শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৪১ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


নীল আকাশ জুড়ে শুভ্র মেঘের ছড়াছড়ি। সূর্যের সোনালি দীপ্তি অরুর ঘুমন্ত মুখ জুড়ে। মাথাটা হেলেদুলে চলেছে চলন্ত গাড়ির তালে-তালে। তন্ময় ভালোভাবেই অবগত ছিলো; অরু বেশিক্ষণ সজাগ থাকতে পারবে না। শিগগিরই গভীরতম ঘুমের দেশে পাড়ি জমাবে। হলোও তাই। স্বাভাবিকভাবে গতকাল রাতে দ্রুত ঘুমুতে যায়নি। সকালে আবার ভোর করে উঠেছে। ঘুমে তলিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কী! তন্ময় একপল ওর মুখপানে আড়চোখে চেয়ে কাঁচটা তুলে দিল। দুটো কাঁচ তুলে দিতেই ভেতরটা আঁধারে এবং গুমোট পরিবেশে আবদ্ধ হলো। জাঁকজমক, ঝঞ্ঝট পৃথিবী হতে বহুদূর, ছোটোখাটো নিজেদের একটি পৃথিবীতে আছে যেন! এযাত্রায় তন্ময় অবাঞ্ছিত একটি কাজ করে বসল। চলন্ত গাড়িটির গতি কামিয়ে ব্যস্ত হলো– মাথার ওপরে হাতের বাম-পাশের আয়নাটির নিদর্শন পরিবর্তন করতে। এবারে অরুর মুখটুকু আয়নাতে পরিষ্কার দেখাচ্ছে। তন্ময় অবলীলায় একপল চোখ তুললেই মুখদর্শন হচ্ছে। ব্যাপারটা যেমন তৃপ্তিজনক তেমনই অশান্তিজনক বটে। তৃপ্তি দু'চোখ হচ্ছে আর অশান্তি হৃদয়! অদ্ভুতভাবে লম্বা একটি সময় অতি নীরবে চলে গেল। অরুর চোখমুখ বন্ধ থাকলে সবকিছু নির্জীব ভারী। এইযে এখনের সময়টাতেই প্রমাণ পাওয়া গেল। ওর চঞ্চলতা, বাচালতা ছাড়া তন্ময়ের দুনিয়া ভয়াবহ রকমের শান্ত, স্তব্ধতায় মোড়ানো। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে দশটা ত্রিশে। জানালার বন্ধ কাঁচেতেই এতক্ষণ যাবত অরুর মাথাটা লেপ্টে ছিল। তন্ময় ভুলবশত চেয়েও এগিয়ে মাথাটা নিজের কাঁধে নিচ্ছে না। যদি ওর ঘুমটা ভেঙে যায় সেই ভয়ে। ভেবেছিক একচিত্তে একইভাবে কতক্ষণই বা ঘুমাবে? নিজেই ফিরবে তার দিকে। তবে তা আর হলো কোথায়? অগ্যত এযাত্রায় ওর মাথাটা নিজ কাঁধে সযত্নে নিয়ে এলো। অরুর ঘুমটা সামান্য কেঁটে গেল বোধহয়। মিটমিট করে আধবোজা চোখে চাইল। তন্ময়ের কাঁধে মাথা রেখেছে বুঝে– আরও নিবিড়ভাবে মাথাটা এগিয়ে নিলো। ঘুম জড়ানো–আকুতি মেশানো কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলল,

'কাঁচটা নামিয়ে দিন না।' 

ঘুমঘুম কণ্ঠটি ঠিক তীর হয়ে বিঁধল তন্ময়ের অন্তরে! অন্তরের ভেতরে কিছু একটা ধপাস করে ভাঙল যেন। ঘুমঘুম কণ্ঠও যে এতটা প্রভাব ফেলতে পারে এই প্রথম উপলদ্ধি করল সে। আবার দেখ, ঘুমের মধ্যেও গাড়ির কাঁচ খোলা চাই! অগ্যত তন্ময় সরু সড়কপথে বিচক্ষণ দৃষ্টি রেখেই, গাড়ির কাঁচ দুটো নামিয়ে ফেলল। দুধারে গিয়েছে দুটো রাস্তা। তন্ময় বাম-পাশের বাঁকা রাস্তাটির দিক ছুঁটে। রাস্তার দুধারে রয়েছে বড়ো-বড়ো হরেকরকমের গাছ। বিশেষ করে নারিকেল গাছ। জমিন জুড়ে ছোটোছোটো সবুজ ঘাস। এদিকটায় পাখিদের কিচিরমিচিরও বড্ড বেশি। রোঁদটাও তেমন তীক্ষ্ণ নয়। আরাম বোধ হচ্ছে বেশ। বাতাস হামলে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদের। গাড়ির গতি বাতাসের স্পর্শের মাত্রা দ্বিগুণ করে ফেলেছে। অরুর শান্ত-স্থির চুলগুলো এবার অশান্ত হয়েছে। ড্রাইভার তন্ময়কে মহাবিরক্ত করছে। তার মুখ-বুক সবাখানে চুলের ছড়াছড়ি। সুড়সুড় লাগছে মুখে। এতে ড্রাইভিংয়ে কনসেন্ট্রেশনে বাঁধা সৃষ্টি করছে। এ-তো মস্তবড় অন্যায়। অথচ অন্যায় কারী ব্যক্তিটি বেশ আরাম-আয়েশিতেই আছে। বাতাসের স্পর্শে, শক্তপোক্ত কাঁধে মাথা রেখে– তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে পুনরায়। তন্ময় ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সুড়সুড়ি সহ্য করেই ড্রাইভ করে গেল। ড্রাইভার তন্ময়ের কনসেন্ট্রেশন ভাঙার মতন অবস্থার বুঝি শেষ নেই!

অরুর গভীর ঘুম ভাঙল ঠিক ঘন্টাখানেক পর। তখন প্রায় এগারোটা ত্রিশ। দ্বিতীয় দফায় তন্দ্রা ভাঙতেই আধবোজা চোখে চেয়ে শুধাল,

'কয়টা বাজে, তন্ময় ভাই!'

তন্ময় একপল হাত ঘড়িতে চাইল। ফের চোখ তুলে আয়নাতে দৃষ্টি ফেলল। আয়নায় প্রতিচ্ছবি হওয়া মুখটুকু দেখে জানাল,

 'এগারোটা পঁয়ত্রিশ।'

জবাবে অরু নাকমুখে 'হুম' ধ্বনি তুলল। আড়মোড়া ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসল। মাথা সহ কাঁধটা ব্যথা হয়ে গিয়েছে তার। কাঁধে মস্তবড় বস্তা ছিল যেন। সমানে মাথাটা এদিক-ওদিক ঘুরিয়েফিরিয়ে ব্যথা দূর করবার প্রচেষ্টা। তন্ময় জিজ্ঞেস করল,

'বেশি ব্যথা করছে?'

প্রশ্নটি বোধহয় অরুর ভালো লাগল। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে–সে ত্বরিত প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন ছুঁড়ল, 'হ্যাঁ বললে কি মালিশ করে দেবেন?'

তন্ময় আশ্চর্য অথবা হতভম্ব হলো না। বরঞ্চ প্রশ্নটির জবাব সে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ভ্রু তুলে দিলো, 'করতে দিবি?'

অরু বুঝি আসমান হতে জমিনে পড়ল? অবিশ্বাস্য হৃদয়ে আর বিস্ফোরিত চোখে চাইল তন্ময়ের মুখে। নির্বাক চোখে কয়েক মুহূর্ত দেখল একচিত্তে। অদেখা হিসেব-নিকেশ কষল যেন। তারপর ভদ্রভাবে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফেলল নিজের দিকের জানালার বাইরে। তন্ময় না চেয়েও সবটাই দেখল। গাল ভরে হাসল শব্দহীন ভাবে। হাসিটুকু মুখে লেগে থাকল দীর্ঘসময়। মেইন রোড পেরিয়ে গাড়িটা নির্জন রাস্তা ধরতেই; অরু এযাত্রায় মুখ খুলে বলল, 

'খিদে পেয়েছে। গাড়িটা থামান। খেয়ে নিই আগে।'

তন্ময় সহমত হলো। তা মাথা দুলিয়ে বোঝাল। নিরিবিলি জায়গা দেখে গাড়ি থামাল। চোখের সম্মুখে দীর্ঘ জায়গা জুড়ে চাষের জমি। দুজন নেমে হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে পুনরায় গাড়িতে উঠে বসল। প্যাকড করা বক্স থেকে একেএকে সবগুলো বাটি বের করল অরু। ঢাকনা খুলতেই ঘ্রাণে ম-ম করল চতুর্দিক। ঘ্রাণ টেনে নিয়ে খেতে শুরু করল চটপট। ওর পছন্দের খাবারের বাটিগুলো রেখে অন্যসবে হাত বাড়াল তন্ময়। যেসব মহারানির পছন্দ নয়– সেসবই তার পেটে গেল। তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করল। গাড়িটা পুনরায় স্টার্ট করবে এসময় অরু বলল, 

'কফি খেয়ে নেন আগে!'

অরু দুটো ফ্লাস্ক বের করল। একটাতে তারজন্য চা আরেকটায় গরম পানি। এই ফ্লাস্কে বারো ঘন্টা পানি-চা গরম থাকে। যখন গরম পানি ঢালল মগে-তখন রীতিমত টগবগ করে ধোঁয়া উঠছিল। 
ওয়ান টাইম কফির প্যাকেট ছিঁড়ে মগে ঢেলে দিলো। চামচ দিয়ে নেড়েচেড়ে এগিয়ে ধরল।
তন্ময় স্থির চোখে এই ব্যস্ত অরুকেই দেখছিল।
এগিয়ে ধরা মগটা এযাত্রায় নিলো। অরু পিনপতন নীরবতায় নিজের চা-টা নিয়ে খেতে ব্যস্ত। সে দিব্যি চা পান করতে নিয়ে মন্তব্য ছুঁড়ল,

'প্রকৃতির জাদু দেখতে-দেখতে চা খাওয়ার মজাই আলাদা।'

তন্ময় দ্বিমত করল না। কফিটা সে বেশ সময় নিয়ে খেলো। কফি এতটা অনুভব করে সে কখনো খেয়েছে বলে মনে হলো না। 

———

চট্রগ্রাম পৌঁছাতে-পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।
শান্তস্থির বিকেলবেলার আসমান জুড়ে তখন পাখিদের আসা-যাওয়া চলছে। এদিক-ওদিক নদীজলের দর্শন মিলছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তা ধরেছে তাদের গাড়ি। এতক্ষণ যাবত বন্ধ করে রাখা ফোনটা তন্ময় এযাত্রায় খুলল। খুলতেই একের পর এক মিসডকলের উচ্চধ্বনিতে মুখরিত গাড়ির ভেতরটা। লাস্ট মিসডকল এসেছে ম্যানেজার সুমন থেকে। তন্ময় তাকেই কল ব্যাক করল সর্বপ্রথম। ব্লুটুথ কানে গুঁজল। ফোনটা হুইলের পাশে রেখে সড়কপথে দৃষ্টি ফেলল। 'রেডিসন ব্লু' হোটেলটি অদূরেই। তারা প্রায় পৌঁছে গিয়েছে। ম্যানেজার সুমন এক রিংটোনেই কল রিসিভ করেছে। তন্ময় জানাল তারা পৌঁছেছে। সে কোথায়? সুমন প্রত্যুত্তরে জানাল সে হোটেলেই। পার্কিং এড়িয়াতে এক্ষুনি আসছে। গাড়িটা মডার্ন রাজকীয় রেডিসন ব্লু-য়ের দোরগোড়া হয়ে সদর দরজা পেরিয়ে ঢুকল। পার্কিং এড়িয়াতে আসতে মিনিট খানেক লাগল। দেখা গেল সুমনকে। যে ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে। গায়ে সাদা রোব্ পরে আছে। পায়ে সাদা স্লিপার্স। অরু এভাবে তাকে দেখে হেসে ফেলল। হাসিতে দুলছে তার শরীর। গাড়ির ভেতরে বসেই হাসতে-হাসতে শুধাল,

'আঙ্কেল, এভাবে চলে এসেছেন যে!'

সুমন বেশ লজ্জা পেয়েছে। লজ্জায় হাঁসফাঁস করছে। মাঝবয়সী তার এহেন পোশাক মানায় নাকি! সে তো ভেবেছে স্যার আসবে রাতে। সারাদিন অপেক্ষা করে যখন দেখল আসছে না, তাই কেবলই গোসল নিতে গিয়েছিল। ভেবে রেখেছিল গোসল সেরে নরম বিছানায় টানটান হয়ে একটি গাঢ় ঘুম দেবে। কে জানতো তার গোসল নেবার সময়টাতেই চলে আসবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে লজ্জাসংকোচ সরিয়ে এগুল সে। ল্যাগেজ বের করল। তন্ময় গাড়িটা পার্ক করে বেরুল। চাবিটা সুমনের হাতে ধরিয়ে দিলো। অরু নিজেও বেরিয়েছে এসময়। সুমনকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। 

'ভালো আছেন, আঙ্কেল? আপনাকে কিছুদিন না দেখে মনে হচ্ছে আরও ইয়ং হয়ে গিয়েছেন।'

সুমন আড়চোখে তন্ময়ের মুখ দেখে ভদ্রসভ্য গলায় রয়েসয়ে বলল, 'ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ্। ধন্যবাদ, মামণি। তুমি কেমন আছো?'
'আলহামদুলিল্লাহ্।'

তন্ময় ল্যাগেজ একটা ডান হাতে টেনে নিয়ে–বামহাতে অরুর হাত ধরল। নিজের সাথে তালে-তাল মিলিয়ে নিতে-নিতে সে সুমনের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত। রিসিপশনে এসে অনলাইন বুকিং দেখাতে হলো। চাবি হাতে তাদের সঙ্গে একজন লেডিস এলো। তৃতীয় তলায় তাদের স্যুট। সেখানে পৌঁছে দিয়ে গেল। চাবি হাতে ঢুকল তারা বিলাসবহুল স্যুটের ভেতরে। যেখানে ফ্লোর হতে সিলিঙ ধরে উইন্ডোস। 
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন