#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৫
কেনো যে সকালবেলা ওরকম লাফিয়ে ফ্লোরে পড়তে গেলো ভেবে নিজেকে নিজেই গালি দিলো মিহি। যাতে ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতিতে আর পড়তে না হয় এজন্য মিহি ভাবছে আজ থেকে আর এক বিছানায় শোবে না। এশার আজানের ধ্বনিতে মিহির ভাবনার ছেদ ঘটলো। ছেলেগুলো সেই কখন ছাদ থেকে চলে গেছে অথচ অন্যমনস্ক থাকায় সেসব খেয়াল করেনি মিহি। ওজু করে এশার নামাজ আদায় করে নিলো সে। জায়নামাজে বসে আছে এখনও। মনটা খুব অস্থির লাগছে মিহির। মানুষটা কখনো না থেকেও মিহির মনের গোপনে বাসা বেঁধে বসে আছে। যদিও রুদ্র এখন তার স্বামী কিন্তু সেই মানুষটার কথা কখনো ভুলতে পারবে না মিহি। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে নিজের মনকে শান্ত করার জন্য প্রার্থনা করেছে মেয়েটা। ফোনের রিংটোনের শব্দে জায়নামাজ থেকে উঠে বিছানায় গিয়ে বসলো মিহি। অচেনা নম্বর যদিও কিন্তু এই নম্বর থেকেই একটু আগে টেক্সট এসেছিল। তারমানে রুদ্র কল করেছে নিশ্চিত।
" এই মিহির দানা দরজা খুলো,আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। "
" কলিংবেল বাজালেও তো হতো কলের কী দরকার ছিলো!"
" একা বাড়িতে দরজা কেউ নক করলেই খুলতে নেই। "
" আচ্ছা আসছি।"
মিহি কল কেটে দিয়ে ধীরে ধীরে দোতলা থেকে নিচে বসার ঘরে গেলো। তারপর দরজা খুললো।
" আপনি এলেন কিন্তু চাচা তো আসলেন না?"
রুদ্র বাসায় ভেতরে প্রবেশ করলো, মিহি দরজা আঁটকে রুদ্রর পিছনে পিছনে আবারও রুমে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো ।
" আজ চাচা আসবেন না,চাচীর শরীর হুট করে খারাপ হয়ে গেছে। "
" ও আচ্ছা। রান্না তো করাই আছে, কিছু নাস্তাও আছে। ভাইয়া আর ভাবী একেবারেই খেতে চাচ্ছিলো না জোরাজোরি করে অল্প দিয়েছিলাম। "
" ভালো করেছো। তোমার কোমরের ব্যথার কী খবর? "
" কমেছে। "
বসার ঘর পেরিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে দু'জন। রুদ্র একবার মিহির দিকে তাকিয়ে দেখলো। পরমুহূর্তে মিহিকে পাঁজা কোলা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।
" এই কী করছেন! ছাড়ুন আমাকে, আমি একাই চলে যাচ্ছি। "
" হ্যাঁ বললে তো কমেছে ব্যথা, আমি তো দেখলাম দরজা আঁটকে আগের মতোই খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছিলে।"
" আপনি আসলে যাচ্ছেতাই, এবার নামান ঘরের সামনে তো এসে গেছি। "
রুদ্র সাবধানে মিহিকে কোল থেকে নামালো। মিহি রুমে ঢুকে জানালার পাশে একটা চেয়ারে বসেছে। রুদ্র তোয়ালে আর টি-শার্ট, লুঙ্গি নিয়ে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে ঢুকেছে। কেনো জানি কিচ্ছু ভালো লাগছে না মিহির। কেমন সবকিছু একঘেয়ে লাগছে একদিনেই।
" আনমনে কী ভাবছো এত?"
রুদ্র মাথার চুল মুছতে মুছতে মিহিকে শুধালো। মিহি ভাবলেশহীনভাবে বসেই আছে। কেনো জানি কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না। মিহির নিস্তব্ধতা দেখে রুদ্র পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
" একা একা বোর হয়েছো সারাদিন? "
" হ্যাঁ, আমি এখনো এরকম একা থাকিনি। "
" সেটা বুঝতে পেরেছি। কাল থেকে কলেজে যাবে।"
" কিন্তু ব্যথা!"
" আমি হাই ডোজের ঔষধ নিয়ে এসেছি আর ব্যথা কমানোর জন্য স্প্রে আছে। "
" ঠিক আছে। শুনুন! "
" হ্যাঁ বলো।"
" আজ থেকে আমরা আলাদা ঘুমাবো।"
" আমি সোফায় শুতে পারবোনা এই শীতে, তোমার ইচ্ছে হলে শোবে।"
" আমি ফ্লোরে শোবো, আপনি বিছানায়। "
" ভুলভাল বুঝে লাফিয়ে পড়ে ব্যথা পেলে নিজে আর আমার দোষ! "
" হয়েছে হয়েছে কথা এটাই ফাইনাল। এখন চলুন ডিনার করে নিবো।"
" আসো। "
" আরে আরে কোলে তুলতে হবে না আর।"
কিন্তু মিহির কথায় কর্ণপাত করেনি রুদ্র। কোলে তুলে নিয়ে সোজা ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসালো মিহিকে। এমনিতে মিহি শুকনো, ওজনের বালাই নেই। তার উপর রুদ্র সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ায় মিহিকে কোলে করে হাঁটা কোনো ব্যাপারই না তার জন্য। রাতের খাবারের তালিকায় আজকে আছে পাবদা মাছ ভাজা, মুসুরি ডাল, বাঁধাকপি ভাজা। মিহি খুব খাবারের বিষয় খুঁতখুঁতে স্বভাবের খুব। তাই শুধু মাছ দিয়ে খাওয়া শেষ করলো। রুদ্র অবশ্য ভোজনরসিক মানুষ। সব ধরনের খাবারই তার রোচে।
ঘড়ির কাঁটায় রাত এগোরাটা বেজেছে। কিন্তু এরমধ্যেই গ্রামের সব বাড়ির মানুষ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। চারদিকে শুনশান নীরবতা ছেয়ে আছে। শহুরে জীবনে রাত এগোরাটা সবে সন্ধ্যার মতো মনে হলেও গ্রামে সেটা মধ্যরাতের সমান। ছয় বছর বয়সী মিতু পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে। উত্তর দিকের ঘরে তার বাব-মা শোয়। টিনের দোতলা বাড়ি তাদের, গ্রামে এটাকে মাঁচা বলে। সুমি বিছানায় শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। সবুজ অন্য কাজে ব্যস্ত। সহবাস করার সময় স্ত্রীর কোনো ইচ্ছে আছে কিনা সেটা কখনো ভাবেনি এই লোকটা। কিছুক্ষণ পরে ক্লান্ত শরীরে সুমির শরীরের উপর থেকে নেমে পাশের বালিশে শুয়ে পড়লো সবুজ। সুমি জামাকাপড় ঠিক করে অন্য দিকে ফিরে শুয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছে। একটা মানুষকে ভালোবেসে অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার করার মতো কঠিন কাজটা করতে হয়েছে সুমিকে। কিন্তু যে মানুষকে বিয়ে করেছে সে যে এরকম পশুর মতো হবে ভাবতেও পারেনি সে। প্রায় দিন গায়ে হাত তোলে সবুজ। কখনো কখনো প্রতিবাদ করে সুমি কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়। বাবা-মা তো সন্তানের অমঙ্গল চাননা কখনো কিন্তু মাঝে মধ্যে না চাইতেও সেটা হয়ে যায়। সুমির ভালোবাসার মানুষটাকে তখন তারা মানতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে সবুজের মতো একটা নেশাখোর পশুর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য সবুজের এই খারাপ রূপ তো তারা জানতেন না তখন। এখন আর কিছু করার নেই! একটা মেয়ে আছে তার উপর আবারও গর্ভবতী হয়েছে সুমি। দীর্ঘশ্বাসে জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু দুঃখ ফুরায় না।
" এই সুমি!"
সবুজের ডাকে সাড়া দিলো না সুমি। মানুষটা এত খারাপ যে দ্বিতীয় বার কাছাকাছি আসতেও পারে। সেই ভয়ে সুমি ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে।
" সুমি? আমার তৃষ্ণা পেয়েছে আবারও। "
সুমির কান্না পাচ্ছে খুব। এই শরীরে এসব সহ্য করতে খুব কষ্ট হয় মেয়েটার। কিন্তু সুমি জানে সবুজ আরেকবার মিলিত না হয়ে চুপ হবে না এখন। সবুজ হেঁচকা টানে সুমির শরীরের পোশাক খুলে আবারও পশুর মতো ঝাপিয়ে পড়লো। সুমি শুধু চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছে। অবিবাহিত মেয়ের কেউ ধর্ষণ করলে সমাজে বিচারব্যবস্থা আছে কিন্তু বিয়ের পরেও যে একটা মেয়ে ধর্ষণ হতে পারে কথাটা শুনলেও অধিকাংশ মানুষ হেসে উড়িয়ে দেয়। ইচ্ছের বিরুদ্ধে সহবাস করলে সেটাই যদি ধর্ষণ হয় তবে স্বামীর ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত। সুমির এসব ভাবনা কতটা যুক্তিসঙ্গত জানে না সে।
সকালের ম্লান রোদ্দুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিক্ত হচ্ছেন সালমান খুরশিদ। আজকে শরীরটা বেশ ভালো লাগছে। বারান্দার এক পাশে কিছু পাতাবাহারের গাছ আছে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করলেন মিহির বাবা। এরমধ্যেই রিনা বেগম হাতে চা নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করলেন।
" কী ব্যাপার সকাল সকাল এত ফুরফুরে মেজাজে আছেন?"
" শরীরটা ভালো লাগছে আগের চেয়ে। আর গতকাল রাতে শাহআলম কল দিয়েছিলো।"
রিনা বেগমের হাত থেকে চায়ের কাপ নিজের হাতে নিলেন সালমান খুরশিদ। বারান্দার গ্রিল ধরে অন্য হাতে চায়ে চুমুক দিলেন।
" তা কী বললো তোশার বাবা? তোশার শরীর কেমন? "
" তোশা ঠিক আছে। ওর বিয়ে নিয়ে আলোচনা করলো কিছুক্ষণ। বয়স তো কম হলোনা, পাগলামিও করলো অনেক। এবার সত্যি বিয়ে দিতে চাচ্ছে ওর বাবা-মা। এরমধ্যেই ছেলে ঠিক করে ফেলেছে তবুও ছেলের বিষয় আরকটু খোঁজ খবর নিতে বললো আমাকে। "
" বাহ ভালোই হবে তাহলে। আপনি বরং আদ্রিয়ানকে ছেলের বয়ো ডাটা বলে দিন ও গিয়ে সব জেনেশুনে আসবে। "
" হ্যাঁ তাই করবো। বুঝলে রিনা,এবার আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত। তোশার থেকে মুক্তি পাবে আদ্রিয়ান আর মিহিরও ভালো ঘর মিলেছে। "
" ঠিক বলেছেন। সন্তানের জীবনে আনন্দ দেখে গেলে বাবামায়ের মরেও শান্তি। "
" আজকে মিহি আর রুদ্রর আসার কথা না? যদিও রুদ্র একা এসে দেখা দিয়ে যাওয়ার নিয়ম কিন্তু রুদ্র বললো মিহিকেও নিয়ে আসবে।"
" হ্যাঁ এজন্যই তো সকাল সকাল আপনার ছেলেকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়েছি। রাহি বাড়িঘর সুন্দর করে পরিপাটি করে রেখেছে কালকেই। "
চলবে.............................