অন্তর্নিহিত কালকূট
পর্ব ৫৮
অনিমা কোতয়াল
.
.
.
রাত তখন সাড়ে এগারোটা। রুদ্র-প্রিয়তা যে হোটেলটা বুক করেছে; সেটা সমুদ্রের খুব কাছাকাছি। বারান্দা থেকে সরাসরি সমুদ্র দেখা যায়। এই সিজনে বরাবরই শান্ত থাকে সমুদ্র। এখনো তাই। তবে এই শান্ত সমুদ্রতেও কেমন আলাদারকম সৌন্দর্য থাকে। আকর্ষণ থাকে। সমুদ্র মানেই আকর্ষণ, রহস্য, সদা অমিমাংসিত এক ধাঁধা।
হোটেল রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। হিমশীতল বাতাস ছুয়ে যাচ্ছে শরীরকে। খোলা চুলগুলো এলোমেলোভাবে দুলছে। ঠান্ডায় কাঁপছে ঠোঁটজোড়া। সেদিকে কোন খেয়াল নেই মেয়েটার। ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শান্ত সমুদ্রের দিকে। ভাবছে এক সমুদ্রের কত রূপ! শীতের কাছে সে শান্ত, নম্র, কোমল। অথচ বর্ষার সম্মুখে সে সর্বদাই অশান্ত, প্রবল, কখনও প্রলয়ঙ্করী।
এতক্ষণে কাজ সেড়ে রুমে এসে ঢুকল রুদ্র। আশেপাশে তাকিয়ে প্রিয়তাকে দেখতে না না পেয়ে উঁকি দিল বারান্দায়। তখনই দেখতে পেল এই দৃশ্য। মেয়েটার মন খারাপ হয়তো। স্বাভাবিক। চারদিন হয়ে গেলো কক্সবাজার এসেছে। অথচ ওকে নিয়ে সেভাবে হোটেল থেকে বের হতেই পারেনি রুদ্র। একদিন মাত্র সৈকতে নিয়ে গিয়েছিল। তাও মাত্র আধ ঘন্টার জন্যে। ব্যস, এইটুকুই। ও-ই বা কী করবে? পরশু মাল ডেলিভারী। এর আগেই সব কাজ গুছিয়ে রাখতে হয়েছে ওকে। প্রিয়তা কয়েকবার বাইরে যাওয়ার বায়না করেছে। কী ব্যপার জিজ্ঞেস করেছে। কোন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি রুদ্র।
কথাগুলো চিন্তা করে চাপা শ্বাস ফেলল রুদ্র। চারপাশে চোখ বুলিয়ে একটা চাদর খুঁজে নিল। সেটা নিয়ে চলে গেল প্রিয়তার কাছে। পেছন থেকে আলতো করে চাদরটা জড়িয়ে দিয়ে বলল, 'ঠান্ডার মধ্যে এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কিছু গায়ে জড়িয়ে নিতে।'
প্রিয়তা জবাব দিলোনা। রুদ্র প্রিয়তাকে ধরে নিজের দিকে ঘোরালো। থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে বলল, 'কী হয়েছে? মন খারাপ।?'
প্রিয়তা রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলল, 'কোথায় ছিলেন?'
'কাজ ছিল।'
প্রিয়তা জিজ্ঞেস করল না কী কাজ। শুধু বলল, 'একটা কথা জিজ্ঞেস করব?'
'করো।'
'এখানে আসার পেছনে আপনার অন্যকোন উদ্দেশ্য আছে তাইনা? আমাদের হানিমুনটা একটা কভার। রাইট?'
'রাইট।' কোনরকম ভনিতা না করে স্বীকার করল রুদ্র।
প্রিয়তা কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেলল। হয়তো কষ্ট পেয়েছে। রুদ্রর খারাপ লাগল। ও প্রিয়তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, 'আ'ম স্যরি। সব ঠিক থাকলে পরশু আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে। তখন তোমাকে এখানকার সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখাব। প্রমিস।'
প্রিয় রুদ্রর পিঠে হাত রাখল। বিষণ্ন গলায় বলল, 'আমার খুব ভয় হয়। আটশ কোটি মানুষের এই পৃথিবীতেও আমি ভীষণ একা ছিলাম রুদ্র। ভীষণ একা। আমাকে আবার একা করে দেবেন না প্লিজ। নিজের খেয়াল রাখবেন। নিজের জন্যে না, আমার জন্যে।'
রুদ্র কিছু বলল না। ওভাবেইপ্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে রাখল নিজের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর ডাকল, 'প্রিয়?'
'হুম?'
রুদ্র প্রিয়তাকে ছাড়ল। সরাসরি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, 'কাল দুপুর অবধি ফ্রি আছি আমি। কাজ নেই। কাল বের হবে? পরশুতো কুহুর জন্মদিন। ওর জন্যে কিছু গিফটও কিনে নেব।'
' আচ্ছা ঠিক আছে। তা খাওয়া হয়েছে মহারাজ?'
' উমহুম। মহারাণীও নিশ্চয়ই খাননি?'
প্রিয়তা হেসে ফেলল। বলল, ' না। রুমে খাবার দিয়ে গেছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি ওভেনে দিচ্ছি।'
রুদ্র পেটে হাত বুলিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল, 'তাড়াতাড়ি হ্যাঁ? খুব ক্ষিদে পেয়েছে।'
'যান আপনি।' রুদ্রকে ঠেলে ভেতরে পাঠিয়ে দিল প্রিয়তা। রুদ্র ঢুকে গেল ওয়াশরুমে। প্রিয়তা বারান্দার দরজা বন্ধ করল। খাবারগুলো ওভেনে দিতে দিতে আনমনেই হেসে উঠল।
-
পরেরদিন সকালের কথা। বেশ ভালো ঠান্ডা পড়েছে আজ। ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে ব্যস্ত শহরটা। সকাল সকাল গুলশানের গলির রাস্তা দিয়ে হাঁটছে উচ্ছ্বাস। ঠান্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচতে মোটামুটি ভারী একটা জ্যাকেট জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে। নীরব, কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে ভালোই লাগছে ওর। হাঁটার এক ফাঁকে পাড়ার এক দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে নিয়েছে। এখন শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। এমনি এমনিই হেঁটে চলেছে অনেক্ষণ যাবত। কিছুটা একঘেয়ে লাগছে এবার। একঘেয়েমি কাটামে পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল উচ্ছ্বাস। প্যাকেটটা নতুন। উচ্ছ্বাস খুলতে নিলেই পেছন কেউ ডেকে উঠল,
'উচ্ছ্বাস?'
উচ্ছ্বাস থমকালো। মনে হলো কিছুক্ষণের জন্যে জমে বরফ হয়ে গেছে ওর শরীর। একবছরেরও বেশি সময় পর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু অতি প্রিয় কন্ঠস্বর! অতি পরিচিত সেই ডাক। উচ্ছ্বাস মনে প্রাণে প্রার্থনা করল এটা যেন ওর ভ্রম হয়। ও চায়না আবার সেই রমনীর দেখা পেতে, তারসাথে কথা বলতে। হৃদয় আর ক্ষ-তবিক্ষ-ত করার ধৈর্য্য নেই ছেলেটার মধ্যে। একরাশ ইতস্তত ভাব নিয়ে পেছন ফিরে তাকাল উচ্ছ্বাস। কিন্তু অভাগাদের কপালে যা হয়, তাই হলো। এবারও বিফলে গেল। উচ্ছ্বাসের প্রার্থনা। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাত মাসের গর্ভবতী নাজিফা।
উচ্ছ্বাস ভালোভাবে লক্ষ্য করল প্রিয়তমাকে। আকাশি রঙের একটা শাড়ি পরে আছে। খোলা চুলগুলো একটা ক্লিপ দিয়ে পেছনে আটকানো। সাতমাসের উঁচু পেট। রোগাপাতলা শরীরটা এখন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়েছে। বেশ লাগছে দেখতে। তবুও চোখজোড়াতে কোথাও যেন একটা বিষাদ, তীব্র হাহাকার, অব্যক্ত যন্ত্রণা। সেটা নজর এড়ালোনা উচ্ছ্বাসের। উচ্ছ্বাসের চোখ চোখ রেখে মলিন হাসল নাজিফা। একটু এগিয়ে এসে বলল, 'কেমন আছো?'
উচ্ছ্বাস জোরপূর্বক হেসে বলল, 'ভালো। তুমি?'
'ভালোই।'
উচ্ছ্বাস নাজিফার দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল। কৃত্রিমতায় ছেয়ে ফেলল নিজেকে। হেসে দিয়ে বলল, 'আরে! প্রেগনেন্ট না-কি? কনগ্রাচুলেশনস্।'
নাজিফা মাথা নিচু করে হাসল। নিষ্প্রাণ হাসি। অতঃপর দুজনেই ধীরপায়ে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতেই নাজিফা বলল, 'আমের ভিলার সবাই কেমন আছে?'
'ভালো আছে। তোমার স্বামী, শ্বশুরবাড়ির সবাই ভালো আছে?'
নাজিফা চুপ থাকল কিছুক্ষণ। অতঃপর তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল, 'আছে। কুহুর কী খবর? নীরব ফিরেছে? বিয়ে কবে ওদের?'
'ফেরেনি। তবে এই সপ্তাহেই ফিরে আসবে। দু সপ্তাহ পর বিয়ের ডেইট। শীঘ্রই ইনভেটেশন কার্ড পৌঁছে যাবে তোমাদের বাড়ি। এসো কিন্তু।'
'নিশ্চয়ই আসব।'
উচ্ছ্বাসের একবার ইচ্ছে করল জিজ্ঞেস করবে, এখানে কী করছে? ওরতো শ্বশুরবাড়ি থাকার কথা। পরে ভাবল হয়তো এইসময় মেয়েরা বাপের বাড়িতে থাকে, তাই হয়তো এখানে আছে। তাছাড়াও নাজিফার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার যে ওর আর নেই। তাই মনের প্রশ্নগুলোকে মনেই চেপে রাখল। দু মিনিট চুপচাপ হাঁটল দুজনে। কেউ কোন কথা বলল না।
কুয়াশাঘেরা নীরব রাস্তা। ভারাক্রান্ত দুটো মন। কত না বলা কথা আছে, কতো কিছু শোনার আছে। অথচ বলার বা শোনার অধিকারটাই নেই কারো। অস্বস্তি কাটাতে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করল উচ্ছ্বাস। ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরল। লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালানোর সময় উচ্ছ্বাসকে ভালোভাবে খেয়াল করল নাজিফা। রোদে পুড়ে গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গেছে। চোখের নিচে হালকা কালি পড়েছে। সিগারেটে পোড়া তামাটে ঠোঁটের কালচে ভাব আরও ফুটে উঠেছে। নাজিফা স্পষ্ট টের পেল এ ছেলে রাতে ঘুমায় না। ঘন্টার পর ঘন্টা টানা নিকোটিনের ধোয়া গিলে বেড়ায়। নিজের নিঃশেষ করতে যা যা করণীয় সবই করে চেলেছে এই পাগলটা। গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে এলো নাজিফার। কোনমতে বলল, 'আবার সিগারেট খাওয়া শুরু করেছো?'
' ছাড়ার কারণ আছে কী?'
নাজিফা জবাব দিলোনা। কী জবাব দেবে? বুকটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। করুণ দৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, 'বিয়ে করছো না কেন?'
উচ্ছ্বাস ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে হাসল। নাক দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এলো নিকোটিনের ধোঁয়া। সকৌতুকে বলল, 'কাউকে বিয়ে করার যোগ্যতা আমার আছে নাজিফা?'
' সারাজীবন এভাবেই থাকবে?'
' ক্ষতি কী?'
' জীবনটা গুছিয়ে নাও উচ্ছ্বাস। এভাবে বাঁচা যায়না।'
উচ্ছ্বাস দাঁড়িয়ে গেল। প্রসঙ্গটা পছন্দ হচ্ছেনা ওর। নাজিফার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, 'ফাঁকা রাস্তায়, একান্তে, নিজের প্রাক্তনের সঙ্গে এতক্ষণ যাবত গল্প করছো। তোমার স্বামী রাগ করবে না? সে জানে আমার ব্যপারে?'
নাজিফার মাথা নিচু করে লম্বা করে শ্বাস নিল। দু হাতে খামচে ধরল শাড়ির আঁচল। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। গা গুলিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। বমি করে দেবে। কিন্তু শক্ত মনের মেয়েটা নিজেকে শক্ত রেখেই বলল, 'আমাকে যেতে হবে। ভালো থেকো। আর পারলে জীবনটা নতুন করে গুছিয়ে নাও উচ্ছ্বাস। মিষ্টি একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও। জীবন কারো জন্যে থেমে থাকেনা। তুমি চাইলেই পারবে।'
নাজিফার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসল উচ্ছ্বাস। নাজিফা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। কেন যেন সহ্য করতে পারল না উচ্ছ্বাসের ঐ বিষাদমাখা হাসি। ও চলে যেতে নিলে উচ্ছ্বাস বলে উঠল, 'এইসময় এতো ঘোরাফেরা ঠিক না, নাজিফা। বাচ্চাটা তোমার। ওর খেয়াল তোমাকেই রাখতে হবে। বাড়িতে থেকে রেস্ট করো। আর নিজের খেয়াল রেখো।'
নাজিফা দাঁড়াল না। পেছন ঘুরে তাকালোও না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখল। আস্তে আস্তে হেঁটে ঢুকে গেল পাশের গোলিতে। নাজিফা চোখের আড়াল হতেই সিগারেটে লম্বা এক টান দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল উচ্ছ্বাস। নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো ঘন বিষাক্ত ধোঁয়া।
হ্যাঁ, এই নাজিফার প্রেমেই উচ্ছ্বাস পাগল ছিল। একঝলক তার দেখা পাওয়ার জন্যে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতো। অপলকে গেইটের দিকে তাকিয়ে থাকতো চাতক পাখির মতো। একটাবার তার কন্ঠস্বর শোনার জন্যে হাজাররকমের ছলনার আশ্রয় নিতো। আজ সেই নাজিফারই মুখোমুখি হতে চায়না উচ্ছ্বাস। চায়না তাকে দেখতে, তার কন্ঠস্বর শুনতে। কথায় বলে, যখন মায়া বাড়িয়ে লাভ হয়না, তখন মায়া কাটাতে জানতে হয়। কিন্তু সব মায়া কী সত্যিই কাটিয়ে ওঠা যায়? কিছু মানুষ, কিছু স্মৃতি, কিছু ভালোবাসাকে কী ভুলে যাও বললেই ভুলে যাওয়া যায়? ঘুরে দাঁড়াও বললেই ঘুরে দাঁড়ানো যায়? চাইলেই নতুন করে শুরু করা যায়? যদি যায় তো উচ্ছ্বাস কেন পারেনা? আজও কেন নাজিফার কথা মনে পড়লে ওর চোখ জ্বালা করে? বুক ভাড় হয়ে আসে। কেন হঠাৎই মাঝরাতে সশব্দে কেঁদে ওঠে? কেন নাজিফার স্বামীর কথা বলতে গিয়ে ওর দম আটকে আসছিল? কেন নাজিফাকে গর্ভবতী অবস্থায় দেখে ওর ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছিল? এইসকল প্রশ্নেয উত্তর কী আজও আসে। নাজিফাল "নতুন করে শুরু করো" কথাটা চিন্তা করে আনমনেই হাসল উচ্ছ্বাস। যে রাস্তাটা দিয়ে নাজিফা চলে গেল; সেদিকে তাকিয়ে বলল, 'তোমাকে কথা দিয়েছিলাম নাজিফা। তুমি অন্যকারো হয়ে গেলেও, আমি চিরকাল তোমারই থাকব। তোমার শরীর, মনজুড়ে অন্যকারো আধিপত্য থাকলেও; আমার শরীর, মনজুড়ে চিরকাল তোমারই আধিপত্য থাকবে। সে কথার খেলাপ করি কীকরে?'
কাছে কোন এক বিল্ডিং থেকে সাউন্ড বক্সে গান বাজছে। শুনতে পেল উচ্ছ্বাস-
তারে আমার আমার মনে করি
আমার হয়েও আর হইল না
দেখেছি,
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
কেন জানি নিজের ওপরেই হাসতে ইচ্ছে হলো উচ্ছ্বাসের। ভালোবাসার তীব্র যন্ত্রণার কথাতো সবাই জানে। তবুও কেন ভালোবাসে মানুষ? জীবন কারো জন্যে থেমে থাকেনা। কথাটা সত্যি। কিন্তু প্রাণোচ্ছলভাবে দৌড়ে চলা আর হাজার আঘাতে বিধ্বস্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য। মুখে হাসি টেনে, ভালো আছি বলে, প্রতিনিয়ত নিজেকে ঠকিয়ে যাওয়ার নামই বোধ হয় মানিয়ে নেওয়া। জীবনে এগিয়ে যাওয়া।
-
কক্সবাজার। হোটেল কল্লোল। রেস্টুরেন্টে বুক করে রাখা একটা টেবিলে বসে আছেন করিম তাজওয়ার, সম্রাট তাজওয়ার আর পলাশ মীর্জা। কারো আসার অপেক্ষা করছে তারা। শওকত মীর্জার অপেক্ষা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওনাদের অপেক্ষার অবসান ঘটল। আগমন ঘটল আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম প্রতাপশালী দল; ডার্ক নাইটের লীডার শওকত মীর্জার। পাঁচ ফুট এগারোর মতো উচ্চতা। মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুল। ক্লিন সেভ করা। চেহারায় কিঞ্চিৎ বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে। নিজের বাঁ পা হালকা টেনে হাঁটতে হচ্ছে তাকে। সেভাবেই এগিয়ে এলেন টেবিলের কাছে। সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে এক সরল হাসি দিলেন। চেয়ারটা টেনে বসে বলল, 'বেশি অপেক্ষা করালাম না-কি?'
করিম তাজওয়ার অনেকটা জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, 'না, তা নয়। বেশিক্ষণ হয়নি এসেছি আমরা।'
'ভাট না বকে কাজের কথায় আসি? খুব বেশি সময় নেই আমাদের হাতে।' গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল সম্রাট।
শওকত মনে মনে একবার ছু-রি চালিয়ে ফেলল সম্রাটের। বেয়াদব একটা। বাধ্য না হলে বুঝিয়ে দিতো শওকত মীর্জা কী জিনিস। তবে মুখে সেই সরল হাসি ধরে রেখেই বলল, 'হ্যাঁ, অবশ্যই। আজকালকার ছেলেমেয়ে তো কথায় কম কাজে বেশি বিশ্বাসী।'
মনে মনে শওকতকে ঝেড়ে কয়েকটা গালি দিল সম্রাট। শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে খোড়াটাকে সহ্য করছে। ইচ্ছে করছে সমুদ্রের নোনা পানিতেই এটাকে চুবিয়ে মারতে। করিম বলল, 'যাই হোক। সম্রাট শুরু করো।'
'আপনার ছেলে, শান কোথায়?' প্রশ্ন করল সম্রাট।
শওকত বলল, 'ও ঢাকায়। কোনকারণে যদি 'প্লান বি' কাজে লাগাতে হয়, ওকে ওখানে দরকার হবে।'
সম্রাট মাথা নাড়ল। বড় সাইজের একটা কাগজ টেবিলের ওপর বেছালো। একটা রঙিন কলম দিয়ে একটা জায়গা মার্ক করে বলল, 'এটা হচ্ছে রূপসা বিচ। এখান থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে ঐ গ্রিন মার্ক করা জায়গাটায় আমাদের লোক উপস্থিত থাকবে। কাল ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। সোলার সিস্টেমের মাল ডেলিভারি দিতে আসবে সন্ধ্যা আটটায়। আমাদের সাজানো পরিকল্পনাও অনুযায়ী সোলার সিস্টেমের লোকেরা মাল নিতে আসবে রাত ন'টায়। মাঝে এক ঘন্টা সময় পাচ্ছি আমরা। ঐ এক ঘন্টার মধ্যে সোলার সিস্টেমের লোক হয়ে সকল মাল রিসিভ করব আমরা। ওদের বিদায় করে, আসল মাল লুকিয়ে নকল মালগুলো রাখব। তারপর আমাদের লোকেরা সাজবে ডেলিভারী ম্যান। আর এই রেড মার্ক করা জায়গাতে সোলার সিস্টেমের লোকেদের জন্যে অপেক্ষা করবে।'
এরপর কীভাবে কোন রাস্তা দিয়ে পাস করব। চেকপোস্টগুলো কীভাবে সামলাবে সব একে একে বর্ণনা করে গেল সম্রাট। সম্রাটের কথা শেষ না হতেই পলাশ বলল, 'কিন্তু এই স্ট্রাটেজিতো আমরা এতোদিন ব্যবহার করেছি। কিন্তু কাল সেটা করা যাবেনা। তুমি ভুলে যাচ্ছো কেন রুদ্র কক্সবাজারে-ই আছে। আর এই সময়, এখানে, বউ নিয়ে সত্যি সত্যিই হানিমুন করতে আসেনি নিশ্চয়ই। এইটুকু বোঝার বুদ্ধি আমাদের আছে।'
গর্জে উঠল সম্রাট। হাত দিয়ে টেবিলে আঘাত করে বলল, 'শাট আপ! আমি জানি কে, কোথায়, কীভাবে আছে। শোনানোর দরকার নেই। চুপচাপ আমার কথা শুনুন। নয়তো বিদায় হন।'
শওকত মীর্জা পলাশকে ধমকে বললেন, 'পালাশ! ওকে বলতে দাও।'
পলাশ দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল চুপচাপ। হাঁটুর বয়সী এক ছেলে তাকে ঝাড়ি মারে! পলাশ মীর্জাকে! একবার শুধু কাজটা আদায় হোক। এই ছেলেকে কুত্তার মতো গু-লি করে মারবে। নিজের মনেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল পলাশ। সম্রাট আবার বলতে শুরু করল, 'আমরা যাই করিনা কেন, আগামীকাল রুদ্র সবটা বুঝে ফেলবে। সেটা নিশ্চিত। যখন দেখবে ওদের আগেই ওদের মাল আমরা ডেলিভারী নিয়ে নিচ্ছি। তখন ওর মনে কয়েকটা প্রশ্ন উঠবে। এক, আমরা কীকরে জানলাম কোথায়, কোন কোন পয়েন্টে ওদের মাল ডেলিভারী হবে? দুই, ওদের মাল ডেলিভারী নেওয়ার জন্যে একটা সিক্রেট কোড প্রয়োজন। যেটাকে অটিপিও বলা যায়।ঐ অটিপি ব্যবহার করা ছাড়া কোনভাবেই মাল ডেলিভারি দেওয়া হয়না। সেই কোডটা আমরা কোথায় পেলাম? কীভাবে পেলাম? তিন, নিশ্চয়ই এইসব অতি গোপন ইনফরমেশন ওদের ভেতর থেকেই কেউ আমাদের দিচ্ছে। যে সবকিছুই খুব ভালো করে জানে। সে কে? আর রুদ্রর মগজ নিয়ে নিশ্চয়ই এখানে কারো কোন সন্দেহ নেই? দুইদিন। জাস্ট দুইদিনে গোটা খেলাটা ধরে ফেলবে ও।'
দুবার তুড়ি বাজিয়ে বলল সম্রাট। করিম বলল, 'খেলাটা এতো তাড়াতাড়ি এই জায়গায় এসে মোড় নেবে কল্পনাও করতে পারিনি আমি। আর দুটো বছর, জাস্ট দুটো এভাবে চললে শেষ করে দিতে পারতাম সোলার সিস্টেমকে। কিন্তু তার আগেই রুদ্র টের পেয়ে গেল।'
শওকত মীর্জা বলল, 'যেটা আর হওয়ার নয় সেটা ভেবে লাভ কী? অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এই পরিণতি যখন এসেই গেছে তখন আর কী করার? প্লান 'বি' তো রেডি করেই রেখেছিলাম আমরা। এখন সেটাই একমাত্র পথ।'
চমকে উঠল করিম। কিছুটা থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, 'কিন্তু রিস্ক? 'প্লান বি' তে কী ভয়ানক রিস্ক সেটা এখানে আমরা সবাই জানি। হ্যাঁ, যদি প্লান বি কাজে লাগাই সোলার সিস্টেম শেষ হবে সেটা নিশ্চিত। সেটা কেউ কোনভাবেই আটকাতে পারবেনা। স্বয়ং রাশেদ আমেরও না। কিন্তু তারসাথে আমাদের সকলের ধ্বংসও নব্বই শতাংশ নিশ্চিত। সেটা কেন ভুলে যাচ্ছো তোমরা?'
' দশ শতাংশতো বেঁচে যাওয়ার চান্স আছে তাই না? কিন্তু কিছুই না করলে বেঁচে থাকার চান্স জিরো পয়েন্ট জিরো জিরো জিরো ওয়ান পার্সেন্টও নেই। তাই রিস্ক নিতেই হবে। লেটস্ এক্সিকিউট প্লান বি।' শক্ত, হিংস্র কন্ঠে বলে উঠল সম্রাট।
পিলে চমকে উঠল উপস্থিত সকলের। সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। স্তব্ধতা চলল টানা এক মিনিট। পলাশ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, 'আর ইউ শিওর?'
'এছাড়া আর কোন উপায় নেই।' শায় দিল শওকত মীর্জাও।
ওরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। শওকত পলাশকে ইশারা করতেই পলাশ খানিকটা ইতস্তত করে নিজের ফোন বের করল। হাত কাঁপছে তার। কাঁপা কাঁপা হাতেই কল করল ঢাকায়। শানকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করতেই শুধু দুটো শব্দ বলল পলাশ, 'প্লাব বি।'
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কোন আওয়াজ এলোনা। হয়তো থমকে গেছে শান মীর্জাও। কয়েক সেকেন্ড পরেই কম্পিত কন্ঠে শুধু একটাই শব্দ ভেসে এলো, 'অলরাইট।'
ফোন রেখে লম্বা শ্বাস নিল সবাই। এই ঠান্ডার মধ্যেও ঘেমে গেছে উঠেছে ওরা। সম্রাট বলল, 'যাই হয়ে যাক, এইসব খবর আমরা কীভাবে, কার কাছ থেকে পাচ্ছি সেটা যেন রুদ্র কোনভাবেই টের না পায়। কোনভাবেই না। দরকারে ইকবালের মতো_'
এইটুকু বলে থেমে গেলো সম্রাট। চারপাশে একবার তাকিয়ে লক্ষ্য করল কোনভাবে কেউ ওদের কথা শুনছে কি-না। নিশ্চিন্ত হয়ে শওকতের দিকে তাকিয়ে বলল, 'নাউ গেট রেডি ফর দ্য ক্লাইম্যাক্স।'
শওকত কিছু বলল না। নিজের কাঠের বাঁ পাটার ওপর হাত বুলিয়ে হিংস্র এক হাসি হাসল কেবল।
-
ঘড়ির কাটায় এগারোটা বেজে পঞ্চান্ন। আবছা অন্ধকার রুম। আলো বলতে কেবল টেবিল ল্যাম্পের আলোটা। গাল ফুলিয়ে, মুখ গোমড়া করে বসে আছে কুহু। বারবার ফোন চেক করছে। গত দুদিন হল নীরব ওকে কল করছেনা। মেসেজ করছেনা। ও কল-মেসেজ করলেও রেস্পন্স করছেনা। এক কথায় কোন যোগাযোগই করছেনা ওর সাথে। আউট অফ টাচ। এদিকে কাল ওর জন্মদিন। সে নিয়ে নিশ্চয়ই কোন এক সারপ্রাইজ প্লান করে বসে আছে ঐ ছেলে। সারপ্রাইজ দিতে গেলে বুঝি কথা বন্ধ করে দিতে হয়? ভীষণ অভিমান হয়েছে কুহুর। তাই ঠিক করে নিয়েছে, যত বড় সারপ্রাইজই দিক; তবুও খুশি হবেনা কুহু। নীরব ওর সাথে দুদিন কথা বলেনি। ও নীরবের সাথে চারদিন কথা বলবেনা। তবেই প্রতিশোধ পূর্ণ হবে। মনে মনে কথাগুলো আওড়ে নিয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলো কুহু।
মনে মনে এসব কল্পনা-জল্পনা করতে করতেই 'টুং' করে আওয়াজ হলো কুহুর ফোনে। হোয়াটস্ অ্যাপ ম্যাসেজ টোন। কুহু দ্রুত ম্যাসেজটা ওপেন করল। একটা ভিডিও পাঠিয়েছে, সাথে একটা টেক্সট। টেক্সটে ইংরেজি বর্ণে লেখা আছে, "ইউজ ইয়ারফোন। এন্ড প্লিজ প্লে দ্য ভিডিও এট টুয়েলভ ও'ক্লক সুইটহার্ট। প্লিজ!"
কুহু ঠোঁট চেপে হাসল। ইয়ারফোন কানে গুঁজে অপেক্ষা করল বারোটা বাজার। ঠিক বারোটায় ভিডিওটা প্লে করল। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এলো নীরবের সুন্দর কন্ঠস্বর,
'নীরবতা! সবার কাছে তুমি কুহু। কিন্তু আমার কাছে তুমি নীরবতা। আমার নিজস্ব নীরবতা। তুমি জানো, আমি সর্বপ্রথম তোমার জন্যে কখন ফিল করেছিলাম? যখন আমার বন্ধুরা তোমাকে র্যাগ করছিল। আর তুমি নিঃশব্দে কাঁদছিলে। কারো নীরব কান্নাও বুঝি এতো সুন্দর হয়? সেই সৌন্দর্য্যেইতো প্রথম ঘায়েল হলাম আমি। তুমি আমার কাছে এতোটা স্পেশাল কেন জানো? বলছি। আগেই জানিয়েছি আমার বাবা-মা দুজনেই ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই মনখুলে কথা বলার মতো কাউকে পাইনি আমি। কেউ শুনতেই চায়নি। চারপাশের এতো কোলাহলে নীরব হয়ে আমার মনের কথা শোনার মতো কেউ ছিলোনা। প্রচন্ড কলহলপূর্ণ জীবনে যখন আমি ক্লান্ত, তখন তুমি একমুঠো নীরবতা হয়ে এলে জীবনে। আমায় বিশ্রাম দিলে। আর আমি হারিয়ে গেলাম তোমার মাঝে। চিরকালের মতো। আমার জীবনে যেসকল কথা যা আমি কাউকে বলতে পারিনি, সেসকল কথা আমি তোমাকে বলেছি। কারণ তুমিই একমাত্র মানুষ যে চুপচাপ আমার সব কথা শুনেছো। মনোযোগ দিয়ে শুনেছো। কখনও বাঁধা দাওনি। পাল্টা জবাব দাওনি। শুধু আমায় বলে যেতে দিয়েছো। আমার কথাগুলো উপভোগ করেছো। তুমি জানো, আজও যখন ভাবি কুহু নামক এই মিষ্টি মেয়েটা শুধু আমার, শুধুই আমার। তখন আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। আমার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার তুমি নীরবতা। আমার ব্যক্তিগত নীরবতা।
এন্ড ইয়েস, হ্যাপিয়েস্ট বার্থডে মাই ডিয়ার। ধন্যবাদ, এই পৃথিবীতে আসার জন্যে। ধন্যবাদ, আমার জীবনে আসার জন্যে। ধন্যবাদ, আমাদের ভালোবাসার জন্যে। অনেক অনেক অপেক ধন্যবাদ, আমার নিজস্ব নীরবতা হওয়ার জন্যে।'
নীরবের বলা প্রতিটা কথা শব্দের সাথে সাথে ফোনের স্ক্রিনেও লেখা আকারে ভেসে উঠছিল। কী অসাধারণ প্রেজেন্টেশান! কুহু এক হাতে মুখ চেপে ধরে হেসে ফেলল। খুশিতে ওর নাচতে ইচ্ছে হলো। গোটা পৃথিবীকে ওর সাথে নাচাতে ইচ্ছে হলো। ওর অঢেল খুশির মাঝে আরও খানিকটা খুশি ঢেলে দিয়ে ভিডিও কল করল নীরভ। কুহু ভেবে রেখেছিল নীরবের সঙ্গে চারদিন কথা বলবেনা। কিন্তু নিজের সেসব প্রতিজ্ঞা নিমেষেই ভুলে গেল মেয়েটা। আনন্দ, উত্তেজনায় সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করল। স্ক্রিনে নীরবের মুখটা ভেসে উঠতেই চোখ পানি চলে এলো কুহুর। নীরব হেসে বলল, 'শুভ জন্মদিন মাই ডিয়ার উড বি ওয়াইফ।'
কুহু একদৃষ্টতে তাকিয়ে রইল নীরবের দিকে। নীরব ভালো করে লক্ষ্য করে বলল, 'এই মেয়ে কাঁদছো কেন?'
কুহু ইশরায় বলল, 'দুদিন কল করেননি কেন?'
নীরব হাসল। ও এখন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝে। এই দুই বছরে শিখে নিয়েছে। শুধুমাত্র কুহুর জন্যে। নীরব বলল, 'দুদিন কথা বললে আজ এতো আনন্দ পেতে?'
কুহু একহাতে চোখ মুখে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। নীরব ঠোঁট কামড়ে দেখল প্রিয়তমার অভিমান। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, 'এতো সুন্দর একটা সারপ্রাইজ দিলাম। তবুও রাগ করে থাকবে?'
কুহু পাত্তা দিলোনা। তাকালোও না নীরবের দিকে। নীরব বলল, 'যাহ, ভেবেছিলাম কালকেই আমি দেশে ফিরছি, খবরটা দিয়ে একজনকে আরেকটা সারপ্রাইজ দেব। কিন্তু কেউতো শুনছেই না আমার কথা। থাক তাহলে। না বলি।'
কুহু চোখ বড় বড় করে তাকাল নীরবের দিকে। দ্রুত গতিতে হাতের ইশারা করল, 'আপনার না তিনদিন পরে আসার কথা?'
নীরব চমৎকার হেসে বলল, 'কথাতো ছিল। কিন্তু আমার কুহুরাণীর জন্মদিটাতে আমি বাইরে থাকলে চলবে?'
এরমধ্যেই পেছন থেকে কুহুর মাথায় টোকা মারল জ্যোতি। কুহু চমকে পেছনে তাকাল। জ্যোতি হেসে বলল, 'আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সেই সুযোগে প্রেম হচ্ছিলো বুঝি?'
তারপর ইয়ারফোনটা ফোন থেকে খুলে নিয়ে স্পিকারে দিয়ে বলল, 'এইযে নীরব সাহে, এভাবে দূরে থেকে থেকে আমার বোনের সাথে প্রেম করলে হবে? দু সপ্তাহ পরতো বিয়ে। তাড়াতাড়ি চলে আসুন।'
নীরব মাথা চুলকে মৃদু হাসল। লজ্জা পেয়েছে খানিকটা। কোনমতে বলল, 'কালকেই চলে আসব, আপু।'
জ্যোতি অবাক হল। কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল, 'সত্যি? দাঁড়াও আমি উচ্ছ্বাস আর রুদ্র-প্রিয়তাকেও এড করি। কুহুকে উইশ করাও হয়ে যাবে। আর তোমার সাথে ওদের কথাও হয়ে যাবে।'
নীরব অসহায় কন্ঠে বলে উঠল, 'রুদ্র ভাইকে এড করতেই হবে?'
জ্যোতি আর কুহু একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। নীরবকে রুদ্রকে এতো ভয় পেতে দেখে। উচ্ছ্বাস, রুদ্র-প্রিয়তা তিনজনকেই ওদেরএড করা হলো। রুদ্র জয়েন হলেও উচ্ছ্বাসকে পাওয়া গেলোনা লাইনে। তাই রুদ্র নিজেই কল করল উচ্ছ্বাসকে। কল রিসিভ হতেই রুদ্র বলল, 'অনলাইনে এসে কলে এড হ। কুহু আর নীরব আছে।'
উচ্ছ্বাস একটু ভেবে বলল, 'ওহ। আজতো কুহুর জন্মদিন না? আমার কাছে একটা ড্রয়িং সেট চেয়েছিল। ভুলেই গেছি, দেখেছিস?'
'সারাদিন এতো মদ গিললে মনে থাকবেও না। কলে এড হ।' অনেকটা ধমকের সুরে বলল রুদ্র।
উচ্ছ্বাস বিনাবাক্যে তাই করল। অনেকদিন পর ছয়জন বেশ জমিয়ে আড্ডা দিলো অনেক রাত অবধি। তবে রুদ্র আড্ডার অংশিদার ছিলোনা বললেই চলে। যা কথা বলার প্রিয়তাই বলেছে। ও শুধু পাশে শুয়ে ছিল। আর মাঝেমাঝে টুকটাক কথার জবাব দিয়েছে। এদিকে রুদ্রর উপস্থিতিতে নীরবের অবস্থা করুণ। তিন লাইন মনে আসলে, এক লাইন বলে, দুই লাইন পেটে রেখে দেয়। পুরোটা সময় রুদ্রর ভয়ে তটস্থ হয়ে ছিল বেচারা। কল কাটার আগে কুহু ইশারায় বলল, 'ভাবী! ওয়েট, ওয়েট। আমি কী গিফ্ট চেয়েছিলাম মনে আছে তো?'
প্রিয়তা বলল, ' হ্যাঁ সোনা। তোমার গিফ্ট রেডী আছে। আমরা ফিরলেই পেয়ে যাবে। এখন রাখছি। বাই হ্যাঁ?'
উচ্ছ্বাস বলল, 'চুপ কর, ছ্যাচরা! চেয়ে চেয়ে জন্মদিনের গিফ্ট নিচ্ছে সবার কাছে।'
কুহু মুখ ফুলিয়ে ইশারায় করল, 'ভাই, ভাবিদের কাছে চাইব না তো কী বাইরের লোকের কাছে চাইব? খোটা দিচ্ছিস কেন? যখন আমি থাকব না। শ্বশুরবাড়ি চলে যাব। তখন দেখব কে চায় তোদের কাছে। তখন আফসোস করবি।'
উচ্ছ্বাস এক ভ্রু উঁচু করে বলল, 'কেউ কী কবি এই মাইয়া আবার কী কয়? ওর ঐ ডান্সিং ল্যাঙ্গুয়েজে?'
জ্যোতি বুঝিয়ে দিল উচ্ছ্বাসকে। কুহুর যাওয়ার কথা শুনে উচ্ছ্বাসের মনটা কেমন করে উঠল। খুব ভালবাসে এই মেয়েটাকে ও। কীকরে থাকবে ওকে ছাড়া? ওর পেছনে না লেগে, ওকে না জ্বালিয়ে দিন কাটবে কীকরে? তবে মুখে কিছু বলল না। উল্টে ব্যঙ্গ করল কহুর উক্তিকে।
ওদের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কল কেটে দিল প্রিয়তা। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখল রুদ্র চুপচাপ শুয়ে আছে। গভীরভাবে ভেবে চলেছে কিছু একটা। প্রিয়তা আস্তে করে রুদ্রর বুকে মাথা রাখল। নরম গলায় প্রশ্ন করল, 'কী হয়েছে?'
রুদ্র চুপ থাকল কিছুক্ষণ। অতঃপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, 'কয়েকদিন পরেই কুহুর বিয়ে। কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল মেয়েটা। তাইনা?'
'খুব ভালোবাসেন ওকে?'
রুদ্র জবাব দিলোনা। প্রিয়তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ শুয়ে রইল। কেমন অদ্ভুত লাগছে রুদ্রর। অস্থির বোধ হচ্ছে।মনে হচ্ছে ভয়ানক কোন অঘটন ঘটতে চলেছে। খুব ভয়ানক।
-
এদিকে জ্যোতি কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। নীরব আর কুহু এখনো হোয়াটস্অ্যাপে ম্যাসেজিং করছে। নীরব লিখল, 'কাল ভার্সিটিতে যাচ্ছো তো?'
' হ্যাঁ, যাচ্ছি। পরীক্ষা আছে একটা। আপনি কখন আসবেন?'
'আমি কাল সোজা ভার্সিটিতে দেখা করব তোমার সাথে।'
কুহু খুশি হয়ে গেল। লিখল, 'সত্যি!'
' হ্যাঁ সত্যি। আর তোমার বাবাকে বলে, তোমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যাব কাল। প্রয়োজনে ঐ দুই কালো হাতিও সঙ্গে যাবে। নো প্রবলেম।'
কুহুর বিশ্বাস হচ্ছেনা। প্রায় দুই বছর পর নীরবকে দেখতে পাবে। এই প্রথম ভার্সিটির বাইরে কোথায় একসঙ্গে বসবে ওরা, সময় কাটাবে। এটা স্বপ্নের চেয়ে কম কী? কাল ওর জীবনের সেরা জন্মদিন কাটবে। ওর তাই মনে হচ্ছে।
'কী হলো? কিছু বল?'
নীরবের ম্যাসেজ টোনে চমকে উঠল কুহু। ও লিখল, 'সত্যি? মানে সত্যি বলছেন? কাল সত্যি ভার্সিটিতে আমার সাথে দেখা করবেন আপনি? আমাকে নিয়ে বের হবেন?'
'হ্যাঁ রে পাগলী! দুটো বছর হলো আমার প্রাণভোমড়াটাকে ছুঁয়ে দেখিনা। টাইটলি হাগ করে কপালে লম্বা একটা চুমু না খাওয়া অবধি আমার ঘুমই হবেনা।'
কুহু লজ্জা পেয়ে গেল। গাল লাল করে লিখল, 'যাহ!'
' আড়াইবছর যাবত প্রেম করেও এতো লজ্জা? বিয়ের ডেইটটাও তো এগিয়ে আসছে। বিয়েটা একবার হতে দাও। প্রথম রাতেই সব লজ্জা ভেঙে দেব।'
কুহু ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে রাখল কিছুক্ষণ। লম্বা লম্বা দুটো শ্বাস নিলো। তারপর লিখল, 'আমার ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট!'
'দাঁড়াও!'
অফলাইন হতে গিয়েই নীরবের মেসেজ দেখে থেমে গেল কুহু। লিখল, 'কী?'
' আমি তোমাকে ভালোবাসি কুহু। মারাত্মক ভালোবাসি। বাঁচতে পারবনা তোমাকে ছাড়া। চিরকাল আমার হয়েই থেকো প্লিজ।'
' আমিতো আপনারই।'
মেসেজটা পাঠিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অফলাইন হয়ে গেল কুহু। আপনমনেই কিছুক্ষণ হাসল, লজ্জা পেল। এরপর জ্যোতিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করল। যাতে কালকের বিশেষ দিনটার অপেক্ষা দীর্ঘ না হয়।
.
.
.
চলবে........................