চাঁদ বিহীন;মেঘহীন আঁধারে আসমানটা মাথার ওপরে। জমিনে সবুজ শীতল ঘাস। চারদিকে অহরহ ফুলের লালিত্য। বাগানে দাঁড়িয়ে বাল্বের সাদা আলোতে নিজের গম্ভীরমুখ প্রদর্শন করে–মোস্তফা সাহেব থমথমে গলায় ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,
'বাবা আমার বসুন একটুখানি। সুখ-দুঃখের আলাপ করি।'
তার কাঠিন্যতা তন্ময় দেখল না। অবুঝের মতন শুধু মাথা দোলাল। একজন ভদ্রসভ্য সন্তানের ন্যায় পার্শ্ববর্তী চেয়ারে বসল। নয়নযুগলের দৃষ্টি অদূরে নিক্ষেপ করা। ছেলের মুখপানে কড়া দৃষ্টি ফেলে;মোস্তফা সাহেব অসন্তোষ গলায় শুধালেন,
'কিছু বলার নেই?'
তন্ময় নির্বোধ সাজল। বাবার চোখে চোখ রেখে– অপরিপক্ব নাটকীয়তার ভাণ ধরে বলল,
'মস্তিষ্ক আমার অসচল না হলে, যতটুকু মনে আছে আমি তোমাকে ডেকে আনিনি। বরঞ্চ তুমি আমায় ইশারায় ডেকে এনেছ। কী বলবে বলো, কাজ আছে!'
মোস্তফা সাহেব মুখে গাম্ভীর্যতা লেপ্টে বললেন,
'কাজ কী? ব্যাগপত্র গুছিয়ে চট্রগ্রাম যাওয়া?'
তন্ময় অবলীলায় বলল, 'নাকি চট্রগ্রাম না গিয়ে কক্সবাজার যাব? সেখান থেকে নাহয় সেনমার্টিন!'
মোস্তফা সাহেবের বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠল। উচ্চকণ্ঠে ধমকের সুরে ডেকে উঠল,
'তন্ময়!'
তন্ময় নিজ মনে জিহ্ব কামড়াল। বেশি হয়ে গেল? সে তো লেগপুল করছিল মাত্র! এতটা সিরিয়াস হলে হয়? নদীতে নৌকা ঘোরানোর মত নিজের কথার ধরন ঘুরিয়ে ফেলল,
'সেদিন অনিকেত আঙ্কেলের সাথে দেখা হলো। দেখে বোঝার উপায় নেই–ভদ্রলোক পঞ্চাশের ঘর পেরিয়েছেন বয়সে। এখনো ইয়ং। মায়ের কথা জিজ্ঞেস করল। এখনকার ছবিও দেখতে চাইল।
চোখমুখে তার স্নেহ লুকিয়ে ছিলো। আহারে বেচারা!'
মোস্তফা সাহেবের মস্তিষ্ক ছেলের অদেখা দঁড়ির টানেতে চলল। ভুলে বসল পূর্বের চিন্তাভাবনা, তর্কবিতর্কতা। তন্ময় যে নদীতে নিলো, সে সেই নদীতেই ডুবে হাপুসহুপুস করে শুধালেন,
'তুমি দেখিয়েছিলে ছবি? খবরদার আমার স্ত্রির ছবি ওই শয় তানটাকে দেখাবে না। নাকি দেখিয়েছ? নাম্বার-টাম্বার চেয়েছিল নাকি? হা রামজাদাটা ফিরল কবে প্যারিস থেকে? ফিরেই অন্যের স্ত্রির ভালোমন্দ জানতে চলে এসেছে। নির্লজ্জ!'
তন্ময় আতঙ্কের ভাণ ধরে চমকিত গলায় বলল, 'আমি তো মায়ের নাম্বার দিয়ে দিয়েছি।'
মোস্তফা সাহেব একলাফে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আঙুল তুলে ছেলেকে শাসালেন। আর একমিনিট অপচয় না করে, ত্বরিত পায়ে ছুটলেন বাড়ির ভেতরে। বাগানে বসে থাকা তন্ময়ের কর্ণে প্রবেশ করছে তার উচ্চকণ্ঠ,
'জবেদা! তোমার ফোনটা কই? দেখি ওটা আমাকে এক্ষুনি দাও।'
তন্ময় দুচোখের পাতা বুঁজে, কপালে ডান হাত চেপে শব্দহীন হাসল। হাসির তালে কাঁপল বুক।
একচোট হেসে চোখ মেলে তাকাতেই অপ্রস্তুত হলো। হাসিটুকু আলগোছে গিলে নিলো। সম্মুখে বিচলিত, চমকিত আগ্রহেরর সপ্তমে চড়ে বসা অরু দাঁড়িয়ে। কখন এলো মেয়েটা? অরু বড়বড় চোখে চেয়ে শুধাল,
'এইমাত্র আপনি কি হাসছিলেন, তন্ময় ভাই? আমি কি যথার্থ দেখেছি? আমার এই চোখ ভুল দেখেনি তো? কেন মনে হচ্ছে আমার সামনে হুবহু আপনার মতন দেখতে একজন জ্বিন বসে?'
তন্ময় তো প্রায়শয় হাসে, ও কি দেখে না? এমন আশ্চর্য হবার মত বিষয় কী এটা? অরুর প্রশ্নের সামনে আর ওর মুখের হাবভাব দেখে তন্ময়ের এযাত্রায়ও হাসি পেলো। তবে হাসল না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
'আমি জ্বিন।'
অরু ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে বলল, 'জ্বিনের বয়স কত? নিশ্চয়ই তন্ময় ভাইয়ের থেকেও বেশি। তন্ময় ভাইয়ের-ই তো ত্রিশ!'
তন্ময় আশ্চর্য হলো। মুহূর্তে ভয়ংকর চটে গেল। গমগমে গলায় বলল, 'ত্রিশ? এক চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব। আমার আঠাশ! তুই ত্রিশ কোথা থেকে জানলি?'
অরু সাদা ফকফকে দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল, 'মাত্র দু'বছরের ব্যবধান। ওই একই ব্যাপার দাঁড়াল না?'
তন্ময় স্তম্ভিত না হয়ে পারল না, 'আশ্চর্য!'
সাধারণ বিষয়ে হাস্যজ্জ্বল তন্ময় যে ক্ষেপে উঠবে, তা কি অরু জানতো? সে ধীরেসুস্থে পিছু সেঁটে যাচ্ছে। কয়েককদম যেয়েই ঘুরে দৌড় লাগাল। তন্ময় পিছু হতে চেঁচাল,
'এই তুই দাঁড়া!'
কে শোনে কার কথা! অন্যদিক বাবাকে নাকানিচোবানি খাইয়ে তৃপ্তিতে আনন্দে থাকা তন্ময়ের আনন্দ আর রইল না। থমথমে হয়ে এলো মুখমণ্ডল। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ফেলল। চোখমুখে আঁধার নামিয়ে বিড়বিড়িয়ে উঠল,
'আমার বয়স ওর বেশি মনে হচ্ছে? মাত্র আঠাশ-ই তো। এরথেকে ভালো বয়স হতেই পারে না।'
———
পরদিন অরু কৈমাছের মতন ধড়ফড়িয়ে তার সম্মুখে ঘুরেফিরে বেড়াল। এতে তন্ময় নির্বিকার হয়ে রইল। চোখ তুলে অগোচরেও তাকাল না। গতকাল রাতে ওর বলা কথাটুকু এখনো তার হৃদয়ে গেঁথে আছে। এভাবেই বয়সের ব্যবধান তার গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকে। ওপর দিক, তারা দুদিনের জন্য বেরোবে মাত্র; তাও কাজের সূত্রে। তবে মহারানি ভিক্টোরিয়া-র ল্যাগেজ দেখে তাহা বোঝাবার উপায় নেই। এই ল্যাগেজ দুদিনের বলে মনে হলো না। মনে হচ্ছে ও লম্বা ট্যুর দিতে যাচ্ছে। নাহলে এত ভারী লাগবে কেন? ল্যাগেজ গাড়িতে তুলতে নিয়ে তন্ময় আশ্চর্য না হয়ে পারল না! অরুর দুহাতে লাঞ্চবক্স সুন্দরভাবে প্যাকড করা। জাবেদা বেগম - সুমিতা বেগম বেশ ভোরে উঠে, কয়েকধরণের রান্নাবান্না করেছেন। সেসবই দু'বাচ্চার জন্য দিয়ে দিয়েছেন। খিদে পেলে যেন চটপট খেয়ে নিতে পারে। কোনোরকমে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে–ত্বরিত অরু গাড়িতে ওঠে বসল। তার উতলতা দেখে হাসল শাবিহা আর রুবি। দীপ্ত আফসোস সুরে জানাল,
'আমিও যেতে চাচ্ছি।'
মুফতি বেগম কান টেনে ধরেন ছেলের। নিজের সঙ্গে নিতে-নিতে বলেন, 'স্কুল যাবে কে?'
মোস্তফা সাহেবের চোখমুখ চূড়ান্ত গম্ভীর। এতে উদাসীন তন্ময়। হাবভাব একই তার। সে আলগোছে বাবার উঁচু নাকের ডগা দিয়ে হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। মোস্তফা সাহেব মনেমনে তিরস্কার করেন নিজেকে। তিনি দিব্যি বুঝে ফেলেছেন, ছেলে তাকে সুকৌশলে গতকাল বোকা বানিয়েছে। তার সফট স্পটের ফায়দা তুলেছে বাটপারের মত। তার ছেলেটা এমন কীভাবে হয়ে গেল? আশ্চর্য!
———
অরু স্টেরিও ছাড়ল। একটি বাংলা গান চলছে। মেঘের নৌকা তুমি। গানের সঙ্গে তালে-তাল মিলিয়ে গুনগুনিয়ে সুর তুলে গান গাইছে। জানালার কাঁচ নামানো। ও গাড়িতে থাকলে কখনো কাঁচ তুলে রাখা যায় না। তন্ময় বৃথা চেষ্টাটুকু করল না তোলার। গাড়ি চালানোতে মনোযোগী হলো। সূর্যের সোনালি রশ্মি ক্ষণেক্ষণে এসে ভিড়ছে ভেতরে। তীক্ষ্ণ ভঙ্গিতে চোখে লাগছে। ডান হাতে স্টেয়ারিং কন্ট্রোলে রেখে, বাম হাতে প্রাইভেট স্পেস হতে সানগ্লাসটা বের করে নিলো। সেটি পরে ফেলল অবলীলায়। খেয়াল করল অরুও নিজের হাতব্যাগ থেকে সানগ্লাস বের করল। সেটিকে বেশ সময় ধরে সযত্নে মুছে পরে নিলো। পরে দুবার আড়ালে-আবডালে চাইল। তা দিব্যি না তাকিয়েও তন্ময় অনুভব করল। এভাবে তো সে এক্সি-ডেন্ট করে বসবে! সে কী ভুল করল গাড়ি এনে? প্লেনের টিকেট কাটলে বুঝি ভালো হতো! চেয়েও তো মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ রূপে রাস্তায় থাকছে না। মস্তিষ্কের অর্ধেক পার্শ্ববর্তী সিটে বসা অরুতে আর অর্ধেক রাস্তাতে। এরপর এক্সি-ডেন্ট করে রুহ থাকবে অরুতে আর শরীর রাস্তাতে। নিজেকে তিরস্কার করে ধ্যানমগ্ন হলো গাড়ি চালাতে। কিন্তু তাকে মনোযোগী হতে দিলে তো? অরু তার কনসেন্ট্রেশনে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে বলল,
'তন্ময় ভাই, সুমন আঙ্কেল এলো না যে? তিনি যাবেন না? আপনার প্রত্যেক বিজন্যেস ট্যুরে উনি সঙ্গে যান দেখতাম।'
তন্ময় মুখে কুঁলুপ এঁটে থাকল। এখন সে তো আর নির্লজ্জের মতন; মুখ ফুটে বলতে পারবে না,
'তুই সঙ্গী যাবি বলে সুমনকে পাঠিয়ে দিয়েছি রাতেই।'
অরু দমল না। প্রবল আগ্রহে ফের শুধাল। তন্ময় ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এযাত্রায় বলল, 'আগে চলে গেছে। কাজ ছিলো ওখানে।'
অরু আফসোস সুরে বলল, 'সঙ্গে গেলে মজা হতো।'
তন্ময় বিরক্ত হলো বটে, 'কী মজা হতো?'
'বাহ-রে, গল্পগুজব হতো। হাসিঠাট্টা হতো। আংকেল ভারী মজার মানুষ। আমার তাকে বেশ লাগে।'
তন্ময় নিজ মনে আওড়াল, 'আর আমি? আমি কী মজার মানুষ নই?'
তন্ময়ের কণ্ঠে অসন্তুষ্টি ঝরেঝরে পড়ছে, 'তাহলে বাসায় দিয়ে আসি। যাওয়ার প্রয়োজন নেই।'
অরু অবাকের চূড়ান্তে। সে তো কথাবার্তা চালানোর সামান্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। নিজে তো কথাবার্তা বলছেই না; গুরুগম্ভীর মুখে বসে। অরু প্রথমে আগ বাড়িয়েছে তাতেও পানি ঢালছে।
ভেংচি কেটে অরু অন্যপাশে ফিরে রইল। কথাই বলবে না সে আর! তবে সেই প্রতিজ্ঞা বেশিক্ষণ টিকলে তো? ক্ষণিকের মধ্যেই পুনরায় মাথা ঘুরিয়ে অনর্গল কথা বলে চলল। একদণ্ড কথা না বলে থাকতে পারে না। পাশে নিজের মানুষ থাকলে তো প্রশ্নই ওঠে না।
.
.
.
চলবে..............................