শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৪৩ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


অরু মৃদু স্বরে গোঙাল। তীব্র প্রচেষ্টা করে চলেছে এই অসহ্যকর অনুভূতি হতে লুকোতে। তবে লুকোনো কী সম্ভব? আবেদনময়ী এই রাতের নির্জন আঁধারে ঘটিত অঘটন থামাতেই বুঝি ঘর আলোকিত হয়ে উঠল! বিদ্যুৎ যেমন আচমকা গিয়েছে–তেমন হঠাৎ করেই ফিরেছে। বিদ্যুতের সঙ্গে ফেরে তন্ময়ের ভাবনাচিন্তার বোধটুকু। সচল হয় মস্তিষ্ক। তার আবরণশূন্য পেশিবহুল শরীরের নিচে চাপা পড়ে থাকা; ফর্সা আধঢাকা দেহ খানা বিদ্যুতের সাদা আলোতে এবার সু'স্পষ্ট। অরুর মেদহীন কোমরে তার একটি বলিষ্ঠ হাত এখনো রয়েছে। অন্যটি অরুর হাত দুটো শক্ত করে ধরে আছে। ওকে সম্পূর্ণ ভাবে, দৃঢ়ভাবে নিজের কাছে বন্দি রেখেছে। বিড়ালছানার মতন অসহায় অরু বিদ্যুতের আলোতে এবার– লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে। কান ধরে গলা রক্তিম হয়ে এসেছে। 

মুহূর্তেই তন্ময়ের উত্তেজনায় জর্জরিত শরীর আসাড় হয়ে আসে। এক ঝটকায় জাপ্টে বন্ধ করে নেয় দু'চোখের পাতা। ব্যাকুলভাবে অনুভব করে অরুর কম্পমান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। বাইরে তখনো বর্ষিত হচ্ছে অদরকারি বর্ষণ। তন্ময় ততক্ষণাৎ ওঠে দাঁড়ায়। একমুহূর্তের জন্যও দাঁড়ায় না। অশালীন ভাবে; দ্বিতীয়বার না চেয়ে–চোয়াল শক্ত করে চোখমুখ বুঁজে, কয়েক কদমে ঢুকে পড়ে নিজ কক্ষে। 

শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে। দরজায় সুঠাম পিঠ লেপ্টে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়। হৃদপিন্ড তিরতির করে কাঁপছে তখনক। বুকের ওঠানামার গতি অস্বাভাবিক দ্রুত। ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নেবার অসীম চেষ্টা। 
এতটা অসহায় বোধহয় এই প্রথম লাগছে তার। 
এমন একটি বিশ্রীরকমের কাজ করে সে পালিয়ে এসেছে? তার অরু নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে? ওকে ওভাবে ফেলে এসেছে ভাবতেই রাগে শরীরের সবটুকু উত্তেজনা হারিয়ে ফেলল। আজ যদি তার অধিকার থাকতো তাহলে কী অপরাধবোধ কাজ করতো? এতটা দ্বিধায় আক্রান্ত হতে হতো হৃদয়কে? বাবাকে দেয়া প্রতিশ্রুতিও সে রাখতে পারেনি। বিদ্যুৎ না ফিরলে সে কী করে বসতো? ভাবতেই শিরশির করে ওঠে মেরুদণ্ড। এতবড় একটি ধাপে সে চলে এসেছে। এই ধাপে পা রেখেও কীভাবে নির্লিপ্ত থাকবে? কীভাবে নিশ্চুপ রইবে? নিজেকে দমিয়ে রাখার রাস্তা তো আর নেই। তার পক্ষে আর নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব নয়! পরিবারের সম্মতির পরোয়া করাও তার দ্বারা আর হবে না। যা হবে এবার তার ইচ্ছেতে- তার মতে।

সারারাত তন্ময় দুচোখের পাতা এক করেনি। সজাগ হয়ে চেয়ে রয় বাইরে। বৃষ্টি পোঁটলাপুটলি বেঁধে চলে যায়। কালো মেঘ সাদা হয়। চাঁদ ডুবে সূর্যোদয় হয়। সবটাই ঘটে তার চোখের সামনে। এযাত্রায় ঘড়ির কাঁটা সাতটায় থামে। তন্ময় ফোন হাতে তুলে নেয়। কল করে সুমনকে। সুমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন। ঘুম কী বসের চেয়ে বড়ো? না, একদমই নয়। সে তরিৎ উঠে বসে। কল রিসিভ করে ফোন কানে তুলে। মুখ খুলে 'গুডমর্নিং' টুকু শেষ করতে পারে না। তন্ময় অধৈর্য কণ্ঠে শুধায়,

'আশেপাশে কাজি অফিস আছে?'

চমকে ওঠে সুমন। বিস্ফোরিত চোখে শূন্যে চেয়ে জিজ্ঞাসু সুরে বলে,

'কেন, স্যার?'

তন্ময় থমথমে শক্ত গলায় বিস্ফোরণ ঘটানো কথাটি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে বসে,

'আমি এইমুহূর্তে বিয়ে করব। যা যা ব্যবস্থা নেবার নিতে হবে। কী কী প্রয়োজন বিয়ে করতে–তার খোঁজ লাগান! কাজি অফিসের লোকেশন ট্র‍্যাক করুন সর্বপ্রথম। কাছাকাছি হলে ভালো হয়। যত দ্রুত সম্ভব তত ভালো। আপনি আমার কথাগুলো বুঝেছেন?'

সুমন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হওয়ার কথা কী নয়? এরথেকে আশ্চর্যের বিষয় দুটো হয় না। মিটিং করতে এসে বস বিয়ে করতে চাচ্ছে! ও মাই গড। 
সুমন চিন্তিত, বাকরুদ্ধ। এসব যদি পরে তার বড়ো বস জানে? সুমন সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মোস্তফা সাহেবকে! এই কাণ্ডে যদি সে হাত লাগায়া, তার হাতই কেঁটে দেবে। কেঁটে দিলেই বা কী? ছোটো বসের কথাও যে অমান্য করা সম্ভব নয়। সুমন গলায় তলোয়ার নিয়েই কোনোমতে শুধাতে চাইল,

'হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন, স্যার? কিছু কি হয়ে…'

তন্ময় অধৈর্যের সপ্তমে। ধৈর্য ফুরিয়ে গিয়েছে। অল্পও অবশিষ্ট নেই। সে তাড়াহুড়ো গলায় বলল,

'কোনো প্রশ্ন না। বিয়ের আগে এই কথা যেন লিক না হয়। যা বললাম তাড়াতাড়ি করুন, সুমন সাহেব। আম সিরিয়াস এবাউট দিস!'

সুমন ফোনের ওপাশে মাথা দোলায়। দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাহস করে না। কিন্তু মনে একটি প্রশ্ন রয়েই যায়। পাত্রী কে? মনে একজনের চেহরা ভেসে উঠেছে। সেই কী? ধড়ফড়িয়ে ওঠা বুক চেপে বলে, 

'স্যার, মাত্র আধঘন্টা দিন। সবকিছু এরেঞ্জ করে ফেলব।'

তন্ময় ফোন কান থেকে নামিয়ে বিছানায় ফেলে। গোসলে ঢোকে। গোসল সেরে বেরোয় বাথরোব পরে। ভেজা চুলে দাঁড়ায় গ্লাসের সামনে। বাইরেটা উজ্জ্বল। খণ্ড খণ্ড শুভ্র মেঘ নীল আকাশ জুড়ে। 
স্বচ্ছ পানির সুইমিংপুল দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈরি হয়ে নেয়। তৈরি হয়েই ফোন হাতে তুলে নেয়। পুনরায় কল করে সুমনকে। সুমন এক রিং হতেই রিসিভ করে। তন্ময় চটপট শুধায়, 

'কতদূর?'

সুমন ত্বরিত জবাবে বলে, 'সব রেডি। ইভেন এই সাতসকালে কাজিকে ধরেবেঁধে এনে কাজিঅফিস খুলিয়েছি। আমি এখন হোটেলের সামনে। আসছি।' 

কয়েয় মিনিট পরপরই বাজল ডোরবেল। তন্ময় সেমুহূর্তে বেরোল। ঢোক গিলল। আড়চোখে চাইতেই দেখল অরু সোফায় বসে আছে। পিটপিট চোখে লজ্জিত মুখে বারংবার চাইছে। অস্বস্তি ওর একেকটা হাবভাব। তন্ময় দরজার দিক যেতে-যেতে আদেশ ছুঁড়ল,

'রেডি হ। আমরা এক্ষুনি বেরোব।'

'কোথায় যাচ্ছি' এই প্রশ্ন মস্তিষ্কে নিয়েই অরু মাথা দোলাল। মনের কুঠুরিতে থাকা প্রশ্নটি করার স্পর্ধা পেলো না বোধহয়। চুপচাপ তৈরি হয়ে এলো কিছু মিনিটের মাঝেই। সুমন তৈরি হয়ে বেরুনো অরুকে দেখে আরও নিশ্চিত হলো। তার ধারণা বুঝি সঠিক হতে চলেছে? তবে দেখেশুনে যতটুকু বুঝল অরু কিছুই জানে না। নির্বোধের মতন চুপচাপ বসে আছে। নিত্যদিনের মতো চঞ্চলও আজ নেই। কিছু কী হয়েছে দুজনের মধ্যে? হলেও বা তার কী? সুমন নিজের ভাবনাচিন্তা তালাবদ্ধ করল। একচিত্তে গাড়ি চালাতে থাকল। পেছনে বসেছে তন্ময়-অরু। দুজনই চুপচাপ ভদ্রসভ্য ভাবে বসে। আজ কাঁচও তোলা। অরু বায়না ধরেনি কাঁচ নামানোর জন্য। আড়ষ্ট ভাবে বসে আড়চোখে চেয়ে যাচ্ছে শুধু। তন্ময় সবটাই না দেখেও অনুভব করল। কিছুক্ষণ পরে যেই কাহিনী ঘটবে সেটি কীভাবে মেনে নেবে অরু? ও কি ভয় পাবে? 

———

কাজি অফিসের সম্মুখে এসে থামল গাড়িটা। তন্ময় বেরোল প্রথমে। ওপর পাশে এসে দরজা খুলে ধরল অরুর জন্য। অরু বড়ো বড়ো চোখে কাজি অফিসের সাইনবোর্ড দেখছে। আশ্চর্য হয়েই বেরোল সে। জিজ্ঞাসু চোখে চাইল তন্ময়ের দিক। সেই দৃষ্টি পরিপূর্ণ ভাবে অগ্রাহ্য করল তন্ময়। অরুর হাত ধরে স্থিরচিত্তে হাঁটা ধরল ভেতরে। কাজি অফিসের ভেতরে দুজন ঢুকল আনম্যারিড রূপে। বেরোল ম্যারিড রূপে। অরুর গলায় সুন্দর গোলাপ ফুলের মালা। তন্ময়ের গলাতেও সেটি। নিজ হাতেই দুজন দুজনকে পরিয়েছে। সুমন এবং সুমনের বড়ো ভাই সহ চেনাপরিচিত কিছু মানুষও বেরিয়ে এসেছে পিছুপিছু। তারাই ছিল পরিবার হিসেবে। বিবাহিত অরু তখনো তাজ্জব। তন্ময় তাজ্জব অরুকে গাড়িতে বসিয়ে সুমন সহ বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল,

'আজকের জন্য ধন্যবাদ। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়েটা হলে নিশ্চয়ই দাওয়াত পাবেন।'

সুমনের বড়ো ভাই রসিকতা সুরে বলল, 'মিষ্টি খেয়েছি তাতেই হবে।'

তন্ময় মাথা দোলায়। সালাম জানিয়ে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। বিয়েটা বেশিক্ষণ প্রাইভেট রাখা গেল না। হাওয়ার গতিতে সেখবর শাহজাহান বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে। এবং সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ঠিক অরুর মতন। তন্ময় গাড়ি চালাতে-চালাতে প্রশ্ন করল,

'বাসায় কী বলবি?'

অরু বোকার মতো শুধাল, 'কী বলব?' 

তন্ময় ধীর গলা শিখিয়েপড়িয়ে নেবার ভঙ্গিতে জানাল,

'বলবি এই বিয়ে তুই স্বেচ্ছায় করেছিস। তোর ইচ্ছেতে সব হয়েছে।'

অরু পুনরাবৃত্তি করল, 'স্বেচ্ছায় করেছি? আমার ইচ্ছেতে হয়েছে?'

তন্ময় ভ্রু তুলে বলল, 'স্বেচ্ছায় নয় বুঝি? তুই কী আমাকে বিয়ে করতে চাস নি? আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই?'

অরু ঘাবড়ে গেল। ভড়কে তোতলানো সুরে কোনোরকমে বলল, 'তা কেন হবে! তা নয়। আ-আমি – আমি চা-চচ্ছিলাম।'

তন্ময় সন্তুষ্টা হলো খানিক। আদেশ দেবার মতন নির্দেশ দিলো, 'এখনকার মতো থেমে থেমে নয়। ফ্রেশ কণ্ঠে ঝরঝর ভঙ্গিতে বলবি। তোতলানো চলবে না। বুঝেছিস?'

অরু না বুঝেও বুঝেছে বোঝাতে মাথা ঝাকাল।
তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাকে আজ শাহজাহান মোস্তফা চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে নির্ঘাত! চাচ্চু কীভাবে বিষয়টা নেবে তা নিয়েও শঙ্কিত সে! ভালোয় ভালোয় সকলে মেনে নিলেই হয়। 
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন