#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৬
" হ্যাঁ এজন্যই তো সকাল সকাল আপনার ছেলেকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়েছি। রাহি বাড়িঘর সুন্দর করে পরিপাটি করে রেখেছে কালকেই। "
" বুঝলে রিনা আমাদের সৌভাগ্য এই যুগে রাহির মতো একটা ছেলের বউ পেয়েছি। "
" হ্যাঁ নিসন্দেহে ঠিক বলেছেন। আপনি চা শেষ করে ঘরে রেখে দিন, আমি রাহির সাথে কিছু আলোচনা করবো।"
" ঠিক আছে। "
সালমান খুরশিদ আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গাছগুলোর সাথে সময় কাটাচ্ছেন। রিনা বেগম সরাসরি রান্নাঘরে রাহির কাছে এসেছে। আদ্রিয়ান সবে বাজার থেকে ফিরলো। রাহি বাজারের ব্যাগ থেকে সবকিছু বের করতে ব্যস্ত। আদ্রিয়ান নিজের ঘরে চলে গেছে।
" মা দেখুন তো সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি-না? "
" তুমি বরং বাজারের লিস্টের সাথে মিলিয়ে নাও সবকিছু, কোনো কিছু বাদ গেলে বলবে। "
" আচ্ছা মা।"
রিনা বেগমের কথামতো রাহি সমস্ত বাজার লিস্ট অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ করে নিলো। মুরগির মাংস, গরুর মাংস, পোলাও এর চাল,ডিম, মাছ, শাকসবজি সবকিছুই আছে।
" কিছু লাগবে আর? মশলা আছে সব?"
" হ্যাঁ মা সবকিছু ঠিক আছে। আমি বরং এখুনি রান্না শুরু করে দিচ্ছি। বেলা তো কম হলোনা ন'টা বেজেছে। "
" হ্যাঁ আমিও হাতে হাতে সাহায্য করছি। ওরা এসে যাবে ঘন্টাখানেকের মধ্যে। "
কথামতো শ্বাশুড়ি বউমা একসাথে রান্নাবান্না শুরু করেছে। আদ্রিয়ান আজকে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে,বোন আর বোনের বরের সাথে সময় কাটানোর জন্য। সালমান খুরশিদ বসার ঘরে এসে টিভি অন করে খবর দেখতে বসলেন। কিন্তু ন'টার খবর একটু আগেই শুরু হয়ে গেছে। অগত্যা খবরের মাঝখান থেকে দেখতে শুরু করলেন তিনি। সামনে নির্বাচন সেই নিয়ে নানাজন নানারকম মতবাদ জানাচ্ছে আজকাল। সেই রকম একটা রাজনৈতিক টকশো দেখায় মনোনিবেশ করলেন তিনি।
" কী হলো রেডি হবে কখন? "
মিহি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। রুদ্র রেডি হয়ে এসে দাঁড়িয়ে শুধালো রাহিকে।
" চোখ কি গেছে? "
মিহির কথায় রুদ্র একবার তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো মিহিকে। পিওর কটনের কালো রঙের একটা শাড়ি সাথে একইরকম রঙের ব্লাউজ। এমনিতেই সুন্দরী তার উপর কালো শাড়ীতে অসাধারণ লাগছিল তাকে। চুলগুলো পাশ থেকে সিধি করে কানে ছোটো একজোড়া কালো পাথরের দুল পড়েছে।
" সব ঠিক আছে কিন্তু মুখে কোনো মেকআপ ব্যবহার করবে না? "
" না আমি ওসব পছন্দ করি না। আপনার হলে চলুন বের হই।"
" ন্যাচারাল মিহির দানা! ঠিক আছে চলো।"
" আবারও! "
রুদ্র ও মিহি এভাবেই খুনসুটি করলো সারা রাস্তা। কলিংবেলের শব্দে নড়েচড়ে বসলেন আদ্রিয়ানের বাবা। রিনা বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দিলেন। মেয়েকে দেখে আনন্দে দু-চোখ টলমল করছে উনার।
" আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন? "
" আলহামদুলিল্লাহ তোমরা ভেতরে এসো।"
রুদ্র ও মিহি বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো। বাবা কেমন আছেন কুশলাদি বিনিময়ের পরে মায়ের সাথে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালো মিহি। এদিকে রুদ্র শ্বশুরের সাথে বসে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে বসেছে।
" তোমার কী মনে হয় রুদ্র সুষ্ঠু নির্বাচন হবে? কোনো ঝামেলা হবে না? "
" সেটা বলা মুশকিল। আচ্ছা আপনার শরীরের অবস্থা কেমন এখন?"
" আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তোমার দেওয়া ঔষধ ভালোই কাজ করেছে। "
" আমার জন্য না সবকিছু উপরওয়ালার ইচ্ছে হয়েছে। ভাইয়াকে দেখছি না! উনি কি অফিসে? "
" না না তোমরা আসবে বলে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে আজকে। মনে হয় ঘরে ঘুমিয়ে আছে! "
" আচ্ছা আঙ্কেল। "
মিহিকে দেখে রাহি বেশ খুশি হয়েছে। রাহি মাংস কষিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে মিহির সাথে কথা বলতে শুরু করলো।
" সবকিছু কেমন চলছে? সংসার, কলেজ? "
" ভালোই চলছে। কিন্তু বাসায় তো আমাকে কোনো রান্নাবান্না করতে দেননা উনি। রহমান চাচা আছেন তিনি সবকিছু করেন।"
" তা থাক তবুও নিজের সংসারের রান্না নিজে করবি বুঝলি?"
" ঠিক আছে মা। "
" মা ঠিক বলেছেন মিহি।"
মিহি ইশারায় রাহির কথায় সম্মতি জানায়। রিনা বেগম পোলাও রান্না করছেন। রাহি মুরগির মাংস চুলোয় রেখে গরুর মাংসের জন্য মশলা বাটছে শিলনোড়ায়। রেডিমেড মশলা দিয়ে রান্না করলে সেই স্বাদ আসে না যেটা বাটা মশলার তরকারির মাঝে থাকে।
" অনেকক্ষণ তো হলো ছেলেটা ড্রইং রুমে বসে আছে, তুই এবার ওকে তোর রুমে নিয়ে যা।"
" থাকুক বসে বদের হাড্ডি একটা! "
" কী বললি মিহি?"
" কিছু না মা আমি যাচ্ছি। "
মিহি আস্তে করে বললেও কিছু একটা শুনেছেন বলেই রিনা বেগম শুধিয়েছিলেন। মিহি বসার ঘরে গিয়ে ইশারায় রুদ্রকে তার পিছুপিছু আসতে বললো্ রুদ্রও মিহির সাথে দোতলায় চলে গেলো। সিড়ি দিয়ে উঠে কয়েক কদম এগিয়ে মিহির রুম। কয়েকদিন পরে নিজের রুমের মধ্যে ঢুকেছে বলে অন্য রকম একটা অনুভূতি অনুভব হচ্ছে। একদম গোছানো আছে সবকিছুই। এসব নিশ্চয়ই ভাবি করেছে ভেবে মুচকি হাসলো মিহি।
" কী হলো অহেতুক হাসছো কেনো?"
" আমি যে অকারণে হাসলাম সে কথা আপনাকে কে বললো শুনি?"
" সব সময় ত্যাড়া কথা! "
" আপনি যে ভুলভাল বলেন তার বেলায় কিচ্ছু না?"
" মিহির দানা এক গ্লাস জল পাওয়া যাবে? "
" হ্যাঁ জল,পানি,ওয়াটার সবকিছুই আছে। অপেক্ষা করুন আসছি।"
মিহি রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই রুদ্র ঘরটা ভালো করে দেখছে। খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো সবকিছু। দেয়ালের পেইন্টিংগুলো বেশি সুন্দর।
" এই নিন আপনার পানি।"
" হ্যাঁ দাও।"
" কী দেখছিলেন এত মনোযোগ সহকারে? "
রুদ্র এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করে মিহির হাতে গ্লাস দিয়েছে।
" তোমার ঘরের দেয়াল দেখছিলাম। "
" ওগুলো ভাবি পেইন্ট করেছে, খুব ভালো পেইন্ট করে। "
" হ্যাঁ আসলেই খুব সুন্দর হয়েছে। "
" আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। "
" আমিও নিচে আঙ্কেলের কাছে যাবো।"
" ওকে।"
রুদ্র ব্যাগ থেকে নিজের পোশাক বের করে ওয়াশরুমে ঢুকেছে।
" ওঁরা কী এখনো আসেনি বাবা?"
আদ্রিয়ান বাবার পাশে বসে বললো। এরমধ্যেই মিহি দোতলা থেকে বসার ঘরে চলে এসেছে।
" না আসবো কীভাবে বলো? তুমি রুমে ঘুমিয়ে ছিলে বলেই তো মাত্র উপর থেকে ল্যান্ড করলাম আমরা।"
আদ্রিয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ঠাট্টা করে বললো। আদ্রিয়ান মিহির মাথায় আস্তে করে একটা গাট্টা মেরে দিলো।
" কেমন আছিস বোন? রুদ্র কি রুমে?"
" ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? উনি চেঞ্জ করে আসছেন। "
" আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আমাকে ডাক দিলি না কেনো?"
" ভাবলাম আমরা তো আছিই তুমি না হয় ঘুমিয়ে নাও।"
দুই ভাইবোনের কথোপকথনের মধ্যে রুদ্র এসে হাজির হলো সেখানে। মিহি রান্নাঘরে গেলো আর রুদ্র আর আদ্রিয়ান গল্প জুড়ে বসেছে। সালমান খুরশিদ নিজের মতো করে এখনও টিভি দেখে চলছেন।
দুপুরের কড়া রোদের মধ্যে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শরীফ। নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো কেমন ছোপ ছোপ দাগের মতো লাগছে। রুদ্র ভাই বিয়ে করে নিয়েছে অথচ শরীফ বিয়ের কথা ভাবতে পারবেনা কখনো। রুদ্রর ভালোবাসার মানুষটা তে ঠকিয়েছিল তাকে, তাই হয়তো সবটা রেখে এগিয়ে যেত পেরেছে। কিন্তু শরীফের বেলায় প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিলো। সুমিও খুব ভালোবাসতো শরীফকে। কিন্তু বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারেনি। আপাতদৃষ্টিতে সুমিকে দোষী ভাবলেও আসলে কি সুমি দোষী? যে বাবা-মা ছোটো থেকে লালনপালন করে বড়ে করে তুলেছেন তাদের মনে কষ্ট দিয়ে ভালোবাসার মানুষের হাত ধরতে পারেনি সে। শরীফের কথা পরিবারকে জানিয়েছিল সুমি,কিন্তু তাতে আরো অত্যাচারীত হয়েছিল মেয়েটা। শেষমেশ বাধ্য হয়ে বিয়ে করলো অন্য একটা লোককে। সবকিছু শেষ!
আকাশের দিকে তাকিয়ে শরীফের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। সুমি থাকলে আজ জীবনটা অন্য রকম হতো।
চলবে...........................