#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৮
সবুজ সিগারেটের বাকি অংশ না শেষ করেই মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো সেটা। রুহুল কবিরের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঠিক কিন্তু কিছু না বলেই দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো সে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তার বিপক্ষে। বিকেলের দিকেই পাশের গ্রামে কুলসুমের সাথে দেখা করতে যায় সবুজ। কুলসুম দেখতে সুন্দরী, যথেষ্ট আকর্ষণীয়। আর সেই মোহে মজেছে সবুজ। কুলসুমের বিষয় এই গ্রামে মোটামুটি সবাই জানে। অনেকেই বলে অনেকগুলো বিয়ে করেছিলো সে। আবার অনেক পুরুষের সাথে বিনা বিয়েতেও শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে। এতকিছু সবুজ জেনেও এই মেয়ের জন্যই উতলা হয়ে আছে। অবশ্য কুলসুম কীসের জন্য সবুজকে পাত্তা দিচ্ছে সেটা কারো বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ সবুজ তো আর্থিকভাবে সচ্ছল না।
বিকেলের ম্লান রোদ্দুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কুলসুম। বাড়িতে সদস্য বলতে কেউ নেই। একা একটা টিনের বাড়িতে থাকে সে। মাঝে মধ্যে লোকের বাড়িতে গিয়ে কাজকর্ম করে কুলসুম। কিন্তু সবাই কুলসুমের সাথে মেশে না।
সবুজ বারান্দায় চেয়ারে বসে একদৃষ্টি তাকিয়ে আছে কুলসুমের পাতলা শাড়ির দিকে। শাড়ি ভেদ করে তার দৃষ্টি এখন কুলসুমের শরীরের ভাঁজে। কুলসুম সবুজের দিকে দৃষ্টিপাত করলো।
" কী দ্যাখতাছেন?"
সবুজ হাসলো। হাসির বদলে কুলসুম ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে সবুজের পাশে এসে বসলো। কুলসুমের কাছে ইশারা পেয়ে সহসাই সবুজ কুলসুমের হাত চেপে ধরে। কুলসুম আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নিলো।
" বোঝোস না তুই? আর কতো দূরে দূরে থাকবি! এবার তো কাছে আয়।"
" আমারে পাওন এত্তো সোজা না সবুজ মিয়া। তা আফনের বউয়ের কোনো খবর পাইছেন? "
সুমির কথা তুলতেই চকিতে মুখ গম্ভীর করে ফেলে সবুজ। মনে হচ্ছে সুমি নামটা এই মুহুর্তে অসহ্য লাগছে।
" জানি না। তয় ও ফিরলেও আমি তালাক দিমু।"
" দেহেন কী করবেন। তয় আমি আবার ভাগাভাগি করতে পারুম না। আমার সব লাগবো। "
" তয় একখানা সমস্যা আচে।"
" কী সমস্যা? আফনের বউয়ের কাবিনের টেহা বেশি? "
" আরে না কুলসুম। ওর পেটে তো বাচ্চা এহন। আর হুজুর কইলো এই অবস্থায় তালাক হইবো না।"
" ওওও। "
কুলসুম বারান্দা পেরিয়ে বাইরে নামে। পিছনে পিছনে সবুজও হাঁটে। দুই গ্রামের লোকজন আড়ালে কানাকানি করে। সুমির মতো ভালো মেয়েটাকে কীভাবে সবুজের সাথে বিয়ে হয়েছিল সেসব নিয়ে কতো কথা।
দিন দিন শরীর খারাপ হচ্ছে সুমির। কিন্তু সেসব সুমি মিহিকে বলে না। কারণ সুমি জানে সবুজের অমানবিক মারধরের জন্য হয়তো শরীরে এত কষ্ট। এমনও হয়েছে রাতে ঠিকমতো তৃপ্তি মেটাতে না পারায় এই অবস্থায় পেটে,পিঠে লাথি মেরে*ছে সবুজ। রাত গভীর কিন্তু চোখে ঘুম নেই। মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সুমি। দৃষ্টি জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে খোলা আকাশের দিকে। শরীরের এই অবস্থা রুদ্র কিংবা মিহিকে জানানো উচিত। নিজের জন্য না হলেও অনাগত সন্তানের জন্য তো বটেই। সারারাত বালিশে মাথা রেখে এই সিন্ধান্ত নিয়েছে সুমি। তাই সকাল হতেই মিহিকে বলার জন্য ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছে সুমি। রহমান চাচা প্রতিদিনের মতো খাবার তৈরি করে টেবিলে রেখে দিয়েছে। মিতু আগেই খেয়ে নিজের ঘরে বসে টিভি দেখছে। টিভি যন্ত্রটা একেবারে নতুন মিতুর কাছে। তাই এ বাড়িতে আসার পর থেকেই টিভিতে বিভিন্ন কার্টুন দেখছে সে।
" সুমি মা তোমাকে এত অস্থির লাগছে কেনো? শরীর ঠিক আছে তো?"
রহমান চাচা সুমির পাশের চেয়ারে বসলেন। সুমিকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে উনার। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
" আসলে শরীলডা কেমন লাগে ইদানীং। হেই লাইগা আপারে কমু।"
" ওই তো মিহি আসছে। "
সিড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় সুমির কথাগুলো শুনেছে মিহি।
" তোমার শরীর খারাপ আগে বলোনি কেনো?"
" আগে তো বেশি ছিলো না এইজন্য কমু কমু কইরা কওয়া হয়নাই। "
" ঠিক আছে। তুমি নাস্তা করে রেডি হয়ে নাও, আমার আজ ক্লাস নেই। তোমাকে নিয়ে হসপিটালে যাবো।"
মিহি নাস্তা খেতে খেতে বললো। রুদ্র কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। যেদিন মিহির ক্লাস থাকে না সেদিন একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে সে। সুমি তেমন কিছু খেলো না কেবল এক টুকরো পাউরুটি খেয়ে পানি পান করলো।
" আমারে মাফ কইরা দিয়েন আপা। আফনেরে এতো জ্বালা দিতাছি।"
" আরে পাগলি কীসের কষ্ট? যাও মিতুকেও রেডি করো। কিছু জামাকাপড় কিনে দিবো ওকে।"
সুমি কিছু বললো না শুধু কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ঘরে গিয়ে মিতুকে রেডি করে নিজেও বোরকা পরে নিলো। হসপিটালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা বারোটা বেজে গেছে প্রায়। এখানে সব ডাক্তারের রোগীদের সিরিয়াল অনুযায়ী দেখা হয়। কিন্তু মিহি বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই রুদ্রকে সিরিয়ালের ব্যবস্থা করতে বলায় অসুবিধা হয়নি। ডাক্তার তামান্না ইসলামের চেম্বারে বসে আছে মিহি ও সুমি। মিতু শরীফের সাথে বাইরে আছে। তামান্না ইসলাম গাইনী বিশেষজ্ঞ।
" আপনি ডক্টর রুদ্র চৌধুরীর স্ত্রী? "
তামান্না ইসলাম মিহিকে ভালো করে দেখে নিলেন একবার। সুমির পোশাক-আশাক আর মিহির পোশাক-আশাকের আকাশ পাতাল পার্থক্য। মিহির পরনে মেরুন রঙের দামী থ্রি-পিস আর সুমির আপাদমস্তক কালো রঙের বোরখা দিয়ে আবৃত।
" জি। "
" রোগী আপনার কী হয়?"
" আমাদের অতিথি। আপনি কাইন্ডলি ভালো করে দেখুন ম্যাম ওর কী সমস্যা। "
" আপনি গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমি আসছি।"
মিহি সুমিকে ইশারায় রোগীর সিটে গিয়ে শুতে বলে। সুমি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলো। ডাক্তার তামান্না সুমির কাছে গিয়ে প্রেশার মাপলেন। চোখ,জিহ্বা দেখলেন। তারপর ফের মিহির পাশে এসে বসলো সুমি।
" মিসেস রুদ্র আমি কিছু টেস্ট লিখে দিচ্ছি এগুলো আজকের মধ্যেই করানোর চেষ্টা করুন।"
" অ্যানিথিং সিরিয়াস ডক্টর? "
" যেটা আন্দাজ করছি সেটা হলে অবশ্যই সিরিয়াস ইস্যু। যাইহোক নেগেটিভ ভেবে মন খারাপ করবেন না। টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসুন।"
এমনিতেই সুমি ভীতু তার উপর ডাক্তারের ভারিক্কি কথোপকথনে আরো ঘাবড়ে গেছে। মিহি সুমিকে নিয়ে চেম্বারের বাইরে বেরোতেই রুদ্রকে দেখলো। রুদ্র দাঁড়িয়েছিলো এতক্ষণ।
" ভাইয়া আমার মাইয়া কই?"
" মিতু শরীফের সাথে আছে। বাইরে গেলো একটু আগেই। কী বললেন ডাক্তার? কোনো টেস্ট দিয়েছেন? "
" আপাতত এই টেস্টগুলো করাতে হবে। আপনিও আমাদের সাথে চলুন।"
" ঠিক আছে চলো। দোতলায় ডায়াগনস্টিক ল্যাব। "
" ওকে।"
সুমিকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করানোর উদ্দেশ্যে দোতলায় গেলো রুদ্র ও মিহি।
বাসার সামনেই একটা ছোটো পার্ক আছে আদ্রিয়ানদের। সেখানেই স্বামীকে নিয়ে এসেছেন রিনা বেগম। সকালে হুট করেই সালমান খুরশিদ বললেন কতদিন একসাথে হাঁটা হয়নি দুজনের। কথাটা তলিয়ে ভাবতে রিনা নিজেও তার সত্যতা উপলব্ধি করে। তাই রাহিকে বাসায় রেখে দু'জন হাঁটতে বের হয়েছে। অবশ্য বাসায় মর্জিনাও আছে। আদ্রিয়ান অফিসের কাজে কক্সবাজার গিয়েছে গতকাল। রাহিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু মায়ের বারণে আর জোর করেনি আদ্রিয়ান। রাহির অবশ্য তাতে একটু মন খারাপ হয়েছে। কারণ আদ্রিয়ানের সাথে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটার সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেছে এবারের মতো। পার্কের এক পাশে বেঞ্চে বসেছেন সালমান খুরশিদ ও রিনা বেগম।
" কী হলো শরীর ক্লান্ত লাগছে? "
" নাহ মিহির মা। এমনি বসলাম। কেনো জানি আজকে খুব পুরনো দিনগুলো মনে পড়ছে। তোমার মনে পড়ে আমাদের বিয়ের পরে কত ঝগড়া হতো?"
রিনা বেগম হাসলেন। পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতেই হাসির মাত্রা দ্বিগুণ হলো।
" হ্যাঁ সেসব কি ভোলার মতো? আমিই তো ছিলাম সব ঝগড়ার হোতা। তুমি তো কখনো নিজে থেকে সেধে ঝামেলা করতে না।"
" সেইজন্যই তো সবার আড়ালে ঝগরুটে রিনা বলে ডাকতাম। "
" আচ্ছা আমি কি এখনও আগের মতো ঝগরুটে আছি?"
" ঝগরুটে না থাকলেও কূট বুদ্ধি মাথা ভর্তি।"
রিনা বেগম চোখ বড়সড় করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালে স্বামীর দিকে। সালমান খুরশিদ স্ত্রী'র অঙ্গভঙ্গিতে হাসলেন আবারও।
" এখনো এরকম চোখ বড়সড় করে তাকানোর দরকার কী? আমি তো এখন তোমার অনুচর হয়ে আছি। স্বাধীনতা কাকে বলে বিয়ের পরে আর মনে নেই। মনে হচ্ছে পাকিস্তানিরা তাদের বংশধর রেখে গেছে। "
আজকে বড়োই ফুরফুরে মেজাজে আছেন সালমান খুরশিদ। রিনা বেগম স্বামীর পাগলামিতে ক্ষেপলেন না। আজ অনেক বছর পর উনি এরকম মজা করছেন।
" হ্যাঁ ভালো হয়েছে। তুমি তো মুক্তিবাহিনীর বংশধর। "
" থাক থাক মুখ গোমড়া করে রেখো না। চলো বাসার দিকে এগোই। "
" হুমম রাহি একা আছে, চলো।"
চলবে.............................