আমি যখন ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে অনার্সে নতুন কলেজে ভর্তি হলাম। সেই কলেজের একজনকে প্রথম দেখায় আমার ভালো লেগে গেল। তিনি আমাদের কলেজের অফিস ইনচার্জ ছিলেন। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট, তাকে দেখে আমারও সেটাই হয়েছিল। তার কথা বলার ধরণ, তার হাসি, তার তাকানো এমনকি তারা হাঁটার স্টাইলটাও আমাকে মুগ্ধ করেছে। লম্বায় কত হবে, উমমম আনুমানিক পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। নতুন স্টুডেন্ট হওয়ায় তার সঙ্গে তেমন কথাও বলতে পারতাম না। সাবধানতা অবলম্বন করে অফিসেরই অন্য আরেক স্যারের কাছ থেকে তার নামটা জানলাম। আমি সাধারনত এমন নাম শুনিনি। কিংবা আমার ফ্যামিলিতেও এমন নাম কারো নেই। তাই প্রথম প্রথম একটু অবাকই হয়েছিলাম। তার নামটাই ছিল অবাক করার মতো। ওহ, তার নাম ছিল হামদান আজিজ। মানুষটা চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। আমি ব্যকুল হয়ে থাকতাম তাকে দেখার জন্য। রোজ কোন না কোন বাহানায় অফিসরুমে যেতাম। তার সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য। কিন্তু কখনো সেই সুযোগটা পাইনি। একদিন কলেজে গিয়ে বান্ধবী ঊষাকে ধরলাম।
- ঊষা, হামদান স্যারের নাম্বারটা আমার প্রয়োজন। তুই যেভাবে পারিস আমায় ম্যানেজ করে দে।
ঊষা দুষ্টু দৃষ্টিতে আমায় দেখল। তারপর কাছে এসে গন্ধ শুকে বলল,
- তুই প্রেমে পরেছিস!
আমি এক গাল হেসে বললাম,
- জানি না। তবে তাকে দেখার তৃষ্ণা বেড়েই যাচ্ছে। আমি মনে হয় সত্যি পাগল হয়ে যাব।
ঊষা আমায় অবাক করে বলল,
- চল আমার সঙ্গে। আজ হামদান স্যারের সঙ্গে কথা বলব।
- সিরিয়াসলি!
- ইয়েস। অফ কোর্স। লেটস গো।
ঊষা দারুণ সাহসী একজন মেয়ে। ওর কাছে আমি দুধভাত। ও যা বলে তা করে দেখায়। ফাঁকা আওয়াজ দেওয়ার মতো মেয়ে ঊষা না। সে ঠিকই আমায় নিয়ে অফিসরুমে চলে গেল এবং সরাসরি হামদান স্যারের ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গলা ঝেড়ে কাশিও দিল। আমি তো কেবল চোখের সামনে হামদান স্যারকে দেখতে পেয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম। ঊষা বলল,
- স্যার, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
হামদান স্যার ঊষার কথা শুনে হালকা হেসে বললেন,
- অফ কোর্স। হাউ ক্যান আই হ্যাল্প ইউ?
এত কাছ থেকে হামদান স্যারের কন্ঠস্বর শুনে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। লজ্জায় আমি মাথা তুলতে পারছিলাম না। ঊষা একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,
- স্যার, এটা বুঝতে পারছি না। আপনি কি কাইন্ডলি একটু বুঝিয়ে দিবেন?
হামদান স্যার কাগজে থাকা বিষয়টা ঊষাকে বেশ ভালো মতো বুঝিয়ে দিলেন। সেদিনের মতো আমরা চলে এলাম। অফিসরুম থেকে বের হয়েই ঊষার পিঠে চাপড় মেরে বললাম,
- এটা কী হলো?
- কী হলো?
- আমার নাম্বার লাগত।
- নিশ্চয়ই ফোন করে কথা বলবি। অপরিচিত কেউ সেজে।
- হ্যাঁ।
- এখন আমি যদি তার নাম্বারটা নিই আর তুই যদি ফোন করিস তাহলে সে বুঝে যাবে না যে কাজটা আমিই করেছি। আজকে অফিসে যাওয়ার কারণ হলো একদম সামনা-সামনি তোকে দেখাতে নিয়ে গেলাম। চিন্তা করিস না, নাম্বারটাও জোগাড় করব তবে অন্যভাবে।
আমি অপেক্ষায় থাকলাম। ঊষা আমায় নাম্বার দেবে। আর তারপরই আমি তার সঙ্গে কথা বলব।
প্রায় এক সপ্তাহ পর ঊষা আমায় হামদান স্যারের দিল। আর দাবি করল তাকে এক প্লেট ফুচকা, আর এক প্লেট ভেলপুরি খাওয়াতে হবে। আমিও রাজি। এই নাম্বারটার জন্য আমি ওকে সব কিছু দিতে রাজি। ওইদিন রাতেই আমি হামদান স্যারকে ফোন করি। কয়েকবার ফোন করার পরও সে ফোনটা রিসিভ করেনি। আমিও বিমর্ষ মন নিয়ে ফোনটা বিছানায় রেখে বারান্দায় গিয়ে বসি। কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর ফোনটা বেজে উঠল। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি, আরেহ! হামদান স্যার ফোন করেছে। দরজা লক করে ফোন কানে নিলাম।
- আসসালামু আলাইকুম।
ভারী কন্ঠে কেউ একজন ফোনের ওপাশ থেকে উত্তরে বলল,
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন?
উফ! তার কন্ঠে পাগল হয়ে যাব। এত সুন্দর কন্ঠ হবে কেন, যেই কন্ঠ শোনার পর পাগল হতে হবে। আমি তাকে বললাম,
- আপনার খুব কাছের কেউ।
- আমার কাছের কেউ? কে বলছেন প্লিজ?
- বললাম তো। আপনার খুব কাছের কেউ।
- আমার এত কাছের আপনি! আমি তো চিনতে পারছি না।
- এত তাড়া কীসের? ধীরে ধীরে না হয় চিনলেন।
- তবে তো বলতে হয় আমার খুব কাছের না, আপনি আমার কাছে আসতে চাইছেন।
ইস! এবার মনে হলো আমার ভেতর থেকে প্রাণটা বের-ই হয়ে যাবে। কেউ এভাবে কথা বলতে পারে! তাকে দেখে তো মনে হয় না। যাই হোক, আমি আবারও কথার মেশিন স্টার্ট করলাম।
- আজ আপনাকে মেরুন শার্টে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল। ইংরেজিতে বলি, লুকিং সো ড্যাসিং এন্ড হট।
আমার কথা শুনে হামদান স্যার বললেন,
- এবার বুঝতে পেরেছি আপনি কে?
আমার বুকে ধরাস করে একটা শব্দ হলো। সে আমায় চিনে ফেলল না তো! ঢোক গিলে আমিও কনফিডেন্টলি তাকে বললাম,
- তবে বলুন আমি কে?
- আপনি নিশ্চয়ই কলেজের কোনো পাজি স্টুডেন্ট।
- তবে খুঁজে বের করুন আমায়।
সেদিনের মতো আমাদের কথা শেষ হলো। আমি ফোন রেখে নাম্বারটা অফ করে রাখি। ওহ হ্যাঁ, শুধুমাত্র হামদান স্যারের সঙ্গে লুকিয়ে কথা বলার জন্য নতুন আরেকটা সিম নিয়েছিলাম। এটা সেই নতুন সিম।
যথারীতি এইভাবেই আমাদের কথা চলতে থাকল। রোজ আমি তাকে একটা সময়তেই ফোন করতাম। আমার মনে হতে থাকল সেও প্রত্যেকদিন আমার ফোনের অপেক্ষায় থাকে। আমি আস্তে আস্তে রিয়েলাইজ করতে পারলাম, আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ক্যান ইউ ইমাজিন! আই লাভ হিম। ইয়েস, আই লাভ হিম।
আমার ভালোবাসা ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকল। কলেজে গিয়েই আমার প্রথম কাজ ছিল অফিসরুমের সামনে দিয়ে একবার করে আসা-যাওয়া। কেন সেই আসা-যাওয়া, প্রশ্নের কোন কারণ নেই। উত্তর জানা, হামদান স্যারকে দেখতে।
কলেজে একবার কালচারাল প্রোগ্রাম হলো। প্রোগ্রামের আগের দিন রাতেও আমাদের কথা হয়েছে। সে খুব কৌশলে জানতে চাইল আমি কী রঙের শাড়ি পরব। আমি নিজেরটা না বলে তারটা জেনে নিয়েছিলাম। সে ধূসর রঙের পাঞ্জাবি পরবে বলেছিল। আমিও সেদিন ধূসর রঙেরই শাড়ি পরেছিলাম। তবে সে আমায় দেখতে পায়নি৷ তার চোখ যে ফোনের সেই মেয়েটিকে খুঁজছিল তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। আমি তার সামনেই ছিলাম। অথচ সে আমায় খেয়ালই করেনি।
প্রোগ্রামের দিন রাতে আমাদের আবার কথা হয়। হামদান স্যার আমাকে একটু ধমকে বললেন,
- এই মেয়ে, আমায় নিজের পরিচয় না দিলে আর কখনো ফোন দেবে না।
আমি খানিক ভয়ই পেয়েছিলাম। বললাম,
- এত ঠান্ডা মানুষকে এত রাগলে ভালো লাগে না।
হামদান স্যার আমার কথার পরিবর্তে খুব স্পষ্ট স্বরেই আমাকে জানিয়ে দিলেন,
- আমি এখন ফোনটা রাখব। এরপর নাম্বারটা ব্লক করব। যাতে আর কখনো আমাদের কথা না হয়।
- কেন কেন? এত নরম কন্ঠস্বরে আজ এত কাঠিন্য কেন?
- আমার এত লুকোচুরি ভালো লাগে না। একদম ভালো লাগে না।
- আমাদের দেখা হোক, সেটা আপনি চান?
আমার কথার উত্তরে সে আমায় এমন কিছু বলেছিল যা শুনলে যে কারোই কষ্ট হবে। খুব কষ্ট হবে।
- দেখা হোক বা না হোক। আমি চাই না আমাদের মধ্যে আর লুকোচুরি থাকুক। কে বলতে পারে, এখন তুমি লুকিয়ে থাকলে আমি অপেক্ষা করলাম। যখন তুমি সামনে আসবে বলে ঠিক করলে তখন আমিই দূরে সরে গেলাম।
আমি চমকে গেলাম তার কথা শুনে। কেন সে এমন বলল? আমি আর সময় নষ্ট করতে চাইছিলাম না। পরদিন কলেজে গিয়েই ঊষাকে সব খুলে বললাম। ঊষাও চিন্তিত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ ভাবার পর সে আমায় বলল,
- হামদান স্যারকে বলে দেওয়া উচিত যে ওই মেয়েটা তুই-ই।
- আমার যে ভীষণ ভয় করছে। সব জানার পর আর আমায় দেখার পর যদি সে আমায় মানতে রাজি না হয়।
- তোর এই এডভান্স ভাবনা গুলোই ভালো লাগে না। আগে চল তো। কথা বলি। তারপর না হয় বাকিটা দেখা যাবে।
আমিও ভাবলাম, ঊষা তো ঠিকই বলেছে। আমিই বা এত আগ বাড়িয়ে ভাবছি কেন? আগে কথা বলে দেখি। আমি আর উষা অফিসরুমে গেলাম। তবে সেখানে হামদান স্যার ছিল না। আরেকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম স্যার আজকে আসেনি। মনটা ভেঙে গেল। আমি দ্রুতই অফিস থেকে বের হয়ে সিম অন করলাম আর তাকে ফোন করলাম। সে ফোনটা রিসিভ করল না। আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। ঊষা আমায় অভয় দিয়ে বলল,
- চিন্তা করিস না। আমার মনে হয় স্যার কোন কাজে আছেন তাই ফোন রিসিভ করছেন না। আজকে আর সিমটা অফ করিস না। দেখ সে ফোন করে কি-না।
ঊষার কথামতো আমি সেদিন সিমটা খোলা রেখেছি। তাকে বহুবার ফোন করেছি। সে ফোন রিসিভ করেনি। পরবর্তীতে আমাকে ফোনও করেনি। চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারিনি। ভোরেরদিকে সিম অফ করে বিছানায় পিঠ লাগাতেই চোখে রাজ্যের ঘুম নামে। পরদিন আর কলেজ যেতে পারিনি। কী করে যেতাম? ১০২° জ্বর নিয়ে বিছানায় পড়েছিলাম। অন্যদিকে হামদান স্যারের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমায় কলেজে যেতেই হতো। কিন্তু বাবা মা তো আমাকে যেতেই দেবেন না।
টানা তিনদিন আমি জ্বরে বিছানা থেকে উঠতে পারিনি। ওই মুহুর্তে জ্বরকে চিরশত্রু মনে হচ্ছিল। চোখ জোড়া বেয়ে পানি পড়ছে। মা ভাবছিল হয়তো মাথা ব্যথার জন্যই এই পানি। কিন্তু সকলের আড়ালে আমি তো জানতাম এই পানির আসল রহস্য কী?
এর মধ্যে আমাদের আর কথা হয়নি। সিমটাই যে আর অন করা হয়নি। হয়নি বললে ভুল হবে। অন করতে পারিনি। জ্বরের জন্য মা রাতে আমার কাছেই ঘুমোতেন। আর দিনের বেলায় ইচ্ছে করেই সিম অন করতাম না। কারণ আমি জানতাম দিনের বেলায় সে ভীষণ ব্যস্ত থাকে অফিসে।
জ্বর যেদিন ভালো হলো তার পরদিনই কলেজে গেলাম। ঊষা আমার ক্লান্ত চেহারা দেখে আমায় জড়িয়ে ধরল। বলল,
- অবশেষে তুই আসলি। একটা খারাপ খবর আছে।
আমার ভেতরে ঝড় শুরু হয়ে গেল। প্রচন্ড অশান্তি হচ্ছিল মনে। ঊষাকে জিজ্ঞেস করলাম,
- কী হয়েছে। হামদান স্যার, সে ভালো আছে তো? কী হয়েছে, বল আমায়।
ঊষা আমতা আমতা করে বলল,
- আমি স্যারকে তোর কথা বলে দিয়েছি। স্যার তোকে চিনতে না পারায় আমি তোর ছবি দেখিয়েছি। ছবি দেখানোর পরই তোকে চিনতে পারল।
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম,
- তারপর কী বলল?
- কিছু বলেনি। চুপচাপ চলে গেল।
- তাহলে এখানে খারাপ খবরের কী আছে?
ঊষা চোখ নামিয়ে বলল,
- স্যার চলে যাবে।
- চলে যাবে মানে! কোথায় যাবে?
- স্যার এখান থেকে চট্টগ্রাম চলে যাবে।
আমার কলিজাটা ঢিপঢিপ করছিল। মুহুর্তেই মাথাটা ঘুরে গেল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি দাঁড়িয়েছিলাম, ধুপ করেই নিচে বসে পড়লাম। আমার পড়ে যাওয়া দেখে দুই চারজন এগিয়ে আসে। আমাকে টেনে তুলে। ঊষা তাদের আড়ালেই আমাকে একটা চিরকুট দিয়ে বলল,
- গতকাল তোকে কতবার ফোন করলাম। রিসিভ করিসনি। স্যার গতকালই চলে গেছেন কলেজ থেকে। আগামীকাল সকালের বাসে স্যার চলে যাবেন। যাওয়ার আগে আমায় এই চিরকুটটা দিয়ে বলল তোকে যেনো এটা দিই।
আমি ঊষার হাত থেকে চিরকুটটা নিলাম। তাতে লেখা ছিল,
প্রিয়তে কী লিখব বুঝতে পারছিলাম না। তাই জায়গাটা খালিই রাখলাম। আমি বলেছিলাম না, এমন সময় আসবে, যখন তুমি সামনে আসবে বলে ঠিক করলে তখন আমিই দূরে সরে গেলাম। তোমার বান্ধবীর কাছ থেকে সবটা শুনেছি আমি। ফোনও করেছি তোমায়। তোমার নাম্বার অফ ছিল। জানতে পারলাম যেই নাম্বার থেকে আমার সঙ্গে কথা বলতে সেই নাম্বারটা অফ রাখো। তোমার বান্ধবী আমাকে তোমার আরেকটা নাম্বার দিতে চেয়েছিল। আমিই নিতে চাইনি। শোন, আমি চলে যাচ্ছি। আমাদের হয়তো আর দেখা হবে না। তোমার নাম্বারটা আমি ব্লক করে দিয়েছি। তুমি ভালো থেকো। পড়াশোনা ঠিকমতো কোরো। অনেক বড় হও। আমার তরফ থেকে অনেক অনেক দোয়া রইল তোমার জন্য। যদি ভাগ্যে থাকে, তাহলে কোথাও না কোথাও আমাদের দেখা হবে।
ইতি
হামদান
আমি পাগলের মতো কাঁদলাম। দৌড়ে কলেজ থেকে বের হয়ে গেলাম। আমার পেছন পেছন ঊষাও দৌড়ে বের হলো। দিকবিক ভুলে দৌড়তে গিয়ে একটা রিক্সার ধাক্কাও খেলাম। ফুটপাতের পাশে বসে কাঁদতে লাগলাম। কিছুতেই স্যারের চলে যাওয়াটা মানতে পারলাম না। পারতামই বা কী করে? আমি তো তাকে বলতেই পারলাম না আমি তাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।
পরদিন কিন্তু আমি বাস স্ট্যান্ডে গিয়েছিলাম। চট্টগ্রামে যাবে এমন সবগুলো বাস চেক করলাম। পরে কাউন্টার থেকে শুনলাম আমি সেখানে যাওয়ার দশ মিনিট আগে একটা বাস ছেড়ে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম হয়তো সেই বাসেই হামদান স্যার বসেছিলেন। আমি এখানেও দেরি করে ফেললাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল এইভেবে যে আমি আমার জীবনের সব থেকে জরুরী বিষয়টাতেও দেরি করে ফেললাম। আমার একটু দেরির জন্য আমার প্রিয় মানুষটাকে আমি হারিয়ে ফেললাম।
•••••••••••••
বেঞ্চে বসে থাকা স্টুডেন্টদের চোখে পানি। চোখ থেকে চশমাটা খুলল অবনী। নিজের অতীতের গল্প শোনাতে শোনাতে কখন যে চশমাটা ঘোলাটে হয়ে গেছে বলতে পারবে না অবনী। আঁচল দিয়ে চশমাটা মুছে আবারও চোখে লাগায় সে। তারপর সামনে বসা স্টুডেন্টদের দিকে তাকায়। বলে,
- সেইজন্যই তোমাদের বলছি, যাকে ভালোবাসবে তাকে বলে দেবে যে তুমি তাকে ভালোবাসো। তার যদি হ্যাঁ বলার হয় তো সে বলবে। না বলার হলে না। কিন্তু কখনো আমার মতো ভুল করবে না। প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে কখনো ভালোবাসার কথা লুকাবেনা।
স্টুডেন্টদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করে,
- তার সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়নি ম্যাম?
অবনী হাসে। হাসিতে নিজের কষ্ট লুকায়। বলে,
- নাহ। আর কখনো দেখা হয়নি। আমি আজও ওই সিমটা অন করে রেখেছি। যদি আমাকে ফোন করে, সেই আশায়। ছয়টা বছর কিন্তু কম না। এই ছয়টা বছরে প্রতিটা দিনই একটা ফোনের আশায় থাকি। আমার আশা নিরাশায় ছেয়ে আছে।
ঘন্টার শব্দ দোতলায় শোনা যাচ্ছে। ক্লাস শেষ হয়েছে। স্টুডেন্টদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অবনী নিচে নেমে আসে। ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়াতেই পিওন বলে,
- ম্যাডাম, প্রিন্সিপাল স্যার তার রুমে যেতে বলেছেন। সবাই চলে গেছে। আপনার ক্লাস চলছিল বলে আপনাকে ক্লাস শেষে যেতে বলেছেন।
অবনী চশমাটা ঠিক করে প্রিন্সিপালের রুমে যায়। সেখানে অন্যান্য টিচাররাও ছিলেন। অবনী রুমে যাওয়ার পরই তার পা জোড়া থমকে যায়। প্রিন্সিপাল তৌহিদূর রহমান একজনকে দেখিয়ে বললেন,
- অবনী ম্যাডাম, আপনি লেট করে ফেলেছেন। ভেবেছিলাম সবাইকে একত্রেই পরিচয় করিয়ে দেব। ইনি হামদান আজিজ। আপনাদের ডিপার্টমেন্টে হ্যাড হিসেবে নতুন জয়েন করেছেন।
চেনা দুটো চোখ। চেনা সেই মুখ। চেনা সেই মানুষ। নতুনরুপে আবারও তার সামনে। ছয়টা বছর। ছয়টা বছর লেগে গেল মানুষটাকে একটাবার দেখার জন্য। জল ছলছল চোখে অবনী বের হয় প্রিন্সিপালের রুম থেকে। নিয়তি বড় নিষ্ঠুর খেলা খেলল তার সাথে।
••••••••••••
কলেজের গেটে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে অবনী। হামদানের সঙ্গে পরবর্তীতে তার আর কথা হয়নি। হয়তো অভিমানে কিংবা রাগে। যেই মানুষটা তাকে একটু সময় না দিয়েই হারিয়ে গেল, তার সঙ্গে এত বছর পর কীসের কথা।
হঠাৎ একটা হাত অবনীর হাত ধরে। অবনী পেছনে ফিরেই দেখে চিরচেনা সেই মানুষটা তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। রাশভারি কন্ঠে অবনী বলল,
- এক্সকিউজ মি! আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন?
হালকা হেসে হামদান বলল,
- আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি অবনী।
- আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।
- তুমি মিথ্যা বলতে পারো না। তাই মিথ্যা বোলো না।
অবনী নত স্বীকার করল। চোখ জোড়া বেয়ে নোনাজল পড়ছে তার। চারপাশে তাকিয়ে ফের জিজ্ঞেস করল,
- আমায় একটু সময় দিতে পারতেন? এইভাবে হারিয়ে নআ গেলেও পারতেন। অবশ্য আপনার এই হারিয়ে যাওয়ার পেছনে আমারই দায় ছিল। আপনাকে আর দুষে কী হবে?
হামদান এক পা এগিয়ে গিয়ে অবনীর হাতটা চেপে ধরে বলল,
- কেন, তুমি কী করেছ?
অবনীও নিজের এক পা এগিয়ে দেয়। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,
- আমি কেবল ভালোবেসেছিলাম।
হামদান আর কিছু বলেনি। হঠাৎই সেখানে একটা রিক্সা এলো। হামদান রিক্সায় উঠে হাতটা বাড়িয়ে দিল অবনীর দিকে। অবনীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হামদান বলে,
- ভালো যখন বেসেছো, তোমায় আর ছাড়ছি না। উঠে এসো।
আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অবনী হামদানের এগিয়ে দেওয়া হাতটা শক্ত করে ধরে। তারপর রিক্সায় চড়ে বসে। হামদান রিক্সাওয়ালাকে বলে,
- টি এস সি চলো তো মামা। আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসব। কিছু মান অভিমানের দাফন হবে আজ।
রিক্সাওয়ালাও হাসিমুখে রিক্সায় প্যাডেল মারেন। তখনও অবনীর হাতটা জড়িয়ে রেখেছে হামদানের হাত।
.
.
.
সমাপ্ত.........................................................................