#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৭
শরীফ যতক্ষণ দৃষ্টি সীমানার মধ্যে ছিলো সুমি দাঁড়িয়ে থেকেছে। তারপর দৃষ্টির আড়াল হতেই দ্রুত পায়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দরজা আঁটকে নিজের রুমে চলে গিয়েছে। মিতু পাশ ফিরে কম্বল মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। সুমি আস্তে করে মেয়ের পাশে শুয়ে ললাটে চুম্বন এঁকে দিলো। মিতু ছোটো থেকে মায়ের কষ্ট বোঝে। বাবার অত্যাচার দিন দিন দেখতে দেখতে বাবা নামক মানুষটাকে ঘৃণা করে এখন। কিন্তু সেই বাবার জায়গায় অন্য কোনো মানুষকে কি মেনে নিবে সে? এই প্রশ্ন মনের মধ্যে বারবার ঘুরছে সুমির। মিতুর অমতে কিছুতেই শরীফকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে পারবেনা।
সকালের মিঠে রোদ্দুর জানালা ভেদ করে চেম্বারে প্রবেশ করছে। শহুরে মানুষের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারদিক। সকাল সকাল তেমন রোগীর ভীড় না থাকলেও জনাকয়েক রোগী আছে বটে। রুদ্র এক এক করে সবাইকে দেখে বিদায় দিতেই শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। আসলে সকাল থেকেই রুদ্র শরীফের অস্থিরতা খেয়াল করেছে। তাই সুযোগ হতেই কথা বলবে বলে ভেবে রেখেছিলো রুদ্র।
" শরীফ,সামনের চেয়ারে এসে বসো তো।"
শরীফ রুদ্রর কথা দ্বিমত পোষণ না করে চেয়ারে এসে বসলো। দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো শরীফ। গতরাতে যেভাবে বিষয়টা বলবে ভেবেছিলো এখন মনে হচ্ছে বিষয়টা ততো সহজ না। পরস্ত্রী'কে বিয়ে করার ইচ্ছে বড়ো ভাই সমতুল্য লোকটাকে অকপটে বলার সাহস হচ্ছে না তার।
" এখন বলো এক্সাক্টলি কী হয়েছে? "
শরীফকে চুপ থাকতে দেখে ফের রুদ্র প্রশ্ন করলো। শরীফ দোনোমোনো করতে করতে বললো,
" ভাই কাল সুমির সাথে কথা হয়েছিলো।"
" তারপর? কী বললো?"
রুদ্র বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শরীফের চেহারার দিকে। শরীফ লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
" ওর স্বামীর থেকে ডিভোর্স আনতে হবে ভাই। কীভাবে কী করবেন আপনি জানেন। আপনি ছাড়া এসব দেখা কিংবা বোঝার মতো আর কোনো মানুষ নেই আমার। "
" আমার যতদূর মনে হয় ওর হাসবেন্ড এমনি ডিভোর্স পেপারে সাইন করবে। কারণ এতদিন গেলো অথচ স্ত্রী'র কোনো খোঁজ নিতে আসেনি। অবশ্য কোথায় এসেছে সেসব তো জানেও না সে।"
" সুমির কাছে যতটা শুনেছি খুব অত্যাচার করতো লোকটা। "
" আমি উকিল আঙ্কেলের সাথে কথা বলে আজই ডিভোর্স পেপার তৈরি করার কার্যক্রম শুরু করতে বলছি। তারপর যদি সাইন না করে দেখা যাবে। তবে সুমি এক তরফাও ডিভোর্স দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে সবুজের কিছু করার নেই। দেশে নারীদের পক্ষে আইনের সুবিধা একটু বেশিই। "
" ঠিক আছে ভাইয়া। কিন্তু কতদিন লাগবে কাগজ আসতে? "
" আমার ভাইয়ের কী বিয়ের জন্য আর তর সইছে না?"
রুদ্র মজা করেছে বুঝতে পেরে শরীফ বেশ লজ্জা পেলো।
" ভাইয়া!"
" হয়ে যাবে। অপেক্ষা করো কিছুদিন। আমি নিজে যাবো সবুজের সাইন নিয়ে আসতে। "
" আচ্ছা ভাইয়া।"
পরিবারে নতুন সদস্য আসার জন্য আজ সালমান খুরশিদের বাড়ি ভোজ উৎসব। মিহি,রুদ্র, রহমান, সুমি,মিতু ও শরীফ সবাই এসেছে। তোশাদের পরিবারের সবাইকে বলেছিলো যদিও কিন্তু তোশা নতুন সংসার ফেলে আসতে পারেনি। আর ওর বাবা-মাও তাদের নিজস্ব কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে বলে জানিয়েছে। রান্নার জন্য আলাদা লোক রাখা হয়েছে। মর্জিনা নামে মাঝ বয়সী একজন মহিলা এখন বাসার সব কাজ করে। রিনা বেগম অবশ্য রান্নার সময় উপস্থিত থাকেন। যোহরের আজান দিয়েছে। রান্নাবান্নাও শেষের পথে। সবাই নিজেদের মধ্যে যার যার পছন্দ সহিত বিষয় নিয়ে কথা বলছে। মিহি রাহির সাথে বেডরুমে এসেছে অনেকক্ষণ।
" তারপর? ভালোবাসা হলো তো দুজনের মধ্যে? "
রাহি মিহিকে জিজ্ঞেস করলো। মিহি হেসে বললো,
" তা হয়েছে। পাগল লোক একটা! "
" তাই বুঝি? ননদী আমার ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে যে! এতো লজ্জাবতী হলে কবে থেকে? "
" ভাবি! ভালো হবে না বলছি। আমি বুঝি বেশরম? "
" তা হবে কেনো? আমি বললাম বিয়ের পরে লজ্জা আরো বেড়ে গেছে। লোকে অবশ্য বলে,বিয়ের পরে না-কি লজ্জাশরম কমে যায়। "
" লোকের সব কথা যে সঠিক হয় না তা তো প্রমাণ পেলেই! তোমার শরীর কেমন আছে এখন?"
" আলহামদুলিল্লাহ। বাড়ির সবাই এত খেয়াল রাখছে ভালো না থেকে উপায় আছে বলো?"
" যাক মা যে তোমাকে মন থেকে ভালোবাসতে পেরেছে এটাই শুকরিয়া। "
" হ্যাঁ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ভালোবাসা দিলে ঠিক ভালোবাসা মিলে। তবে সময় লাগে, কষ্ট সহ্য করতে হয়। আর এরপরেও যদি কেউ ভালো না বাসে তার ভালোবাসার দরকার নেই। কারণ সব সময় সবাইকে ভালোবাসলেও ভালোবাসা মিলে না।"
" তা ঠিক বলেছো। নিচে চলো,দেখি রান্না কতদূর হলো। আজকে মা চিংড়ী মাছের মালাইকারি রান্না হচ্ছে শুনে ক্ষিদে পেয়ে গেছে। "
" হাহাহা! চলো তাহলে। "
মিতুকে বাগানে খেলতে পাঠিয়ে দিয়ে রুদ্র, শরীফ ও সুমির বিষয় সবকিছু খুলে বলেছে। যেহেতু সুমি প্রথমে এই বাড়িতেই এসেছিলো তাই তাদের সবার জানার অধিকার আছে এ বিষয়। রিনা বেগম স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টা মন থেকে মানতে পারছেন না। তাই বসার ঘর থেকে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। একটা মেয়ে আছে আবার আরেকটা পেটে! এই অবস্থায় অন্য একটা পুরুষের সাথে কীভাবে বিয়ের কথা ভাবতে পারে মেয়েটা? নাহ মিহির বরের কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। মনে মনে এরকম অনেক কথাই ভাবতে লাগলেন রিনা বেগম। সালমান খুরশিদ সবকিছু শুনে চুপ করে আছেন। সুমি আর শরীফ ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র সোফায় বসা।
" দেখো সুমি তোমার স্বামী তোমার উপর যেসব অত্যাচার করেছে সেসব আমি সমর্থন করি না। সবচেয়ে বড়ো কথা, তোমার জীবন তোমার সিন্ধান্ত। বাবা-মা সব সময় সন্তানের মঙ্গল চাইলেও আদতে সর্বদা মঙ্গল হয় না। যেমনটা তোমার সাথে হয়েছিল। তাই এবার নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী বিয়ে করে দেখো তকদীরে কী আছে। আর শরীফকে আমি যতটুকু দেখেছি, ছেলেটা তোমাকে অযত্নে রাখবে না। তোমার সন্তানরা-ও ভালো থাকবে। "
বেশ লম্বা কথা বললেন সালমান খুরশিদ। সবাই সেগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। সুমি সালমান খুরশিদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। যদিও তিনি এরকম সালাম করা পছন্দ করেননা তবুও সুমিকে কিছু বললেন না। বরং মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিঞ্চিৎ।
" দোয়া করবেন চাচা।"
" আমার দোয়া সব সময় তোমাদের সাথে আছে। "
" কী ব্যাপার সবার মুখ এত সিরিয়াস মনে হচ্ছে কেনো? ডাক্তার সাহেব! কিছু হয়েছে? "
সুমি ও সালমান খুরশিদের কথোপকথনের মধ্যে রাহি ও মিহি এসে উপস্থিত হয়েছে বসার ঘরে। রুদ্র মুচকি হেসে বললো,
" তেমন কিছু হয়নি। বাড়ি গিয়ে সবকিছু বলবো তোমাকে। "
" আচ্ছা তোমরা বসো সবাই আমি গিয়ে দেখে আসি রান্না কতদূর। "
রাহি রান্নাঘরের দিকে গেলো। মিহি বাবার পাশের সোফায় বসলো। এদিকে রান্না শেষে মর্জিনা আর রিনা বেগম খাবার ডাইনিং টেবিলে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাহিকে দেখেই রিনা বেগম বললেন,
" শুনেছো কিছু? "
" কী শুনবো মা?"
" ওই ড্রাইভার শরীফের সাথে না-কি সুমির বিয়ে হবে। কী অনাচার! "
বিষয়টা বুঝতে একটু সময় লাগলো রাহির। তাহলে এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তখন। কিন্তু মিহি মনে হয় কিছু জানে না এইসব বিষয়।
" মা যার জীবন সে যেভাবে ইচ্ছে চালনা করুক। তাতে আমাদের কী? আমরা বরং আমাদের নিজেদের কথা ভাবি?"
পুত্রবধূর কথা বিশেষ ভালো লাগেনি রিনা বেগমের। তবুও ম্লান হাসলেন তিনি।
" তুমি গিয়ে সবাইকে খাওয়ার টেবিলে আসতে বলো। আমরা খাবার নিয়ে আসছি। "
" হ্যাঁ আসুন। মিহিকে আজকে বেশি চিংড়ীর মালাইকারি দিবেন মা। আপনার হাতের রান্না খায়নি অনেক দিন। "
মেয়ের কথা শুনে প্রানখুলে হাসলেন রিনা। আহ্লাদী কন্ঠে বললেন,
" পাগল মেয়ে আমার। "
দুপুরে সবাই গল্প করতে করতে খাওয়াদাওয়া শেষ করলো। রুদ্র হসপিটাল থেকে একদিনের ছুটি নিয়েছে। আজকে এই বাড়িতে থাকবে। কাল সকালে শরীফ রুদ্রকে পৌঁছে দিয়ে পরে মিহি আর সুমিদের বাসায় নিয়ে যাবে।
দুপুরের রোদের তেজ কমে এসেছে। ডিসেম্বরের হালকা হিমেল বাতাসে গ্রামের শীত ভালোই পড়েছে। মাটির রাস্তার একেবারে শেষ মাথায় একটা ছোটো দোকান। সেখানেই বসে সিগারেট ফুঁকছে সবুজ। পাশে আরো লোকজন বসে চা-সিগারেট খাচ্ছে।
" কী রে সবুজ তোর বউ তো আর ফিইরা আইলো না! কার লগে পলাইয়া গেলো রে?"
দোকানী রুহুল কবিরের কাছ থেকে সুমির বিষয় এসব কথা শুনে কোনো প্রকার হেলদোল নেই সবুজের। সিগারেটের ছাই পাশে ফেলে আরেকটা সুখটান দিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বলে,
" গেছে ভালা হইছে। ওই গ্যারামের কুলসুম আছে না? হেয় আমারে খুব পছন্দ করে। ওরে বিয়া করমু ভাবতেছি।"
দোকানী রুহুল কবির সবুজের কথায় হাসে। সবুজ বোঝে এরা বিদ্রুপের হাসি। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে সবুজের। কিছুটা রাগ সংবরণ করে ফের বলে সবুজ,
" দাঁত বাইর কইরা হাসেন ক্যান মিয়া?"
" বিয়া যে করবি তা খাওয়াবি কী হুনি? থাহোস তো অর্ধেক দিন বাংলা মদ খাইয়া।"
সবুজ সিগারেটের বাকি অংশ না শেষ করেই মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো সেটা। রুহুল কবিরের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঠিক কিন্তু কিছু না বলেই দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো সে।
চলবে............................