#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২১
আজ পর্যন্ত কেউ থাকেনি রুদ্রর জীবনে, তাই নতুন করে মিহিকে নিজের সাথে জড়াতে চায় না। হুট করে কাছে এসে ভালোবেসে আবার বদলে গেলে খুব কষ্ট হয়। তারচে মানুষের থেকে দূরে থাকাই ভালো।
" আজকে তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে?"
হঠাৎ মিহির কথায় নড়েচড়ে উঠলো রুদ্র। এরমধ্যেই ঘুম ভেঙে গেলো মেয়েটার? রুদ্র চোখমুখ স্বাভাবিক করে মিহির দিকে ফিরে মুচকি হেসে বললো,
" কেনো আগেভাগে আসলো সমস্যা? "
" আমার আবার কীসের সমস্যা? আরো ভালো হয়েছে, সারাদিন একা একা বাড়িতে থাকা লাগে। "
" রহমান চাচা তো মাঝে মধ্যে থাকেন।"
" মাঝে মধ্যে সব সময় তো থাকেন না।"
" তা সব সময় থাকার জন্য কাউকে লাগবে? "
রুদ্র ঠিক কী বললো বুঝতে পারলোনা মিহি। কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলো। তারপর কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
" খবরদার যদি আমার আশেপাশে আসেন। এহহ শখ কতো!"
" কী আশ্চর্য কথাবার্তা বলতেছো! তোমার কাছাকাছি কেনো যাবো আমি? দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছে? "
" মানে? আপনি কি বাইরে মেয়েদের সাথে ইটিসপিটিস করেন?"
" কি পিটিস করি? এসব কোথা থেকে শিখছো তুমি মিহির দানা? "
" বন্ধুরা বলে।"
" তাই তো বলি! যাইহোক তুমি বরং রাহি ভাবি কিংবা আম্মাকে কল দিয়ে বলো একজন মহিলাকে ঠিক করে দিতে। কোনো কাজকর্ম করতে হবে না শুধু তোমার সাথে থাকবে। "
" ঠিক আছে বলবো। আপনি দাঁড়ান আমি কফি নিয়ে আসছি।"
রুদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। একাকীত্ব অভিশাপ না-কি আর্শীবাদ? মানুষ যখন বাজেভাবে ঠকে যায় তখন মনে করে একাকীত্ব সুন্দর। কারো সাথে থেকে কষ্ট পাওয়ার থেকে একা থেকে নিজের মতো বাঁচা ঢের ভালো। আবার যখন প্রিয় মানুষটা দূরে থাকে অথচ ব্যস্ততার জন্য কথা বলতেও তেমন সময় হয় না তখন একাকীত্ব অভিশাপ।
সারাদিন শেষে রাতে মা-মেয়ে বসেছে নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য। এ বাড়ির লোকজন খুব ভালো বলেই অতিথিদের জন্য যে রুম বরাদ্দ সেখানেই থাকে মিতু ও সুমি। বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে দু'জন। সবুজের কথা ভেবে সুমির একটুআধটু খারাপ লাগছে। কিন্তু মিতুও মোটেও বাবাকে মিস করছে না। ছোট্ট মিতুর মনে বাবার প্রতিদিনের অন্যায় কর্মকাণ্ড তার প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্ম দিয়েছে।
" মিতু তুই কী আমার লগে রাগ করছিস?"
" না তো মা। তোমার লগে রাগ করমু কেন?"
" তোর বাপের থেইকা দূরে নিয়া আইলাম তোরে এইজন্যে।"
মিতু আরেকটু গভীরভাবে মা'কে জড়িয়ে ধরে। সুমি মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
" তুমি যা করবা তাতেই আমার স্বায় থাকবো মা।"
" আমার সোনাচান।"
সুমি মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করে। মিতুও মায়ের আলিঙ্গনে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
ঘরের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান। শোয়ারঘর ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখেছে রাহি। কিন্তু কীসের জন্য সেটা বুঝতে পারছেনা আদ্রিয়ান। কয়েকবার ডাকাডাকি করলে রাহি বলেছে কিছুক্ষণ অপেক্ষার করতে। সেই জন্য ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা! হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে ঘরের দিকে দৃষ্টিপাত করলো আদ্রিয়ান। দরজা খুলে দিয়েছে রাহি। আদ্রিয়ান কৌতুহল নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দেখলো সারা ঘরে বৈদ্যুতিক বাতির বদলে মোমবাতি জ্বলছে। আদ্রিয়ানের মনে পড়ে গেলো প্রথম বিবাহবার্ষিকীর কথা। সেদিন রাতে ঠিক এরকমভাবে ঘর সাজিয়ে সারপ্রাইজ দিয়েছিল রাহিকে। আজ বুঝি তার উল্টো হলো। আদ্রিয়ান এবার বিছানার দিকে তাকাতে দেখলো রাহি সেজেগুজে বসে আছে। চোখেমুখে তার লাজুক হাসি লেপ্টে আছে। আদ্রিয়ানের প্রিয় কালো রঙের শাড়ি পরেছে সে। সাথে হাতে কালো চুড়ি, কপালে ছোট্ট কালো টিপ,ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল। আদ্রিয়ান ঘরের দরজা আঁটকে ধীরে ধীরে গিয়ে রাহির পাশে বসলো।
" কী ব্যাপার বলো তো এতো সাজগোছ! আজ তো আমাদের বিবাহবার্ষিকীও নয়।"
" তাতে কী হয়েছে? এমনি একটু সারপ্রাইজ দিলাম।"
" তা ঠিক আছে,নতুন করে আরেকবার ফুলসজ্জা করে নিবো। কী বলো?"
আদ্রিয়ান রাহির হাতে হাত রেখে হেসে বললো। রাহি মাথা নিচু করে ফেললো কিছুটা।
" শোনো না একটা কথা বলবো?"
" হ্যাঁ বলো। বিয়ে হলো কত বছর এখনো এত লজ্জা কীভাবে পাও তুমি? "
" ধ্যাৎ! সুমি বলছিলো আমাদের কোনো বাচ্চা নেই কেনো।"
আদ্রিয়ান হেসে রাহিকে বুকে জড়িয়ে নিলো। রাহি কোনো কথা না বলে চুপচাপ প্রিয়তমের বুকের হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ শুনছে।
" তাহলে এই কথা? তাহলে নতুন অতিথি আসুক?"
রাহি মুখে কোনো উত্তর দিলো না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো কেবল। আদ্রিয়ান বিছানা থেকে উঠে ঘরের সমস্ত মোমবাতি নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে ফের রাহির পাশে এসে বসলো।
" ওগুলো নিভালে কেনো?"
" ম্যাডাম আমরা তো এখন আর আমাদের মধ্যে থাকবো না,মহাকাশ ভ্রমণে যাবো। তাই তখন তো এই পৃথিবীর কোনো খেয়াল থাকবে না। কোনো দূর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য বুঝলেন? "
" ভাবছি তুমি বিজ্ঞানী হলে না কেনো?"
" আমি না হলেও আমার ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য চেষ্টা করবো ঠিক আছে। "
রাহি আদ্রিয়ানের কথায় হাসলো কেবল। আদ্রিয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহির দিকে। কী সুন্দর স্নিগ্ধ মুখখানা তার! হাসিতে যেনো প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে তার। আদ্রিয়ান রাহিকে জড়িয়ে কপালে ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিলো। রাহিও আদ্রিয়ানের গালে,নাকের ডগায় ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো।
" রাহি।"
" হ্যাঁ বলো।"
" একটা গান শোনাবে?"
" এখন?"
" হুম। "
ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি
আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি
সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে
সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে
সেই সুরে বাজে মনে অকারনে
ভুলে যাওয়া গানের বাণী
ভোলা দিনের কাঁদন
কাঁদন হাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি!!
সকাল সকাল মেয়ের নম্বর থেকে কল আসায় কিছুটা চিন্তায় নিমজ্জিত হলেন রিনা বেগম। ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন তিনি। রাহি আর সুমি সকালের নাস্তা পরিবেশন করছে। রিনা বেগম কল রিসিভ করলেন।
" সবকিছু ঠিক আছে মিহি? সকাল সকাল কল দিলি!"
" ঠিক না থাকার কী আছে বলো তো? বাসায় আমি আর সে,ঝামেলা হবে কার সাথে? "
" তাহলে ঠিক আছে। কেমন আছিস তোরা?"
" আলহামদুলিল্লাহ, তোমরা কেমন আছো? "
" হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ। নাস্তা খেয়েছিস?"
" হ্যাঁ। আচ্ছা মা একজন মহিলাকে ঠিক করো তো,আমার সাথে থাকবে সারাদিন। সকালে আসবে সন্ধ্যায় যাবে বাসায় এরকম। কোনো কাজকর্ম করা লাগবে না, সেসব রহমান চাচা করেন।"
" তাই? ভালোই হবে তাহলে আমাদের বাসায় তোর বাবার পূর্ব পরিচিত গ্রাম থেকে একটি মেয়ে এসেছে। ওর একটা ছয় বছরের মেয়েও আছে সাথে, আমাদের এখানেই থাকবে। আমি বরং ওকে তোর ওখানে পাঠিয়ে দিবো,দিন-রাত সব সময় থাকবে।"
" আরে বাহ! তাহলে আজকেই পাঠিয়ে দিও। ভাইয়ার সমস্যা থাকলে শরীফ ভাই গিয়ে নিয়ে আসবে।"
" আদ্রিয়ান তো সকাল সকাল না খেয়ে বেরিয়ে গেলো। অফিসে না-কি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। "
" ওকে তাহলে আমি উনাকে বলে শরীফ ভাইকে পাঠিয়ে দিবো বিকেলে, এখন তো কলেজে যাবো। "
" ঠিক আছে। "
" আচ্ছা ভালো থেকো।"
" তুইও নিজের খেয়াল রাখিস সাথে সংসারেরও।"
ফোন কেটে নাস্তার দিকে মনোযোগ দিলো রিনা বেগম। রাহি অবশ্য বুঝতে পেরেছে সুমিকে নিয়ে কিছু বলেছে।
" সুমি!"
সুমি রান্নাঘরে ছিলো,রিনা বেগমের ডাকে দ্রুত পা চালিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো।
" হ্যাঁ ম্যাডাম।"
" বিকেলে তোমাকে নেওয়ার জন্য লোক পাঠাবে আমার মেয়ে। খুব ভালো মানুষ আমার মেয়ে, ওর শ্বশুর বাড়িতে কেউ নেই। সারাদিন একা থাকে বলে একজন লোক খুঁজতে বলছিলো। তুমি আর মিতু যখন আছো বাইরে লোক কেনো খুঁজবো বলো?"
সুমি রাহির দিকে একপলক তাকালো। রাহি মুচকি হাসলো সুমির দিকে তাকিয়ে। সময় কম হলেও এরমধ্যেই রাহিকে ভরসা করতে শুরু করেছে সুমি।
" ঠিক আছে। আমরা যাবো।"
রিনা বেগম খুশি মনে খাবার খেতে শুরু করলেন।
মিহি কথা শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভালোই হবে বাসায় ছোটো একটা মেয়েও আসবে। ভাবতেই মিহির খুব ভালো লাগছে। ফুরফুরে মেজাজে মিহি রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
চলবে.........................