মনেরও গোপনে (পর্ব ১১)


#মনেরও_গোপনে 
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া 
#পর্ব_১১ 



আদ্রিয়ান অবাক হয়েছে মায়ের আচরণে। আসলেই কী উনি আদ্রিয়ানের আপন কেউ! রাহি মোটেও অবাক হয়নি কিন্তু খারাপ লাগছে। 
" মা তুমি? কিন্তু কেনো! তোমার কাছে আমার সুখ বড়ো না-কি তোশার খামখেয়ালি? "
" অবশ্যই তোর সুখ আগে। কিন্তু তুই নিজের ভালো নিজে বুঝিস? "
" মা প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো আমি রাহির সাথে থাকতে চাই। মানছি মাঝখানে আমি ভুল করেছিলাম। কিন্তু সবারই তো ভুল হয় তাই না?"
" আদ্রিয়ান আমার সাথে সম্পর্ক থাকাটা এখন ভুল হয়ে গেছে? "
" তুই চুপ কর তোশা,আমি মায়ের সাথে কথা বলছি।"
এতক্ষণে কথা কাটাকাটির আওয়াজে সালমান খুরশিদ আবারও বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। তোশাকে দেখেই ঝামেলার কেন্দ্রবিন্দু আঁচ করতে পেরেছেন তিনি। আর স্ত্রী'র আচরণও তার অজানা নয়। গম্ভীর মুখে স্ত্রী'র সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন সালমান খুরশিদ। রাহির খুব খারাপ লাগছে এসব। অশান্তি যেনো তার জীবন থেকে সরছে না কিছুতেই!
" রিনা তোমাকে স্পষ্ট একটা কথা জানিয়ে দিচ্ছি আজ,আমার কাছে আমার ছেলেমেয়েদের সুখ আগে তারপর তুমি। তাই সেই সুখের পথে যদি তুমি কোনো প্রকার বাঁধা সৃষ্টি করো তাহলে তোমাকে ছাড় দিবো না আমি। শেষ বয়সে এসে বিচ্ছেদ সহ্য হবে তো তোমার?"
মিহির বাবার কথায় সবাই অবাক হয়েছে। বিশেষ করে রিনা বেগম। এতো কঠিন একটা কথা তিনি বলবেন কেউ ভাবেননি। তোশা মনে মনে বেশ রেগে গেছে। রিনা বেগম ভয়ে চুপসে গেছেন ইতিমধ্যেই। স্বামীকে হারানোর কথা ভাবতেও পারেননা তিনি।

" চাচা আমি কী তোমার কাছে কেউ না? আমার কথা একটুও ভাববে না!"
মেকি কান্নায় মন ভোলাতে চাইলো তোশা। সালমান খুরশিদ এমনিতেও যথেষ্ট স্নেহ করেন তোশাকে। তাই সেই সুযোগ নেওয়ার পূর্ণ চেষ্টা চালাচ্ছে তোশা। সালমান খুরশিদ মুচকি হেসে তোশার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিলেন। তোশার ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি ফুটে উঠেছে। সম্ভাব্য বিজয়ের আভাস মিলেছে ভেবে আনন্দে মন উড়ু উড়ু করছে তার।
" শোন তোশা,তোকে এতটা স্নেহ করি বলেই এতদিন কিছু বলিনি। কিন্তু এখন যদি না বলি ওই মেয়েটার প্রতি অবিচার করা হবে। এবার তোর বাবা-মাকে বলবো একটা ভালো পাত্র দেখে তোকে বিয়ে দিয়ে দিতে। আশা করি আমাকে কঠিন হতে বাধ্য করবি না। এখন চলে যা,পরের বার জামাই নিয়ে আসিস।"
নিজের চাচার কাছ থেকে এসব কথা মোটেও আশা করেনি তোশা। ফলে রাগে কটমট করতে করতে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। 
" ভাবি এবার রুমে যাও তোমরা। আপদ বিদায় হলো অবশেষে। আর মা তুমিও এবার বোঝো কোনটা আসল হিরা আর কোনটা নকল।"
মিহি মায়ের উপর বেশ রেগে গেছে। তাই কথা শেষ করেই নিজের রুমে হনহনিয়ে চলে গেলো। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন আদ্রিয়ানের মা। আদ্রিয়ান রাহির হাত ধরে রুমের দিকে গেলো। বসার ঘরে এখন শুধু আদ্রিয়ানের বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছেন।
" দাঁড়িয়ে না থেকে নাস্তা দাও টেবিলে। বেলা তো কম হলো না! দুপুর থেকে তো রাহি রান্না করবে তোমার ছুটি। "
রিনা বেগম মুচকি হাসলেন স্বামীর কথায়। আসলেই তো এই মেয়েটা না থাকলে সব কাজ তাকেই করতে হতো। মিহি অবশ্য মাঝে মধ্যে সাহায্য করতো কিন্তু সেটা রাহির শূণ্যতা পূর্ণ করতে পারতোনা। ডাইনিং টেবিলে নাস্তা পরিবেশন করেছেন রিনা বেগম। সালমান খুরশিদ এরমধ্যেই খেতে বসে গেছেন। মিহিকে রিনা বেগম খেতে ডাকলেও আসেনি খেতে। মায়ের উপর বড্ড রাগ করেছে মেয়েটা। আদ্রিয়ান অবশ্য রাহিকে নিয়ে এসেছে। শ্বাশুড়িকে খেতে বসিয়ে দিয়ে নিজে সবাইকে নাস্তা দিচ্ছে রাহি। রিনা বেগম চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস নিলেন। সব কুটিলতা বাদ দিয়ে সবাইকে আঁকড়ে ভালো থাকার চেষ্টা করবেন ভেবে মনে মনে প্রতিজ্ঞ হন তিনি।
" রাহি!"
" হ্যাঁ মা বলুন,কিছু লাগবে? "
" না, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার কারণেই হয়তো আদ্রিয়ান তোমার প্রতি অবিচার করার সাহস পেয়েছিল। আমি তো প্রথম থেকেই তোমাকে অপছন্দ করতাম। "
" এখন কী পছন্দ করেন তাহলে?"
রাহি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হেসে বললো। রিনা বেগমও হাসলেন। 
" একেবারে পছন্দ না করলেও এখন থেকে আর তোমাকে কষ্ট দিবো না। "
" যাক আলহামদুলিল্লাহ। "

দেখতে দেখতে মিহির বিয়ের দিন চলে এসেছে। এরমধ্যে রুদ্রর বাসায় গিয়ে আংটি বদল সেরেছে মিহির পরিবার। ওখানেই ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলো রুদ্র। আজ মিহি ও রুদ্রর বিয়ে। বেশ ধুমধামে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলেন সালমান খুরশিদ কিন্তু মেয়ের কথায় ঘরোয়া ভাবেই বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। মিহি অযথা টাকাপয়সা খরচ করা মোটেও পছন্দ করে না। তার মতে যে টাকাপয়সা বিয়েতে খরচা হবে সেগুলো ভবিষ্যতের জন্য জমা করে রাখলে ভালো হবে। তাই সেটাই করেছেন সালমান খুরশিদ। 
রাত আটটা বাজতে বাকি বিশ মিনিট। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফুল দিয়ে সাজানো সুন্দর চার চাকার গাড়ি। গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসে আছে শরীফ। শরীফ শুধু রুদ্রর চেম্বারের কাজ করে না সাথে ড্রাইভারের কাজটাও করে। রুদ্র গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মিহি রাহিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে অবিরত। রিনা বেগম বসার ঘরে সোফায় বসে কাঁদছেন। মেয়ের সামনে ছিলেন এতক্ষণ কিন্তু মাত্রাধিক কান্নাকাটির জন্য ভিতরে দিয়ে এসেছে আদ্রিয়ান। সালমান খুরশিদ দাঁড়িয়ে আছেন রুদ্রর পাশেই।
" বাবা একটি মেয়ে আমার, দেখেশুনে রেখো। কোনো ভুলত্রুটি করলে আমাকে জানিও।"
" আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আঙেল। আমি আগলে রাখবো আপনার রাজকন্যাকে।"
রুদ্র সালমান খুরশিদের হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করলো। 
" এভাবে কাঁদে না মিহি। দেখো আমিও তো বাবার বাড়ি ছেড়ে তোমাদের সাথে থাকছি,এটাই নিয়ম। তাছাড়া তোমার বাসায় তো তুমি আর তোমার বর শুধু। ইচ্ছে করলেই চলে আসতে পারবে।"
মিহি নিশ্চুপ চোখের পানি ফেললো আরো কিছুক্ষণ। তারপর রুদ্রর সাথে গাড়িতে বসে নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। পেছনে ফেলে এলো চিরচেনা জায়গা,মানুষজন সাথে কতশত স্মৃতি! 
গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। এমনিতে রুদ্র বাসা কাছেই তবে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম থাকলে একটু বেশি সময় লাগে। তবে আজ রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। মিহি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। রুদ্র মাঝে মধ্যে ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মিহিকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেয়েটা কী এখনও কাঁদছে! 
" এই যে মিহির দানা! তুমি কি এখনও কাঁদছো? "
আকস্মিক রুদ্রর এরকম প্রশ্নে বিরক্ত হলো মিহি। চোখমুখ কুঁচকে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বললো,
" মিহির দানাপানি নই আমি শুধু মিহি। আর কাঁদবো কেনো আমি? "
" এমা! কিছুক্ষণ আগেই তো ভেউভেউ করে কাঁদলে সবার সামনে। "
রুদ্র মজা করছে মিহির সাথে যাতে কিছুটা হলেও মনটা ভালো হয়ে যায় তার। কিন্তু মিহি যথেষ্ট সিরিয়াস হয়ে আছে। এমনিতেই বাসার সবার জন্য মন কেমন করছে।
" আপনি তো মহা বজ্জাত লোক! আপনাকে তো অন্য রকম ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি... "
" এখন দেখছে খুব খারাপ লোক তাই না? "
হঠাৎ কিছু একটা ভাবতেই মিহির চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেলো।
" ওয়েট ওয়েট আপনি না একটু আগে পর্যন্ত আমাকে আপনি বলে সম্মোধন করেছিলেন? তাহলে এখন হঠাৎ তুমি করে বলছেন কেনো!"
" এখন তো তুমি আমার স্ত্রী, আর এমনিতেই তুমি বয়সেও যথেষ্ট ছোটো। তাই আর আপনি করে ডাকবো না।"
মিহি হুট করে একেবারে জানালার পাশে চেপে বসলো যাতে রুদ্রর শরীরের সাথে একটুও ছোঁয়া না লাগে। বিষয়টা বুঝতে পেরে রুদ্র মুখ টিপে মিটিমিটি হাসছে। 
" শুনুন আপনার কিন্তু বলেছিলেন আপনার একটা অতীত আছে এবং তাকেই ভালোবাসেন আপনার, এখন যদি আমাকে পেয়ে সেসব ভুলে উল্টোপাল্টা কিছু ভেবে থাকেন মোটেও ভালো হবে না। "
" তা কী হবে শুনি?"
" গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে প্রাণ দিয়ে দিবো আমি। "
রুদ্র মিহির হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
" এখন পারলে ঝাঁপিয়ে দেখাও। আর হ্যাঁ গাড়ি থেকে বাইরে পড়লে মরবে বলে মনে হয় না। তারচেয়ে বাসায় চলো তারপর অন্য কোনো উপায় দেখা যাবে। তবে তোমার প্রতি শুধু বন্ধু হিসেবে খেয়াল রাখছি অন্য কিছু না হুহ্। "
মিহি কিছু বলার আগেই রুদ্র মিহির হাত ছেড়ে গাড়ির দরজা লক করে দিলো। রুদ্রর শেষ কথাটায় কিছুটা ভরসা পেয়েছে সে। রুদ্র হয়তো সত্যি বন্ধুর মতোই আচরণ করছে কিন্তু মিহির মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে বলে সব অন্যরকম লাগছে। ভাই আর ভাবির কথোপকথন শুনে এতক্ষণ নিঃশব্দে হাসছিলো শরীফ। বাসার সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করিয়ে শরীফ হেসে বললো, 
" বাকি কথা বাসায় গিয়ে বলবেন ভাবি,আমরা এসে গেছি।"
" ওহ এসে গেছি! এতটুকু সময়ে নিজের বাড়ির রাস্তা ভুলে গেছি কিছুদিন এই মেয়ের সাথে থাকলে তো পাগল হয়ে যাবো।"
মিহি চোখ পাকিয়ে তাকালো রুদ্রর দিকে। রুদ্র হাসছে তখনও। শরীফ গাড়ি থেকে নেমে দুপাশের দরজা খুলে দিয়েছে। রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে মিহিকে নামানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মিহি রুদ্রর হাত না ধরে একা একা নামলো।
" ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব।"
" স্বাগত মিহির দানা। "
" আবারও! "



চলবে...........….................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন