"বারোটা বাজতে এখনো বাকি পনেরো মিনিট। তারপর বন্ধ করবে। "
" ঠিক আছে। "
সালমান রেজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে। জায়েদের আজ কাজ নেই। এক এক দিন একজনের কাজ থাকে না দোকানে। কালকে সালমানের কাজ নেই। রেজওয়ান গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে আবারও। গত কয়েকমাসে আসমা প্রায় তিন লাখ টাকা দিয়েছে তাকে। আসমার বাবার বাড়ি সম্পদশালী। তাছাড়া নিজে ব্যাংকে কর্মরত। কিন্তু রেজওয়ানের চেয়ে তার কাছে যে আগের স্বামী বেশি গুরুত্বপূর্ণ এটা রেজওয়ান বুঝে গেছে ইতোমধ্যে। রেজাকে দোকান বন্ধ করতে বলে মাথাভর্তি এলোমেলো চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরলো রেজওয়ান। রেজা খুব বিশ্বস্ত রেজওয়ানের। এজন্য দোকান বন্ধ হওয়ার অপেক্ষা না করে প্রায় বেরিয়ে যায় সে। রেজওয়ান আজকে আর কোনো ঝামেলা করলোনা বাসায়। প্রিয়ন্তি ইদানীং রাত জাগে। আগে এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে গেলেও এখন সেটা আর হচ্ছে না। এমন অনেক দিন গেছে ঘুমের ঘোরে মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনে হকচকিয়ে উঠেছে প্রিয়ন্তি। তাই জেগে থেকেই মায়ের সাথে সময় কাটায় আজকাল।
ভোরের আলো ফুটতেই প্রিয়ন্তি ঘুম ঘুম চোখে টলমল পায়ে গেটের সামনে পৌঁছে। নিঃশব্দে গেট খুলে বেলি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে আবার নিজের রুমে পৌঁছে। ডায়রির আরেকটা পৃষ্ঠার ভাঁজে ফুলটা রেখে বিছানায় শুয়ে কম্বল মুড়ি দেয়।
" আমার ফুল কি অন্য ফুল পেয়েছে? "
ফোনের নোটিফিকেশনের আওয়াজে স্ক্রিনে তাকিয়ে মেসেজটা দেখে মুচকি হাসে প্রিয়ন্তি। ছোটো করে "হুম" লিখে ফোন পাশে রেখেই ফের ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় মেয়েটা।
গত এক বছরে এমন একটা দিন যায়নি যেদিন গেটের সামনে বেলি ফুল পায়নি প্রিয়ন্তি। তবে প্রথম দিকে ফুলগুলো রাস্তায় পড়ে থাকতো, প্রিয়ন্তি সেগুলো স্রেফ দেখে চলে আসতো। কিন্তু যখন দেখলো তার চরম বিপদের দিনেও মানুষটা একইভাবে পাশে থেকেছে তখন আর মুখ ফেরাতে পারেনি সে। প্রিয়ন্তিদের বাড়ি থেকে তিনটা বাড়ি পেরিয়ে সেলিনা পারভীনের বাসা। উনারই বোনের ছেলে তিয়াস প্রিয়ন্তিকে পছন্দ করে। ছেলেটার মা বাইরে থাকে। খুব ছোটো থাকতেই তিয়াসের বাবা-মা আলাদা হয়ে যায়। পরে তিয়াসের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন আর মা প্রবাসে পাড়ি জমায়। নানা বাড়িতে বড়ো হয়েছে তিয়াস। ছোটো থেকে লোকের কথা শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছে ছেলেটা। মায়ের প্রবাসে থাকা নিয়ে এখনও কতো কথা শুনতে হয়!
" পুরুষ মানুষ বাইরে গেলে হয় বাদশা আর মহিলারা গেলে হয় বে*শ্যা। "
মায়ের সম্মন্ধে এরকম কুৎসিত কথা শুনেও চুপ থাকতে হয়েছে তিয়াসকে। কয়জনকে চুপ করাবে সে? সমাজের প্রতিটি মানুষ তাকে কটাক্ষ করে কথা বলে। তাই এখন আর কারো কথা গায়ে মাখে না। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে খালার বাসায় এসেছে বছরখানেক আগে। চেয়েছিলো খালুর সাথে মিলে ব্যবসা করবে। সেলিনা পারভীনের স্বামী মুজিবুর খামারি। প্রায় একশো গরু আছে তার খামারে। লেখাপড়া করে চাকরির পিছনে ছুটে সময় নষ্ট না করে নিজস্ব উদ্যোগে খামারের কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। আজ তিনি সফল খামারি। চেষ্টা ও ধৈর্য থাকলে সফলতা আসে অবশ্যই। তিয়াসের বাবা যদিও তার ভারবহনের জন্য মাসে মাসে টাকা পাঠান কিন্তু তাতে তিয়াসের সৎমায়ের ভীষণ আপত্তি। নানা-নানি কেউ জীবিত নেই। মামা-মামী তেমন ভালো চোখে দেখে না তাকে। তাই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে খালার বাড়িতে আসা।
মুখোমুখি বসে আছে রেজওয়ান ও আসমা। মাথার উপর খোলা আকাশ। দুপুরের কড়া রোদে ঘেমে জবজব করছে রেজওয়ানের শরীর। সকাল থেকে অনেক বার কল দিয়ে বলেকয়ে আসমাকে এই পার্কে আসতে বলেছে রেজওয়ান।
" আসমা তুমি কিন্তু আমাকে ঠকিয়েছো। তুমি যদি তোমার স্বামীর সাথে সংসার করবে তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেনো? বিয়ে বলছি কেনো! আইনী মতে তো তুমি ওই লোকটার স্ত্রী। "
"এসব বাদ দাও। আমি যদি আমার স্বামী, সন্তান ছেড়ে তোমার কাছে আসি তুমি কি তোমার স্ত্রী'কে তালাক দিতে পারবে রেজওয়ান? "
ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আসমা। রেজওয়ান বিচলিত। যতই হোক ঘরে সোমত্ত মেয়ে আছে। অর্পাকে তালাক দিলে প্রিয়ন্তি যদি কিছু ঘটিয়ে ফেলে? তাছাড়া দোকানের সকল রান্নাবান্না পর্যন্ত অর্পা করে। বাসা থেকে অর্ধেক প্রস্তুত করা খাবার দোকানে নিয়ে ফ্রাই করে বিক্রি করে। সবকিছু ভেবে চুপ করে আছে রেজওয়ান। আসমা কথার খেই ধরে।
" জানি তো পারবে না। গত কয়েকমাসে তুমি সেরকমভাবে কয়টা রাত আমার সাথে কাটিয়েছো? হ্যাঁ আমিও লুকোচুরি করেছি আর তোমার বাসায় ঝামেলা হবে বলেই হয়তো তুমিও সেরকম থাকোনি। তারচে আমার টাকাগুলো ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমার স্বামী যথেষ্ট ভালোবাসে আমাকে,সংসার করবো শান্তিতে।"
" বাহ! এখন ওই লোকটা তোমার স্বামী? আর আমার সাথে যে এতদিন কাটিয়েছো সেটা ছিলো কী?"
রেজওয়ান চালাক লোক। এতো সহজে টাকার কুমির হাতছাড়া করতে নারাজ সে। আসমা অবশ্য রেজওয়ানকে সত্যি চায়। গতকাল রাতে তরিকুলের সাথে প্রচন্ড ঝামেলা হয়েছে তার। তরিকুল নেহাৎ প্রচন্ড ভালোবাসে বলেই আসমাকে এখনও তালাক দেয়নি। আসমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন তো তরিকুলের সাথে কথা পর্যন্ত বলে না। যে স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে গিয়ে মিথ্যা বিয়ে করে দিনের পর দিন ঠকিয়ে গেছে তাকে কীভাবে কোনো পুরুষ ঘরে রাখতে পারে সেই নিয়েই তরিকুলের বাবা-মায়ের সাথে তার তর্কবিতর্ক। মাঝখান থেকে মুয়াজ ভুক্তভোগী। ছেলেটা এতকিছু না বুঝলেও আশেপাশের কথোপকথনে এতটুকু বোঝে তার মা নিশ্চয়ই কোনো খারাপ কাজ করেছে।
