অন্তর্নিহিত কালকূট - পর্ব ৬১ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


অন্তর্নিহিত কালকূট
পর্ব ৬১
অনিমা কোতয়াল
.
.
.
সূর্য নিজস্ব ছন্দে ডুব দিয়েছে অন্তরালে। অস্বাভাবিক দ্রুত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠল চারদিক। আজকের অন্ধকারটা যেন একটু বেশিই কালো, গভীর। আমের ভিলার সকল সদস্যের উপস্থিতি এখন ইউনাইটেড হসপিটালের করিডরে। আকস্মিক ঝড়ের পর সবকিছু যেমন স্তব্ধ, স্থির হয়ে যায়। সেরকমই অবস্থা হয়েছে ওদের। আচমকা প্রলয়ের তীব্র ধাক্কার পর শান্ত হয়ে গেছে সবকিছু। চুপচাপ, পাথরের মতো পড়ে আছে একেকজন একেক জায়গায়। একই সঙ্গে এতোকিছু ঘটে গেছে যে কেউ বুঝতেই পারছেনা কী করবে। কীভাবে শোক প্রকাশ করবে। এ অবস্থায় আসলে কী করা যায়?

কুহু নিখোঁজ হওয়ার কয়েক ঘন্টা পড়েই কল আসে রাশেদ আমেরের কাছে। কলটা ছিল ডার্ক নাইটের কারো। প্রথমে রাশেদকে জানানো হয় কুহু তাদের দখলে। হাত বাঁধা অজ্ঞান ছবিও পাঠানো হয় প্রমাণ সরূপ। শর্ত দেওয়া হয়, কুহুকে জীবিত এবং সুস্থ ফেরত চাইলে ওনাদের পাঠানো কাগজে সই করে পাঠাতে হবে রাশেদকে। যদি সে সেটা না করে, সকালে কুহুর লা-শ পরেরদিন সকালে। রাশেদ বিচক্ষণ মানুষ। সিদ্ধান্ত নিতে বেশি ভাবতে হয়নি তাকে। সোলার সিস্টেমের সমস্ত গোপন তথ্য জেনে যাওয়া, নীরবকে কৌশলে রাস্তায় আটকে দেওয়া, দুটো গেইটে সিকিউরিটি ছিল; তবুও ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে কুহুকে তুলে নিয়ে যাওয়া। পরিকল্পনা হঠাৎ হয়নি। দীর্ঘদিনের সাধনার ফল এটা। অতি গোপন এবং ভয়ানক ষড়যন্ত্র। কোথাও কোন লুপ হোল রাখেনি তারা। আর যেভাবেই খুঁজুক, আচমকাই যে কুহুকে পাওয়া যাবেনা সেটাও বুঝে ফেলেছিলেন সোলার সিস্টেমের এই বিচক্ষণ লীডার। কাজগুলো আসার পর রাশেদ দেখলেপ ওগুলো ডিল ট্রান্সফার এবং চুক্তিভঙ্গের কাগজ। অর্থাৎ বাইরের সেই দলগুলোর সঙ্গে সমস্তরকম চুক্তি ভঙ্গ করছে সে। এবং কাজটা করে সে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত। তার পরিবর্তে ব্লাক হোল কিংবা ডার্ক নাইটের কাছে ডিলগুলো ট্রান্সফার করার পরামর্শও লেখা আছে সেখানে। কাগজগুলো পড়ে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে ছিলেন রাশেদ। এরপর যখন তাতে সই করছিলেন, জাফরের মধ্যে খানিকটা ইতস্তত ভাব দেখা গেলেও রাশেদ ছিলেন নির্বিকার। ওনার কাছে ঐ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ একজনই ছিল। কুহু। সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি পিছুটানহীন নন। তারও দুর্বলতা আছে। ভয়ানক দুর্বলতা আছে। তাইতো তিলে তিলে গড়ে তোলা তার বিশাল সম্রাজ্যকে নিজ হাতে ধ্বংস করতেও উনি দু'বার ভাবেননি। কিন্তু ওনার এই ত্যাগ বাঁচাতে পারেনি ওনার মেয়েকে। মাঝরাত পেরোনোর পর হঠাৎই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় ব্লাকহোল আর ডার্কনাইট। সবকিছু আচমকা শান্ত হয়ে যায়। কোনমতেই আর যোগাযোগ করা গেলোনা তাদের সাথে। সেই মুহূর্তে রাশেদ জানলেন তিনি ভয়ও পান। মারাত্মক ভয় পান মেয়েকে হারানোর ভয়ে প্রথমবার কম্পিত হয়েছিল রাশেদ আমেরের হৃদয়। পাগলের মতো খোঁজাখুঁজি শুরু হয় তখন। এতক্ষণ কুহুর নিরাপত্তার কথা ভেবে সাবধানে এগোলেও তখন বেপরোয়াভাবে খোঁজা শুরু করে গোটা দল মিলে। নীরব প্রচন্ড অসহায় বোধ করে। ছটফট করে। খানিক বাদে বাদে ভয়ে কেঁপে ওঠে ওর সমগ্র শরীর। কিছু করতে না পারার যাতনায় ভেতর থেকে যেন ঝলসে যাচ্ছিল ও।

সারারাত নিরন্তর খোঁজাখুঁজির পর সেই পরিত্যক্ত গোডাউনের খোঁজ পেল উচ্ছ্বাস। পাওয়া গেল কুহুকে। জীবিত কিন্তু নিষ্ঠুরভাবে ধ/র্ষি/ত, অত্যাচারিত, অজ্ঞান অবস্থায়। সকলের অতি আদরের মেয়েটার এরকম নির্মম দশা দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো আমের পরিবার। রাশেদ আমের কথা বলতে পারলেন না। নড়তে পারলেন না। জাফর, উচ্ছ্বাসের চোখ ফেঁটে জল বেরিয়ে এলো। দু হাতে মুখ চেপে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলল জ্যোতি। আকস্মিক ঘটনায় বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে ছিল প্রিয়তা। শক্ত পাথরের মতো জমে গিয়েছিল ওর সমগ্র শরীর। সকলের চোখের মণির এ কী দশা!
আর নীরব! বড়, ছোট কাউকে তোয়াক্কা না করল না সে সেই মুহূর্তে। অবহেলায় পরে থাকা নিজের সেই লাল ওড়নাটা তুলে নিয়ে সম্পূর্ণ ঢেকে দিয়েছিল কুহুকে। সকলের সামনেই বুকের মাঝে জাপটে ধরেছিল কুহুর বিধ্বস্ত শরীর। উন্মাদের মতো চিৎকার করছিল ছেলেটা। কুহুর নাম ধরে বারবার ডাকছিল। কুহু সাড়া দেয়না নীরবের ডাকে। নীরবের করুণ আহাজারিতে বদ্ধ সেই গোডাউনটাও যেন কেঁপে উঠল। নীরব পাগলের মতো বিলাপ করতে করতে বলল, 'কুহু? আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেনা তুমি? আমি এসেছিতো। দেখো, আমি এসেছি। তোমার নীরব এসেছে। তোমার মনে আছে কুহু? আমি তোমাকে কী বলেছিলাম? বলেছিলাম না দেশে ফিরে আমি নিজে এই ওড়নাটা তোমার গায়ে জড়িয়ে দেব? কিন্তু সেটা এভাবে? এভাবেতো আমি জড়াতে চাইনি কুহু। তুমি শুনতে পাচ্ছোনা আমার ডাক? এই কুহু!'

কুহুর অমন দশা। নীরবের বিলাপ। সব মিলিয়ে দমবন্ধকর পরিবেশ তৈরি হল। একপ্রকার যু' দ্ধ করে, অনেকভাবে বুঝিয়ে, নীরবের বাহুবন্ধন থেকে কুহুকে ছাড়ানো গেল। এতোসবের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্যে সকলের মাথা থেকে বেরিয়ে গেল রুদ্রর কথা।

কুহুকে দ্রুত হাসপাতালে আনা হলো। সকলের মধ্যে ব্যস্ততা আর অস্থিরতা। ডাক্তাররা দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলেন। প্রচুর র-ক্ত-ক্ষরণ হয়েছে কুহুর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রক্তের ব্যবস্থা করতে বলা হল। ডক্টর, নার্সদের ছোটাছুটি দেখে ওদের কাঁপুনি ধরার জোগাড়। যা ঘটে গেছে তা বদলানো যাবেনা। তাই সকলে মনে-প্রাণে একটাই প্রার্থনা করে চলছিল, যেকোন কিছুর বিনিময়ে মেয়েটা যেন প্রাণে বেঁচে যায়। 

তার ঠিক দু ঘন্টা পর আরও এক ধাক্কার সম্মুখীন হলো ওরা। র-ক্তা-ক্ত, ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে টলতে টলতে হসপিটালের করিডরে এসে হাজির হলো রুদ্র। সবার আগে দেখতে পেল প্রিয়তা। চমকে গেল ও। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু গোঙানী বেরিয়ে এলো ওর মুখ দিয়ে। প্রিয়তার আওয়াজে সকলেই সেদিকে তাকাল। রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। উচ্ছ্বাস আর জাফর গিয়ে দৌড়ে ধরল ওকে। রাশেদ আস্তে করে উঠে দাঁড়ালেন। হতভম্ব দৃষ্টিতে চোখ বুলালেন নিজের ছেলের শরীরে। সারা শরীরে মারাত্মক সবসআ-ঘা-তের চিহ্ন। বাঁ পা'টা সম্পূর্ণ র-ক্তে ভিজে গেছে। জ্যোতি 'খোদা' বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। প্রিয়তা চোখে অবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জ্যোতির আর্তনাদে হুঁশ ফেরে ওর। দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরল রুদ্রকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। সেদিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলেপ রাশেদ আমের। অতঃপর বুকে হাত দিয়ে আস্তে করে বসে পড়লেন রাশেদ। কিচ্ছু বললেন না। 

'কুহু কেমন আছে?'

অস্ফুট স্বরে কেবল এতোটুকুই বলতে পেরেছিল রুদ্র। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করল না কেউ। ওকেও ধরাধরি করে দ্রুত চিকিৎসার জন্যে ভেতরে পাঠানো হল।

রুদ্র আর কুহু দুজনেই এইমুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি। রুদ্রর জখমগুলোর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। ইঞ্জেকশনের প্রভাবে এখন ঘুমোচ্ছে সে। তবে এখনো চিকিৎসা চলছে কুহুর। বিকেলের দিকে ডাক্তার নিশ্চয়তা দিয়ে গেছেন, এখন আর ভয়ের কিছু নেই। কুহু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সত্যিই কী সব ঠিক হয়ে যাবে? সব ঠিক হওয়া সম্ভব? শারীরিক ক্ষ-তির কথা বাদ দিলেও, যে ভয়ানক মানসিক ক্ষ-তি হয়ে গেছে মেয়েটার। তা যে অপূরণীয়। 

দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে নীরব। সদা চঞ্চল, হাসিখুশি ছেলেটা যেন একদিনেই হারিয়ে গেছে। অনুভূতিহীন ভাবে পড়ে আছে এক কোণে। নীরবের বাবা-মাও এসেছিল। কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরে গেছে। নীরব কুহুর সেই ওড়না হাতে পেঁচিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওটার দিকে। বারবার মনে পড়ছে প্রথমবার কুহুর মাথায় এই ওড়নাটা পরিয়ে দেওয়ার মুহূর্তটা। তার ওপরে ধরে রেখেছে আরেকটা হীরের আংটি। ইন্ডিয়া থেকে নিয়ে এসেছিল ও। নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে। ভেবেছিল গতকাল নিজ হাতে কুহুকে এটা পড়িয়ে দিয়ে উইশ করবে। আলতো করে চুমু খাবে কুহুর আঙুলে। লজ্জায় চিবুক নামিয়ে ফেলবে কুহু। নীরব নিজ হাতে সেই চিবুক তুলে ধরবে। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। সব। অসহায়ভাবে একবার কুহুর কেবিনের দিকে তাকালো নীরব। ভেতর থেকে কেঁপে কেঁপে কান্না বেরিয়ে এলো ছেলেটার। নীরবে ফুঁপিয়ে উঠল।

এদিকে দু হাতে মুখ চেপে ধরে উবু হয়ে বসে আছে প্রিয়তা। শরীর থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ওর। অদ্ভুত এক ঘোরে চলে যাচ্ছে বারবার। আবার জোর করে ফিরিয়ে আনছে নিজেকে। কক্সবাজার থেকে ঢাকা আসার পথটুকু জালে আটকে পড়া প্রাণীর মতো ছটফট করেছে প্রিয়তা। ভয়ানক অমঙ্গলের আশঙ্কায় সিঁটিয়ে ছিল মেয়েটা। দীর্ঘ কয়েকঘন্টার প্রতিক্ষার পর অবশেষে পৌঁছলো আমের ভিলায়। কিন্তু চিন্তা বাড়লো বৈ কমলো না। এরপর কুহুর নিখোঁজ হওয়া থেকে শুরু করে রুদ্রর না বলে গায়েব হয়ে যাওয়া পর্যন্ত পরপর এতোগুলো ঘটনায় দিশেহারা বোধ করল ও। দুশ্চিন্তায় মাথা ভাড় হয়ে এলো। পাড় হলো অসহ্যকর গোটা রাত। সকালে থেকে কুহুকে ঐ অবস্থায় উদ্ধার করা, রুদ্রর এমন অবস্থা সব মিলিয়ে পাগল পাগল লাগছে ওর নিজেকে। সবকিছু কেমন স্বপ্ন, ঘোর মনে হচ্ছে। গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু।
প্রিয়তা প্রেগনেন্ট। মা হতে চলেছে। কিন্তু এতো ভালো খবরটা রুদ্র ছাড়া কেউ জানেনা। কাউকে জানানোর মতো পরিস্থিতি তৈরীই হয়নি। আর এখন যে মারাত্মক বিষাদের পাহাড় আমের ভিলার ওপর ভেঙ্গে পড়েছে, এই সুসংবাদের সুখটুকু সেই পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে। এখন আর গতকালের মতো সেই সুখ, সেই উত্তেজনা অনুভব করছেনা ও। 
একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে বসল প্রিয়তা। চারপাশে চোখ বুলালো। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই কুহুকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। উচ্ছ্বাস সকলের জন্যে খাবার আনতে গেছে। কাল রাত থেকে সকলেই না খেয়ে আছে। এরকম ভয়ানক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যে হলেও সকলের খাওয়া প্রয়োজন। রাশেদ একটা বেঞ্চে বসে আছেন। চুপচাপ, গম্ভীর। কপালের রেখাদ্বয় আরও গভীর হয়েছে। ভেতরে কী চলছে বোঝার উপায় নেই। প্রিয়তা আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। চোখ পড়ল কুহুর কেবিনের সামনে ফ্লোরটাতে। প্রিয়তা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সেদিকে। নীরবের সামনে বসে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতেতাকিয়ে রইল ওর দিকে। কিন্তু নীরবের কোনরকম ভাবান্তর হলো না। ও সেভাবেই বসে আছে। প্রিয়তা নীরবের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, 'ভাইয়া?'

নীরবের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলোনা। প্রিয়তা নরম গলায় বলল, 'কুহুকে একবার দেখে আসুন।'

নীরব অসহায় চোখে তাকাল প্রিয়তার দিকে। চোখদুটো ছলছল করছে। প্রিয়তার ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। ভীষণ কান্না পেল। কোনমতে নিজের কান্না আটকে বলল, 'যান। একবার দেখে আসুন।' 

নীরব মাথা ঝাঁকালো। কোনরকমে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। একবার উঁকি দিল কুহুর কেবিনে। অনেকটা সংকোচ, দ্বিধা আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকলো। নিজের পা দুটোই আজ ভীষণ ভাড়ি মনে হলো নীরবের।

প্রিয়তা জ্যোতির কাছে গিয়ে বলল, 'আমি রুদ্রর কেবিন থেকে আসছি। দেখি উঠেছে কি-না। বাবার দিকে একটু খেয়াল রেখো। ভেতরে ভেতরে গুড়িয়ে গেছেন মানুষটা।'

জ্যোতি মাথা নাড়ল। প্রিয়তা রাশেদের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল। এগিয়ে গেল রুদ্রর কেবিনের দিকে।
-

কুহু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। র-ক্ত দেওয়া হচ্ছে। যেই মুখের দিক তাকালে চোখ ফেরাতে পারতো না। সেই মুখটার দিকে তাকাতে পারছেনা আজ নীরব। কুহুর সারা শরীরের বিভিন্ন ক্ষ-তের চিহ্ন, কিছু জায়গা কালসিটে পড়ে গেছে। দেখে গা শিরশির করে উঠল নীরবের। বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। ওর কুহুর সঙ্গে এমন ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে! কেউ জঘন্যভাবে ওর কুহুকে ছুঁয়েছে! এতো ভয়ানক কষ্ট দিয়েছে! কিছুতেই নিজের মনকে মানাতে পারছেনা সেটা। মন বারবার বলছে এটা কোন দুঃস্বপ্ন হোক। ঘুম ভেঙে যাক। সব ঠিক হয়ে যাক। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তির এই দুঃস্বপ্নে ঘুম ভাঙেনা। কিচ্ছু ঠিক হয়না। নীরব আস্তে করে কুহুর পাশে গিয়ে বসল। ওর একটা হাত ধরে কান্নামিশ্রিত গলায় বলল, 'কুহু? এখনো উঠবেনা। সেই কখন দেশে ফিরেছি আমি। ভেবেছিলাম এসে সবার আগে তোমাকে দেখব। কিন্তু তুমি উঠছোই না। এতো ঘুমায় কেউ?এই পাঁজি মেয়ে উঠতে বলেছিতো। এমনতো কথা ছিলোনা, তাইনা? দুটো বছর পর এসেছি। তুমি দেখবেনা আমাকে? আমি রাগ করব কিন্তু এবার। ভয়ংকর রাগ করব। তোমার ঐ কিউট স্টাইলের কান ধরাও কিন্তু এবার আমার রাগ ভাঙাতে পারবেনা।'

এরপর সেই আংটিটা বের করে বলল, 'দেখো তোমার জন্যে কী এনেছি। পরবেনা এটা? এই ওঠোনা_'

আর কিছু বলার আগেই নার্স এসে থামিয়ে দিল নীরবকে। কুহুর বিশ্রাম প্রয়োজন। কথা না বলে শান্ত হয়ে বসতে বলল। কিন্তু নীরব মানতে চাইল না। কুহুর সঙ্গে কথা বলার জন্যে উন্মাদ হয়ে উঠল। কিছুতেই কিছু বোঝানো গেলোনা ওকে। তাই বাধ্য হয়েই জোর করে কেবিন করে বের করতে হলো নীরবকে।
-

বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে রুদ্র। মাথায়, বাঁ পায়ে, ডান গালে ব্যান্ডেজ। শরীরে আরও বিভিন্ন জায়গায় ঔষধ আর ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো হয়েছে। কোন কথা বলছে না ও। চুপচাপ বসে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে। তাঁবু থেকে শওকত সহ বাকিরা যখন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। তখনই রুদ্র বুঝে গিয়েছিল কোন একটা গন্ডগোল হয়েছে। নয়তো রুদ্রকে টর্চার করার এমন দারুণ আনন্দকে মাঝপথে ছেড়ে বের হতো না শওকত। কোনভাবেই না। ভাগ্যিস তাড়াহুড়োর মধ্যে ড্রিল মেশিনটা ওখানেই ফেলে গিয়েছিল শওকত। কিছুক্ষণের কঠোর কসরতের পর ওটাকে হাতে পায় রুদ্র। তারপর শেকলটা কেটে ফেলতে বেগ পেতে হয়নি ওকে। তাঁবুর পেছনে দাঁড়ানো দুজন গার্ডের একজনের ঘা-ড় ভেঙ্গে, অপরজনকে তারই পি-স্ত-ল দিয়ে শু-ট করে বেরিয়ে আসে ওখান থেকে। ভেতরের পথ দিয়ে জঙ্গল থেকে বের হয় ও। এরপর সোজা গ্যারেজে যায়। গ্যারেজ থেকে জীপ নিয়ে প্রথমে পৌঁছায় আমের ভিলায়। ওখান থেকে সমস্ত খবর নিয়েই হসপিটালে প‍ৌঁছায় ও। এমন আহত অবস্থায় এতোখানি করতে সমস্ত ইচ্ছাশক্তিকে একত্রিত করতে হয়েছে ওকে। কতটা তীব্র যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে এতোটা লম্বা রাস্তা এসেছে কেবল ওই জানে। বাজি রাখতে হয়েছে নিজের প্রাণ। কিন্তু ও আসতে আসতে যে এতোবড় ক্ষ-তি হয়ে যাবে সেটা কল্পণাও করতে পারেনি রুদ্র। ভেতরে ভেতরে রাগে, প্রতিহিংসায় কেঁপে উঠছে ও। কিন্তু বাহিরে দিয়ে একদম শান্ত রেখেছে নিজেকে। এখন উত্তেজিত হলে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ নেই। আবেগের বসে আর কোন ভুল করতে চায়না ও।
পাশে একটা চেয়ারে বসে বাটিতে সুপ ঢালছে প্রিয়তা। রুদ্রকে খাওয়াতে হবে। ও এখনো কিছুই জিজ্ঞেস করেনি রুদ্রকে। এতক্ষণ কোথায় ছিল, এসব কীকরে হলো। এসব প্রশ্নের উপযুক্ত সময় এটা নয় সেটা জানে প্রিয়তা। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে এতোটা যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছে জেনেও নিজেকে কীভাবে সামলে রেখেছে সেটা একমাত্র ও-ই জানে। নিজের অসীম ধৈর্য্যের পরিচয় দিচ্ছে ও এখন।

'কুহু কেমন আছে এখন?'

আসার পর এতক্ষণে কথা ঠিকভাবে কথা বলল রুদ্র। কেমন ফ্যাসফ্যাসে শোনালো ওর কন্ঠস্বর। প্রিয়তা মৃদু গলায় বলল, 'কেবিনে দেওয়া হয়েছে। ডক্টর বলেছেন আউট অফ ডেঞ্জার।'

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র। কিছু বলল না। বাকিদের অবস্থাও জিজ্ঞেস করল না। কারণ ও জানে, এ মুহূর্তে কার কেমন প্রতিক্রিয়া কেমন। প্রিয়তা রুদ্রর দিকে এক চামচ স্যুপ এগিয়ে দিল। রুদ্র পানসে গলায় বলল, 'ইচ্ছে করছেনা।'

'ঔষধ খেতে হবে।'

'তুমি খেয়েছো?'

প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, 'ভাই গেছে খাবার আনতে। ও এলে খাবো। কাল থেকে কেউ একটা দানাও কাটেনি। নীরবের অবস্থাটা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। খাওয়ার মতো অবস্থায় নেই কেউ।'

রুদ্র প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, 'তোমার মধ্যে এখন আরেকজন আছে প্রিয়। ওর খেয়াল রেখো। এসবে ওর কিন্তু কোন দোষ নেই।'

প্রিয়তা মাথা ঝাঁকাল। স্যুপটুকু খাইয়ে দিতেই নার্স এসে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে গেল। প্রিয়তা রুদ্রর হাতের ওপর হাত রেখে বলল, 'কুহুকে দেখতে যাবেন?'

রুদ্র চুপ থাকল। নড়তে গিয়ে ব্যথায় কুঁচকে গেল ওর মুখ। প্রিয়তার চোখে পানি চলে এলো। সারা শরীরে এতো তীব্র আঘাত, ঠিকভাবে নড়তেও পারছেনা লোকটা। প্রিয়তা কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে সাহায্য করল রুদ্রকে। কিছুক্ষণের নীরবতার পর রুদ্র বলল, 'ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব না আমি এখন।'

প্রিয়তা কিছু বলার মতো খুঁজে পেলোনা। কী বলা যায় এমন পরিস্থিতিতে? এ অবস্থার সান্ত্বনা কী হয়? উত্তর না পেয়ে অসহায়তাভাবে রুদ্রর পাশে বসে রইল প্রিয়তা। টের পেলোনা রুদ্রর ভেতরে কী ভয়ংকর আগুন জ্বলছে। যে আগুনে ভস্ম হয়ে যাবে সবকিছু।

উচ্ছ্বাস খাবার আনার পর খেতে আপত্তি করল না কেউ। সকলেই বুঝতে পেরেছিল বাস্তবিক পরিস্থিতি। কেবল খেতে চাইল না নীরব। প্রিয়তা অনেকটা জোর করেই নিজ হাতে খাইয়ে দিল নীরবকে। রাতে হাসপাতালে প্রিয়তা, জ্যোতি, উচ্ছ্বাস আর নীরব রইল। অনেকেটা বাধ্য হয়েই রাশেদ এবং জাফর বাড়ি চলে গেলেন। হাসপাতালে এতো মানুষ চাইলেও থাকা সম্ভব নয়। রুদ্রকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে একটানা দীর্ঘ সময় ঘুমের প্রয়োজন ওর। জ্যোতি আর নীরবকে কুহুর কাছে রেখে প্রিয়তা চলে গেল রুদ্রর কাছে।

রাশেদ এবং জাফরকে এগিয়ে দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে উচ্ছ্বাস। শারীরিক, মানসিক উভয় দিক দিয়েই ক্লান্ত আজ ও। কাল থেকে অনেক ধকল গেছে শরীরের ওপর দিকে। আর নিজের বোনের এমন অবস্থা দেখার আগে যেকোন ভাই নিজের মৃ-ত্যু কামনা করবে। উচ্ছ্বাসতো মনেপ্রাণে কুহুকে বোন মানে। ভোরবেলা যে অবস্থায় কুহুকে উদ্ধার করেছে সে দৃশ্য কল্পনা করলেই শরীর জমে যাচ্ছে উচ্ছ্বাসের। ভেতর থেকে থরথর করে কেঁপে উঠছে সর্বাঙ্গ। দীর্ঘ একবছর পর আবার কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর। সত্যিই কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কান্নার আগমনে বারবার কেঁপে উঠছে ঠোঁটজোড়া। সঙ্গে তীব্র প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্ব-লছে হৃদয়। এর শেষ দেখে তবেই ছাড়বে ও।

হসপিটালের গেইটে এসে চমকে গেল উচ্ছ্বাস। নাজিফা দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকছে। এ সময় নাজিফা এখানে! কেন? উচ্ছ্বাস ডাকল। ডাক শুনে থেমে গেল নাজিফা। পেছন ঘুরে উচ্ছ্বাসকে দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে এগোতে যাচ্ছিল। হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিল উচ্ছ্বাস। নিজেই এগিয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে হাতঘড়িতে সময় দেখে বলল, 'এতো রাতে তুমি এখানে?'

উচ্ছ্বাসের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অস্থির হয়ে নাজিফা বলল, 'যা শুনলাম সেটা সত্যি! কুহু_'

'তোমাকে কে জানালো?'

'তারমানে সত্যিই_'

নাজিফার চোখে অবিশ্বাস। দু হাতে মুখ চেপে কেঁদে ফেলল ও। বিড়বিড়িয়ে বলল, 'আল্লাহ্! এ কেমন অবিচার। এতো ভালো একটা মেয়ে_'

উচ্ছ্বাস একটু এগিয়ে এসে ডাকল নাজিফাকে। নাজিফা একাএকাই বিড়বিড় করে যাচ্ছে। যেন ঘোরে চলে গেছে ও। উচ্ছ্বাস এবার একটু জোরেই ডাকল, 'নাজিফা!'

কেঁপে উঠল নাজিফা। কোনমতে নিজেকে সামলে বলল, 'কীকরে হলো এসব?'

'সে অনেক কথা। আগে তুমি বলো তুমি কী করে জানলে?'

'নার্গিস খালা বললেন। ওনাদের বাড়িতো আমার বাড়ির কাছেই। আমি বিশ্বাস করিনি। এখনো করতে পারছিনা। ঐরকম একটা মেয়ের সাথে। হে আল্লাহ!'

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল নাজিফা। উচ্ছ্বাস দীর্ঘশ্বাস লুকালো। নাজিফাকে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল উচ্ছ্বাস। কুহুকে দেখালো। এরপর করিডরে বেঞ্চে বসিয়ে পানি খাওয়ালো। কিছুটা সময় দিল নিজেকে ধাতস্থ করার জন্য। নাজিফা কিছুটা সামলে উঠলেই উচ্ছ্বাস বলল, 'কিছু খেয়েছো রাতে?'

হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল নাজিফা। উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, 'এখনো বাবার বাড়িতেই আছো?'

'হুঁ।'

'এ সময় তোমার বেরিয়ে আসাটা উচিত হয়নি নাজিফা। তুমি এখন আর একা নও। সেটা বুঝতে হবে। তোমার স্বামী-ই বা কেমন! সেদিন দেখলাম ভোরবেলা রাস্তায় হাঁটছিলে। আর আজ মাঝরাতে বেরিয়ে এসছো। বউ কী করছে না করছে সেই খেয়ালটুকুও নেই তার!'

নাজিফা উত্তর দিলোনা। মাথা নিচু করে বসে রইল। উচ্ছ্বাস বলল, 'কুহু এখন ঠিক আছে। চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই। কাল আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব তোমাকে। তখন দেখ। এখন রেস্ট করো গিয়ে।'

'আমি আজ এখানেই থাকব।'

উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে বলল, 'পাগল হয়ে গেছো? এখানে থাকলে রাত জাগতে হবে। এই অবস্থা_'

নাজিফা উচ্ছ্বাসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, 'জানি আমি তোমাদের কেউ না। কিন্তু একসময় ঐ মেয়েটা আমাকে ভাবি মানতো। সম্পর্কটা না হলেও ভালোবাসাটা কিন্তু মিথ্যে ছিল না। তোমার কোন অধিকার নেই আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার।'

উচ্ছ্বাস ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, 'কিন্তু তোমার বর? উনি শুনলে সমস্যা হবেনা? যদি ফোন করে? সামনের মাসে ডেলিভারী তোমার!'

নাজিফা মলিন হেসে বলল, 'সে ফোন করবেনা।'

উচ্ছ্বাস আরেক দফা অবাক হলো। ফোন করবেনা! অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী সারারাত বাইরে থাকবে আর স্বামী ফোন করবেনা! উচ্ছ্বাস ভ্র কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, 'তুমি ভালো আছোতো নাজিফা? কোন ভাবে তোমার স্বামী তোমাকে_'

বাক্যটা শেষ করল না উচ্ছ্বাস। কী বলে শেষ করবে বুঝতে পারল না তাই। নাজিফা স্থির কন্ঠে বলল, 'উনি মা' রা গেছেন, উচ্ছ্বাস।'

উচ্ছ্বাসে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল নাজিফার দিকে। মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না ও।

-

সকালে জ্যোতির চিৎকারের আওয়াজে চমকে উঠল নীরব, উচ্ছ্বাস আর নাজিফা। কুহুর কেবিন থেকে আসছে আওয়াজ টা। ওরা প্রায় দৌড়ে গেল সেখানে। কেবিনে ঢুকে অমন দৃশ্য দেখে থমকে সবাই। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল ওদের মা-থায়। কুহু উন্মাদের মতো ছটফট করছে। ক্যানেলা টেনে খুলে ফেলেছে। কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছেনা ওকে। পাগলের মতো করে যাচ্ছে মেয়েটা।
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন