মনেরও গোপনে (পর্ব ২২)


#মনেরও_গোপনে 
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২২



মিহি কথা শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভালোই হবে বাসায় ছোটো একটা মেয়েও আসবে। ভাবতেই মিহির খুব ভালো লাগছে। ফুরফুরে মেজাজে মিহি রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। অহনার সাথে দেখা হবে ভেবে আরো ভালোলাগার রেশ বয়ে যাচ্ছে হৃদয়ে। সেদিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাওয়া দরকার বলে মনে হয়েছিল মিহির। 

দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে ঘরে এসে মিতুকে সুমি বললো, 
" এদিকে আয় তোকে রেডি কইরা দেই।"
ছোট্ট মিতু কৌতুহল নিয়ে মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে শুধালো,
" ক্যান মা? আমরা কই যামু?"
সুমি সব জামাকাপড় আলনা থেকে সরিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। মিতুকে কাছে টেনে চুলগুলো পরিপাটি করে বেনী করে দিচ্ছে। 
" এই বাড়ির মাইয়ার শ্বশুর বাড়ি যামু। শুনছি হেয় একলা থাকে।"
" তুমি লগে থাকলে আমার সব জায়গা সমান আম্মা।"
মেয়ের কথায় সুমি হেসে জড়িয়ে ধরে তাকে। 

চেম্বারের এক কোণে চেয়ারে বসে আছে মিহি। শরীফ দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রর পাশে,রুদ্র রোগী দেখছে। আজকের রোগীর চাপ বেশি থাকায় দেরি হচ্ছে খাওয়াদাওয়ায়। রুদ্র একটু সময় পর পর মিহির দিকে তাকিয়ে দেখছে। মিহি ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। 
" শরীফ আর কেউ আছে? "
" নাহ ভাইয়া আপাতত কেউ নেই, বিকেলে আসবে হয়তো। "
" মিহি চলো আজ হসপিটালের ক্যান্টিনে গিয়ে খাবো। "
" কেনো? বাসায় গেলে হয় না? "
মিহি ফোনের উপর থেকে নজর সরিয়ে বললো। রুদ্র ততক্ষণে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। 
" এত সময় হবে না। চলো তারচে তিনজন একসাথে এখানেই লাঞ্চ করি। ক্যান্টিনে কিন্তু ভালো ভালো খাবার পাওয়া যায়। "
" আচ্ছা চলুন তাহলে। "
ক্যান্টিনে বসে তিনজনে একসাথে খাবার খাচ্ছে। মিহি রুদ্রকে বলে ওর বাবার বাড়ি অলরেডি একজন আছেন, যার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। শরীফকে পাঠিয়ে দিলেই সে চলে আসবে। 
" তাহলে খাওয়া শেষ হলে তুমি চলে যাও শরীফ। "
" ঠিক আছে ভাইয়া।"
খাওয়াদাওয়া শেষে শরীফ মিহির বাবার বাড়ি চলে যায়। আসরের আজান দিয়েছে। রাহি নামাজ শেষে রান্নাঘরে সবার জন্য চা তৈরি করতে ঢুকেছে। শরীফ বসার ঘরে সোফায় বসে আছে একাই। সালমান খুরশিদও এরমধ্যে নিচে চলে এলেন। শরীফের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। রাহি চা তৈরি করার পরে সুমিকে গিয়ে রেডি হতে বলে। কিন্তু সুমি আর মিতু আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকায় রাহির সাথেই বসার ঘরে এলো। শরীফ তখন চা খাচ্ছিলো। 
" শরীফ ভাই এই হলো সুমি আর এই মিতু ওর মেয়ে। আর সুমি তোমরা উনার সাথে নিশ্চিন্তে যেতে পারো।"
শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই সুমির হৃদকম্পন যেনো কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুমি। শরীফ নিজেও বরফের মতো জমে গেছে। এটা স্বপ্ন না-কি সত্যি বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে এই মুহুর্তটা আর এগোবে না,সবকিছু কেমন ঘোরলাগা হয়ে গেছে। রাহি সুমির নিস্তব্ধতা দেখে ফের বলে উঠলো,
" সুমি? "
রাহির ডাকে হুঁশ ফিরলো সুমির। চক্ষুদ্বয় ছলছল করছে। আশেপাশে লোকজন আছে বলেই হয়তো চোখের জল সংবরণ করলো সে। 
" ঠিক আছে ভাবি। চাচা আমরা গেলাম, কোনো ভুল করলে মাফ কইরা দিয়েন আর চাচিরেও কইয়েন। "
" আরে কীসের ভুল পাগলি? তাছাড়া যাচ্ছো তো আমার মেয়ের বাসায়, দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। "
"আচ্চা।"
সুমি স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতেও কেমন যেনো আঁটকে যাচ্ছে বারবার। মনের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। এই অনুভূতি বলে বোঝনো সম্ভব নয়। শরীফ এখনও স্থির নেত্রে তাকিয়ে আছে সুমির দিকে। হাতে থাকা চায়ের কাপের চা ঠান্ডা হয়ে গেছে কখন সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। সালমান খুরশিদের কথায় টনক নড়ে উঠলো শরীফের। কোনো প্রকার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে পৌঁছুলো শরীফ। সুমি পিছনে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মিতু গাড়ির দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। শরীফ এক নজর তাকালো সুমির দিকে তারপর গাড়ির দরজা খুলে ইশারায় ভেতরে বসতে বললো। সুমি বিনবাক্যে মিতুকে নিয়ে 
গাড়ির ভেতর বসলো। শরীফ ড্রাইভিং সিটে বসেছে কিন্তু গাড়ি স্টার্ট না করে গাড়ি থেকে নেমে সুমির ও মিতুর সিট বেল্ট বেঁধে দিলো। সুমি আর চোখের জল সংবরণ করতে পারলোনা। নিঃশব্দে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়ালো। তবে মিতু কিংবা শরীফ কেউ সেটা খেয়াল করেনি। শরীফকে দেখে মিতুর মনে হচ্ছে তাকে দেখে কোনো হেলদোল নেই শরীফের। এসব ভেবেই কেনো যেনো সুমির কষ্টের মাত্রা দ্বিগুণ বাড়ছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। এত বছর পর দেখা তবুও কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। মানুষ দূরে থেকেও মনের দিক থেকে কাছাকাছি থাকতে পারে যেমন তেমনই পাশাপাশি থেকেও মন থেকে অনেক দূরে থাকতে পারে। লোকটা নিশ্চয়ই এতদিনে বিয়ে-শাদি করে সুন্দরভাবে সংসার করছে! এসব ভেবে বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছে সুমি। 
" মা আর কতক্ষণ লাগবো?"
" রাস্তায় জ্যাম আছে, ঘন্টাখানেক তো লাগবেই। তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে? "
মিতুর প্রশ্নের উত্তর শরীফ দিলো। সুমি কিছু বললো না। মিতু শরীফের সাথে আরো টুকটাক কথা বলতে লাগলো। সুমি বাইরের তাকিয়ে রইলো বাকি সময়। 

সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় পৌঁছালো সুমি,শরীফ ও মিতু। মিহি ওদের জন্য অপেক্ষা করেই বসে ছিলো। তাই কলিংবেলের আওয়াজ শুনতেই দরজা খুলে দেয় মিহি। সুমি আর মিতুকে পৌঁছে দিয়ে শরীফ গাড়ি নিয়ে রুদ্রর হসপিটালের দিকে রওনা দিলো। 
" আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো তোমাদের? "
সুমি ও মিতুকে দোতলায় ঘর দেখিয়ে দিয়েছে মিহি। বিছানায় বসে আছে মিতু,সুমি দাঁড়িয়ে। 
" না আপা।"
" আচ্ছা শোনো আমি তোমাদের তুমি করে ডাকবো,তোমরাও তাই ডেকো।"
" আচ্চা আপা।"
" তোমার কি শরীর ঠিক আছে সুমি? না-কি এভাবেই কম কথা বলো তুমি? "
সুমির কথাবার্তা কেমন অদ্ভুত ঠেকলো মিহির কাছে এজন্যই জিজ্ঞেস করলো। আসলে শরীফের আচরণে খুব খারাপ লেগেছে সুমির। বেশি কিছু তো আশা করেনি সে,অন্তত "কেমন আছো " জিজ্ঞেস করতে পারতো! 
" আসলে আপা মাতা ব্যাথা করতাছে একটু এইজন্য আরকি।"
" ওহ আচ্ছা। তুমি বরং রেস্ট করো,আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি। সেগুলো খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবে। আর তোমার মেয়েকেও কিছু খাইয়ে দিও। "
মিহির আন্তরিকতায় সুমি অবাক হলো। এতটা ভালো কীভাবে কেউ হয়! 
" না আপা কিচ্ছু লাগবো না এহন। রাইতে খাইয়া ঔষধ খামু লাগলে।"
" ঔষধ না খেলেও কিছু খেতে পারো। ডাইনিং টেবিলের উপর ফলের ঝুড়ি রাখা আছে, সেখান থেকে না হয় কিছু ফল দিও ওকে।"
মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো মিহি। সুমি উত্তর করলোনা। মিহি নিজের ঘরে পড়তে চলে গেলো।
চেম্বার থেকে বের হয়েছে রুদ্র ও শরীফ। শরীফের চোখমুখ কেমন শুকনো লাগছে রুদ্রর। এতক্ষণ চেম্বারে অনেক রোগীর ভীড় থাকায় কথা বলার সুযোগ পায়নি সে। কিন্তু হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসা মাত্রই শরীফকে জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে? 
" কিছু হয়নি ভাইয়া।"
শরীফ গাড়ি চালাচ্ছে, রুদ্র পাশের সিটে বসেছে আজ। শরীফ এমনিতে রুদ্রর থেকে কখনো কিছু লুকায় না। 
" শরীফ আমি তোমার চোখ পড়তে পারি,কী হয়েছে বলো।"
" ভাইয়া সুমিকে দেখলাম আজ কতগুলো বছর পর। "
" কোথায়!"
" তোমাদের বাসায় দিয়ে এলাম,ওই বাড়ি থেকে যাকে আনতে গিয়েছিলাম সেই সুমি।"
" ও মাই গড! তারপর কী হলো? কথা বললে?"
" নাহ। ওর একটা মেয়ে আছে পাঁচ / ছয় বছর হবে। "
" তারজন্য কথা বলোনি?"
রুদ্রর এই প্রশ্নে শরীফ উত্তর দিলো না। নিজেকে নিজেই বুঝতে পারছেনা রুদ্রকে কী বলবে? রুদ্র ফের শুধালো,
" কী হলো বলো? এত বছর পর দেখা হলো অথচ সে কেমন আছে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলে না?"
" জিজ্ঞেস করার দরকার ছিল না ভাইয়া,ওর চোখমুখ বলে দিচ্ছিলো ও ভালো নেই। চোখের নিচের কালো দাগ বলে দিচ্ছিলো এক আকাশ চিন্তা নিয়ে কতো রাত নির্ঘুম কেটেছে তার।"
" এখনও এতো ভালোবাসো?"
" আপনি কী ভুলতে পেরেছেন ভাইয়া? তাছাড়া সুমি আমাকে ঠকায়নি। ও এখনো আমাকে ভালোবাসে, চোখ কখনো মিথ্যা বলে না।"
রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শরীফের কাঁধে হাত রাখলো।



চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন