অন্তর্নিহিত কালকূট
পর্ব ৫১
অনিমা কোতয়াল
.
.
.
"ঢাকা বিভাগ জুড়ে পরপর আটটা রহস্যময় খু-ন। এতোদিন যাবত খু-নির সন্ধান করছিলেন গোয়েন্দা বিভাগের সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর, তুহিন আহমেদ। সে আদোও খু-নি অবধি পৌঁছতে পেরেছেন কি-না; তা এখনো ধোঁয়াশা। শোনা গেছে, পলিটিশিয়ান শওকত মীর্জার জেষ্ঠ্য পুত্র শান মীর্জার ওপরেও হয়েছে প্রা'ণ'ঘা'তি হামলা। বর্তমানে শহরের এক হাসপাতালে ( নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) ভর্তি রাখা হয়েছে তাকে। ধারণা করা হচ্ছে, এক্ষেত্রেও জড়িয়ে আছে সেই রহস্যময় ঘা-ত-ক। তবে মিডিয়ায় সামনে এ বিষয়ে এখনই কোনরকম কোন তথ্য দিতে রাজি হননি তুহিন আহমেদ। কয়েকবার চেষ্টার পরেও কোনরকম সাক্ষাৎকারে আনা যায়নি তরুণ এই গোয়েন্দাকে। তবে গতকাল কমিশনারের দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে ধারণা করা যায়, পাওয়া গেছে খু-নির সন্ধান। অপেক্ষা কেবল তাকে পুলিশের আওতায় আনার।"
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল তুহিন। আর পড়ল না। পড়ার প্রয়োজন বোধ করল না। অনেকটা অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মতোই একপাশে ফেলে রাখল খবরের কাগজটা। ধোঁয়া ওঠা কফির মগটা হাতে নিয়ে চলে গেল। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়াল। কনকনে শীত। শরীর কিছুটা গুটিয়ে এলো তুহিনের। জ্যাকেটটা আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিল গায়ে। বাইরে ঘন কুয়াশা। তার দাপটে বেশিদূর কিছু দেখা যাচ্ছেনা। এইমুহূর্তে চারপাশটা সাদাকালো সিনেমার মতো লাগছে তুহিনের। দৃশ্যপট খারাপ না। ভালোই। প্রকৃতির সৌন্দর্য বিশ্লেষণ ছেড়ে কেইসটার দিকে মনোযোগ দিল ও।
খু-নির ছবি মিডিয়া আর নিউজপেপারে দেওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেছিল তুহিন। ও চায়নি খু'নি রুদ্র আমের এখনই টের পাক যে সে ধরা পড়ে গেছে। এমনিতেই প্রচন্ড চালাক মানুষ এই রুদ্র আমের। কোনমতে টের পেয়ে গেলে ওকে ধরা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে যাবে। কাজেই খু'নির খোঁজ যে পাওয়া গেছে; ব্যপারটা সম্পূর্ণ চেপে রাখতে বলা হয়েছিল ডিপার্টমেন্টকে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ থাকে, যারা নিজেদের জাহির করতে না পারলে শান্তি পায়না। অতি উত্তেজনায় নিশ্চয়ই বেফাঁস কিছু বলে বসেছে কমিশনার। না হলে কাগজে এধরণের কথা লিখবে কেন?
কথাগুলো চিন্তা করতে করতে কফির মগে চুমুক দিল তুহিন। আজ একটু দেরী করেই বের হবে। সময়ট ফাঁকা। ইরার সঙ্গে একটু কথা বলা যেতেই পারে। পকেট থেকে ফোনটা বের করল তুহিন। ইরার নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়ে চমকে উঠল হঠাৎ। মনে পড়ে গেল ওদের বিচ্ছেদের কথা। এইতো সেদিনই দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্কের ইতি টেনেছে দুজনে। এখন আর কোন সম্পর্কে নেই ওরা। ওদের পথ এখন আলাদা। তুহিন কখনও ভাবেনি ওদের বিচ্ছেদ এতোটা সহজ হবে। এতো সামান্য কারণে ওরা আলাদা হয়ে যাবে। সামান্য! কারণগুলো কী আদোও সামান্য ছিল? সে বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে গিয়ে কেমন অন্ধকার দেখল তুহিন। মনে হল ঘোলা পানিতে তলিয়ে গেছে। এতো জটিলতম কেইস সহজেই সমাধান করে ফেলা তুহিন আহমেদ এতো সহজ ব্যপারটার সমাধান খুঁজে পেল না।
তুহিন বাস্তববাদী মানুষ। প্রেমে বিচ্ছেদ অস্বাভাবিক কিছু নয়। ও নিজেও যথেষ্ট স্বাভাবিকভাবে নিতে চাইছে ব্যপারটা। তবুও শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে। সত্যিই কী হারিয়ে ইরাবতী আর ওর নেই? সব শেষ? আর কী কিছুই করার নেই? হতাশ হয়ে ফোনটা আবার জায়গামতো রেখে দিল তুহিন। বুকের ভেতর কেমন খাঁ খাঁ করে উঠল ওর। কুয়াশা ঘেরা সকালটাকে ভীষণ অসহ্য দমবন্ধকর মনে হল। উদাস চোখে তাকিয়ে রইল শূণ্যে।
কিছুক্ষণ পর বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়লেন মাহমুদা। কিছুক্ষণ প্রাণভরে দেখে নিলেন তুহিনকে। এমন একটা ছেলে যদি তার থাকতো! সেই আফসোসটাই কখনও ত্যাগ করতে পারেন না মাহমুদা। কিন্তু তার তৃপ্তির জায়গাটাও বিশাল। পেটে ধরেনিতো কী হয়েছে? মায়ের মতো যত্নটাতো করতে পারছে। ভালোবাসাতো দিতে পারছে। এই বা কম কীসে? মৃদু হাসলেন মাহমুদা। মোলায়েম গলায় তুহিনকে ডেকে বললেন, 'বাবা, আজ এখনো বাড়ি যে? অফিস যাবেনা?'
তুহিন ঘন কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, 'যাবো। একটু দেরী হবে।'
' খাবার দেব?'
তুহিন একবার সময়টা দেখে নিল। দায়সারভাবে বলল, 'দাও।'
তুহিন ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখল, মাহমুদা পরোটা আর আলু দিয়ে মুরগির মাংস রান্না করেছেন। খিদেতে পেট চোঁ চোঁ করছে তুহিনের। তাই আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত খেতে বসে পড়ল। মাহমুদা খাবার দিয়ে নিজেও বসল তুহিনের পাশে। তুহিনের দিকে গভীরভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, 'কী হয়েছে বাবা?'
তুহিন খেতে খেতেই বলল, ' কই? কী হবে?'
'তোমাকে দেখছি আমি। কেমন একটা হয়ে আছো। শরীরতো ঠিকঠাকই লাগছে। কোনকারণে মনটা ভালো নেই নাকি?'
তুহিন হাসল। মাহমুদার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল, 'কী দেখে এমন মনে হলো তোমার?'
মাহমুদা তুহিনের প্লেটে আলু দিতে দিতে বলল, 'তোমার চেহারা, হাবভাব দেখে যে কিছু বুঝব সে উপায় রাখো তুমি? কিন্তু তোমাকে সেই ছোটবেলা থেকে চিনি আমি। নিজের হাতে বড় করেছি। তাই এইটুকু বুঝি। কী হয়েছে? ইরা আম্মুর সাথে ঝগড়া করেছো আবার? কিন্তু তোমাদের ঝগড়াতো এক দুইদিনের বেশি থাকেনা। মারাত্মক কিছু?'
তুহিন মলিন হেসে বলল, 'তেমন কিছু না। নতুন কেইসটা নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত আছি, এই আরকি। ঠিক হয়ে যাবে।'
মাহমুদা নিজেও এবার হাসলেন। তুহিনের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, 'মিথ্যে বলে লাভ আছে? কঠিন কাজ পেলে তুমি খুশি হও। বেশি ব্যস্ত হয়ে যাও ঠিকই কিন্তু মনমরা থাকোনা।'
তুহিন কিছুক্ষণ চুপ থাকল। খাবার চিবিয়ে গেলো আনমনে। তারপর হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 'ওর কথা ভুলে যাও খালা। ওর সঙ্গে এখন আর কোন সম্পর্ক নেই আমার। যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে।'
আঁতকে উঠলেন মাহমুদা। নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তুহিনের দিকে। বিস্মিত গলায় বললেন, 'কীসব কথা বলছো বাবা! এসব বলতে নেই। ছোটখাটো মান-অভিমান সব সম্পর্কেই হয়। তাই বলে সম্পর্ক ছিন্ন করতে আছে না-কি?'
' ব্যপারটা এখন আর ছোটখাটো মান অভিমানে আটকে নেই, খালা।'
' তাই বলে এভাবে..। একবার কথা বলেই দেখোনা। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ইরা আম্মুকে চিনি আমি। দেখবে, রেগে থাকতেই পারবে না।'
' ছাড়োনা। ওকে থাকতে দাও ওর মতো। যা ঘটে গেছে, গেছে। ভালো লাগছেনা এসব নিয়ে কথা বলতে আর। আরেক পিস মাংস দাও তো।'
বলে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল তুহিন। মাহমুদা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, 'তুমি যথেষ্ট বুঝদার বাবা। আমার তোমাকে বোঝানোর কিছু নেই। তবে একটা কথা মনে রেখো। অহম্ এক ভয়াবহ বিষ। যে সম্পর্কে একবার অহম্ জায়গা করে নেয়, সে সম্পর্কে বিচ্ছেদ অনিবার্য।'
তুহিন খাওয়া থামিয়ে দিল। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে হেসে নিয়ে বলল, 'ভালো দার্শনিকদের মতো কথাবার্তা বলোতো তুমি! হাইয়ার স্টাডি করলে ভালো কিছু করতে।'
মাহমুদা হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলেন তুহিনের দিকে। উনি জানেন, সবদিক দিয়ে ঠিক থাকলেও এই ছেলের অহম্ মারাত্মক। তুহিনের অন্যতম, বলা চলে একমাত্র ঋণাত্মক বৈশিষ্ট্য এটা। কোনভাবেই মাথা নিচু করতে নারাজ সে।
*
বারোতলা বিশাল এক বিল্ডিং। তার ঠিক ষষ্ঠ তালার এক বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র আমের। পরনে কালো একটা শার্ট, ধূসর রঙের ময়লা জিন্স। গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হালকা কালি পড়ে যাওয়া চোখদুটোতে একটা বাইনকুলার ধরল রুদ্র। খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করল ঠিক কিছুটা দূরের এক হসপিটালে। ওখানকার পাঁচতলা বিল্ডিং এর একটা নির্দিষ্ট কেবিনই তার লক্ষ্য। যা যা দেখা প্রয়োজন তা ঠিক মমতো দেখে নিল রুদ্র। বাইনকুলার নামিয়ে রাখল চোখ থেকে। খালি চোখে সেদিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল সে। সারা দেশজুড়ে খোঁজা হচ্ছে ওকে। অথচ ও এখানে। নিজের লক্ষ্যের ভীষণ কাছে। শান মীর্জাকে ভর্তি করা হসপিটালটার ঠিক পাশের বিল্ডিংয়েই ওর অবস্থান। যে জায়গাটার কথা চিন্তা করাও মুশকিল।
পকেট থেকে সোনালী রঙের একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল রুদ্র। শুষ্ক ঠোঁটের মাঝে একটা সিগারেট চেপে জ্বালিয়ে নিল । মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে নিজের বাঁ হাতের মুঠোটা খুলল রুদ্র। দুটো লকেট। লকেট দুটোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ও। হঠাৎই ঘনঘন কয়েকটা টান দিল সিগারেটে। চোখদুটো ভীষণ জ্বালা করছে ওর। সিগারেটের ধোঁয়ায় নাকি অন্যকারণে জানা নেই রুদ্রর।
*
নিজের কেবিনে বসে ল্যাপটপে কিছু ফাইল ঘাটছে তুহিন। ডার্ক নাইট গ্রুপ আর শওকত মীর্জা সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিচ্ছে। কিন্তু সেখানে ওর মনোযোগ নেই তেমন। ও ভাবছে রুদ্রর কথা। পুরো ডিপার্টমেন্ট লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ওর পেছনে। তবুও ওর টিকির সন্ধানটাও পাচ্ছেনা কেউ। ছেলেটা কী দিয়ে তৈরী? এতৌটা কৌশলে নিজেকে আড়ালে রাখা সম্ভব!
এরমধ্যেই দরজায় এসে উপস্থিত হলো তমাল। ও কিছু বলার আগেই হাতের ইশারায় ভেতরে আসতে বলল তুহিন। তমাল দ্রুত ভেতরে এসে বলল, 'স্যার, রুদ্রকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওর কোন খবর এখনো পর্যন্ত কোন খবর আমাদের কাছে আসেনি স্যার।'
তুহিন যেন জানতো এমন কিছুই বলবে তমাল। তাই ওর মধ্যে হতাশ হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলোনা। ও গভীরভাবে ভাবছে কিছু একটা। কিছুক্ষণ চিন্তা করে তুহিন বলল, 'তমাল, রুদ্র গাধা না। এমন কোন জায়গায় ও যাবেনা যে জায়গার কথা আমরা সহজেই চিন্তা করতে পারব। ও এমন কোথাও আছে যেখানে সহজে ওকে আমরা খুঁজব না। কিংবা খোঁজার কথা ভাবব না।'
'সেটা কোথায় হতে পারে স্যার?' তমালের কন্ঠে তীব্র কৌতূহল স্পষ্ট।
তুহিন চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিল। দু হাতের আঙুলগুলো একত্রিত করে মিনিটখানেক চিন্তা করল। তারপর বলল, 'শান মীর্জা যে হসপিটালে আছে সেখানে আমাদের কড়া সিকিউরিটি আছে। তাইনা?'
' জ্বি স্যার।'
' তারমানে তার আশেপাশের ফ্যাল্ট বা বিল্ডিং গুলোকে নিয়ে আমরা তেমন মাথা ঘামাচ্ছি না। তাইতো?'
তমাল টানা পাঁচ সেকেন্ড তাকিয়ে রইল তুহিনের দিকে। তারপর হালকা হেসে বলল, ' বুঝে গেছি, স্যার।'
' কী বুঝলে?'
' বিল্ডিংগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে এবার।'
তুহিন চোখ বন্ধ রেখেই মৃদু হাসল। তমালের ফোনের আওয়াজে চোখ খুলল তুহিন। কল রিসিভ করে এক মিনিটের মতো কথা বলল তমাল। ফোনটা রেখে সরাসরি তুহিনের দিকে তাকাল তমাল। উত্তেজিত গলায় বলল, 'জ্যোতিকে পাওয়া গেছে, স্যার। নিয়ে আসা হচ্ছে ওকে।'
কথাটা শোনামাত্র ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল তুহিন। যেন বহু কাঙ্ক্ষিত কিছু পেয়ে গেছে। কিছু একটা চিন্তা করে বলল, 'ওর সঙ্গে আর কেউ?'
' না স্যার, জ্যোতিকে রাস্তা থেকেই ধরে আনা হচ্ছে। পালাচ্ছিলো। ওর সঙ্গে আর কেউ ছিলোনা।'
' আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি ঐদিকের বিল্ডিংগুলোতে খোঁজ নাও দ্রুত। জ্যোতিকে ইন্ট্রোগেট আমি করব।'
' জি স্যার।'
কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল তমাল। খুব বেশি হতাশ হয়নি তুহিন। একজন তো পাওয়া গেলো। এবার অনেক কিছু পরিষ্কার হতে শুরু করবে। অনেক অজানা রহস্য থেকে পর্দা উঠবে এবার।
-
একটা চেয়ারে বসানো হয়েছে জ্যোতিকে। বাঁধতে চাইছিল, কিন্তু বারণ করেছে তুহিন। তবে দুজন মহিলা কন্সটেবল দাঁড়িয়ে আছে দুপাশে। জ্যোতির ঠিক মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে আছে ইনভেস্টিগেটর তুহিন আহমেদ। থুতনিতে হাত রেখে জ্যোতির দিকে তাকাল তুহিন। ভালোভাবে পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিল একবার। পরনে ধূসর রঙের সুতি শাড়ি, কালো সুতি কাপরের ব্লাউড। চুলগুলো একপাশে এনে বেনী করে রেখেছে। মাঘের এই শীতেও সারা মুখ ঘামে ভিজে একাকার। ঘনঘন ঢোক গিলছে মেয়েটা। বাঁ হাতের নখ দিয়ে বারবার চেয়ারের হাতলে আঁচড় কাটছে। ডান হাতে আঁচল দিয়ে মুখ মুচ্ছে বারবার। সবকিছুই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে খেয়াল করল তুহিন। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে থেকেই এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। জ্যোতি একবার তুহিনের দিকে, আরেকবার পানির গ্লাসটার দিকে তাকাল। দু সেকেন্ড ইতস্তত করে আর অপেক্ষা করল না। গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিল সবটুকু পানি। পানি খেয়ে ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলল জ্যোতি। স্হির করল নিজেকে। তুহিন কোনরকম তাড়াহুড়ো করল না। জ্যোতির স্বাভাবিক হওয়া অবধি অপেক্ষা করল। জ্যোতি একটু শান্ত হতেই মুখ খুলল তুহিন। শান্ত গলায় প্রশ্ন করল, 'ভালো আছেন?'
জ্যোতি উত্তর দিলোনা। তুহিন উত্তের অপেক্ষাও করল না। নিজের মতো দ্বিতীয় প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, 'আপনাকে এখানে কেন আনা হয়েছে জানেন?'
জ্যোতি এবারেও কোন কথা বলল না। নিচের দিকে তাকিয়ে রইল চুপচাপ। তুহিন এবার তৃতীয় প্রশ্ন করল, 'আমের ভিলাতেই বড় হয়েছেন আপনি। ঠিক বলছি?'
জ্যোতি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, 'জি'
জ্যোতি এতক্ষণে কথা বলায় সেকেন্ডের জন্যে মৃদু হাসল তুহিন। সঙ্গেসঙ্গেই গম্ভীর হয়ে বলল, 'রাশেদ আমেরের সাথে কী সম্পর্ক ছিল আপনার? কেন থাকতেন ঐ বাড়িতে?'
জ্যোতিকে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে উঠতে দেখল তুহিন। যেন গভীর কোন অতীতে হারিয়ে গেল মেয়েটা। স্থির, ধীর কন্ঠে জানাল, 'আমার মা একজন পতিতা ছিলেন। আমার পেটে আসাটাও ছিল এক দুর্ঘটনা। কিন্তু আমি জন্মানোর পর মা আর থাকতে চাননি ওখানে। উনি চাননি ঐ নোংরা পরিবেশে বেরে উঠি আমি। তাই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ঐ পল্লী থেকে পালিয়ে এসেছিল আমায় নিয়ে। কিন্তু শহরে একা এক মহিলা, সদ্যজাত বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাবে বুঝতে পারছিল না আমার মা। বাহিরের শেয়ার কুকুরেরা যেখানে পরিবারের সঙ্গে থাকা মেয়েদেরকেই ছাড়েনা। সেখানে আমার মাতো ছিলো একা, অসহায়।'
বলে থামল জ্যোতি। তুহিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জ্যোতি কথার খেই ধরে বলল, ' তখন মা আমের ফাউন্ডেশনের খবর পায়। জানতে পারে রাশেদ বাবার কথা। উনি নাকি অনেক ডোনেশন দিতেন অসহায় মানুষদের। মা ওখানে গিয়েছিল কটা টাকা দান পাওয়ার আশায়। কিন্তু রাশেদ বাবার হয়তো মায়া হয় ওনার অসহায়ত্ব দেখে। তাই আমাকে সহ মাকে নিয়ে যায় আমের ভিলায়। তারপর থেকেই ঐ বাড়িতে কাজ করতো আমার মা। কিন্তু সেই শান্তি বেশিদিন সহ্য হয়নি মায়ের। ব্রেইন স্ট্রোক করে দু বছরের মাথাতেই চলে গেলেন। বাবারতো পরিচয়ই জানতাম না। আর মাও ঐ বয়সেই_'
আবার থামল জ্যোতির কেঁপে যাওয়া কন্ঠস্বর। তুহিন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কথাগুলো। জ্যোতি থামতেই ও বলল, 'আর তারপর থেকে ঐ বাড়িতেই আছেন আপনি?'
জ্যোতি একবার ওপর নিচে মাথা ঝাঁকালো। তুহিন ভাবল হিস্ট্রি জেনে ওর কোন লাভ নেই। তাই কাজের কথায় আসল। সোজাসুজি প্রশ্ন করল, 'আমের ভিলা আছে, কিন্তু আপনি সেখানে নেই। কেন?'
জ্যোতি চোখ তুলে তাকালো তুহিনের দিকে। হঠাৎই ব্যক্তিত্বে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল ওর। এতক্ষণে চেহারায় লেগে থাকা অসহায় ভাবটা কেটে গেছে। এই মুহূর্তে অদ্ভুত রহস্যময় লাগছে ওকে দেখতে। জ্যোতি বেশ শান্ত গলায় বলল, ' জগতে কোন কিছুই শাশ্বত নয়। বাসস্থানও না।'
তুহিন মাথা নাড়িয়ে বলল, ' ঠিক। সাথে এটাও ঠিক সবকিছুর পেছনেই কারণ থাকে। কেন ছাড়লেন আপনি আমের ভিলা?'
' ওখানে থাকা নিরাপদ ছিলোনা তাই।' সহজ স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল জ্যোতি।
তুহিনের ভ্রু কুঁচকে উঠল। সোজা হয়ে বসে বলল, 'কেন? কী এমন বিপদ ছিল ওখানে?'
' জানিনা।'
' লুকিয়ে ছিলেন আপনি। পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। পুলিশ দেখেও পালাচ্ছিলেন। মানুষ সাধারণত দুটো কারণে পালায়। নিজে কোন অন্যায় করলে, কিংবা তার সাথে কোন অন্যায় হওয়ার ভয় পেলে। আপনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী?'
' দুটোই।' এবারও সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট উত্তর দিলো জ্যোতি।
তুহিন কয়েক সেকেন্ড পলকহীন তাকিয়ে রইল জ্যোতির দিকে। মেয়েটার এমন অতিরিক্ত সোজাসাপ্টা উত্তরে বিরক্ত হওয়ার কথা তুহিনের। হচ্ছেও। কিন্তু তবুও শান্ত থাকল। বিষয়টাকে ওখানেই থামিয়ে তুহিন নতুন প্রশ্ন তুলল, 'রুদ্র কোথায় মিস জ্যোতি?'
জ্যোতি স্থির চোখে তাকাল তুহিনের দিকে। সেটা দেখে তুহিন বলল, 'প্লিজ এটা বলবেন না যে রুদ্রকে চেনেনই না। এইমুহূর্তে হাসার ইচ্ছে নেই আমার।'
জ্যোতি মলিন হেসে বলল, ' ওকে চিনতে অস্বীকার করব? অতোটা সাহস নেই আমার। কিন্তু এখন কোথায় আছে তা আমি জানিনা।'
' মিথ্যে বলছেন আপনি।'
' আমি মিথ্যে বলছিনা স্যার। রুদ্র কোথায় আছে আমাকে বলেনি ও।'
' প্রিয়তাকেও না? প্রিয়তা, মানে রুদ্রর স্ত্রী কোথায় এখন?'
' সেটাও জানিনা।'
তুহিন ভীষণ অবাকই হলো কথাটা শুনে। কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল, 'শেষ কবে দেখা হয়েছিল ওদের দুজনের সাথে আপনার?'
একটু চিন্তা করল জ্যোতি। চিন্তায় ডুবে থেকেই বলল, ' ১১ই জানুয়ারি।'
তুহিন ভেবে দেখল। গুলশানে শেষ খুনটা হওয়ার ঠিক একদিন পর। তারমানে গুলশান ছেড়ে যাওয়ার পর ওরা আর দেখা করেনি জ্যোতির সাথে। কিন্তু কেন? কোথায় ওরা? তুহিন জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটজোড়া। বলল, ' একটা ছোট বাচ্চা ছিল আপনার সাথে। বাচ্চাটা কার?'
' আমার না।'
জ্যোতির এধরণের উত্তরে রেগে উঠছে তুহিন। ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। তবুও পরের প্রশ্ন করল, 'আর বাকিরা? আমের ভিলার বাকিরা কোথায়?'
' কাদের খবর দেব? জীবিতদের নাকি মৃতদের?'
কথাটা প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই ঠান্ডা গলায় কথাটা বলল জ্যোতি। গা কেমন শিরশির করে উঠল তুহিনের। মেরুদন্ড বেয়ে যেন শীতল কিছু একটা নেমে গেল। নিজেকে সামলে বলল, 'মানে?'
জ্যোতি আবার নিরুত্তর রইল। আধ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কিছু বলল না। মেজাজ এবার তুঙ্গে উঠল তুহিনের। সজোরে এক চাপড় বসাল টেবিলে। ধমকের সুরে বলল, 'অনেকক্ষণ যাবত ঠান্ডা গলায় কথা বলছি আপনার সঙ্গে। আর আপনি আমাকে হলিউডের হরর মুভির ফিলিংস দিতে চাইছেন? মজা করছেন আমার সাথে? আপনি জানেন পরপর ন'টা খু-ন করেছে রুদ্র? আরও দুটো খু-ন করতে চলেছে ও।। যেকোন সময় ভয়ানক অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। আপনার সাসপেন্স উপভোগ করার সময় নেই এখন আমাদের।'
তুহিনের কথাগুলো চুপচাপ চোখে চোখ রেখে শুনলো জ্যোতি। হঠাৎই অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ল। তুহিন চমকে উঠল। বোকা বনে গেল ও। কেমন ভৌতিক মনে হচ্ছে জ্যোতির এই হাসি। যেন কোন পিশাচিনী ভর করেছে মেয়েটার ওপর। নিজের অজান্তেই একটা ঢোক গিলে ফেলল তুহিন। কোনমতে হাসি থামিয়ে জ্যোতি বলল, 'আপনি নিশ্চিত, নটা খু-নের সবগুলোই রুদ্র করেছে?'
.
.
.
চলবে............................