অস্থিরতা, চঞ্চলতা– ব্যাকুলতা এবং আকুলতা যেসব প্রভৃতির ভাব তন্ময়ের শক্তপোক্ত হৃদয়ে ছিল; এই পর্যায়ে সেসব পোঁটলাপুটলি বেঁধে হাওয়ায় ভেসে গেল। হৃদয় তীব্র বিদ্রো হী হয়ে ওঠল। আন্দো লন ঘোষণা করল যেন। যার জন্য করল চু রি, দিনশেষ সেই বলল চো র। বন্ধুবান্ধব ফেলে তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো যার জন্য; সেই রাণী ভিক্টোরিয়া তো দিব্যি ঘুরতে বেরিয়ে গিয়েছে। তন্ময়ের অপেক্ষাতে চুপচাপ বসে নেই। অভিমানে তন্ময়ের স্বভাবসুলভ গম্ভীরমুখটা, দ্বিগুণ এবং গাঢ়তম ভাবে গম্ভীর হয়ে এলো। জবেদা বেগম চিন্তিত কণ্ঠে শুধালেন,
'আমার বাবার মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?'
তন্ময় নির্বিকার হাবভাবে বলল, 'কিছু না। একটা কফি করে দাও, মা!'
জবেদা বেগমের গলাতে একদলা আগ্রহ গেঁথে আছে, 'সে নাহয় করে দিলাম। আগে এটা বল, ভালোয় ভালোয় এলি, যেই শুনলি অরু বেরিয়েছে মুখটা ভোঁতা করে ফেললি! ব্যাপার কী? আমাকেও বল। আমিও শুনে মুখ ভাড় করি।'
তন্ময় অস্বস্তিতে পড়ল। লজ্জা পেলো ইষৎ।
গম্ভীরমুখে অদেখা সংকোচ! দৃষ্টি ঘুরিয়ে অস্বস্তিটুকু নিপুণভাবে এড়িয়ে গেলো,
'কীসব বলছ! কফি করে দিবে না; তা সরাসরি বলে দাও।'
জবেদা বেগম ঠোঁট টিপে হাসলেন, 'বাহ্ বাহ্, কথা ঘোরানো হচ্ছে! বোস। এনে দিচ্ছি।'
তন্ময় লিভিংরুমের সোফাতে গিয়ে বসল। সম্পূর্ণ বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা। মুফতি বেগম আর জবেদা বেগম ছাড়া কেউই নেই এই মুহূর্তে। মোস্তফা সাহেব সবাইকে নিয়ে বেরিয়েছেন। তন্ময় সংবাদপত্র হাতে তুলে নিলো। মনোযোগী হওয়ার প্রয়াস। হেডলাইন কোনোরকম পড়তেই চোখ বুঁজে নিলো। সংবাদপত্র ভাঁজ করে পুনরায় টি-টেবিলে রেখে দিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাড়ল টেলিভিশন। আর-টিভিতে একটি বাংলা নাটক চলছে। সেটাতে ক্ষীণ মস্তিষ্ক নেওয়ার প্রচেষ্টা।
কিছুক্ষণ বাদে জবেদা বেগম এলেন কফি হাতে।
নিজের জন্যও চা নিয়ে এসেছেন। ছেলের পাশে বসে কফিটা এগিয়ে ধরেন। তন্ময় নিয়ে পুনরায় টিভির পর্দায় দৃষ্টি ফেলল। একটি ঝগড়ার দৃশ্য চলছে। দুজন গ্রামীণ মহিলা আঁচল বেঁধে ঝগড়া করছে। ভাষা এবং চেঁচামেচি শুনে তন্ময় স্তব্দ, বিমুঢ়। সে চ্যানেল পরিবর্তন করতে চাইলে, জবেদা বেগম বাঁধ সাধেন। আগ্রহী চোখে চেয়ে বলেন,
'দেখ কীভাবে ঝগড়া করছে! ঝগড়ার একেকটা কথা পয়েন্টে পয়েন্টে।'
তন্ময় বাকরুদ্ধ না হয়ে পারল না, 'আশ্চর্য! এই ঝগড়ার কথা পয়েন্টে পয়েন্টে হলেও আমি দেখে কী করব?'
জবেদা বেগম বিরক্তমুখে বোঝালেন, 'ঝগড়া করাও একটা আর্ট! শিখে রাখা ভালো। কাজে দেবে ভবিষ্যতে।'
তন্ময় বিরসভাব নিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইল। জবেদা বেগম নিজের থেকে দ্বিগুণ উচ্চতার ছেলেকে টেনে বসিয়ে দিলেন। উৎসাহ নিয়ে বললেন, 'দেখ না একটু।'
তন্ময় অগ্যত উদাস নয়নে ফের দৃষ্টি ফেলল টিভির পর্দায়। কফিতে ঠোঁট বসাতে-বসাতে মস্তিষ্ক অন্য ভাবনায় বিভোর। এযাত্রায় মুফতি বেগম আসলেন। তিনি এসেই ভীষণ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
'কী হয়েছে!'
ওম্নেই জবেদা বেগম তাকে টেনে পাশে বসিয়ে দিলেন। টেলিভিশনের পর্দায় চলতে থাকা ঝগড়া দেখাতে ব্যস্ত হলেন। মুফতি বেগমও অতিমাত্রায় আগ্রহভরা নয়নে দেখতে বসেন। দেখে-দেখে মন্তব্যও করেন। সে সুযোগের সৎব্যবহার করল তন্ময়। আলগোছে উঠে পড়ল। ত্বরান্বিত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো। নিজ রুমে ফিরল ঝটপট। আগামীকালের গুরুত্বপূর্ণ অফিস কাগজপত্র সহ ল্যাপটপ হাতে তুলে নিয়ে এগুল বারান্দার দিক। বারান্দায় বসল আরামদায়ক ভঙ্গিতে। ঊরুতে ল্যাপটপ রেখে, কফি খেতে-খেতে ব্যস্ত হলো কাজে। কাজকর্মে মননিবেশ হতেই ভুলে বসল রাণী ভিক্টোরিয়া অরুকে। যিনি ধেইধেই করে ঘুরতে বেরিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা এখন এগারোটা বিশে। আসমানের এসময় গুরুতর দুর্দশা। কালো মেঘে আচ্ছন্ন পরিপূর্ণ আকাশ। ঢাকঢোল পিটিয়ে মেঘেরা গর্জন করছে। চাঁদের কোনো হদিশ নেই। উদাসীন বৃষ্টি এই নামবে নামবে হাবভাব। গাড়ির ধ্বনি কর্ণগোচর হলো। ফিরেছে হয়তো সকলে। তন্ময় উঠল না। নাক ফুলালো। ধ্যানমগ্নতায় কাজে ডুবল পুনরায়। মিনিট চারেকের মাথায় দরজায় করাঘাত পড়ল। পরপর ঢুকল অরুর মাথাটা।
তন্ময় মাথা তুলল না ল্যাপটপ স্ক্রিন হতে। না সে ফিরে চাইল। অরু ছোটো করে, 'আসলাম' বিড়বিড়িয়ে জানাল। এতেও তন্ময় বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নিজের মতোন কাজ করেই গেলো। অরু ছোটোছোটো পদচারণে বারান্দায় এলো। মাথা ঝুকিয়ে দেখল কর্মরত তন্ময়কে। চঞ্চল চাহনি দ্বারা চেয়ে রইল। বেচারি বেজায় চিন্তিত তন্ময়ের গম্ভীর, আগ্রহহীন হাবভাবে। অরু মিনিটখানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শুধাল,
'তন্ময় ভাই, কী করেন?'
তন্ময় নিরুদ্বেগ, নির্লিপ্ত। ইষৎ ধ্বনি তুলে ল্যাপটপের কীবোর্ড টিপে চলল। প্রয়োজন অনুভব করল না দৃষ্টি তুলে তাকানোর। অরু আশ্চর্যের সপ্তমে পৌঁছাল। চোখমুখ ভোঁতা হলো। অভিমানে সিক্ত হবার জোগাড় তার আঁখিদুটি,
'কথা বলছেন না কেন!'
দিনশেষে তন্ময় দুর্বল অরুর প্রতি। ওর সামনে সে অসহায়। চেয়েও দীর্ঘক্ষণ এড়াতে পারে না, এই মেয়েকে! বিধাতা তাকে এতটা শক্ত হৃদয় দেননি। এযাত্রায় ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখেই গম্ভীরকণ্ঠে বলে, 'দেখছিস না কী করছি?'
অরুর বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপল। তিরতির কাঁপছে ওষ্ঠদ্বয়। যেন কিছু বলতে চায়ম অভিমানে হৃদয় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একচিত্তে চেয়ে থাকে তন্ময়ের মুখপানে। ঝুমঝুমিয়ে বর্ষণ নামে তক্ষুনি। অরু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বাইরে তাকায়। বৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়তে ভেতরটা ধক করে ওঠে। ছাঁদে ঘটিত একেকটি দৃশ্য ফিল্মের মতো দু'চোখের পাতায় ভাসে। ক্ষণিকের অভিমান অদৃশ্য হয়ে যায়। দৃষ্টি ফিরিয়ে আড়চোখে তন্ময়ের পানে চাইতেই, দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে। তন্ময় গুনেগুনে মিনিট খানেক ধরে দেখেছে অরুর লাজুক মুখশ্রী।
বৃষ্টির পানে চেয়ে রক্তিম হয়ে আসা; ওর গালজোড়া সে নির্নিমেষ উপভোগ করেছে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই তন্ময়ের শরীর জুড়ে উত্তাপ। দৃষ্টি নিবিড়। নীরবতা ভেঙে বলে,
'ঘুরতে গিয়েছিলি?'
অরু ধীরেসুস্থে দুবার মাথা দুলিয়ে বোঝায়, হুঁ গিয়েছিল। তন্ময় নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
'ঘুরাফেরা হয়েছে, এখন গিয়ে শুয়ে পড়।'
অরু চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মুখটা চুপসানো। সে ইতস্তত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, 'আপনি কী আমার ওপর রেগে!'
তন্ময়ের কাঠখোট্টা জবাব, 'না।'
অরু যেন পাকাপোক্ত ভাবে স্বীকৃতি পেলো। বিড়বিড়িয়ে বলল, 'আমি কি করলাম! আমার ওপর রাগার কারণ কী! রাগা তো আমার উচিত!'
তন্ময় শুনেও শুনল না। কাগজপত্র, ল্যাপটপ হাতে উঠে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো পায়ে বেডরুমে চলে এলো। আশানুরূপ তার পিছু-পিছু আবছায়া অনুভব করতে না পেরে, আড়চোখে পেছনে চেয়ে দেখল অরু বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে। একচিত্তে বৃষ্টি দেখছে। তন্ময় সে দৃশ্যে থমকাল। হৃদয় অশান্ত, দৃষ্টি নরম হলো। ঢোক গিলে অনুভব করল ভেতরটা স্রোতের ন্যায়! তার ছোট্টোখাট্টো একচিলতে অভিমান রইল না। পাজোড়া নিজ মোতাবেক কাজ করে বসল। ধীরেসুস্থে এগুতে থাকল বারান্দার দিক। থামল ঠিক অরুর পেছনে। অরু গ্রিলের ফাঁকফোকর দ্বারা হাত বাইরে দিয়ে রেখেছে। বৃষ্টির জল ছুঁয়ে দিচ্ছে ওর কোমল, ফর্সা চিকন হাত। সেই দৃশ্যও দেখতে বেশ লাগছে তন্ময়ের। আনমনেই নিজ হাতটাও বাড়াল। ঠিক অরুর হাতের নিচে। আড়চোখে দেখল এহেন কাণ্ডে অরু হাসছে। মিটিমিটি হাসিটুকু ওর ভালোলাগা কী সুন্দর ভাবে জাহির করছে! অরুকে দেখতে নিয়ে অনুভব করল তার হাতে আরেকটি হাতের স্পর্শের। ত্বরিত সেদিকে দৃষ্টি ফেলে দেখল অরুর ছোটো হাতটা, তার বৃহৎ হাতের মুঠোতে যত্নসহকারে পড়ে আছে। মুহূর্তে ইষৎ হাসি খেলা করল তার ওষ্ঠদ্বয় জুড়ে। অরু একচিত্তে বৃষ্টি দেখলেও; তার দৃষ্টি বৃষ্টি উপভোগ করা প্রেয়সীতেই নিবদ্ধ হয়ে রইল।
.
.
.
চলবে.............................