতদিন। আদ্রিয়ানও বারবার অবহেলিত হয়ে বুঝতে পেরেছে প্রিয় মানুষের নিকট থেকে অবহেলা পেলে ঠিক কতটা পুড়ে যায় হৃদয়। রাহির আশকারা পেয়ে আদ্রিয়ান তার ললাট মাঝে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দিলো। মাথায় হাত বুলানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এতক্ষণে রাহির কান্নার বেগ কমেছে। আদ্রিয়ান আঁখি যুগল মুছে দিলো তার। ল্যাম্পপোস্টের বাতির আলোতে দু'জন দু'জনার মুখাবয়ব দেখছে। 
" তুমি খুব খারাপ লোক একটা। তুমি খুব খারাপ আদ্রিয়ান। "
" আর একটা সুযোগ দিয়ে দেখো এই খারাপ মানুষটা আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবে না। "
" আমি একা পারবোনা সেটা আদ্রিয়ান। বাসায় এসে কথা বলে দেখো, উনারা যদি তোমাকে ক্ষমা করেন তাহলে আমি যাবো।"
" বেশ তাহলে কালকেই আমি আসবো। আব্বুও আসবেন, তোমার চিন্তায় উনি অসুস্থ হয়ে গেছেন।"
" আমার কিছু করার ছিল না, তুমি বাধ্য করেছিলে আমাকে। মিহির না-কি বিয়ের কথা চলছে? "
" হ্যাঁ আজকেই ঠিক হলো। আগের সম্মন্ধ বাতিল,আব্বুর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে হবে। "
" বাহ। "
" মিহির বিয়ের আগেই তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো।"
" দেখা যাক।"
আদ্রিয়ান মুচকি হেসে রাহিকে বিদায় জানিয়ে বাসায় গেলো। 
পরেরদিন সকালে যথারীতি সালমান খুরশিদকে নিয়ে আদ্রিয়ান রাহিদের বাসায় উপস্থিত হয়েছে। রাহির বাবা-মা প্রথম প্রথম দ্বিমত পোষণ করলেও শেষমেশ রাহিকে ফিরিয়ে দেয় আদ্রিয়ান ও সালমান খুরশিদের সাথে। দেড় বছর পর রাহি নিজের সংসারে পা রেখেছে আজ। রিনা বেগম ছেলের এরকম কর্মকাণ্ডে বিশেষ খুশি হননি। অবশ্য শ্বাশুড়ি যে তাকে দেখে খুশি হবেন না এটা আগেই থেকে জানতো রাহি। কিন্তু মিহি রাহির আসার অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। দরজার কলিংবেলের শব্দ পেতেই নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এসেছে মিহি।
" কি খবর মিহি কেমন আছো? অনেক দিন পর দেখলাম তোমাকে। "
" আলহামদুলিল্লাহ ভাবি। কালকে সন্ধ্যায় যখন কল দিয়েছিলে তখনই ভেবেছিলাম এরকম কিছু হবে। আমি খুব খুব খুশি হয়েছি ভাবি। "
" আমিও খুশি হয়েছি তোমার বিয়ের খবরটা শুনে।"
" হ্যাঁ এবার কোমর বেঁধে বিয়ের কাজ শুরু করো।"

মিহি হেসে বললো রাহিকে সাথে রাহি ও আদ্রিয়ানও হাসলো। সালমান খুরশিদ বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে পারেননা তাই বাসায় ফেরা মাত্রই নিজের রুমে চলে গেছেন। রিনা বেগম রান্নাঘরে কাজ করছেন, সকালের নাস্তা তৈরি হয়নি এখনো। 
" বাহ আমাকে রেখেই সব আনন্দ করছো আদ্রিয়ান?"
দরজা খোলা ছিল, হঠাৎ তোশার আগমনে কিঞ্চিৎ অবাক হলো সবাই। মিহির তো রাগ হতে শুরু করেছে। সম্পর্কে চাচাতো বোন হলেও মিহি তোশাকে সহ্য করতে পারে না একদম। মেয়েটা বরাবরই তার কাছে কেমন গায়েপড়া স্বভাবের। রাহির ভিতরে কী যেনো হলো হঠাৎ। বাসায় আসা মাত্রই এরকম কিছু ঘটবে আশা করেনি মেয়েটা। তোশার গলা শুনতেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রিনা বেগম। আদ্রিয়ান রেগে দাঁত খিঁচিয়ে বললো, 
" তুই! তুই সকাল সকাল এখানে কী করতে এসেছিস?"
" আমি বলেছি ওকে আসতে। "
রিনা বেগম ভাবলেশহীনভাবে বললেন কথাটা। আদ্রিয়ান অবাক হয়েছে মায়ের আচরণে। আসলেই কী উনি আদ্রিয়ানের আপন কেউ! রাহি মোটেও অবাক হয়নি কিন্তু খারাপ লাগছে। 
" মা তুমি? কিন্তু কেনো! তোমার কাছে আমার সুখ বড়ো না-কি তোশার খামখেয়ালি? "



চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন