অন্তর্নিহিত কালকূট
পর্ব ৫৭
অনিমা কোতয়াল
.
.
.
সকাল থেকেই চারপাশে উজ্বল রােদ ছড়িয়েছে আজ। তবে আবহওয়া ঠান্ডা। আমের ভিলার বসার ঘরে সকলেই আজ উপস্থিত। সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন রাশেদ আমের। কিছুক্ষণ আগে নাস্তা করেছেন। এখন চায়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। দ্বিতীয় সিঙ্গেল সােফাটায় জাফর বসেছেন। রদ্র আর উচ্ছ্বাস একসঙ্গে বড় সোফাটায় বসে কফি খাচ্ছে। উচ্ছ্বাসের ব্যবহার একদম স্বাভাবিক। যেন কিছুই ঘটেনি। ওর এই স্বাভাবিক ব্যবহারটা আরও বেশি অস্বস্তিতে ফেলছে রুদ্রকে। রুদ্র চাইছে উচ্ছাস ওকে কিছু বলুক। অভিমান করুন। অভিযোগ করুক। রেগে গাল ফুলিয়ে বসে থাকুক। কিন্তু কিছুই করছেনা ছেলেটা। বুকে এতো কষ্ট চেপে রেখে এভাবেও হেসে খেলে বেড়ানো যায়! কথাগুলো চিন্তা করলেও বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায় রুদ্র।
কুহু ভার্সিটি যাওয়ার জন্যে রেডি হয়ে বসে আছে। এখন চায়ের জন্যেই অপেক্ষা করছে ও। রাশেদ বেশ মনােযােগ দিয়ে পেপার পড়ছেন। ওনার পাশে টি-টেবিলে কিছু রাখার আওয়াজ পেয়ে ভাবলেন চা দেওয়া হয়েছে। সেদিকে না তাকিয়েই হাত বাড়ালেন। কিন্তু কোন কাপ পেলেন না। পেলেন একটা বাক্স। ভ্রুকুটি করে পেপার থেকে চোখ সরিয়ে তাকালেন সেদিকে। দেখলেন ওনার ঔষধের বাক্স। তার পাশে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা।
রাশেদ একটু হাসলেন। পেপারটা সাইডে ভাঁজ করে রেখে চশমাটা খুলে রাখলেন। তারপর প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'ভূলেই গিয়েছিলাম। ভালো করেছো মনে করেছাে।'
প্রিয়তা চোখ ছোট ছোট করে দেখছে রাশেদকে। কিছু বলছে না। রাশেদ কোনমতে দ্রুত হাতে সকালের ঔষধগুলাে বের করে খেলেন। প্রিয়তা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে তপ্ত স্বাস ফেলে বলল, 'এভাবে অনিয়ম করেছেন বলেই শরীরের ভেতরে এতো রোগ। বাইরে দিয়ে ফিটফাট থাকলে কী হবে? ভেতরে ভেতরে কতােটা সুস্থ আছেন সেটাতো যারা কাছ থেকে দেখি তারা জানি তাইনা? কেন এমন করেন বাবা?'
রাশেদ কিছু বললেন না। চুপচাপ মেনে নিলেন প্রিয়তার শাসন। এরমধ্যেই রাশেদ আর কুহুর জন্যে চা নিয়ে এলাে জ্যোতি। রাশেদের জন্যে রাখা চা-টা তাকে দেওয়া হলাে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই মুখ কুঁচকে গেল রাশেদের। চিনি সল্পতা। কিছু বলত গিয়েও প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললেন না। সেই চা-টাই খেয়ে নিলেন চুপচাপ। প্রিয়তা হেসে বলল, 'নাক কোঁচকাতে হবেনা। সুগার ফ্রি শেষ হয়ে গেছে। এ বেলা চালিয়ে নিন। আজকেই আনিয়ে নেব।সন্ধ্যায় মিষ্টি চা-ই পাবেব। '
রাশেদ কিছু বললেন না। চুপচাপ চায়ে চুমুক দিলেন। বাকি সবাই মিটমিটিয়ে হেসে চলেছে। বাড়ির সবাইযে যে দমিয়ে রাখে, তাকে এভাবে দমে যেতে দেখতে মন্দ লাগছেনা ওদের।
চা খেয়ে কয়েকসেকেন্ড বসে রইলেন রাশেদ আমের। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বললেন, 'রুদ্র?
রুদ্র চট করে তাকাল রাশেদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বলল, 'জ্বি বাবা?'
'বিয়ের পর তোমার আর প্রিয়তার সেভাবে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়ে ওঠনি। তাইনা?'
'হ্যা আসলে_'
এইটুকু বলে থেমে গেল রুদ্র। কী বলবে বুঝে উঠতে
পারল না। প্রিয়তাসহ বাকি সবাই কৌতৃহলী চোখে তাকিয়ে আছে। রাশেদ হালকা গলা ঝেড়ে বললেন, 'বিয়ের তো দু'বছর হতে চলল। কোথাও যাওয়াও হয়নি। এক কাজ করো, প্রিয়তাকে নিয়ে কটা দিন কক্সবাজার থেকে ঘুরে এসাে।'
হঠাৎ রাশেদ আমেরের এমন প্রস্তাবে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত। সে হঠাৎ এমন কিছু বলে বসবেন তা সকলেরই কল্পনাতিত ছিল। প্রিয়তা নিজেও বোকার মতো তাকিয়ে আছে। জাফর বলল, 'কিন্তু এই সময়?'
বলে চারপাশে একবার বুলিয়ে নিলেন নিজের দৃষ্টি। আবার বলল, 'মানে এই সিজনে কক্সবাজার গিয়ে কী করবে? বর্ষাকালে গেলে ভালাে হতোনা?'
রাশেদ নিজের কণ্ঠে গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই বললেন, 'সে যখন বর্ষা আসবে তখন দেখা যাবে। আপাতত গিয়ে ঘুরে আসুক।'
তারপর রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'তােমাদের দু সপ্তাহ ওখানে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছি। কালই বেরিয়ে পড়াে।'
সকলের চোখ চড়াক গাছ। দুই সপ্তাহ! রুদ্র আমের ঘুরতে যাবে তাও দুই সপ্তাহের জন্যে? ব্যপারটা কেউই ঠিকভাবে হজম করে উঠতে পারছেনা। কুহু বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। কিন্তু রুদ্র স্বাভাবিক। এবং স্বাভাবিকভাবেই বলল, 'কিন্তু বাবা, এতগুলো দিন থাকার কী দরকার?
রাশেদ বললেন, 'দরকার আছে। মেয়েটা বিয়ের পর
থেকে বাড়িতেই পড়ে আছে। যাও ওকে নিয়ে একটু আলাদা সময় কাটিয়ে এসাে। দুজনের মন ফ্রেশ হবে।'
রুদ্র আর কিছু বলল না। প্রিয়তা মাথা নিচু করে মুচকি
হাসল। দ্রুত পায়ে চলে গেল রান্নাঘরে। জ্যোতি ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস চাপল। স্বাডাবিক হতে চায় ও। সবটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে চায়। কিন্তু মন কী মস্তিস্কের কথা মানে? সে যে বড্ড বেহায়া। তাইতাে আজও জ্যোতির হৃদয় পোড়ে। দম আটকে আসে। মন খুলে কাঁদতে ইচ্ছে করে। তীব্র অভিমানী মন বারবার একই প্রশ্ন করে, আমায় কেন ভালােবাসলে না রুদ্র? কেন? কী এমন কমতি ছিল আমার? যার দ্বায় আমায় চিরকাল বয়ে নিতে হবে?
চা খাওয়া শেষে রাশেদ আর জাফর গেলেন নিজ কাজে। ওনারা বেরিয়ে যেতেই উচ্ছ্বাস রুদ্রর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, 'হানিমুন মােবারক বস।'
কুহু শব্দ করে হাতে তালি দিয়ে উঠল। খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে মেয়েটা। রুদ্র গঞ্ভীর এক চাহনী দিয়ে দুজনকেই চুপ করিয়ে দিলো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমের ভিলার সকলেই যে যার যার কাজে বেরিয়ে পড়ল।
-
রাতে আমের ফাউল্ডেশন থেকে একসঙ্গেই বের হলাে রুদ্র আর উচ্ছাস। হঠাৎই বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে। বারবার হাতের তালু ঘষছে দুজন। রুদ্র জিপে উঠতে গিয়ে দেখল উচ্ছ্বাস অন্যদিকে যাচ্ছে। রুদ্র "উচ্ছ্বাস" বলে ডাকতেই উচ্ছ্বাস দাঁড়িয়ে গেল। পেছন ঘুরে রুদ্রর দিকে এগােতে এগোতে বলল, 'কিছু বলবি?'
রুদ্রও নিজেও দু'কদম এগিয়ে এসে বলল, 'যাচ্ছিস কোথায়?'
'জানিসই তো।'
'আজ এমনিতেই ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে। বারে যেতে
হবেনা। বাড়ি চল।'
উচ্ছ্বাস হাসল। রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলল,'ভয় পাস না। বারেই যাচ্ছি। কোন ইনফরমেশন লিক করতে না।'
রুদ্র রেগে গেল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল উচ্ছাসের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, 'একটা থাপ্নড়ে মেরে দেব কিন্তু। বাড়াবাড়ি হচ্ছে এবার। তুই আমার সিচুয়েশন টা বুঝছিস না।'
উচ্ছাস এখনো হাসছে। হাসি মুখেই বলল, বুঝেছিতো। কিন্তু কী বলতো? লজিক ব্যপারটা মস্তিস্কের জন্যে তৈরী। মনের জন্যে নয়। লজিকতো মস্তিষ্ক নিজ দায়িত্বে বুঝে নেয়। কিন্তু মন? মনতো শুধু আবেগটাই বোঝে। মন লজিক বুঝতে চায়না। তাকে জোর করে মানাতে হয়। তাের সিচুয়েশনটা মগজকে বুঝিয়ে দিয়েছি। সে বুঝেছেও। কিন্তু মনকে মানাতে একটু সময় লাগছে। ভাবিস না। একটু সময় দে, সব ঠিক হয়ে যাবে।'
কথাটা বলে রুদ্রর কাঁধে হাত রাখল উচ্ছুাস। ওর ঠোঁটে হাসি থাকলেও চোখের বিষণ্নতা রুদ্রর নজর এড়ালোনা। মনে অদ্ভুত এক ব্যথা অনুভব করল রুদ্র। উচ্ছ্বাস আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল নিজের গন্তব্যে। রদ্র ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল। এরপর জিপে উঠে নিজেও বেরিয়ে পড়ল বাড়ির উদ্দেশ্যে।
-
নিজের রুমে আসতেই রুদ্র দেখল প্রিয়তা ব্যাগ গোছাচ্ছে। ভালােভাবে খেয়াল করে বুঝল কালকে বের হওয়ারই প্রস্তুতি নিচ্ছে মেয়েটা। রুদ্র মৃদু হেসে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে আলতাে করে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। রুদ্রর ঠান্ডা হাতের স্পর্শে মৃদু কেঁপে উঠল প্রিয়তা। অথচ মুখে কৃত্রিম বিরক্তিভাব ফুটিয়ে বলল, 'এসেই শুরু করেছেন? দেখছেন না কাজ করছি?'
রুদ্র ছাড়লো না। আরও আয়েশ করে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরল নিজের সঙ্গে। কাঁধে থুতনি রেখে বলল, 'আমাকে কাজ দেখাচ্ছাে? সেইতাে আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সময় কাটানাের জন্যেই প্রস্তুতি নিচ্ছো। একান্তে।'
শেষের শব্দটা রুদ্র খানিকটা ইঙ্গিতপূর্ণভাবেই বলল। ফিসফিসিয়ে, শিহরণ জাগানো আওয়াজে। কিন্তু প্রিয়তা বিন্দুমাত্র লজ্জা পেলোনা। বরং রুদ্রকে ছাড়িয়ে চলে গেল কাবার্ডের কাছে। নির্বিকারছন্দে পোশাক বের করতে করতে বলল, 'তাও ভালো। বাবাতা একটু একান্তে সময় কাটাতে পাঠাচ্ছেন আমাদের। কিন্তু আপনি? বাবা না বললতো এ জীবনে আর এসব কিছু ভাবতেন না। আনরােম্যান্টিক গােমড়ামুখাে একটা!'
কথাগুলো বলে আবার লাগেজে কাপড় রাখায় মনােযােগ দিল প্রিয়তা। রুদ্র কোমরে হাত দিয়ে, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই বিছানায় বসল। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল, 'আমি আনরোম্যান্টিক?'
প্রিয়তা থেমে গেল। বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, 'কোন সন্দেহ আছে আপনার?
রুদ্র বিছানায় হেলান দিয়ে বসল। হাত ভাজ করে দুষ্টু এক হাসি দিয়ে বলল, 'কাজগুলো শেষ করে কাছে এসোতো সোনা! তারপর বোঝাচ্ছি রােম্যান্টিকতা কাকে বলে।'
প্রিয়তা রুদ্রর হুমকিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলােনা। নিজের কাজ করতে করতেই বলল, 'হ্যাঁ। ঐ অবধিই দৌড় আপনার। সবজায়গাতে গুন্ডামিটাই করতে জানেন। সেটা রাস্তা হােক বা বেডরুম।'
'আমি গুন্ডামি করি? অবাক হয়ে বলল রুদ্র।
প্রিয়তা হেসে ফেলল। লাগেজটা বন্ধ করে জিপ টেনে দিয়ে বলল, 'এই কথাটা জিজ্ঞেস করে আর হাসাবেন না। শুনে মনে হচ্ছে বাদর প্রশ্ন করছে, "কী! আমি গাছে গাছে লাফাই?"।'
ছোট হলো রুদ্রর চোখ। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। উঠে দাঁড়িয়ে ধরতে নিল প্রিয়তাকে। কিন্তু পারল না। তার আগেই এক ছুটে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাে প্রিয়তা। রুদ্র হেসে ফেলল। বিছানায় বসে চেঁচিয়ে বলল, 'বের হও একবার। তারপর দেখাচ্ছি।'
-
পরেরদিন বেশ ভােরবেলা থেকেই রান্নাবান্নার তোড়জোড় চলছে। রুদ্র আর প্রিয়তা তাড়াতাড়ি বের হব। ওদেরকে সময়মতা খাবার দেওয়ার জন্যই এতাে তাড়াহুড়াে। রান্না জ্যোতি করছে। হাতে হাতে সাহায্য করছে নার্গিস বেগম। একটা সাদা টিশার্ট আর নীল শর্টস্ পরে হাই তুলতে তুলতে কিচেনে এলো উচ্ছ্বাস। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলল, 'বউমনি ওঠেনি?'
উঠেছে। বের হবেতো। তাই তৈরী হচ্ছে।'
'অহ! তাহল কফিটা তুই করে দেনা প্লিজ।'
'দুধ-পানি গরম করাই আছে। শুধু কফি আর চিনিটা
মেশাতে হবে। আমি দিয়ে দিচ্ছি। নিজে একটু করে নাও
প্লিজ।'
'দে।'
জ্যোতি দ্রুত হাতে সবকিছু এগিয়ে দিল। উচ্ছ্বাস কফি
বানাচ্ছে। তখনই নার্গিস বেগম বলে উঠল, 'সাধে কী আর বলেছি বাদশা আর গোলাম এক পেরেসাদে থাকলে কী হবে? বাদশা বাদশাই থাকে। আর গোলাম সারাজীবন গােলামি-ই করে। নিজের ছেলেরে বিয়ে দিল। এখন আবার ঘুরতেও পাঠাচ্ছে। এবার কদিন পরতো ওদের বাচ্চাকাচ্চাও হবে। কিন্তু এইযে, এই ছেলেটারওতো বয়স হচ্ছে। ওরও একটা ভবিষ্যি আছে। সেটা ভেবে দেখেছে এ বাড়ির কেউ? কিছু করেছে ছেলেটার জন্যে? করেনি। কিছুই করেনি। করবিও না। সাদেকি বলে, র-ক্ত র-ক্তই হয়।'
কথাটা বলে বাসন হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নার্গিস। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলাে জ্যোতির। এই মহিলা যখনই কথা বলে বিষাক্ত কথাই বলে। একটা ভালো শব্দ যদি এর মুখ দিয়ে বের হতো। কে যে এর বি-ষমুখ একদিন বন্ধ করতে পারবে, আল্লাহ্ই জানেন।
কিন্তু অবাক করা বিষয় ঘটেছে, আগের বারগুলোের মতো আজ উচ্ছ্বাস কান দাঁতভাঙা জবাব দিলোনা। চুপচাপ শুনে গেল কেবল। জ্যোতি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, 'তুমি ঠিক আছাে?
'হুম? হুম ঠিঠকই আছি।' হাসিমুখেই চামচ দিয়ে কফি মেশাতে মেশাতে বলল উচ্ছ্বাস।
'কাল নাজিফাকে দেখলাম।'
'ওহ।'
' তুমিও দেখছাে। দু মাস আগে। যখন আমরা শপিং করতে গিয়েছিলাম তখন। তাইনা?'
উচ্ছাস কিছু বলল না। ঠোঁটে মুচকি হাসি। তবে কফি
মেশানাের গতিটা বেরে গেছে আগের চেয়ে। নাক চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। দুমাস আগে শপিং মলে দেখেছিল উচ্ছ্বাস নাজিফাকে। ওর ভাবির সঙ্গে ছিল। দেখেই বােঝা যাচ্ছিল সে গর্ভবর্তী। নাজিফার দেখা পেয়ে চোখের শান্তি যেমন পেয়েছে। ওকে গর্ভবতী অবস্থায় দেখে দম আটকে আসছিল উচ্ছ্বাসের। চারপাশটা ঝিঁ ঝিঁ। ভেতরের সবকিছু বেরিয়ে আসবে বোধ হচ্ছিলো। বুক ভার হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিলো মরে যাবে ও। একদম মরে যাবে। ঐ সন্তানের বাবা তো ওর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হায় নিষ্ঠুর নিয়তি! ভাবে এক; হয় আরেক। উচ্ছ্বাস কয়েক সেকেন্ডের বেশি তাকায়ই নি নাজিফার দিকে। তবে নাজিফা যে সুখে আছে সেটাই কম কী? স্বামী নিয়ে ভীষণ সুখে সংসার করছে সে এখন। একবছর পাড় হতে না হতেই তাদের সন্তান আসছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও আসবে। পরিপূর্ণ সুখী এক পরিবার। এটাইতো চেয়েছিল উচ্ছ্বাস। মেয়েটা ভালো থাক, সুখে থাক। তাইতো আছে। নাজিফার সুখেইতো ওর সুখ। আর কী চাই?
জ্যোতি একটা দীর্ঘশ্বাসে ফেলে বলল, 'কয়েক সেকেন্ডের জন্যেই দেখতে পেলাম ওকে। রিকশায় ছিল। একা। দেখেতো মনে হলাে প্রায় সাত-আট মাসের গর্ভবর্তী। এই সময়ে একা একা কেন বের হয়েছে বুঝতে পারলাম না।'
উচ্ছাস কোন জবাব দিলোনা। ওর কফি করা শেষ। মগটা নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। সেদিকে উদাস চোখে তাকিয়ে রইল জ্যাতি। উচ্ছ্বাসের যন্ত্রণাটা ভালোভাবে বুঝতে পারে ও। দুজনেই তোে প্রেমে ব্যর্থ হওয়া অভাগা মানব-মানবী। তবে উচ্ছ্বাসের কষ্টের পরিধি হয়তো জ্যোতির চেয়ে কয়েকগুন বেশি। জ্যোতিতো একাই ভালোবেসেছিল, একাই চেয়েছিল, একাই স্বপ্ন সাজিয়েছিল। কিন্তু উচ্ছ্বাস? দিনের পর দিন রোদে পুড়ে, মশার কামড় খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একপলক নাজিফাকে দেখার আশায়। রাতের পর রাত জেগেছে নাজিফার এক টুকরো গলার স্বর শোনার জন্যে। কতটা তৃষ্ণা, কতটা ভালোবাসা থাকলে তা সম্ভব! অতঃপর নাজিফার কাছ থেকেও ভালোবাসা পেয়েছিল ও। দীর্ঘ এগারো মাস একে অপরের সঙ্গে গভীর প্রনয়ে আবদ্ধ ছিল দুজন। কত প্রেমময়, শিহরণময়, ভালোবাসাময় সময় কাটিয়েছে। কত স্বপ্ন সাজিয়েছে একে অপরকে নিয়ে। একসঙ্গে সংসার করার স্বপ্ন, বাঁচার স্বপ্ন। এতোকিছুর পর যখন আলাদা হত হলো। সব স্বপ্ন, সব আশা ভেঙে গেল। নাজিফা অন্যকারো হয়ে গেল। উচ্ছ্বাসকে নিরুপায় হয়ে প্রাণপ্রিয়াকে অন্যকারো হাতে তুলে দিতে হলো। নিজ চোখে অন্যকারো হয়ে যেতে দেখল নিজের ভালোবাসাকে। কীকরে সহ্য করল ছেলেটা এই কষ্ট? এই যন্ত্রণা? কথাগুলো ভাবতে গিয়েও কেমন দম বন্ধ হয়ে এলো জ্যোতির। সবকিছু অন্ধকার মনে হল।
-
একঘন্টার মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বের হওয়ার জন্যে তৈরী হলো রুদ্র-প্রিয়তা। ওদের এই ঘুরতে যাওয়া নিয়ে কুহুর উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি। সকাল থেকেই আনন্দে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে মেয়েটা। ওর আনন্দ দেখে বাড়ির সকলের মনটাই ফুরফুরে হয়ে গেল। বয়স বাইশ হলেও মনের দিক থেকে বাচ্চা মেয়েটা। একদম শিশুর মতো।
রাশেদ আর জাফরকে সালাম দিল রুদ্র-প্রিয়তা। উচ্ছ্বাস আর জ্যোতির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শেষে এলো কুহুর কাছে। কুহু হাসিমুখে রুদ্রকে ইশারা করে বলল, 'ভাইয়া, তােরা ফিরে আসতে আসতে আমার জন্মদিন চলে যাবে। তাই আমার কিন্তু আমার গিফ্ট চাই।'
রুদ্র ভ্রুকুটি করে বলল, 'গিফ্ট? মারব টেনে এক চর। তোর জন্মদিন সেটা ভালো কথা। কিন্তু জন্মেছিলিতো তুই। আমি কোন দুঃখে গিফ্ট দেব? কোন গিফ্ট-ফিফ্ট হবেনা।'
গাল ফুলিয়ে রুদ্র বাহুতে কিল মারল। কাঁদোকাঁদো চেহারা করে ইশারা করল, 'ভালো হচ্ছেনা ভাইয়া। আমি কাঁদব কিন্তু।'
সত্যিই কেঁদে ফেলার জোগাড় হল কুহুর। রুদ্র আর চটালো না বোনকে। নরম গলায় বলল, 'কী চাই বল?'
কান্না ভুলে সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল কুহু। দ্বিগুণ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,.'কক্সবাজার যাচ্ছিস তাে। আমার জন্যে সুন্দর সুন্দর ঝিনুকের গহনা কিনে আনবি। এত্তোগুলো করে।'
রুদ্র মুচকি হেসে কুহুকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, 'আচ্ছা। আর কিছু?'
কুহু মাথা নেড়ে না করল। প্রিয়তা কুহুকে বলল, 'শুধু ভাইয়ার কাছেই সব আবদার? আমার কাছে কিছু চাইবেনা?'
কুহু প্রিয়তার হাত ধরে একটান দিয়ে সাইডে নিয়ে এলাে। প্রিয়তা ভ্রু নাচিয়ে বোঝালো, 'কী?'
কুহু ইশারায় বলল, 'এবার ফিরে এসে একটা ছোট্ট বাবু গিফট করো। তাহলেই হবে।'
প্রিয়তা চোখ বড়বড় করে তাকালো কুহুর দিকে। একহাতে কান মুলে দিয়ে বলল, 'পাঁজি মেয়ে!'
কুহু হাসল। নিঃশব্দ কিন্তু প্রাণখোলা হাসি। সে হাসি দেখে রুদ্র আর প্রিয়তা দুজনেই শান্তি পেলো। সকলের কাছ থেকে আরও একবার বিদায় নিয়ে আমের ভিলা থেকে বেরিয়ে পড়ল রুদ্র-প্রিয়তা।
কিন্তু রুদ্র জানলো না ওদের এই যাত্রার সঙ্গেসঙ্গেই
আমের ভিলা তথা সোলার সিস্টমের ধ্বংসের যাত্রা
শুরু হলাে। এরপর যা হবে, শুধুই বিনাশ। হাড় কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো ভয়াবহ বিনাশ। সেই মর্মান্তিক বিনাশের একবিন্দুও যদি টের পেতো, তাহলে রুদ্র ভুল করেও যেতোনা। কখনও না।
.
.
.
চলবে..........................