" যা হয়েছে সেটা হয়ে গেছে। এখন যদি তুমি তোমার সংসার বাদ দিয়ে আমাকে ওই ঘরে নিয়ে রাখতে পারো,তাহলে আমি তরিকুলকে ডিভোর্স দিবো।"
" ঠিক আছে। কিন্তু প্রিয়ন্তি? যতই হোক আমার মেয়েকে তো বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারবো না। "
" বেশ তো। বিয়ে দিয়ে দাও। আঠারো তো হয়ে গেছে। "
" এখনই বিয়ে! "
" দেখো আমি বললাম এখন কী করবে তোমার বিষয়। হয় তিন দিন পর তোমাকে ছাড়বো নয়তো তরিকুলকে। এরকম দ্বৈত সম্পর্কে থাকতে পারবোনা আমি। "
রেজওয়ান ভাবনায় পড়ে গেলো। মেয়েটার কতো স্বপ্ন লেখাপড়া করে ডাক্তার হবে! কিন্তু আসমার মোটা অঙ্কের টাকা পেতে হলে এসব করতেই হবে।
ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে ঘাসের উপর বসে আছে স্নেহা,রিক্তা ও প্রিয়ন্তি। আশেপাশে ছেলেমেয়েরা নিজেদের মতো কথাবার্তা বলছে। মাধ্যমিক থেকে একসাথে পড়ালেখা করে তিনজন। সুখ-দুঃখ সবকিছুই তিনজন তিনজনের সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছে সব সময়। প্রিয়ন্তির বাবার কর্মকাণ্ডের বিষয়ও অজানা নয় তাদের। কিন্তু তবুও রিক্তা ও স্নেহা সর্বদা সাহস জুগিয়েছে প্রিয়ন্তিকে। তবে স্নেহা আর রিক্তার বনিবনা খুব কম। কথায় কথায় দু'জনার প্রায় ঝগড়া লেগে যায়। প্রিয়ন্তি তখন দুজনের মধ্যে দেয়াল হয়ে ঝগড়া থামায়।
" তোদের পড়ালেখার খবর কী বল তো। আমার তো পড়া-ই হচ্ছে না ইদানীং। "
হতাশা জড়িত কন্ঠে বললো স্নেহা। পাশ থেকে রিক্তা মুক ভেংচি কেটে বললো,
" হবে কীভাবে? সারাদিন তো প্রতিবন্ধী সেজে টিকটিকি করিস।"
" খবরদার বললাম রিক্তা প্রতিবন্ধী বলবি না। আর ওটাকে টিকটক বলে টিকটিকি না। এসবের তুই কী বুঝবি হুহ্? "
দাঁত খিঁচিয়ে বললো স্নেহা। রিক্তা তাতে আবারও ভেংচি কেটে অন্য দিকে তাকালো। রিক্তা ফের কিছু বলতে যাবেই এমন সময় প্রিয়ন্তি রিক্তার হাত চেপে ধরে।
" তোরা আবারও শুরু করলি? থাম না ভাই! পরীক্ষার হলে গিয়েও তোরা এরকমই ঝামেলা করবি কি-না সেটাও ভাবতে হচ্ছে এখন।"
" আচ্ছা প্রিয় তিয়াস ভাই আজকে এলোনা? এমনিতে তো এমন সময় গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। "
" কেনো এলোনা জানি না তো। আমি তো আর প্রেম করি না তার সাথে। আগেই বলেছি শুধু বন্ধু হিসাবে কথা বলবো। "
" কিন্তু ভাইও তো বলেছে সে প্রেমিকা হিসেবে ভালোবাসে।"
" সেটা ওর সমস্যা। লেখাপড়া শেষ না করা পর্যন্ত কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাই না আমি। শেষে মায়ের মতো ভালোবাসার জন্য না পড়ালেখা বন্ধ করা লাগে। "
প্রিয়ন্তি কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো। ইদানীং বড্ড মুড সুইং করে মেয়েটার। এই মন ভালো আবার এই খারাপ! তিয়াসের সাথে ফোনে কথা বলে না প্রিয়ন্তি। কথা বললে যে মায়া বাড়ে! আর মায়া ভয়ংকর এক অসুখ। একবার এই অসুখে পেয়ে বসলে জীবন শেষ হয়ে যায়। তাই কেবল দিনে দু'একটা টেক্সটের উত্তর করে। লেখাপড়া নিয়ে এতো আশা করা মেয়েটা যদি জানতো তিনদিন পরে তার জীবনে কী অপেক্ষা করছে!
.
.
.
চলবে...........................