আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে গল্প সম্বন্ধে আপনার মতামত অবশ্যই প্রকাশ করবেন। আপনাদের মতামত আমাদের এই ছোট প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। শীঘ্রই আরও নিত্য নতুন গল্প আপডেট আসছে, সঙ্গে থাকুন। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখক/লেখিকা'র নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত গল্পের ডায়েরি’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখক/লেখিকা'র কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় গল্পের ডায়েরি কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

অন্তর্নিহিত কালকূট - পর্ব ৫৫ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


অন্তর্নিহিত কালকূট
পর্ব ৫৫
অনিমা কোতয়াল
.
.
.
সেদিন উচ্ছ্বাসের পা দুটো জড়িয়ে সমানে কঁদছিলছ নাজিফা। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে যায় বেচারীর। উচ্ছ্বাস অসহায়, অপারগ হয়ে দেখে যায় তার প্রেয়সীকে। যাকে সবসময় বুকে রাখতে চেয়েছিল; সেই মেয়েটা ওর পায়ে পড়ে এভাবে আকুতি-মিনতি করছে! সে দৃশ্য যে উচ্ছ্বাসের কল্পনারও অতীত ছিল। যেই মেয়েটার আত্মসম্মানে এতো ধার, তার একি অবস্থা করে দিয়েছে ও! কথাগুলো ভাবতে গিয়ে সবকিছু গুলিয়ে ওঠে উচ্ছ্বাসের। নিজের প্রতি রাগ, ঘৃণা দুটোই ভীষণভাবে অনুভব হয় ওর!
উচ্ছ্বাস লম্বা এক শ্বাস টানে। জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নেয় শুকনো ঠোঁটজোড়া। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে অনেকেই দেখছে ওদেরকে। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে। নাজিফাকে দু হাতে জোর করে টেনে তোলে উচ্ছ্বাস। একটা বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়ে। নাজিফার দু হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে, 'এমন কেনো করছো? তিনদিন পর তোমার বিয়ে। আশেপাশে চেনা কোন লোক দেখতে পেলে কী হবে বুঝতে পারছো? তোমার বাবার সম্মানের কথাটা ভাবো।'

নাজিফা অবুঝ বাচ্চার মতো বলে ওঠে, 'আমি পারছিনা উচ্ছ্বাস। আমি আজ আর অন্যকিচ্ছু ভাবতে পারছিনা। আমার অস্তিত্বে মিশে গেছো তুমি। তোমাকে ছাড়া আমি শেষ হয়ে যাবগো। প্লিজ আমাকে এভাবে শেষ করে দিওনা।'

উচ্ছ্বাস করুণ চোখে তাকায় নাজিফার দিকে। চারপাশ থেকে একবার ঘুরে আসে ওর অসহায়তা দৃষ্টি। হতাশ, নিস্তেজ গলায় বলে, 'প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। তুমি যা চাইছো আমি তোমাকে তা দিতে পারব না।'

'কেন উচ্ছ্বাস? কেন পারবেনা বলো? ভালোবেসেতো মানুষ নিজের প্রাণও দিতে পারে। সেখানে তুমি একটা দল ছাড়তে পারবেনা? তারমানে কী তুমি কখনও আমাকে ভালোই বাসোনি? সবটাই মিথ্যে ছিল?'

উচ্ছ্বাস আস্তে করে ছেড়ে দেয় নাজিফার হাত। চোখ সরিয়ে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। চোখজোড়া মারাত্মক জ্বালা করে ওঠে ওর। বুকে তীব্র ব্যথা শুরু হয়। প্রাণবায়ু টানতে সংঘর্ষ করতে থাকে ফুসফুস। নাজিফা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাসের দিকে। পলকটাও ফেলছেনা। কিছুক্ষণের নীরবতার পর উচ্ছ্বাস বলতে শুরু করে, 'ছোটবেলা থেকেই আমি জানতাম না আমার পরিচয় কী। আমার বাবা-মা কে। বংশ কী। কোথা থেকে এসেছি। কিছুই না। যেদিন থেকে জ্ঞান হয়েছে, যতটুকু মনে পড়ে রেললাইনের ধারে ভিক্ষা করে, লোকের কাছে খাবার চেয়ে বেঁচে ছিলাম আমি। ওভাবে যেদিন টাকা পেতাম না, সেদিন পেটের দায়ে চুরি, পকেটমারিও করতাম। তখন দশ বছর হবে আমার। অনেকক্ষণ যাবত না খেয়ে ছিলাম। টাকাও ছিলোনা সেদিন। তাই চুরি করব ভাবলাম। চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম ইকবাল ভাইয়ের কাছে। উনি পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখালে কোনমতে হাতে, পায়ে ধরে মাফ চাইলাম। সেটা দেখে বোধ হয় দয়া হয়েছিল ওনার। তাই বলল, উনি কাজ দিতে পারেন আমায়। যদি আমি কোনরকম শয়তানী না করে; ভালোভাবে কাজগুলো করি তাবেই। আমি রাজি হয়ে গেলাম। কারণ আধপেটা অবস্থায় লোকের মার খেয়ে রেললাইনের ধারে পরে থাকার চেয়ে ভালো ছিল সেই কাজ। সেদিনের পর থেকে আমের ফাউন্ডেশনে চা দেওয়া, ঘর পরিষ্কার রাখা সব আমিই করতাম। বদলে তিনবেলা পেটপুড়ে খেতে পেতাম। ভালোই লাগছিল।'

'তারপর?' নাজিফার কন্ঠে ন--গ্ন কৌতূহল।

' তিনদিনের দিনই রাশেদ বাবার নজরে পড়ে গেলাম আমি। একদিন ডেকে আমাকে। আমার সম্পর্কে সবকিছু জিজ্ঞেস করল। আমিও ভয়ে ভয়ে সব বললাম। ঘাবড়ে ছিলাম। যদি ঘাড় ধরে বার করে দেয়? আবার সেই রেলস্টেশনে পরে থাকতে হবে। লোকের মার খেতে হবে। ক্ষিদের জ্বালায় ছটফট করতে হবে। সেদিন কিছু না বললেও দুদিন পর আবার ডেকে পাঠালেন রাশেদ বাবা। কড়া গলায় জানালেন, এখন থেকে আমের ফাউন্ডেশনে না ওনার বাড়িতে কাজ করতে হবে আমাকে। আমার না করার উপায় বা কারণ ছিলোনা। থাকার জায়গা আর খাবার পেলেই হলো। সেদিন প্রথম পা রাখলাম আমের ভিলায়। স্পষ্ট মনে আছে জানো, হা করে তাকিয়ে ছিলাম আমি। অমন রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে থাকতে পারব ভেবে মনে মনে বেশ খুশিই হলাম সেদিন। বিকেলবেলা বাড়িটা দেখতে দেখতে হঠাৎ ছাদে গিয়ে পৌঁছলাম। আর দেখলাম এক অবাক করা দৃশ্য। প্রায় আমার বয়সী এক ছেলে। বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে। সারা শরীরে মারের দাগ। ছেলেটা ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। দেখে মায়া হলো আমার। এগিয়ে গেলাম সাহায্য করতে। আমি গিয়ে বাঁধন খুলতে নিলেই ছেলেটা ক্ষেপে উঠল। বাঘের মতো তাকাল আমার দিকে। ধমকে বলে ওঠল, "এই! তোকে বলেছি খুলতে? আমি নিজেই নিজেকে ছাড়াতে জানি।" আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছিল ছেলেটা। কিন্তু মুক্তির আনন্দ ছিলোনা ওর চোখে-মুখে। যেন এসব দুধভাত। ছেলেটা চোখভর্তি বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গিয়েছিল ওখান থেকে। আমি ভীষণ অবাক হলেও পরে আর সেসব নিয়ে ভাবিনি। পরে জেনেছিলাম ছেলেটার নাম রুদ্র। ও রাশেদ বাবারই ছেলে। বিস্মিত ছিলাম, নিজের ছেলেকে এভাবে মারধর করে বেঁধে রাখে কেউ? ভয়টা বাড়ছিল। নিজের ছেলের সঙ্গেই যে এমন করতে পারে, না জানি আমার সঙ্গে কী কী করবে। এরপর ধীরে ধীরে জ্যোতির সাথেও কথা হলো। ভাব হলো। কুহু তখন প্রায় তিন বছরের বাচ্চা। তবে অবাক করা বিষয় হলো দুদিন পাড় হয়ে গেলেও কোন কাজ করার সুযোগ পেলাম না আমি। সবই বাকি সার্ভেন্টরা করে রাখতো। আমায় কিছুই করতে হতোনা। বাড়ির ওপরের তলায় ভালো একটা কামড়ায় থাকতে দেওয়া হল আমাকে। আয আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম আমার কাজটা কী! এরপর একদিন রাশেদ বাবা একটা পোশাক আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, তৈরী হয়ে নিতে। আমি চুপচাপ তৈরী হলাম। জাফর কাকা আর রুদ্রর সঙ্গে বের হতে হলো সেদিন আমায়। আমি তখনও জানিনা কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু পরে জানতে গিয়ে পারি আমাকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে এসেছে তারা। বিশ্বাস করো নাজিফা, আমার মনে হচ্ছিলো আমি স্বপ্ন দেখছি। কোন সুখকর স্বপ্ন। এমনটাও লেখা ছিল আমার ভাগ্যে! আর তারপর থেকে বাকিসব স্বপ্ন-ই লাগতো। একদম ঐ বাড়ির ছেলের মতোই যত্ন, ভালোবাসা পাচ্ছিলাম আমি। রুদ্রর জন্যে যা বরাদ্দ ছিল, আমার জন্যেও তাই ছিল। আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেতাম। অবিশ্বাসে স্তব্ধ হয়ে যেতাম। কিন্তু কিছু বলার ভাষা পেতাম না। জানো? আমার উচ্ছ্বাস নামটা রাশেদ বাবারই দেওয়া। আগে সবাইতো টোকাই বলে ডাকতো। প্রথম দিকে রুদ্রর ব্যবহার আমার প্রতি সহজ-স্বাভাবিক ছিলোনা। যদিও কখনও খারাপ ব্যবহার করতো না, আবার যেচে কথাও বলতো না। আমি বলতে গেলে বিরক্ত হতো। সবসময় কেমন গম্ভীর হয়ে থাকতো। তবে কোনদিন হিংসেও করতো না ওর সমান সবকিছু পাচ্ছি বলে। অদ্ভুত ছিল ছেলেটা। যদিও এখনো অদ্ভুতই। কীভাবে যে ওর সঙ্গে বন্ডিংটা হয়ে গেল। নিজেও এখন বুঝতে পারিনা এখন। আর এই আঠারো বছর পরেও আমি এখনো সেভাবেই সেই বাড়িতে আছি। বাড়ির ছেলে হয়ে। বিশ্বাস হয় নাজিফা? একটা রাস্তার ছেলেকে কেউ এভাবে ঘরের ছেলে বানিয়ে দিচ্ছে?'

নাজিফা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। চোখের দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল গালে শুকিয়ে গেছে ততক্ষণে। উচ্ছ্বাস তখন নাজিফার দিকে তাকিয়ে বলে, 'এবার তুমিই বলো। আমি তাদেরকে কীকরে ছেড়ে দেই যারা আমায় কখনও ছাড়েনি। রেলস্টেশনে পড়ে পড়ে মা-র খাওয়া একটা ছেলেকে নিজেদের ঘরে জায়গা দিয়েছে। বড় করেছে। আমার সব প্রয়োজন মিটিয়েছে। আর বর্তমানে দলের অবস্থা খুববেশি ভালো না নাজিফা। আমাকে ভীষণ প্রয়োজন ওদের। আর এই অবস্থায় নিজের সুখের জন্যে, নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্যে আমি ওদের ছেড়ে দেব? রাশেদ বাবাকে ছেড়ে দেব? এতোটা স্বার্থপর কীকরে হই বলোতো? তুমি যদি এইমুহূর্তে আমার কাছ থেকে আমার প্রাণটাও চেয়ে নাও, আমি হাসিমুখে দিয়ে দেব নাজিফা। কিন্তু সোলার সিস্টেম ছাড়তে পারব না। তারমানে এই না যে আমি তোমাকে ভালোবাসিনা। বাসি নাজিফা। প্রচন্ড ভালোবাসি। তুমি আমার প্রাণ। কিন্তু ঐ মানুষগুলো আমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়। তাই জেনে রাখো আজ আমি তোমাকে না, আমার প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছি।'

নাজিফা কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। এরপর কী বলা যায়?এইসব শোনার পরেও ও কীকরে বলবে উচ্ছ্বাসকে যে সব ছেড়ে চলে এসো? বললেও বা উচ্ছ্বাস শুনবে কেন? নাজিফা অসহায় বোধ করে সবকিছুই কেমন এলোমেলো মনে হয় ওর কাছে। পাখল পাগল লাগে নিজেকে। উচ্ছ্বাসের দুহাত ধরে অস্থির গলায় বলল, 'কিন্তু আমার কী হবে উচ্ছ্বাস? আমি কীভাবে থাকব তোমাকে ছেড়ে? তোমাকে ভুলে অন্যকারো সঙ্গে কীকরে জীবন সাজাবো? এটা সম্ভব না। কিছুতেই না।'

উচ্ছ্বাস নাজিফার চোখের দিকে তাকায়। মলিন হেসে বলে, 'সব সম্ভব নাজিফা। পৃথিবীতে কজন আছে বলোতো যারা নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে করতে পারে? তাদের সাথে জীবন কাটাতে পারে? কিন্তু তারাতো কেউ মরে যায়না তাইনা? মানিয়ে নেয়। আমরাও মানিয়ে নেব।'

নাজিফা আবার কেঁদে ফেলে। অস্থির হয়ে ওঠে। ছটফট করতে করতে বলে, 'না, না। আমার দ্বারা হবেনা। আমি পারব না। কিছু একটা করো প্লিজ। কিছু একটা করো।'

উচ্ছ্বাস নাজিফাকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। বুকে ভারী পাথর চেপে বলে, 'কিছু করার নেই নাজিফা।'

নাজিফার কান্নার গতি বেড়ে। হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে মেয়েটা। উঠে দাঁড়িয়ে চেপে ধরে উচ্ছ্বাসের কলার। দুঃখ, যন্ত্রণা, রাগ, অভিমানে হিশহিশিয়ে বলে, 'আগে কেন নিজের সত্যিটা বললে না? শুরুতেই কেন সবটা শেষ করে দিলেনা? নিজের সাথে আমাকে জড়িয়ে; আমার শরীর, মন, আত্মার সঙ্গে এভাবে মিশে যাওয়ার পরেই কেন বললে? আমাকে এভাবে কেন শেষ করে দিলে? কেন? কোন পাপের শাস্তি দিলে আমাকে উচ্ছ্বাস? বলোনা? কোন পাপের শাস্তি দিলে?'

উচ্ছ্বাসের প্রচন্ড কান্না পায়। মনে হয় যেন কেউ ওর গলা চেপে ধরেছে। শ্বাসনালী রোধ করে দিয়েছে। উচ্ছ্বাস নাজিফার সামনে হাত জোর করে। আহত, পরাজিত কন্ঠে কোনমতে বলে, 'আমাকে ক্ষমা করে দাও।'

কথাটা বলে কেমন ফুঁপিয়ে উঠে উচ্ছ্বাস। নাজিফা উচ্ছ্বাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলকে। অস্ফুট স্বরে বলল, 'ঘন্টার পর ঘন্টা হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে কার জন্যে অপেক্ষা করবে?'

'জানিনা।' মাথা নুইয়ে আস্তে করে বলে উচ্ছ্বাস।

'এই পার্কে এসে, মাথা রেখে শোয়ার জন্যে নতুন কোন কোল খুঁজে নেবে বুঝি?'

'চুপ করো।'

'রাতের পর রাত যখন তোমার ফোনে কল আসবে না। আমার গলায় স্বর শুনতে পাবেনা। আমার বকা শুনতে পাবেনা। তখন কী করবে? ঘুম আসবে তোমার?'

'থামো নাজিফা।'

'ঐ চায়ের দোকানটায় চা খেতে বসলে আমার কথা মনে পড়বেনা তোমার?'

'নাজিফা প্লিজ।'

কোনকিছুকে পরোনা না করে হুট করেই উচ্ছ্বাসকে জড়িয়ে ধরে নাজিফা। উচ্ছ্বাস বাঁধা দিতে গিয়েও দেয়না। হয়তো এটাই শেষ। এরপর এই মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরার অধিকার থাকবেনা ওর। সে অধিকার থাকবে অন্য এক পুরুষের। কথাগুলো ভাবতেই ভেতরসহ কেঁপে ওঠে উচ্ছ্বাসের। নিজের অজান্তেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাজিফাকে। পারলে নিজের মধ্যে মিশিয়ে ফেলতো মেয়েটাকে। তখন বাস্তবতা, ভাগ্য, আদর্শ নামক কোন দেয়াল থাকতোনা ওদের মধ্যে। কেউ আলাদা করতে পারতোনা আমাদের, কেউনা।

দুজনেই নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। একে অপরের অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে ওদের শরীর । নাজিফা‍ অস্ফুট স্বরে বলল, 'আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উচ্ছ্বাস। আমি মরে যাব।'

উচ্ছ্বাস নিজের বুক থেকে সরায় নাজিফাকে। আলতো হাত রাখে ওর দুগালে। সযত্নে কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলে, 'আমার প্রাণ তুমি নাজিফা। আমাকে মেরে ফেলার অধিকার নেই তোমার। আমার জীবনটাই হারানোর গল্প গিয়ে পূর্ণ। সেই সব অপূর্ণতার একমাত্র পূর্ণতা তুমি। হয়তো আমাদের সংসার করা হলোনা। হয়তো একে অপরের শরীরে মিশে থেকে বুড়ো হওয়া হলোনা। হয়তো তোমাকে নিজের সন্তানের মা বানানো হলোনা। কিন্তু পৃথিবীর কোন বাস্তবতা আমাদের ভালোবাসাকে মিথ্যে করতে পারবেনা নাজিফা। তোমাকে সুখী দেখলেই সুখী হব আমি। এই সুখটুকু আমার কাছ থেকে কেড়ে নিওনা প্লিজ। বাড়ি যাও। নতুন জীবন, নতুন দায়িত্ব, নতুন মানুষের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করো।'

কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত নাজিফা। কোনমতে টেনে টেনে বলে, 'পারবোনা আমি।'

উচ্ছ্বাস অস্থির হয়ে ওঠে। তবুও যথাসম্ভব স্থিরতা বজায় রেখে বলে, 'পারবে। আমার ঝাঁসির রাণী সব পারে। তোমার সুন্দর একটা সংসার হবে। ভালো একটা বর হবে। ছোট ছোট রসগোল্লার মতো মিষ্টি বাচ্চা হবে। জীবনের প্রত্যেকটা ধাপ পাড় করে বুড়ো হয়ে তবেই মরবে তুমি। এর আগে না বুঝলে?'

' আর তোমার কী হবে?' করুণ স্বরে জানতে চায় নাজিফা।

উচ্ছ্বাস ছলছল চোখে হেসে ফেলে, ' ঐযে বললাম, তুমি আমার প্রাণ। তোমার পরিপূর্ণ জীবন দেখে আমি পূর্ণ হব। তোমার সুখ দেখেই আমি সুখী হব। চিন্তা করোনা। তুমি অন্যের ঘরোনী হচ্ছো তাতে কী হয়েছে? শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি কেবল তোমারই থাকব।'

নাজিফা ডুকরে কেঁদে উঠল। এক পা এক পা করে পেছাতে পেছাতে বলল, 'আমি তোমাকে ক্ষমা করবোনা উচ্ছ্বাস। কোনদিন ক্ষমা করব না। কোনদিন না।'

উল্টো ঘুরে প্রায় দৌড়ে চলে গেল নাজিফা। যতদূর নাজিফাকে দেখা গেল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল উচ্ছ্বাস। পলক ফেলেনি। নাজিফা চোখের আড়াল হতেই উচ্ছ্বাসের চোখ দিয়ে জ্বল গড়িয়ে পড়ে। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ভেঙ্গে আসে ওর অজান্তেই। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে তাকায় মুক্ত আকাশের দিকে। ব্যস্ত হাতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজে বের করে। কিন্তু প্যাকেটটা খুলে নিরাশ হয় ও। একটা সিগারেটও নেই। ফাঁকা। ঠিক ওর জীবনের মতোই। তিক্ততা আর বিতৃষ্ণায় প্যাকেটটা ছুড়ে ফেলে দেয় উচ্ছ্বাস। সামনে পড়ে থাকা একটা ইটে জোরে লাথি মারে। পায়ে ভীষণ জোরে লেগে যায়। চোখ দিয়ে আবার জল বেরিয়ে যায় উচ্ছ্বাসের। পায়ের ব্যথায় নাকি মনের ব্যথায়, কে জানে?

সেটাই ছিল উচ্ছ্বাসের সঙ্গে নাজিফার শেষ আলাপ। তার ঠিক তিনদিন পর নাজিফার বিয়ে হয়ে গেল। নিমন্ত্রন রক্ষা করতে কেবল রাশেদ আর জাফর গিয়েছিলেন। রুদ্র বা উচ্ছ্বাস কেউ যায়নি। তবে নাজিফার বাড়ির আশেপাশেই ছিল উচ্ছ্বাস। সবার অলক্ষ্যে। আড়ালে। শেষবারের মতো নাজিফাকে একটাবার দেখার লোভ সামলাতে পারেনি ও। যাকে নিজের বউ বানানোর স্বপ্ন দেখেছিল, তাকে অন্যের বউয়ের সাজে কেমন লাগে জানতে চায় ও। নাজিফার বিদায়ের সময় সেই দেখা পায় উচ্ছ্বাস। দূর থেকে দেখছিল নাজিফাকে। লাল শাড়ি পড়ে, বধু বেশে। নিজের প্রিয়তমাকে নববধূর সাজে দেখার দীর্ঘ এগারো মাসের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল সেদিন। কিন্তু আফসোস, সেই সাজ অন্যকারো জন্যে ছিল। নাজিফাকে বধূ বেশে অপূর্ব লাগছিল উচ্ছ্বাসের। কিন্তু মুখটা ছিল প্রাণহীন। বিদায়ের সময়টাতেও একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি মেয়েটা।
নাজিফার পাশে ওর বরকে দেখে বুকের ভেতরে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল উচ্ছ্বাসের। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো। চোখ দিয়ে অজান্তেই অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছিল অনবরত। কিন্তু যখন দেখল নাজিফার বর ওকে পরম যত্নে গাড়িতে তুলছে। ঝুঁকে শাড়ির আঁচল গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। মূল্যবান কোপ রত্নের মতো আগলে রাখছে নিজের নববধূকে। তখন চোখে জল থাকলেও মুখ‍ে হাসি ফুটেছিল উচ্ছ্বাসের। আনমনেই বলেছিল, 'সুখী হও।'

তারপর থেকে উচ্ছ্বাসের জীবনের মোড় বদলে যায়। কিন্তু সেই বদল বাইরে থেকে কারো চোখে পড়েনা। সকলের সামনে হাসি-খুশিতে মাতিয়ে রাখা, দলের কাজকর্ম পূর্ণ সমর্পনের সাথে করে যাওয়ার, এসবের আড়ালে চাপা পড়ে যেত ওর একেকটা নির্ঘুম রাত। একের পর এক শেষ করা সিগারেটের প্যাকেট। পেটে অতিরিক্ত মাত্রায় পড়তে থাকা অ‍্যালকোহল। এ সবকিছু রুদ্রর নজর এড়াতো না। বাকিরাও বুঝতো, ছেলেটা ভেতরে ভেতরে জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কারো কিছু করার ছিলোনা। সকলেই ছিল নিরুপায়। সময়ের নিয়মে একটা বছর পাড় হয়ে যায়। এখন সবকিছুই স্বাভাবিক। কিন্তু সব স্বাভাবিকতার মধ্যেও কোথাও একটা প্রচ্ছন্ন অস্বাভাবিকতা রয়েই গেছে। কোথাও একটা চাপা পড়ে আছে নির্ঘুম রাতের একেকটা দীর্ঘশ্বাস।

-

রাত একটা বেজে বিশ। আকাশটা তখন মেঘলা। মাঝেমাঝে মেঘ মৃদু আওয়াজে ডেকে উঠছে। হঠাৎ হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে সব ঠান্ডা করে দিয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া যেন চিৎকার করে বলছে, শীত আসছে। নিজ ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আজ সন্ধ্যায় আবার মিটিং বসেছিল বৈঠক ঘরে। দুই মাসের মধ্যে মাল আসছে। দ্রুত ডেলিভারী হবে। আসল গন্ডোগোলটা ঠিক কোথায় হচ্ছে ধরার জন্যে একটা পরিকল্পনা করে রেখেছে ও। এখন শুধু সে অনুযায়ী কাজ হওয়ার অপেক্ষা। ঠিকঠাক কাজটা করতে পারলেই অনেককিছুই বোঝা যাবে।

কিছুক্ষণ কেটে যা প্রিয়তা এলো বারান্দায়। দু হাতে দুটো কফির মগ। প্রিয়তাকে দেখে সিগারেটে লম্বা করে একটা টান দিল রুদ্র। তারপর অ‍্যাশট্রেতে গুজে রাখল সেটা। হাত বাড়িয়ে নিল কফির মগটা। প্রিয়তাও রুদ্রর পাশে দাঁড়াল। দুজনে কারোরই ঘুম আসছেনা তাই ঠিক করেছে রাত জেগে গল্প করবে। কাল সবাই বাড়িতেই থাকছে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার কোন ব্যাপার নেই। রুদ্র কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে উঠল, 'একটা জিনিস খেয়াল করেছি।'

' সেটা কী?'

' তুমি কখনও আমাকে সিগারেট ছাড়তে বলোনি। সাধারণত বউরা যেভাবে ফোর্স করে। তুমি করোনি। বিশেষ কোন কারণ?'

প্রিয়তা বলল, 'বললে শুনতেন?'

রুদ্র জবাব দিলোনা। প্রিয়তা হাসল। নিজেও কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, 'আপনিই তো বলেছিলেন জীবনটা সিনেমা নয়। সেইজন্যেই তো আপনাকে এরকম জীবন থেকে ফেরানোর চেষ্টা করিনি আমি। কারণ আপনি শুনবেন না। অপরদিকে আপনাকেও ছাড়তে পারিনি। নাজিফার মতো ভালোবাসাকে ত্যাগ করে, আদর্শকে আকড়ে ধরতে পারিনি আমি। কারণ নাজিফার সবাই আছে। বাবা, মা, ভাই। কিন্তু আমার আপনি ছাড়া আর কে আছে বলুন? একজন বন্ধু ছিল। মীরা। সেও_'

কথাটা বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো প্রিয়তার। ওদের বিয়ের ছ'মাসের মাথাতেই মীরার মৃত্যুর খবর পায় ওরা। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সবাই বলছে সুই-সাইড করেছে। কিন্তু সুই-সাইডের আসল কারণটা আজ ও অজানা। পুলিশ কেইস হয়েছে, তদন্ত হয়েছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। রুদ্র একহাতে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। কিছু বলল না। মীরার মৃত্যুর ধাক্কাটা সামলে নিতে এক সপ্তাহ লেগেছিল প্রিয়তার। তাই এ বিষয়ে কথা বাড়াতে চাইল না ও। প্রসঙ্গ বদলে বলল, 'তোমার আকাশ এতো পছন্দ কেন?'

প্রিয়তা লম্বা শ্বাস নিয়ে তাকাল আকাশের দিকে। মুচকি হেসে বলল, 'জানিনা। কিন্তু ভালোলাগে। আকাশকে রঙ বদলাতে দেখে ভালো লাগে। অন্ধকারে হাজার তারায় ভরা আকাশটা দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। পূর্ণিমার গোল চাঁদটা দেখলে মনে হয় যেন আমার সাথে কথা বলছে সে। ধূসর মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখলে মনটা কেমন করে ওঠে। মনে হয় তার খুব কষ্ট। তবে আকাশের একটা রূপ আমার এখনো দেখা হলোনা। ধুমকেতু! আরও কতবছর অপেক্ষা করতে হবে সেটা দেখার জন্যে।'

রুদ্র হেসে বলল, '২০৬১ সাল। অলমোস্ট আরও চল্লিশ বছর।'

'ততদিন বেঁচে থাকবতো আমরা?'

'জানিনা। তবে যদি বেঁচেও থাকি তো বুড়োবুড়ি হয়ে যাবো। হাই পাওয়ারের চশমাও লাগতে পারে দেখার জন্যে। সঙ্গে থাকবে আমাদের রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যা!'

প্রিয়তা হেসে ফেলল। রুদ্র বলল, 'কিন্তু তোমার মাথায় এই ধুমকেতু দেখার ভুত কীভাবে চাপল বলোতো?' 

'কী-জানি? ছোটবেলায় প্রথম যখন বইতে এই সম্পর্কে পড়েছিলাম। তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল ধুমকেতু দেখব। ইচ্ছেটা কবে যে এতো সিরিয়াস হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি।'

রুদ্র প্রিয়তাকে টেনে নিল নিজের কাছে। কপালে চুমু খেয়ে বলল, 'একদিন আমরা দুজনে একসঙ্গে আকাশে ধুমকেতু দেখব, প্রিয়।'

কথা বলতে বলতে দুজনেই খেয়াল করল জিপ নিয়ে গ্যারেজের দিকে যাচ্ছে উচ্ছ্বাস। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে আস্তে আস্তে ভেতরে চলে এলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নেশায় টলছে উচ্ছ্বাস। রুদ্র ঘড়ি দেখল। দুটো বাজতে চলেছে। ফোঁস একটা শ্বাস ফেলল রুদ্র। প্রিয়তা বলল, 'রাশেদ বাবাকে বলে ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করলে হয় না? হয়তো তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।'

রুদ্র হতাশ স্বরে বলল, 'ও রাজি হবেনা। নাজিফার জায়গাটা ও কোনদিন কাউকে দিতে পারবে বলে মনে হয়না। এতো তাড়াতাড়ি তো না-ই।'

-

পরেরদিন সকালে আমের ভিলার সকলেই খুব আস্তেধীরে ঘুম থেকে উঠল। কারো কোন কাজ নেই। ঘুম থেকে ওঠার পরেও যেন অলসতায় বেঁধে রেখেছে সবাইকে। রুদ্র আর উচ্ছ্বাস সোফায় হেলান দিয়ে বসে বসে ফোন দেখছে। মাঝেমাঝে লম্বা হাই তুলছে। কুহু নিচে ফ্লোরে বসে ল্যাপটপে ভিডিও দেখছে। রাশেদ আর জাফর আছেন নিজেদের বৈঠক ঘরে। প্রিয়তা আর জ্যোতি ধীরেসুস্থে রান্না করছে। তারকারি নাড়তে নাড়তে করতে করতে জ্যোতি বলল, 'কতদিন পরপর বাড়ির এমন দৃশ্য চোখে পড়ে বলোতো? বাড়ির অতি ব্যস্ত মানুষজন সব ল্যাদ খেয়ে পড়ে আছে।'

প্রিয়তা পরোটা বেলতে বেলতে হাসল। বলল, 'যা বলেছো! সবগুলোর অবস্থা দেখো। বিশেষ করে ঐযে বাড়ির দুজন ইয়াং ম্যান। টিশার্ট আর শর্টস্ এ কেমন লাগছে! আর চুল তো নয় যেন কাকের বাসা।'

দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠল। নার্গিস বেগম একা একাই মুখ বাঁকালেন। এতো ন্যাকামি অসহ্য লাগে তার। জ্যোতি বলল, 'একটা জিনিস কী জানো প্রিয়তা, তুমি বাড়ির সবাইকে এতো অল্প সময়ে আপন করে নেবে আমি ভাবতেও পারিনি। এটা মানতে বাধ্য যে, আজকাল তোমার মতো মেয়ে দেখা যায়না। তুমি সত্যিই খুব ভালো।'

প্রিয়তা মুচকি হাসল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে পরোটা তাওয়ায় দিয়ে বলল, 'এটা তোমার মনে হচ্ছে আপু। মাটিতে হাঁটার সময় পথে যে খড়কুটোকে আমরা পা দিয়ে ঠেলে দেই, পানিতে ভেসে যাওয়ার সময় সেই সামান্য খড়কুটোকেই আকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করি। কারণ তখন সেটা আমাদের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। সেটাকে খড়কুটোর প্রতি ভালোবাসা না, প্রয়োজনের প্রতি ভালোবাসা বলে। আমার নিজের কে আছে বলো? এতো সুন্দর একটা পরিবার পেয়েছি। পায়ে ঠেলার মতো বোকামি করব কেন? তোমাদের সবাইতো আমার খুব প্রয়োজন। এতে আমার কোন ভালোমানুষী প্রকাশ পাচ্ছেনা। প্রয়োজন প্রকাশ পাচ্ছে।'

জ্যোতি হেসে বলল, 'আচ্ছা হয়েছে। কথায় পারব না তোমার সাথে।'

সকলে একসঙ্গে সকালের খাওয়ার পর রাশেদ আর জাফর আবার চলে গেলেন নিজেদের ঘরে। তাদের কফি তাদের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আর ওরা বসার ঘরে একসঙ্গে কফি খেতে খেতে গল্প করতে বসল। তখন কুহুর ল্যাপটপে ভিডিও কল করল নীরব। সকলের সঙ্গে কথা বলবে তাই। ভিডিও কলে অনেকক্ষণ হাসি-মজা হলো। উচ্ছ্বাস নানারকমভাবে নীরবকে খোঁচা মারল। তবে রুদ্রর সঙ্গে কেবল সালাম দেওয়া নেওয়া টুকুই হলো। এর বেশি কিছু না। নীরব মাস দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসছে সেটাও জানালো সবাইকে। কল কাটার পর প্রিয়তা রুদ্রকে বলল, 'আজ বিকেলে সবাই মিলে শপিং করতে যাব। কতদিন যাইনা। এইযে স্যার? আপনাকেও যেতে হবে কিন্তু।'

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, 'আমি গিয়ে কী করব? গার্ডস যাবে। ওদের পাঠিয়ে দেব।'

' আজব! গার্ডস যাবে বলে আপনি যাবেন না? কেমন পুরুষমানুষ আপনি? বাড়ির মেয়েদের এভাবে অসহায়, অবলা_'

প্রিয়তা আর কিছু বলার আগেই রুদ্র হাত জোড় করে বলল, 'ব্যাস! আমি যাচ্ছি। হ্যাপি? কখন যেতে হবে সময়টাষবলে দিও।'

সবাই একেওপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসল। উচ্ছ্বাস একটু এগিয়ে এসে বসল রুদ্রর কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, 'একটা বউ পেয়েছিস বটে। বাঁধিয়ে রাখার মতো।'

রুদ্র উচ্ছ্বাসের বলার ভঙ্গি নকল করে বলল, 'এতেই প্রমাণ হয়, শকুনের অভিশাপে গরু মরেনা।'

উচ্ছ্বাস দেঁতো হাসল। একটু চুপ থেকে বলল, ' কথা ঠিক। তাইতো আমার দেওয়া অভিশাপগুলো আমার গায়ে এসেই লাগল।'

রুদ্র একপলক উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। এই ছেলেটাকে সামলানোর কিংবা সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা ওর জানা নেই। আছে কেবল সহানুভূতি আর দীর্ঘশ্বাস।
.
.
.
চলবে..........................
Author, Publisher & Developer

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উফ!
মনে হচ্ছে আপনার ইন্টারনেট সংযোগে কিছু সমস্যা আছে। অনুগ্রহ করে আগে আপনার ইন্টারনেটের সংযোগ ঠিক করুন এবং তারপর আবার ব্রাউজিং শুরু করুন৷
AdBlock সনাক্ত করা হয়েছে!
আমরা শনাক্ত করেছি যে আপনি আপনার ব্রাউজারে অ্যাডব্লকিং প্লাগইন ব্যবহার করছেন৷ আমরা আপনাকে আপনার অ্যাডব্লকিং প্লাগইন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি, কারন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরা যে রাজস্ব আয় করি তা এই ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়।