মনেরও গোপনে (পর্ব ২৪)


#মনেরও_গোপনে 
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৪



" আপনি থাকতে আমারে ডাকলেন ক্যান ভাই? "
" কথা পরে বলো আগে পাল্টে দাও প্লিজ,ঠান্ডা লেগেছে খুব ওর। আমারই ভুল ড্যাম ইট!"
রুদ্র নিজের উপর রেগে গেছে খুব। কেনো যে তখন বৃষ্টিতে ভিজতে যাওয়ার কথা বললো! মিহির জন্য আলমারি থেকে থ্রিপিস বের করে দিয়ে রুদ্র ওয়াশরুমে গিয়ে ভেজা জামাকাপড় পাল্টাতে গেলো। সুমি মিহির জামাকাপড় পাল্টে পাশে বসে হাত ও পায়ের তালুতে ঘষা দিচ্ছে। একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে মিহির শরীর। সুমি বেশ ভরকে গেছে বটে। রুদ্র ওয়াশরুম থেকে বের হতেই সুমি ভয় জড়সড়ভাব করে বললো,
" ভাই আপার কী হইছে! এক্কেরে সারা শরীল ঠান্ডা হইয়া গেছে। "
" বৃষ্টিতে ভিজেছে এজন্য। তুমি এখন যাও আমি সামলে নিবো। চিন্তা করতে হবে না। "
" আইচ্ছা ভাই লাগলে ডাক দিয়েন আবার। "
সুমি নিঃশব্দে ঘর ত্যাগ করলো। রুদ্র মিহির পাশে বসলো। মিহির চোখ বন্ধ কিন্তু ঠোঁটগুলি কাঁপছে। রুদ্র মিহির গায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করছে। শরীরে তেমন তাপ বৃদ্ধি পায়নি উল্টো ঠান্ডা হয়ে আছে। রুদ্র ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত একটা বেজেছে। মিহিকে আরো ভালো করে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়ে ঘরে পায়চারি করতে শুরু করলো। দেখে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না শুধু শরীরের তাপমাত্রা কমে গেছে ঠাণ্ডায়। 
" মা...."
মিহি অস্ফুটে কিছু বলতেই রুদ্র তড়িৎ গতিতে মিহির পাশে বসে।
" মিহির দানা? এই মিহির দানা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার? "
" ডাক্তার সাহেব... "
মিহির মুখে "ডাক্তার সাহেব " ডাকটা শুনে কেমন ভালো লাগলো রুদ্রর। কপালে হাত রেখে রুদ্র হেসে বললো, 
" হ্যাঁ বলো।"
" আমার... "
" হ্যাঁ তোমার কী?"
" খু..."
মিহি কথা বলতে পারছেনা ঠিকমতো। শরীর কাঁপছে রীতিমতো ঠান্ডায়। অবস্থা বেগতিক দেখে রুদ্র মিহির কম্বলের মধ্যে ঢুকে জড়িয়ে ধরলো। মিহি রুদ্রর শরীরের উষ্ণতায় একটু নড়েচড়ে উঠলো। হিমশীতল শরীরের পাশে হঠাৎ রুদ্রর উপস্থিতি তাপের সঞ্চার মনে হলো মিহির অবচেতন মনের। রুদ্র মিহির হাতের তালুতে ঘষা দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে একটু গরম হয় মিহির হাত। শীতের মধ্যে কেনো যে বৃষ্টিতে ভিজতে গেলো এই কারণে বারবার নিজের উপর ক্ষেপে যাচ্ছে রুদ্র। 
" ডাক্তার সাহেব! "
আনমনে তাকিয়ে ছিলো রুদ্র। মিহির ডাকে তার দিকে তাকালো সে। অল্প অল্প চোখ মেলে তাকিয়েছে মিহি। 
" কেমন লাগছে এখন?"
রুদ্র আস্তে করে সরে যেতে চাইলো মিহির কাছে থেকে। কিন্তু মিহু দূর্বল শরীরে জড়িয়ে রাখতে চাইলো রুদ্রকে। 
" ছেড়েই যখন যাবেন তাহলে কাছাকাছি এসেছিলেন কেনো?"
" তোমার শরীর, মাথা কোনোটাই ঠিক নেই এখন।"

মিহি রুদ্রর পিঠে এত জোরে আঙুল দিয়ে ধরেছে যে রীতিমতো নখের কারণে ব্যথা পাচ্ছে সে। কিন্তু রুদ্র কিচ্ছু বললো না। মিহি আধো আধো চোখে রুদ্রর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলো। রুদ্র চমকালো,মেয়েটার কী হয়েছে! কিন্তু রুদ্র কিছু বলার আগেই মিহি রুদ্রর ওষ্ঠ নিজের দখলে করে নিলো। মুহুর্তেই কেঁপে উঠলো রুদ্র। মিহি এখন হুঁশে নেই বলে ছাড়াতে চাইলো সে। কিন্তু মিহির আবেদন অগ্রাহ্য করার সাধ্য হলোনা তার। মিহিকে জড়িয়ে ধরে নিজেও গভীর চুম্বনে লিপ্ত হলো প্রিয়তমার সাথে। 

সকাল হতেই সুমি কয়েকবার রুদ্র ও মিহির ঘরের বাইরে এসেছিলো। কিন্তু এখনো ভেতর থেকে দরজা আঁটকা ছিলো বলে আর ডাকতে পারেনি সে। অগত্যা রহমান চাচার সাথে হাতে হাতে নাস্তা তৈরি করতে শুরু করে সুমি। মিতুও ঘুমোচ্ছে এখনো। রহমান চাচা ফজরের নামাজ শেষে আর ঘুমান না। সোজা এই বাড়িতে এসে নাস্তা তৈরি করার কাজে লেগে যায়। এ নিয়ে মাঝে মধ্যে তার স্ত্রী তহমিনা অভিমান করেন অবশ্য। তবে রুদ্রর প্রতি রহমানের ভালোবাসা তারও কিছু কম নয়। চুলোয় চায়ের জন্য পানি বসিয়ে টোস্ট তৈরি করছেন রহমান চাচা। সুমি পাশে দাঁড়িয়ে সেদ্ধ ডিমগুলোর খোসা ছাড়িয়ে অন্য পাত্রে রাখছে।
" তুমি আবার বাসনকোসন পরিষ্কার করতে গেলে কেনো মা?"
রহমান চাচা পরম মমতার সাথে সুমির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন। সুমি হাসলো, রহমান চাচার ঠোঁটের কোণেও হাসি। 
" আফনে আমার বাবার বয়সী, সব কাম আফনেরে ক্যামনে করতে দেই?"
সুমির কথায় রহমানের বুকের ভেতর কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো। বাবা! দু-চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে রহমান চাচার। সুমি বিষয়টা বুঝতে পেরে ফের বলে উঠলো,
" আমার তো বাপ থাইকাও নাই, আপনার বুঝি মাইয়া নাই? "
" নাহ মা, আমার কোনো সন্তান নেই। "
" তাতে কী হইছে! রুদ্র ভাই তো আফনের পোলার মতোই আর এহন তো আমিও আছি। আফনের মাইয়া!"
রহমান চাচা হুট করেই সুমির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে কেঁদে উঠলেন। সুমি উনার চোখের অশ্রু মুছে দিলো। 
" সত্যি তুমি আজ থেকে আমার মেয়ে। "
নতুন মেয়েকে নিয়ে রহমান চাচা খুব খুশি আর সুমিও। দু'জনে মিলে হাতে হাতে খাবারগুলো ডাইনিং টেবিলে পরিবেশন করে। তারপর চেয়ারে বসে আরো কিছুক্ষণ কথোপকথন চলে তাদের। এরমধ্যেই শরীফ এসে উপস্থিত হয়। দরজা ভেজানো ছিলো বলে বিনা কলিংবেলের আওয়াজে বাসায় প্রবেশ করেছে সে। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতটা শরীফকে দেখা মাত্রই ফের দগদগে হয়ে উঠলো সুমির। 
" শরীফ তুমি! তা-ও এই সকালবেলা? "
এমনিতে সকালে রুদ্র নিজেই ড্রাইভ করে হসপিটালে যায়। তাই রহমান চাচা শরীফের আগমনে কিছুটা অবাক হয়েছেন।
" আসলে আজকে যদিও হসপিটাল ছুটি কিন্তু ডাক্তারদের তো ছুটির সুযোগ কম। আজকে একটা সিরিয়াস পেসেন্ট আসবে, হঠাৎ করে কল দিলেন তারা। আর যেহেতু আগেও এসেছিলেন তাই না করা যায়নি। এদিকে রাত থেকে রুদ্র ভাইয়াকে কতবার কল দিলাম ধরছে না। ভাবলাম কোনো বিপদআপদ হয়নি তো?"
বিপদের কথা শুনে সুমি ভাবলো মিহি আপার শরীর খারাপের কথা বলা দরকার সবাইকে। 
" চাচা মিহি আফার শরীর খারাপ ছিলো গত রাইতে। মনে হয় ঘুমাইতেও পারেনাই ভাই ঠিকমতো। "
শরীফ সুমির কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। দীর্ঘ দিন পর কথা বলতে দেখলো প্রেয়সীকে। রহমান চাচা কিছুটা উদগ্রীব হয়ে শরীফকে বললেন, 
" তাহলে এখন ডাকতে হবে না ওদেরকে। সাড়ে আটটা বাজে তো কেবল,তা রোগী মনে হয় আরো দেরিতে আসবে তাই না? "
" হ্যাঁ উনারা সাড়ে দশটার দিকে আসবেন বলেছেন। "
" তুমি তাহলে নাস্তা করতে শুরু করো। রুদ্র বাবা আর মিহি মা একসাথে খেয়ে নিবে।"
রহমান চাচা, শরীফ ও সুমিকে সকালের নাস্তা খেতে দিলেন। এ বাড়িতে কাউকে হেয় চোখে দেখে না রুদ্র। এখানে সবার পরিচয় শুধু মানুষ হিসেবে ধনী-গরিব হিসেবে নয়।
সকালের মিঠে রোদ জানালা দিয়ে প্রবেশ করে মিহির মুখখানায় পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো তার। ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকালো মিহি। বিবস্ত্র শরীরে মিহিকে জড়িয়ে আছে রুদ্র। যদিও শুধু টিশার্ট নেই। মিহি দ্রুত রুদ্রর বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো ।
" উফ! মিহির দানা একটু ঘুমোতে দাও প্লিজ।"
" ইশশ! কী আদুরে আবদার। ছাড়ুন বলছি।"
রুদ্র ছাড়লো না মিহিকে। ঘুমের দেশে তলিয়ে গেছে আবারও সে। মিহি আস্তে করে রুদ্রর হাত নিজের গায়ের উপর থেকে সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো। কিন্তু ওড়না খুঁজতে গিয়ে দেখলো সেটা ফ্লোরে পড়ে আছে। মিহির বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। কী হয়েছিলো গতরাতে? মিহি দ্রুত আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলো চুলগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেছে। ঠোঁটের কোণে কেমন লাল দাগ হয়ে গেছে। সবকিছু বুঝে উঠতেই ভীষণ লজ্জা পেলো মিহির। সবকিছু এভাবে না হয়ে অন্যভাবে হলেও তো হতো? কিছু মনে নেই মিহির এটা ভাবতেই খারাপ লাগছে। লোকটা কেনো তার অবচেতন অবস্থায় এসব করতে গেলো! ন'টা বেজেছে, এলার্ম-ঘড়ি তার সময়মতো বাজতে শুরু করেছে তাই। মিহি জানে রুদ্রর ঘুম এখুনি ভেঙে যাবে। তাই আর দেরি না করে দ্রুত বাথরুমে চলে গেলো গোসল করতে। এরকম এলোমেলো অবস্থায় সামনে পড়তে চায় না সে মোটেও। 
এলার্ম-ঘড়ির অত্যাচারে বেশিক্ষণ ঘুমানো সম্ভব হলো না রুদ্রর পক্ষে। মিহিকে পাশে দেখতে না পেয়ে বাথরুমের দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করলো সে। বাইরে থেকে লক করা না মানে ভেতরে মিহি আছে। গতরাতের সুখকর স্মৃতি রোমন্থন করতেই আনমনে হেসে উঠলো রুদ্র। নিশ্চয়ই মেয়েটার কিছু মনে নেই ভেবে ঠোঁটের কোণের হাসি আরও প্রসস্থ হলো।



চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন