#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৯
" হ্যাঁ ভালো হয়েছে। তুমি তো মুক্তিবাহিনীর বংশধর। "
" থাক থাক মুখ গোমড়া করে রেখো না। চলো বাসার দিকে এগোই। "
" হুমম রাহি একা আছে, চলো।"
" হ্যাঁ চলো। "
যৌবনের শুরু থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত একে অপরের হাত ধরে এভাবেই পথ চলে এসেছে এই দম্পতি। ভালোবাসা সুন্দর যদি মানুষটা সঠিক হয়। হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান নয় তেমনই পৃথিবীর সকল নারী-পুরুষও এক রকম না। কেউ কেউ আজীবন থেকে যায়, আগলে রাখে।
তামান্না ইসলামের চেম্বারে বসে আছে মিহি ও সুমি। শরীফ মিতুকে বাইরে থেকে বিভিন্ন খাবার খাইয়ে নিয়ে এসে এখন কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করছে। রুদ্র যদিও নিজের চেম্বারে রোগী দেখতে গেছে কিন্তু কোনো প্রয়োজন হলে মিহিকে কল দিয়ে জানাতে বলেছে। ডাক্তার তামান্না বেশ মনোযোগ দিয়ে সুমির রিপোর্টগুলো দেখছেন। সুমির চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এতো যন্ত্র তার অচেনা। টেস্ট করার পুরোটা সময় মিহি সাথে ছিলো তার।
" মিসেস রুদ্র, উনার উপর সৃষ্টিকর্তা খুব প্রসন্ন। এজন্য এ যাত্রায় উনার কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু.. "
" কিন্তু কী ডক্টর? "
" কী হইছে ডাক্তার আপা? আমার বাচ্চা ভালা আচে তো!"
সুমির আঁখি যুগল ছলছল করছে। মনের ভেতর কেমন অস্থির লাগছে। মিহি সুমির হাত ধরে শান্ত হতে বলে ইশারায়।
" সরি টু সে,উনার বেবিটা বেঁচে নেই। অনেক আগেই মারা গেছে। কোনো আঘাতের ফলেই এরকম হয়েছে মনে হচ্ছে। এতদিন গর্ভে থেকেও মায়ের কোনো প্রকার ইনফেকশন হয়নি। কিন্তু অনেক বড়ো ক্ষতি হতো পারতো.."
ডাক্তার তামান্না ইসলামের কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো।
" আর কী ক্ষতি হইতো আমার! আমার বাচ্চা যহন বাঁইচা নাই তহন আর আমার বাঁইচা কী হইবো আপা? আমি বাঁচতে চাই না মিহি আপা। মিতুর বাপ আমার বাচ্চা মাইরা ফালাইলো।"
" সুমি শান্ত হও। মিতুর জন্য তোমাকে বাঁচতে হবে। মিতু তোমার মেয়ে। আমি হয়তো মায়ের কষ্ট বুঝতে পারছি না কিন্তু যে আছে তার জন্য না বেঁচে যে নেই তার জন্য কেনো নিজেকে শেষ করবে বোন? মিতুর কি অধিকার নেই ওর মায়ের সাথে বাঁচার? আর সবুজ ঠিক ওর কর্মের ফল ভোগ করবে। আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্য করেন।"
" আপনি উনাকে একটু শান্ত করুন। বুঝতেই পারছেন এটা হসপিটাল। আপনারা যতো দ্রুত সম্ভব অপারেশন করে বাচ্চাটা বের করান। "
মিহি সুমির মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে শান্ত করলো কিছুটা। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে রুদ্রকে কল দিয়ে সবকিছু বলে। তারপর শরীফ মিহি, সুমি ও মিতুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। শরীফের মনটাও ভীষণ খারাপ লাগছে। সুমিকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না। কিন্তু তার হাতে তো কিছু নেই। বাড়ি ফিরে মিহি সুমির সাথে সাথে থাকে সারাদিন। মেয়েটার মনটা একেবারে ভেঙে গেছে। দুপুরে খাবার খাওয়ার পরে মিহি নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। সুমিকে এক প্রকার জোরাজোরি করে খাইয়ে দিয়েছে মিহি। মিতুও মায়ের মন ভালো করতে চেষ্টা করছে। বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে নিলো মিহি রাহির কাছে কল দিবে ভেবে । সুমির খবরটা জেনে মিহির মনটা কেমন ভয় ভয় লাগছে। যদিও সুমির বিষয় আলাদা। সবুজের অত্যাচারের ফলেই সুমির বাচ্চা গর্ভে থাকতেই শেষ হয়ে গেছে।
" আসসালামু আলাইকুম ভাবি,কেমন আছো তুমি? "
" আলহামদুলিল্লাহ মিহি। তোমরা কেমন আছো বলো।"
" এমনিতে ভালোই। তুমি সাবধানে চলাফেরা করবে বুঝলে? আর ভারী কাজকর্ম করবে না। ভাইয়াকে বলে ডাক্তারের কাছে যেও একবার। "
" আরে পাগলি এইতো কয়েকদিন আগেই ডাক্তারের কাছে গেলাম। কী হয়েছে বলো তো? এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছো!"
" সুমির বেবিটা বেঁচে নেই ভাবি। ডাক্তার দ্রুত অপারেশন করে বাচ্চাটা বের করতে বললো আজ।"
" ইশশ! সুমির কোনো সমস্যা হয়নি তো?"
" না,আল্লাহ সব দিক থেকে কাউকে শেষ করে দেন না। বাড়ি ফিরুক ডাক্তার সাহেব, তারপর আলোচনা করে দেখি কবে অপারেশন করাবেন। "
" সুমিকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিও তুমি। আর শরীফকেও বলবে সুমিকে সময় দিতে। "
" ঠিক আছে। রাখছি এখন টেইক কেয়ার। "
" সেইম টু ইউ। "
রাতে রুদ্র বাসায় ফেরার পরে সব শুনে ঠিক করে আগামীকাল বিকেলেই অপারেশন করা হবে সুমির। যতো দ্রুত সম্ভব অপারেশন করতে হবে বলেই এত তাড়াতাড়ি অপারেশন করানোর কথা বললো রুদ্র। প্রথমে সুমির মানসিক অবস্থা ভীষণ খারাপ থাকার জন্য অপারেশনের বিষয় খেয়াল ছিলো না। কিন্তু রাত পেরুতেই সুমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে। অপারেশন শব্দটা গ্রামে থাকতে শুনলেও এরকম ছুরি দিয়ে পেট কাটবে শুনতে*ই কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু এছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
" বিশ্বাস করো সুমি তুমি কোনো ব্যাথা টের পাবেনা। এমন মেডিসিন দিবে তখন শরীর অসার হয়ে যাবে। যদিও সেটা কেবল কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত। "
গাড়িতে বসে আছে মিহি ও সুমি। মিতুকে সাথে আনেনি, রহমান চাচার সাথে তাদের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
" আপা আমার খুব ভয় লাগে, আগে তো কহনো এসব কাটাকাটি হয়নাই। "
" কিছু হবে না সুমি। আমরা তোমার সাথে আছি।"
সামনে থেকে শরীফ বললো। মিহি সুমির হাত ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে পৌঁছালো ওঁরা। সুমি হঠাৎ হঠাৎ কাঁদছে, অনাগত সন্তানকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন বুনেছিল সে। আজ তাকেই এভাবে বের করতে হবে তা-ও মৃত! এসব ভাবতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মিহির। মাতৃত্বের চেয়ে বড়ো কোনো সুখ মেয়েদের জন্য হয় না। আর যখন সেই সন্তান নিজের শরীরে থাকা অবস্থায় প্রাণ হারায় তখন একটা মেয়ের মন কতটা উতলা হতে পারে তারই প্রমাণ সুমি।
" আর কয়েকটা বিস্কিট দিবো নাতি?"
মিতুকে উদ্দেশ্য করে বললেন ফুলবানু। রহমানের স্ত্রী তিনি। মিতুকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন ভদ্রমহিলা। স্বামীর কাছ থেকে সুমির বিষয় সবকিছুই শুনেছেন তিনি। মেয়েটার জন্য খুব আফসোস করেছেন ফুলবানু। রহমান মিতুর জন্য বাইরে থেকে ঝালমুড়ি আর চকলেট কিনে নিয়ে এসেছেন। সেগুলো দেখে মিতু অকপটে বললো,
" আমি ওইগুলান খামু এহন,মুড়ি মাহানো ওইডা আগে দাও। "
ফুলবানু ও রহমান হাসলেন। শিশুর মন কতটা অবুঝ! মায়ের অপারেশনের কথা জেনেও খেয়াল নেই।
" ঠিক আছে। ফুলবানু তুমি ওগুলো ওকে খেতে দ্যান।"
" হ্যাঁ দিচ্ছি। "
ফুলবানু কাগজের ঠোঙা থেকে ঝালমুড়ি বের করে একটা বাটিতে করে সেগুলো মিতুকে খেতে দিলো। মিতু হাসি হাসি মুখ করে সেগুলো নিয়ে খেতে শুরু করলো। ফুলবানু মিতুর কাছ থেকে সরে রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বললেন,
" মিহি মা'কে একবার কল দিয়ে দেখতেন, অপারেশন কতদূর হলো।"
রহমানের নিজেরও বেশ চিন্তা হচ্ছে।
" হ্যাঁ দিবো একটু পর। অপারেশন শুরু হলো আধঘন্টা হবে। "
" ঠিক আছে। "
ফুলবানু আবারও মিতুর পাশে গিয়ে বসলেন। হঠাৎ মিতুর মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখমুখ মলিন হয়ে গেছে। খাবার পাশে রেখে অস্থিরতা মিশ্রিত নয়নে রহমানের দিকে তাকিয়ে বললো,
" নানা আমারে মায়ের কাছে নিয়া চলেন তো। মায়ের অপারেশন হয়নাই এহনো? নানা অপারেশনে কী হয়!"
রহমান নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে মিতুর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
" অপারেশন করলে মা সুস্থ হয়ে যাবে। একটু পরেই মায়ের কাছে নিয়ে যাবো তোমাকে। তুমি চিন্তা না করে খাওয়া শেষ করো।"
" জানেন নানা, গ্যারামে থাকতে মায়েরে আব্বা কত মারতো। আমার খুব কষ্ট হইতো তয় কিচ্ছু করবার পারতাম না। এইহানের সবাই কত্ত ভালা! আফনেরা,ওই বাড়ির সক্কলে তারপর শরীফ চাচায়।"
ছোটো মেয়েটির কথা বলতে বলতে চোখমুখ হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ফুলবানুও মিতুর পাশে বসে। শ্যামবতী বললে কোনো ভুল হবে না মিতুকে। ডাগর ডাগর আঁখি যুগল তার। মায়ের মতো হাসলে গালে টোল পড়ে।
" ওসব ভেবে কষ্ট পেও না। এখন তো আমরা সবাই আছি।"
" হ নানী। আপনি ওই বাড়ি যাইয়েন,আমরা একলগে ঘুরতে যামু।"
" ঠিক আছে। তোমার মা সুস্থ হোক তারপর সবাই একসাথে ঘুরবো পাঁকা মেয়ে। "
মিতু শেষ মুঠো ঝালমুড়ি মুখে পুরে হ্যাঁ বোধক ইশারা করে মাথা নাড়িয়ে।
চলবে........................