অরুর বয়সটা এমন এক জায়গায় এসে থেমেছে— যেখানে সবকিছুতেই ওর বড়ো কৌতূহল। তন্ময়কে নিয়েও ওর কৌতূহলের শেষ থাকে না। আজকাল সাহস হয়েছে বড়ো। পূর্বে একটু ভয় পেতো; এখন ভয়ের 'ভ'টুকুও পায় না।
উদগ্রীব চোখে চেয়ে বিড়বিড়িয়ে সব ধরনের প্রশ্ন করে বসে! সেদিন জিজ্ঞেস করছিল, সে মোট কটা প্রেম করেছে। তন্ময় প্রেমট্রেম করেনি। বন্ধুবান্ধব থেকে পরিবার-পরিজন কমবেশ সকলেই জানে। অরুও শতভাগ জানে। ও আবার না জেনে আছে নাকি? তবুও একই প্রশ্ন করে বেড়াবে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, তার ফেলে আসা যুবককালের কলেজ-ভার্সিটির জীবন সম্পর্কে জানতে মেয়েটা অত্যন্ত আগ্রহী। তবে তন্ময় ঠিক আঁচ করতে পেরেছে, আসল আগ্রহ খানা কোথায়! তাকে কতজন প্রপোজ করেছে, কতশত মেয়েরা পিছু ঘুরেছে এসব শোনার প্রবণতাই বেশি। শাবিহাও একদিন ইনিয়েবিনিয়ে কৌতুক সুরে বলেছিল,
'তোমাকে ঠিক কত গুলো মেয়ে পছন্দ করেছে, এই সম্পর্কে জানতে অরুর আগ্রহের শেষ থাকে না। আকাশা ভাইয়ার যুবককালের আলোচনা করতে বসলে, ও নির্বিকার থাকে। যেই তোমার কথা ওঠে, ওর থেকে ভালো শ্রোতা আর হয় না।'
তন্ময় ভেবে পায় না– এসব জানার আগ্রহ কেন ওর এতো? সারাদিন ওর মাথাতে ঠিক কি চলে? বাল্যকালে তন্ময় একটি ইংরেজি নোভেলের বাংলা অনুবাদ পড়েছিল। সেখানে লেখক লিখেছিলেন, 'যুবতি মেয়েদের মতিগতি বোঝা আর পর্বতের চূড়া ছুঁতে পারা অনেকটা একই বিষয়।'
তন্ময়ের আপাতত তাই মনে হচ্ছে! আধপাগলটার মাথাতে কী ঘুরেবেড়ায় ও-ই জানে। সে নিপুণভাবে দেখেশুনে রেখে বড়ো করেছে, ঠিকাছে! তবে সবসময় তো দেখে রাখতে পারেনি। স্কুলের গণ্ডি তো একাই পেরিয়ে এসেছে। কলেজেও পড়ছে। কখনো তন্ময়কে আশাহত করেনি। ও সর্বদাই 'গুড গার্ল' থেকেছে। ছেলেদের সাথে মেলামেশা বলতেই শুধু এহসান। এহসান আবার বোকাসোকা ছেলে। একই বয়সের হলেও ছেলেটা অরুকে বোনের নজরে দেখে। তন্ময় দৃষ্টি দেখেই বুঝতে পারে। তাই কখনো নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রয়োজন মনে করেনি। অরুর ছেলেবন্ধুহীনতা একদিকে তন্ময়কে প্রশান্তি দেয়। সে আবার পজেসিভ ধাঁচের মানুষ। যা নিজের তা একান্তই নিজের। সেখানে অন্যকারো দৃষ্টি,পছন্দ-অপছন্দ তার ঠিকঠাক হজম হবে না! অরু যখন নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ত, সহস্র ছেলেপেলে তন্ময় আড়ালে-আবডালে পিটিয়েছে– অরুকে প্রোপজাল দিয়েছে বলে! সেসব কথা কে জানে? কেউ নয়। আড়ালে-আবডালে কাজ সেরে, সেখানেই ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে।
এসব ভেবে দুর্লভ হাসে তন্ময়। স্বভাবসুলভ হাত বাড়ায় পরন্ত শার্টের বোতাম খুলতে। অফিস হতে ফিরে ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই, এটি তার প্রথম অভ্যাসে পরিণত কাজ। আজও তাই করতে ধরেছিল। বুকের কাছটার দুটো বোতাল খুলতেই–অরুর অস্তিত্ব মস্তিষ্কে এলো। ততক্ষণাৎ হাত গুটিয়ে নিলো। আড়চোখে পিছু চেয়ে দেখল অরু থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে। কণ্ঠে একরাশ অসন্তুষ্টি বিদ্যমান,
'তন্ময় ভাই, আপনি কী সত্যি চট্রগ্রাম যাচ্ছেন?'
তন্ময়ের মুখশ্রী গম্ভীর ধাঁচের। ওষ্ঠেদ্বয় জুড়ে সামান্য হাসি না থাকলে তাকে চূড়ান্ত গম্ভীর দেখায়। সুদর্শনও বটে। এতে সাত- খু ন তার মাফও হয়। এবারো নিত্যকারের ন্যায় গম্ভীরমুখে নাক-মুখে জবাবে বলে,
'হুম'
এতে অরুর অসন্তুষ্টি দ্বিগুণ হলো বলে। তবে সেয়ানা মস্তিষ্ক খাটিয়ে ভেবেচিন্তে শেষমেশ ছ্যাঁত করে ওঠে না। এসময়ে বুদ্ধিমান লোকেরা নিজেকে শান্ত রাখে। সেও শান্ত হাবভাবে, ভীষণ রকমের নরম গলায় শুধায়,
'চট্রগ্রাম খুব সুন্দর, তাই না?'
তন্ময়ের দক্ষ মস্তিষ্ক মুহূর্তে লক্ষ্ করল অরুর কণ্ঠের পরিবর্তন। কিছুক্ষণ পূর্বের কণ্ঠে ছিল একঝাঁক তিক্ততা, এখনকার কণ্ঠে মধু ঝরেঝরে পড়ছে। বিড়াল মাছের মতন ছটফট করছে। তন্ময় অন্যপাশে ঘুরে ফাইল দেখার ভাণ ধরল। তার নির্লিপ্ততা এযাত্রায় ভাঙতে শুরু করল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসিটুকু গিলে ফেলল সযত্নে। অরু ঘুরেফিরে উরণচণ্ডী রূপে সম্মুখে এসে দাঁড়াল। মাথাটা বেঁকিয়ে চোখ তুলে চেয়ে ফের জানতে চাইল,
'সুন্দর তাই না?'
তন্ময়ের ভাবান্তর হলো না বুঝি? সে নির্বিকারের চূড়ান্তে গিয়ে এবারো ছোট করে বলল,
'হুম।'
অরুর উতলতা এতে মোটেও দমানো গেল না,
'আমি কখনো যাইনি। একটু গিয়ে ঘুরে আসতে পারলে মন্দ হতো না, তাই না?'
তন্ময় ভ্রুদ্বয় কুঁচকে বসল। মস্তিষ্ক বাতি জ্বলল যেন! এইমুহূর্তে সে স্পষ্ট খেয়াল করল অরুর আকারইঙ্গিত কোন নদীতে ছুটছে! ও ঠিক কোন নদীর মাছে নজর ফেলছে, তাও কিঞ্চিৎ আন্দাজ করতে পেরেছে। তন্ময় স্তম্ভিত গলায় কোনোমতে বলল,
'হুঁ।'
অরুর চোখমুখে প্রত্যাশা, 'ভাবছিলাম এবার ঘুরে আসব।'
'কী?'
অরু নিপুণ দৃষ্টি ফেলে চটপটে ভঙ্গিতে শুধাল, 'আপনার সঙ্গে আমায় নেবেন?'
তন্ময় বাকরুদ্ধ–চমকিত চোখে চাইল। হৃদপিন্ড উথালপাতাল সমুদ্রের ন্যায় কয়াক দফাতে লাফাল। পরপর শান্ত হলো পড়ন্ত স্থির নদীর মতো। অরুর ভোলাভালা সরল মুখখানিতে দৃষ্টি রেখে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
'কী বললি?'
অরু খানিক গুটিয়ে এলো, 'সঙ্গে যেতাম?'
'সঙ্গে গিয়ে?'
অরুর হেলদোল হলো না, 'একটু ঘুরব।'
তন্ময় বিরক্ত হওয়ার প্রয়াস করল। চোখমুখে গাম্ভীর্যতা আনতে চেয়ে বলল, 'আমি কি ঘুরতে যাচ্ছি?'
অরুর কণ্ঠ মিনমিনে শোনাল, 'আপনি কাজ কি সারাদিন করবেন? যতক্ষণ করবেন– ততক্ষণ আমি হোটেলেই থাকব। আপনি ফিরলে একটু নাহয় ঘুরব।'
তন্ময় অশান্ত ভঙ্গিতে অন্যদিক ছুঁটল। অরু পিছু-পিছু চলে এলো। একই প্রশ্ন বারংবার করে মাথাটা খেতে লাগল। শেষমেশ চোখমুখ বুঁজে বলল,
'বাবার পারমিশন নিতে পারলে যেতে পারবি।'
অরুর নিভুনিভু চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠল।
উত্তেজনায় ধড়ফড়িয়ে উঠল বুকের ভেতরটা। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
'সত্যি? চাচ্চুর পারমিট পেলে যেতে পারব? পড়ে আবার অস্বীকার করে বসবেন না তো, তন্ময় ভাই? আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। চাচ্চুর পারমিশন পাওয়া এক চুটকির ব্যাপার!'
অরু একদৌড়ে বেরিয়ে গেল। তন্ময়ের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বিছানায় গা ছেঁড়ে বসল। নিজ ভাবনায় বিভোর হলো। অরুকে নেয়া কি ঠিক হবে? পাঙচুয়াল কোনো টুইস্ট না হয়ে যায় আবার! সে আজকাল আর নিজেকেই ভরসা করতে পারছে না। যতটুকু সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখছে। অরুর সঙ্গে একত্রে নিরিবিলি সময় কাটানোর ভাববার সাহস করে না। কথায় আছে, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেশি হয়। বিপরীত চরিত্রের প্রতি মহব্বত দ্বিগুণ আসে। আর তার বেলাতে দুটোই খাপেখাপে মিলে গেল। আশ্চর্য!
———
মোস্তফা সাহেব মাত্রই ফিরলেন অফিস থেকে। তার আবার আজকাল কাজের চাপ। নতুন শিফম্যান্ট এসেছে গোডাউনে। সবকাজ কি আর ম্যানেজার, এসিট্যান্ট দিয়ে করানো যায়? নিজেকেও খাটতে হয়। ক্লান্ত দিন শেষে বাড়ি ফিরেই লিভিংরুমে বসেন। জবেদা বেগম ঠাণ্ডা লেবু শরবত হাতে এলেন। ডেকে গ্লাস ধরিয়ে বলেন,
'ফ্রেশ হয়ে নাও ভালো লাগবে।'
মোস্তফা সাহেব উদাসীন গলায় বলেন, 'তা নাহয় নিলাম।'
'নিলাম নয়। নেব।'
অগ্যত শরবতটুকু গিলে উঠে দাঁড়ান মোস্তফা সাহেব। সেমুহূর্তেই অরু উপস্থিত হয় ঝড়ের গতিতে। তন্ময় দোতালায় দাঁড়িয়ে নিপুণ দৃষ্টিতে সবটাই দেখতে প্রস্তুত। অরু একপল দেরি না করে জানায়,
'চাচ্চু, আমি চট্রগ্রাম যেতে চাই। চট্রগ্রাম ঘুরতে চাই। সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো দেখার জন্য আমার এই চোখজোড়া অধীর আগ্রহে তৃষ্ণার্ত।'
বেকুব বনে গেলেন মোস্তফা সাহেব, 'আচ্ছা, তা নাহয় গেলে। সবার সাথে কথাবার্তা বলে দুটো দিন বের করে সকলে মিলেমিশে যাব।'
অরু বিব্রত হলো খানিক। তবুও সরল গলায় বলে গেল, 'আমি কাল যেতে চাচ্ছি।'
মোস্তফা সাহেব আশ্চর্য হয়ে বলতে নিলেন, 'কাল কে নিয়ে যাবে…' বাকিটুকু গলায় আটকে গেল। কাল তো তার গুণধর পুত্র চট্রগ্রাম যাবে। অরু কী তার সাথে যাচ্ছে? ভ্যাবাচেকা খেয়ে সে মাথা তুলতেই ছেলেকে দেখলেন। খবিশটা হাসছে। দেখেছ কাণ্ড ছেলের! লাজলজ্জা নেই বললেই চলে। যাকে বোনের নজরে দেখে না তার সাথে কীসের ঘুরতে যেতে চাওয়া? নির্লজ্জ ছেলে একটা! কোনো ঘুরাফেরা হবে না। বিদ্রো হী কণ্ঠে মোস্তফা সাহেব সাফসাফ দ্বিমত করতে মুখ খুলবেন– পূর্বেই আনোয়ার সাহেব লিভিংরুমে আসতে নিয়ে বলেন,
'তন্ময় তো যাবে কাল চট্রগ্রাম। ওর ঘুরে এসো। শোনো ভাইয়াকে আবার জ্বালিয়ো না। কাজ করে ফ্রি হয়ে ঘুরতে নেবে। সেপর্যন্ত ভদ্রভাবে থাকবে। যা বলে শুনবে।'
পারমিশন পেয়ে অরুর হৃদয় আনন্দে, উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ। অন্যদিক মোস্তফা সাহেব ভোতামুখে ছেলের দুর্লভ হাসিটুকু কোনোমত সহ্য করে বলেন,
'এই ছেলে, তোমার সাথে কথা আছে। বাগানে আসো।'
.
.
.
চলবে..............................