মনেরও গোপনে (পর্ব ১৩)


#মনেরও_গোপনে 
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া 
#পর্ব_১৩ 



"জি চাচা, সাবধানে যাবেন।"
" চাচা খাবার প্যাকেট করে নিয়েছেন তো? "
" হ্যাঁ রুদ্র বাবা নিয়েছি।"
" ঠিক আছে। "
রহমান চাচা চলে যেতেই রুদ্র আইসক্রিমের বাটিটা হুট করে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এক চামচ আইসক্রিম মুখে দিয়ে বললো, 
" তখন ক্ষ্যেপে গিয়ে কী জানি বলতে চেয়েছিলে মিহির দানা? "
" আপনি আসলে খুব বজ্জাত লোক। আমি রুমে গেলাম। "
মিহি রাগে কটমট করতে করতে সিড়ি দিয়ে দোতলায় চলে গেলো। রুদ্র এখনও ডাইনিং টেবিলে বসে আইসক্রিম মুখে হাসছে। নবনীও ঠিক এরকমই রাগী ছিল। কথায় কথায় রেগে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলতো। স্মৃতি মনে পড়তেই মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেলো রুদ্রর। 

ঘরে এসে বিছানায় ধপ করে বসে পড়েছে মিহি। একদিনের সংসারেই রুদ্র এত খুনসুটি করছে ভাবতেই মিহির মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এতটা গায়ে পড়া পুরুষ মানুষ মোটেই ভালো লাগে না তার। তুই পুরুষ মানুষ কোথায় চোখমুখ গম্ভীর করে রাখবি তা না সব সময় টম এ্যান্ড জেরীর মতো করবি কেনো?
" কী হয়েছে দানাপানি এমন রেগে বসে আছে কেনো?"
মিহি ভাবনার অতলে ডুবে ছিল বিধায় রুদ্রর আগমন টের পায়নি। তাই কিছুটা নড়েচড়ে বসলো সে। রুদ্র দরজা আঁটকে আলমারি থেকে একটা সাদা পাঞ্জাবি বের করে রাখলো টেবিলের উপর। 
" হোয়াট দ্য! মিহির দানা অবধি একরকম ছিল কিন্তু দানাপানি? "
কপট রাগ দেখিয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো মিহি। রুদ্র ভাবলেশহীনভাবে মিহির পাশে বসলো।
" একেই বলে মেয়ে মানুষ! যখন মিহির দানা ডাকি তখন তো বলো, আমি কোনো দানাপানি নই। তাই ভাবলাম মিহির দানার চেয়ে দানাপানি ডাকলে বেশি খুশি হবে। "
" শুনুন ডাক্তার রুদ্র চৌধুরী, আমার নাম মিহি শুধু মিহি। আন্ডারস্ট্যান্ড? "
" ওকে মিহির দানা। "
মিহির চোখমুখ এখন দেখার মতো হয়েছে। ফর্সা গালদুটোর চামড়ায় রাগের কারণে লাল আভা ফুটে উঠেছে। রুদ্র সেসব দেখেও না দেখার ভান করে মিহিকে পাশ কাটিয়ে অন্য পাশে শুয়ে ফোন হাতে নিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিলো। মিহির মাথা দিয়ে মনে হচ্ছে আগুন বের হচ্ছে। এই লোক কোন পাগলাগারদ থেকে এলো? কোনো ডাক্তার এরকম আধ-পাগলা হয় বলে জানা ছিল না তার। 
ঘুম ভাঙলো এলার্ম ঘড়ির আওয়াজে। চোখ মেলে তাকাতেই কেমন ভারী ভারী অনুভব হলো মিহির। বিষয়টা আঁচ করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। পরক্ষণেই একপ্রকার বিছানা থেকে লাফিয়ে ফ্লোরে পড়লো। আর তারপরেই মুখ থেকে অস্ফুটে স্বরে আওয়াজ বেরিয়ে এলো মিহির। হুট করে বিছানা থেকে ফ্লোরে পড়ার কারণে কোমরে একটু ব্যথা পেয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় রুদ্রও ঘুম থেকে উঠে চোখ বড়সড় করে ফ্লোরে তাকিয়ে আছে। 
" অসভ্য লোক ওরকম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আবার। "
" আমি কী করলাম! তুমি ওরকম ফ্লোরে বসে চিৎকার করলে কেনো?"
" আপনিই তো আমার পিঠে নিজের হাত রেখেছিলেন। পাশে শুয়েছি বলে সুযোগ নিবেন এভাবে? উঁহু কোমরে লেগেছে ভালোই। "
রুদ্র বিছানার সবখানে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর বিছানা থেকে নেমে মিহির হাত ধরে দাঁড় করাতে চাইলো কিন্তু মিহি হাত না ধরে নিজেই দাঁড়াতে চাইলো কিন্তু পারলো না দাঁড়াতে। 
" ব্যাথা ভালোই লেগেছে কোমরে। তবে মিহির দানা বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখো,আমার হাত তোমার শরীরের উপর ছিল না। ওটা অবলা কোলবালিশ আমার, ভুলে তোমার পিঠের ওপর চলে গেছিলো।"
রুদ্রর কথায় ঠিক বিশ্বাস হলোনা মিহির। তাই সন্দিহান দৃষ্টিতে একবার বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো। আসলেই খাটের মাঝ বরাবর কোলবালিশ রাখা আছে এখনো! নিজের ভুল বুঝতে পেরে কিছুটা লজ্জা পেলো মিহি। কিন্তু নিজ থেকে রুদ্রর সাহায্য চাওয়া কী ঠিক হবে? 
" আসলে আমি বুঝতে পারিনি,সরি।"
" এবার কি উঠবে না-কি এভাবেই বসে থাকবে বলো?"
মিহি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। রুদ্র নিজে থেকেই মিহির হাত ধরে বিছানায় উঠিয়ে বসালো। তারপর ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে একটা মলম এগিয়ে দিলো মিহির দিকে।
" ঔষধ লাগবে না এমনি ঠিক হয়ে যাবে। "
" ডাক্তার কি আমি না তুমি? "
" আপনি হার্ট স্পেশালিষ্ট হৃদপিণ্ড নিয়ে থাকুন। "
" পাকনামি কম করো বুঝলে এটা লাগাও। আশেপাশ থেকে লোকজন আসতে পারে আবার না-ও পারে কিন্তু তোমার বাসা থেকে নিশ্চয়ই কেউ আসবেন। "
মিহি রুদ্রর হাত থেকে মলমটা নিলো কিন্তু রুদ্রর কথার আগামাথা কিচ্ছু বুঝলো না।
" হ্যাঁ তা তো আসতেই পারে তাতে কী? "
" তুমি কি আসলেই মাস্টার্সে পড়ো?"
" হ্যাঁ কোনো সন্দেহ আছে? "
" অবশ্যই আছে। বিয়ের পরের দিন নতুন বউ কোমরের ব্যথায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলে সবাই কী ভাববে জানো না? মনে মনে তো সবাই আমাকেই দোষারোপ করবে।"
মিহির কিয়ৎক্ষণ লাগলো রুদ্রর কথার মানে বুঝতে। কিন্তু না বুঝলেই হয়তো ভালো হতো। এই লোকটা আসলে কী! লজ্জায়, রাগে মিহির চোখমুখ আবারও লাল হয়ে গেছে। রুদ্র আর কিছু বললো না। শুধু মুচকি হেসে বাথরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
সকাল হতেই আদ্রিয়ান ও রাহিকে হসপিটালের করিডরে ছুটে আসতে হয়েছে। রিনা বেগমও আসতেন কিন্তু মিহির বাবার শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যাওয়ায় আসতে পারেননি। সেদিন তোশা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরে আদ্রিয়ানের বাসার কেউ ভাবতেও পারেনি মেয়েটা এরকম একটা কাজ করতে পারে। আদ্রিয়ানের চাচা শাহআলম নিজাম এরমধ্যেই আদ্রিয়ানকে একদফা কথা শুনিয়েছেন। উনার ভাষ্যমতে আদ্রিয়ানের জন্যই তোশা শেষমেশ আত্মহ*ত্যার মতো একটা সিন্ধান্ত নিয়েছে। রাহি রাস্তায় থাকাকালীন সময়েই আদ্রিয়ানকে বারবার বারণ করে দিয়েছে যাতে কারো সাথে কোনো প্রকার কথা কাটাকাটি না করে। সে কারণে চাচার সব কথা মুখ বুঝে সহ্য করছে সে। আগে তোশা সুস্থ হোক তারপর কথা বলা যাবে। 
" ডাক্তার সাহেব কেমন আছে আমার মেয়ে? "
ডাক্তারকে ও.টি থেকে বের হতে দেখা মাত্রই তোশার মা ফাতিমা তেড়ে এসে প্রশ্ন করলেন। ডাক্তার তানজিম খান গম্ভীর স্বরে বললেন, 
" আপাতত ঠিক আছে। আরেকটু দেরি হয়ে গেলে শরীর থেকে বিষ বের করা যেতোনা। "
" যাক আলহামদুলিল্লাহ। আমরা কী দেখতে পারবো এখন?"
" না মি.শাহআলম, এখনই আমরা কাউকে এ্যালাউ করবো না,কেবিনে নেওয়া হবে এখন। দুপুরে দেখা করতে পারবেন শিউড়লি। "
" ঠিক আছে ডক্টর, থ্যাংক ইউ। "
" নো নিড ইটস মাই ডিউটি। "
ডাক্তার সাহেব নিজের রুমের দিকে চলে গেছেন। আদ্রিয়ান চুপ করে আছে সাথে রাহিও। ফাতিমা আদ্রিয়ানের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, 
" তোরা বাসায় চলে যা। আমি জানি দোষ আমার মেয়ের তাই অহেতুক তোকে দোষারোপ করছি না আদ্রিয়ান। "
" চাচি তুমি একটু চাচাকে বোঝাও। আমরা থাকি,তোশার সাথে দেখা করেই না হয় ফিরবো।"
" না তার কোনো দরকার নেই। তোকে দেখলে ওর পাগলামি বাড়বে। আমরা ওকে এটুকুও বলবো না যে তুমি এখানে এসেছিলে।"
" আপনি যেটা ভালো মনে করেন চাচি তাই করুন। আমি আর আদ্রিয়ান তাহলে আসছি,তোশার দিকে খেয়াল রাখবেন। "
" ঠিক আছে। "
দূরে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হচ্ছেন শাহআলম নিজাম। স্ত্রী'র এরকম উদারতা মোটেও ভালো লাগে না উনার। কপাল ভালো যে মেয়েটা মায়ের মতো হয়নি বলে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করেন তিনি।
সকালের নাস্তা শেষে রুদ্রর সাহায্যে নিজের রুমে এসে বসেছে মিহি। রহমান চাচা খুব সকালে এসে নাস্তা তৈরি করে রেখেছিলেন। মলম দেওয়ার জন্য কোমরের ব্যথাটা একটু কমেছে। কিন্তু এতবেলা হয়ে গেলো তবুও বাবার বাড়ি থেকে কেউ একবার কল পর্যন্ত দিলো না ভেবে কিছুটা মন খারাপ লাগছে মিহির। তাছাড়া রুদ্রর এত জ্বালাতনও বিরক্ত লাগছে। লোকটার হসপিটাল কতদিন বন্ধ কে জানে? রিংটোনের আওয়াজে বিছানায় তাকাতেই ফোনের স্ক্রিনে মায়ের নম্বর ভেসে উঠতে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে মিহির। কালক্ষেপণ না করে দ্রুত কল রিসিভ করে কানে ধরলো। 
" হ্যালো মা কেমন আছো তোমরা? "
" হ্যাঁ ভালো আছি। তোরা কেমন আছিস?"
" ভালো কিন্তু তোমার গলাটা এমন লাগছে কেনো? কিছু হয়েছে মা?"
" তোশা সুইসা*ইড করতে গেছিলো, আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে বেঁচে গেছে। "
" কী! বদমাশ মেয়ে একটা। দূরে গিয়েও আমার ভাই আর ভাবিকে অশান্তিতে রাখার বুদ্ধি। "
" থাক এসব বিকেলে তোর ভাবি যাবে তোকে দেখতে। তোর বাবার শরীর একটু খারাপ নইলে আমরাও যেতাম। "
" বাবার কী হয়েছে? বাড়াবাড়ি কিছু হয়নি তো!"
" আরে না, তুই চিন্তা করিস না। একটু প্রেশার বেড়ে গেছিলো। নিজের খেয়াল রাখিস রাখছি।"
" বাবার খেয়াল রেখো আর নিজেরও টাটা।"



চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন