মনেরও গোপনে (পর্ব ১৪)


#মনেরও_গোপনে 
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া 
#পর্ব_১৪ 



"আরে না, তুই চিন্তা করিস না। একটু প্রেশার বেড়ে গেছিলো। নিজের খেয়াল রাখিস রাখছি।"
" বাবার খেয়াল রেখো আর নিজেরও টাটা।"

" শুনতে খারাপ লাগলেও মেয়েটা মরলেই ভালো হতো।"
মায়ের সাথে কথা বলা শেষে কিছুটা ক্ষোভের উদ্রেকই কথাটা বললো মিহি। তোশা সম্পর্কে বোন হলেও তার প্রতি চরম বিতৃষ্ণা তার। যে মেয়ে জেনেশুনে অন্য মেয়ের স্বামীর দিকে নজর দেয় সেরকম মেয়ের বেঁচে থাকার দরকার নেই। 
" কে মরলে ভালো হতো তোমার? "
" আপনার দরকার নেই তাতে, শুনুন সারাদিন আমার সাথে এরকম করবেন না। "
রুদ্র আলমারি থেকে ফর্মাল পোশাক বের করে রেডি হচ্ছে। 
" কী করলাম আমি! আমি তো খুব ভালো আচরণ করছি। "
" ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করুন আগে, লাজ লজ্জা কিচ্ছু নেই। "
" আমি তো সবকিছু খুলে চেঞ্জ করছি না। "
"যান বলছিইই।"
"ঠিক আছে যাচ্ছি যাচ্ছি মিহির দানা। "
মিহির চোখ পাকানোর জন্য রুদ্র আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে রেডি হয়ে বের হলো।
" বিকেলে ভাবি আসবে বাসায়। "
" সমস্যা নেই বাজার করা আছে শুধু রহমান চাচাকে বললেই সবকিছু তৈরি করে দিবেন। "
" ওকে।"

রুদ্র কখনোই দুপুরে বাসায় খেতো না তাই বিয়ের পরেও আজকেও আসেনি। কিন্তু রহমান চাচা মিহির জন্য সবকিছু রান্নাবান্না করেছেন। যেহেতু রহমান চাচা উনার স্ত্রী'কে রেখে খাবার খাননা তাই দুপুরে একাই খাবার খেতে হলো মিহিকে। কোমরের ব্যথায় হাঁটতে অবশ্য একটু কষ্ট হচ্ছিল মেয়েটার। কিন্তু চলাফেরা তো করতেই হবে। খাওয়া শেষে নিজের রুমে গিয়ে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছে মিহি। রুমের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে বুকশেলফ। অনেকগুলো বই রাখা আছে সেখানে। মিহি আস্তে আস্তে বইগুলো দেখতে শুরু করলো। বেশির ভাগ বই হুমায়ূন আহমেদ স্যারের তারপর কিছু সমসাময়িক লেখকের বই। তারমধ্যে হুমায়ূন আহমেদের "অপেক্ষা" নামক বইটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসলো। বিকেলে ভাবি আসবে তাই তার আগ পর্যন্ত বই পড়ে সময় কাটাবে বলে সিন্ধান্ত নিলো মিহি।

" কী হলো হুট করে এই ভরদুপুরে ঘরের দোর দিলে কেনো?"
রাহি ঘরের দেয়ালে আঁকি ঝুকি করছিলো। রাহি ভালো আঁকতে পারে তাই দেয়ালে কিছু পেইন্ট করবে বলে ভাবছিল সকাল থেকে। আদ্রিয়ান খাওয়া শেষে ঘরে এসে দরজা আঁটকে রাহির পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
" তুমি কী ঠিক করেছো আমাকে এভাবে পোড়াবে?"
" মাথা ঠিক আছে তো! এসব কী বলতেছো?"
আদ্রিয়ানের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে রাহি। আদ্রিয়ানের চোখমুখ লাল হয়ে আছে। কোনো প্রকার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রাহির হাত ধরে টেনে বিছানায় বসালো।
" এতটা কষ্ট দিও না। "
" আদ্রিয়ান! "
" কী? আমি পুরুষ মানুষ তোমার মতো সহ্য শক্তি আমার নেই। এরকম তিলে তিলে কষ্ট না দিয়ে একেবারে মেরে ফেলো। একই বিছানায় আমার ভালোবাসার মানুষটা থাকে অথচ আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে পর্যন্ত পারিনা। তুমি দূরে ছিলে এতটা উতলা ছিলাম না তখন কিন্তু পাশে শুয়ে এতটা দূরত্ব সত্যি আমার সহ্য হয় না। "
সত্যি বলতে রাহিরও কষ্ট হয় ভীষণ। কতদিন প্রিয়তম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমানো হয়নি তার! তোশার কথাগুলো কিছুতেই কেনো জানি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু মানুষ মাত্রই তো ভুল করে। আদ্রিয়ান তার ব্যতিক্রম নয়। 
" তাহলে কি আলাদা ঘরে থাকবো আজ থেকে? 
" সেই সুযোগ পাবে না।"
রাহি কিছু বুঝে উঠার আগেই আদ্রিয়ান দু'হাতে আলতো ধাক্কা দিয়ে বিছানায় শুয়ে দিলো তাকে। রাহি অবাক হয়েছে আদ্রিয়ানের আচরণে। কতটা অধৈর্য হয়ে গেছে লোকটা? 
" আদ্রিয়ান তুমি আমাকে এভাবে জোর করতে পারো না।"
আদ্রিয়ান কোনো উত্তর দিলো না। কোনো বাক্যব্যয় না করে রাহির ওষ্ঠ নিজের ওষ্ট যুগলে বন্দী করে নিলো। কেমন একটু কেঁপে উঠলো রাহি। কিন্তু ছাড়াতে চাইলো না আদ্রিয়ানকে। গভীর আলিঙ্গনে দু'হাতে আঁকড়ে ধরে নিজেও সাড়া দিলো। রাহির সাড়া পেয়ে আদ্রিয়ান আলতো করে গালে, কপালে চুম্বন এঁকে দিলো। রাহি দু-চোখ বন্ধ করে আছে। 
" উঠে রেডি হয়ে নাও মিহিদের বাসায় যেতে হবে না?"
" একটু দেরি হলে কিচ্ছু হবে না। কন্টিনিউ করো।"
রাহির আশকারায় আদ্রিয়ান ভালোবাসার পরশে সিক্ত হলো।

সময় যেনো কিছুতেই কাটছে না আজ। বই পড়ায়ও মন দিতে পারেনি মিহি। রহমান চাচা ছিলেন কতক্ষণ কিন্তু মিহি নিজেই তাকে বাসায় ফিরে যেতে বলেছে। তবে যাওয়ার আগে অতিথিদের জন্য কিছু খাবার-দাবার প্রস্তুত করে ডাইনিং টেবিলে পরিবেশন করে রেখে গিয়েছেন। যেহেতু একা ভালো লাগছিল না তাই এরমধ্যে একবার কল করে অহনার সাথে কথা বলবে বলে ভাবলো মিহি। তাই দেরি না করে অহনার নম্বরে ডায়াল করলো। 
" কী খবর নতুন বউয়ের?"
" আর বলিস না রে কোমরে লেগেছে খুব, ব্যথা হচ্ছে ভালোই। "
" হায় হায় দুলাভাই দেখি পুরাই আগুন। "
" নাউজুবিল্লাহ, অসভ্য মেয়ে। মুখ সামলে কথা বল, ফ্লোরে পড়ে গেছিলাম সকালে এজন্য লেগেছে। "
" ওহ এই কথা আমি ভাবলাম রাতের ঘটনার জন্য হয়েছে। "
" শোন বিয়ে হলেই কেউ বরের সাথে ওসব করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে না। আমি ভাবতেই পারছিনা এসব অশালীন কথাবার্তা কীভাবে তুই বললি!"
" হয়েছে হয়েছে শালীনতার প্রতীক এসেছেন। দুপুরে খেয়েছিস?"
" হ্যাঁ, তুই? "
" হ্যাঁ খেয়ে বের হলাম একটু। রাতে কথা হবে টেইক কেয়ার মিহি।"
" সেইম টু ইউ চুন্নি। "
কথা শেষ হতেই কলিংবেলের শব্দ ভেসে এলো মিহির কর্ণকুহরে। ভাই-ভাবী এসেছে ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেছে মেয়েটার। কিন্তু যতটা দ্রুত দরজা খোলার জন্য যেতে চাচ্ছিলো ততটা দ্রুত যেতে পারছিলো না। অগত্যা আস্তে আস্তে গিয়ে দরজা খুলে দিলো মিহি।
" কেমন আছিস মিহি?"
" ভালো আছি ভাইয়া,তোমরা আগে ভেতরে এসো।"
আদ্রিয়ান ও রাহি মিহির পিছুপিছু বাসায় প্রবেশ করে বসার ঘরে সোফায় বসলো। 
" মিহি তোর কী হয়েছে! এরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিস কেনো?"
বোনের শরীর খারাপ ভেবে প্রশ্ন করলো আদ্রিয়ান। কিন্তু রাহি পাশে থেকে চিমটি কেটে বললো,
" তুমি চুপ করো,মিহি রুদ্র ভাই হসপিটালে?"
" হ্যাঁ উনি একেবারে রাতে ফিরবেন। ভাইয়া সকালে ফ্লোরে পড়ে গেছিলাম এজন্য কোমরে লেগেছে একটু।"
" সেকি পড়লে কীভাবে? ঔষধ খেয়েছো? "
" হ্যাঁ ভাবি। বাবা এখন কেমন আছেন? "
" চিন্তার কিছু নেই প্রেশার বেড়ে গেছিলো একটু।"
" আচ্ছা ডাইনিং টেবিলে বসবে চলো,নাস্তা খেতে খেতে আলাপ করবো।"
" আরে এখানেই বসো মিহি। মাত্র খেয়ে এলাম তো।"
" আচ্ছা তাহলে ঘরে চলো।"
সারা বিকেল ভাই ভাবীর সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে খুব সুন্দরভাবেই কাটলো মিহির। কিন্তু সন্ধ্যার আগে আদ্রিয়ান ও রাহি চলে যাওয়াতে আবারও একাকীত্ব গ্রাস করলো মিহিকে। হুট করে এরকম একা থাকাতে খারাপ লাগছিল। বারবার চোখের সামনে মা-বাবা, ভাই-ভাবীর সাথে কাটানো সময়গুলো মিস করছে। 
" এই যে মিহির দানা, ব্যথা কমেছে? "
হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে অচেনা একটা নম্বর থেকে টেক্সট দেখলো মিহি। এটা যে ডক্টর রুদ্র চৌধুরী সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই মিহির। মেসেজের কোনো রিপ্লাই দিতে ইচ্ছে করছে না। সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। মাগরিবের নামাজ পড়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আশেপাশের বিল্ডিং দেখছে মিহি। জায়গায়টা একেবারে নতুন মিহির জন্য। ডিসেম্বর মাসেও আকাশে কালো মেঘেরা আনাগোনা করছিলো বিকেলো। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশের বাড়ির ছাঁদে নজর দিলো মিহি। সেখানে কিছু ছেলেরা ব্যাডমিন্টন খেলতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাদের খেলা দেখলো মেয়েটা। কাল থেকে ক্লাসে যাওয়ার কথা ছিল মিহির কিন্তু কোমরে চোট পেয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে এখন। কেনো যে সকালবেলা ওরকম লাফিয়ে ফ্লোরে পড়তে গেলো ভেবে নিজেকে নিজেই গালি দিলো মিহি। যাতে ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতিতে আর পড়তে না হয় এজন্য মিহি ভাবছে আজ থেকে আর এক বিছানায় শোবে না। 



চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন