#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২০
" হুম কচুর মজা।"
" ছি অশ্লীল কথা। "
রুদ্রর এমন কথায় মিহি চোখ বড়সড় করে তার দিকে তাকালো। রুদ্র ঠোঁট টিপে হাসছে। মিহি বুঝতে পেরেছে লোকটা তাকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করছে নির্ঘাত।
" কোনটা অশ্লীল কথা? "
" এই যে কচু বললে সেটাই। "
" কেনো কচু খাননা? না-কি অ্যালার্জি! "
রুদ্র এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলোনা। জোরে হাসতে হাসতে ছাদের এক পাশ থেকে অন্য পাশে গেলো। মিহি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রুদ্রর কান্ডকারখানা দেখছে। লোকটা যে এরকম আধপাগল হবে বুঝলে বাবার কথামতো বিয়ে করতোনা মিহি।
" হাসাহাসি বন্ধ করুন তো,গা জ্বলে যাচ্ছে। "
" ফায়ারসার্ভিসে কল দিবো না-কি? "
" আমি পাবনা সিট বুকিং করে দিচ্ছি। আপনি কাইন্ডলি সেখানে চলে যান।"
" কিন্তু কেনো বলো তো?"
"কারণ আপনি ওখানকার বাসিন্দা।
" পাগল তো সেই কবেই হয়েছি মিহি,মানুষটা যখন ঠকালো! ছোটো থেকে একা একা বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যখন বড়ো হলাম, তখন নবনীকে পেয়ে জীবনে নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জেগেছিল। "
হঠাৎ রুদ্রর চোখমুখ কেমন শক্ত হয়ে গেছে। মিহি খেয়াল করলো এই প্রথম রুদ্র মিহিকে মিহিরদানা না ডেকে শুধু মিহি বলে ডাকলো। রুদ্র নিজের জীবনের কথা মিহির সাথে বলতে চাইছে ভেবে মিহি সাহস সঞ্চার করে বললো,
" আজকের রাতটা চলুন গল্প করে কাটাই তবে হ্যাঁ এই খোলা ছাদের নিচে না।"
" ঠিক আছে রুমে চলো।"
রুদ্র ও মিহি ছাদ ত্যাগ করে তাদের রুমে ঢুকে মুখোমুখি বসলো। রুদ্রর চেহারা স্বাভাবিক না,দেখে মনে হচ্ছে নীলচে ব্যথারা বুকের মধ্যে তীব্র গতিতে ছোটাছুটি করছে।
" কী হয়েছিল আন্টি-আঙ্কেলের?
" বলছি.."
রুদ্রর বয়স তখন সবে ছয় বছর, ডাক্তার হঠাৎ করে একদিন বললেন রুদ্রর মা ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। বড়োজোর কয়েকদিন বাঁচতে পারে। রুদ্র তখন অতকিছু না বুঝলেও নানার মুখ দেখে ঠিক বুঝেছিলো বাবার মতো মা'কেও আর দেখতে পারবে না হয়তো। জন্মের পরে বাবাকে দেখেনি ছেলেটা। মায়ের মুখে শুনেছিল রুদ্র গর্ভে থাকতেই একটা গাড়ি দূর্ঘটনায় নিহত হন তিনি। এমনিতেই প্রেমের বিয়ে ছিল পারিবারিক অশান্তি ছিল রুদ্রর দাদার বাড়ি থেকে। তাই রুদ্রর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর মাকে সবাই তাড়িয়ে দেয় শ্বশুরবাড়ি থেকে। তারপর থেকে নানাবাড়ি বড়ো হয়েছে রুদ্র। রুদ্রর মা ছিলো পরিবারের একমাত্র সন্তান। মা মারা যাওয়ার পরে একেবারে এতিম হয়ে গেলো রুদ্র। নানা বড়ো করে তুলেছিলো ছেলেটাকে। নানী পরপারে গেছিলো অনেক আগে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ যখন তখনই আলাপ হয় নবনীর সাথে। নবনী তখন কলেজে ভর্তি হয়েছিল মাত্র। দেখতে দেখতে সময় গড়ায়,দুজনের সম্পর্ক গভীর হয়। রুদ্রর ইন্টারমিডিয়েট শেষ হওয়ার পরে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার কথা থাকলেও নবনীর জন্য রাজি হয় না। নানা অনেক বোঝায় কিন্তু রুদ্র কিছুতেই নবনীর মায়া কাটিয়ে দূরে যেতে পারছিলো না। নানার সাথে এ নিয়ে একটু মনোমালিন্য হয় বটে। তবুও জেদ করে স্থানীয় ইউনিভার্সিটিতেই মেডিকেল শেষ করে। তবে রুদ্র দেখিয়ে দিয়েছিলো লেখাপড়ার ইচ্ছে থাকলে সব জায়গায় বসেই ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব। কিন্তু আরো ভালো করার জন্য পিএইচডি করতে ঢাকা যেতেই হতো। তাই একদিন দুপুরে নবনীর সাথে দেখা করতে গিয়ে নিজেরই এক বন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পায় নবনীকে। ব্যস!সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। নবনী নিজেই রুদ্রকে স্পষ্ট জানায় সে তার বন্ধুকে চায় তাকে না। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকায়নি রুদ্র। সেদিনই ঢাকা চলে আসে।
ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেছে। মিহি ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছেনা। তার জীবনে এরকম কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই। অথচ রুদ্র ছোটো থেকেই সব হারিয়ে বেঁচে আছে। রুদ্রর চোখ কেমন লাল হয়ে গেছে। কেবল মাত্র পুরুষ মানুষ বলেই হয়তো হাউমাউ করে কাঁদতে পারছেনা। মিহি হুট করে রুদ্রর হাত ধরে। রুদ্র কিঞ্চিৎ চমকায়।
" কী হয়েছে? "
" এই হাত দিয়ে নবনীকে ছুঁয়েছেন? "
মিহির এরকম প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা রুদ্র। কিছুটা থতমত খেয়ে বললো,
" তুমি কী কখনো প্রেম করোনি?"
" নাহ,আমি এসবে জড়াইনি। "
" খারাপভাবে কখনো স্পর্শ করিনি তবে.. "
" তবে? "
" সে আমার জীবনে প্রথম নারী, একসাথে হাত ধরে অনেকটা পথ চলেছি। সেই চলার পথে মাঝে মধ্যে আঁকড়ে ধরেছিলাম হারিয়ে ফেলার ভয়।"
" হয়েছে হয়েছে। নিজের বউয়ের জন্য অপেক্ষা না করে পরনারীর সাথে লটরপটর করেছেন বলেই হারিয়েছেন। "
মিহির কথায় রুদ্রর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। এ যে ভুতের মুখে রামনাম!
" কীসব বলছো? তোমার শরীর ঠিক আছে মিহির দানা? আর লটরপটর কেমন শব্দ? "
মিহি রুদ্রর হাত ছেড়ে দিয়ে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখলো। রাত প্রায় শেষের দিকে। ঘরের বাতি বন্ধ করে রুদ্রকে পাশ কাটিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। রুদ্র আগের মতোই ঠাঁয় বসে রইলো। মেয়েটা কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করলো আজ। তবে কী সম্পর্কে এগোতে চাইছে সে? কিন্তু রুদ্র যে কেবল তাকে বন্ধুর মতো আগলে রেখেছে। মিহির বাবাকে দেওয়া কথার কারণে সব সময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করেছে,তার বেশি কিছু হওয়ার নয়। নবনী ঠকালেও রুদ্র আজও মনে মনে স্রেফ নবনীর।
ভোরের আলো ফুটতেই রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে সুমি। মিতু অবশ্য এখনো ঘুমোচ্ছে। এঁটো থালাগুলো জড়ো করে সেগুলো ধুয়ে নাস্তা তৈরি করার জন্য ভাবছে। কালকে রাতে রাহির থেকে মোটামুটি রান্নাঘরের কোথায় কী আছে দেখে নিয়েছিল। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার এত তাড়াতাড়ি শেখা সম্ভব হবে না সুমির। তাছাড়া শহুরে খাবারদাবারও তৈরি করতে জানে না সে। গ্রামে থাকতে তো সকালে পান্তাভাত খেতো। অন্য খাবার বলতে মাঝে মধ্যে পিঠে তৈরি করতো আর নুডলস। এসব ভাবতে ভাবতে কিছুটা সময় গড়িয়ে গেলো। আচ্ছা সবুজ কী তাকে খুঁজেছে একবারও? নাহ ওই মানুষটার কথা মোটেও ভাবতে চায় না সুমি। কিন্তু যাইহোক ওই লোকটাই সুমির সন্তানদের বাবা।
" এত সকালে তুমি রান্নাঘরে কী করছো?"
হঠাৎ রাহির প্রশ্নে ভাবনার সুতো ছিড়ে গেলো। স্নিগ্ধ মুখখানায় হাসি ফুটিয়ে সুমি বললো,
" আসলে ভাবি নাস্তা বানাইতে আইছিলাম কিন্তু এই মেশিনগুলা দিয়ে কেমনে কী করে তা তো জানি না।"
সুমির কথায় হাসলো রাহি। পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। টোস্টার মেশিনের ওপর হাত রেখে বললো,
" এটা দিয়ে টোস্ট তৈরি করে, আর এটা দিয়ে মশলা গুড়ো করা হয়। তবে চাইলে অনেককিছুই ভাঙা যায়। আর এটা হচ্ছে জুস তৈরি করার মেশিন।"
রাহি একটা একটা করে রান্নাঘরের সব যন্ত্রপাতি সুমিকে দেখালো এবং কার্যকারিতা বললো। কিন্তু সব কথা সুমি বুঝলো কিনা সেটা বোঝা গেলোনা।
" আচ্ছা ভাবি এহন কী তৈরি করবেন খাওয়ার জন্য? "
" উমম...সেদ্ধ ডিম, জুস, কিছু ফল সাথে সান্ডউইচ। "
" আচ্ছা আমি তাইলে ডিম সেদ্ধ করতাছি আপনি উইস বানান।"
" ওটা সান্ডউইচ হবে সুমি।"
সুমি গ্যাস অন করে একটা পাতিলে পানি দিয়ে চুলোয় বসিয়ে ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে সেদ্ধ দিলো। এগুলো শিখে নিয়েছে আগেই।
" ওই হইলো ভাবি। তা ভাবি একখানা কথা কমু?"
রাহি ফ্রিজ থেকে কিছু আপেল আর কমলা বের করে সেগুলো খোসা ছাড়িয়ে রাখতে রাখতে বললো,
" হ্যাঁ বলো।"
" আপনার বাচ্চাকাচ্চা নাই? "
" থাকলে তো দেখতে তাই না? তবে হয়ে যাবে ব্যাপার না। "
রাহি একটু লজ্জাই পেলো মনে হয়। মনে মনে ভাবলো এবার হয়তো সত্যি একটা বাচ্চা দরকার সংসারে। আদ্রিয়ানের সাথে কথা বলতে হবে রাতে।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। আজকে বিকেলেই বাসায় ফিরে এসেছে সে। মিহি ঘুমোচ্ছে রুমে। গতকাল রাতের পর থেকে মিহির আচরণে কেমন বদল এসেছে। রুদ্র বিষয়টা খেয়াল করলেও মিহিকে কিছু বললো না। সকালে রুদ্রর আগে উঠেই নাস্তা করার জন্য ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছিলো মিহি। দুপুরে কলেজ থেকে সরাসরি চেম্বারে চলে গিয়েছিল। সবকিছুই কি দয়া করছে মিহি? কেউ নেই বলে এই করুণা? রুদ্রর ভাবনার অতলে ডুবে যাচ্ছে বারবার। ভালোই তো দুষ্টমিষ্টি সম্পর্ক ছিলো দুজনার। অতীতের কথা না বললে হয়তো মিহি এরকম করুণা করতো না তাকে। রুদ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে নানার কথা ভাবে।
" কেনো আমাকে রেখে চলে গেলে নানা? সবাই কি পণ করেছিলে আমাকে একা রেখে চলে যাওয়ার? "
আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে রুদ্র। সে জানে কোনো উত্তর আসবে না এই প্রশ্নের তবুও মনকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা। আজ পর্যন্ত কেউ থাকেনি রুদ্রর জীবনে, তাই নতুন করে মিহিকে নিজের সাথে জড়াতে চায় না। হুট করে কাছে এসে ভালোবেসে আবার বদলে গেলে খুব কষ্ট হয়। তারচে মানুষের থেকে দূরে থাকাই ভালো।
চলবে............................