অন্তর্নিহিত কালকূট
পর্ব ৬০
অনিমা কোতয়াল
.
.
.
অন্ধকার ঘর। ইলেক্ট্রেসিটি নেই। একটা মোমবাতি জ্বলছে কেবল। মোমবাতির হলদেটে আলোয় মৃদু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে ঘরের একেকটা কোণ। অন্ধকার সেই ঘরময় পায়চারী করে চলেছে প্রিয়তা। বারান্দার দরজাটা খোলা। ওদিকে তাকালে দূরে ঘন জঙ্গল চোখে পড়ে। মৃদু হিমশীতল বাতাস বয়ে আসছে সেদিক থেকে। মোমবাতির আগুনের শিখাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। গা'টা কেমন শিরশির করে উঠল প্রিয়তার। দুচিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছে ও। রুদ্রকে ফোনে পাচ্ছেনা। ঢাকায় ঠিক কী ঘটেছে সেটাও বুঝতে পারছেনা। কেউ কিছু বলছেনা ওকে। তবে এইটুকু বুঝতে পারছে মারাত্মক কিছু ঘটে গেছে কোথাও। রাগে দুঃখে হব ভেঙে গুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে ওর। অপরদিকে ভীষণ চিন্তাও হচ্ছে। এতো মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে থাকা যায়!
দরজায় টোকা পড়তেই চকিতে দরজার দিকে তাকাল প্রিয়তা। রুদ্র এসেছে কি-না ভাবল। আবার টোকা পড়ল। প্রিয়তা কাঁপাকাঁপা গলায় প্রশ্ন করল, 'কে?'
সঙ্গেসঙ্গেই দরজায় ওপাশ থেকে রঞ্জুর কন্ঠস্বর ভেসে এলো, 'ভাবি, দরজা খোলেন। আমি রঞ্জু।'
রঞ্জুর আওয়াজ পেয়ে প্রিয়তা এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। দ্রুত দরজা খুলে দিল। অস্থির গলায় বলল, 'রুদ্র?'
রঞ্জু হাত দিয়ে নাকের নিচের অংশটা মুছে বলল, 'ভাই আপনেরে নিয়া ঢাকা চইলা যাইতে বলছে আমারে। এখনই।'
প্রিয়তা বড়সর ধাক্কা খেলো। আতঙ্কে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো ওর। কোনরকমে বলল, 'উনি কোথায়?'
'আমি জানিনা।' বলার সময় খানিকটা ইতস্তত করল রঞ্জু।
'কখন বলেছেন এটা তোমার ভাই?'
'আমি ভাইয়ের ফোন পাইয়াই ছুইটটা আইছি।'
'কোন বিপদ হয়েছে, রঞ্জু? সবকিছু কেমন যে লাগছে আমার। আর তুমি কক্সবাজার ছিলে? আমি বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে? আমার চিন্তা হচ্ছে।প্লিজ বলো।' প্রিয়তার কন্ঠে স্পষ্ট উদ্বেগ।
রঞ্জু মাথা নিচু করে ফেলল। প্রিয়তার প্রশ্নকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বলল, 'তাড়াতাড়ি তৈর হইয়া নেন ভাবি। আমগো যাইতে হইব।'
প্রিয়তা কিছু ভাবতে পারল না। একহাতে মুখ চেপে ধরে দু কদম পিছিয়ে গেল। রুদ্র এভাবে ওকে চলে যেতে বলেছে! তারমানে নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। প্রিয়তা দ্বিধায় ভুগল। মন সায় দিলোনা রুদ্রকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু প্রিয়তা জানে, ও রাজি না হলে ওকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হবে। সেরকম নির্দেশনা অবশ্যই দিয়েছে রুদ্র। আর রুদ্র এখন কোথায়, কীভাবে আছে তার কোন সঠিক উত্তর রঞ্জুর কাছ থেকে পাওয়া যাবেনা। সেটাও বুঝতে সময় লাগল না প্রিয়তার। প্রিয়তা কয়েক সেকেন্ড কিছু চিন্তা করল। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, 'তুমি বাইরে দাঁড়াও। আমি দু'মিনিটে চেঞ্জ করে আসছি।'
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। রঞ্জু আর অপেক্ষা করল না। প্রিয়তা আর বাকি লোকদের নিয়ে কক্সবাজার ত্যাগ করল।
-
কুহুর জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ হলো। প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই বুঝতে উঠতে পারছিল না মেয়েটা। হঠাৎ সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করে চমকে উঠল ও। ধরধরিয়ে উঠে বসল। উপলব্ধি করল ওর হাতদুটো পেছন মোড়া অবস্থায় শক্ত করে বাঁধা। গালে, ঠোঁটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করল কুহু। চোখ ফেটে দিয়ে জল বেরিয়ে এলো। আস্তে আস্তে মনে পড়ল সবটাই। ভার্সিটির পুকুরপাড়ে নীরবের জন্যে অপেক্ষা করছিল ও। হঠাৎ কেউ নাকে কাপড় চেপে ধরল। তারপর সবটাই অন্ধকার। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে এখানেই আবিষ্কার করে। এরপর? এরপর সেই ভয়ংকর লোকগুলো! ও বের হতে চাইছিল, ওদের কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছিল বলে কী জঘন্যভাবে মারল ওকে। চড়গুলোর কথা মনে পড়তেই শিউরে উঠল কুহু। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। সেই সকালে খেয়ে বেরিয়েছে। দুপুরে নীরবের সঙ্গে একসাথে খাবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। এখন কত রাত! একফোটা পানিও পেটে পড়েনি মেয়েটার। কী ঘটে গেল এসব? কেন ঘটল? কথাগুলো চিন্তা করতেই কান্নার বেগ বেড়ে গেল কুহুর। ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছে বেচারী। ঐভাবে মারার পর জ্ঞান হারানোর আগে একটু পানি চেয়েছিল ওদের কাছে। কিন্তু দেয়নি। নাকি বুঝতে পারেনি!
হঠাৎ আওয়াজ করেই দুজন ছেলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। কুহুর জ্ঞান ফিরেছে দেখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে হাসল। ওদের একজন বলল, 'খুকির জ্ঞান ফিরেছে দেখছে। খবর দে ভাইকে।'
ভয়ে আতঙ্কে গুটিয়ে গেল কুহু। এরা কারা, ওকে কেন ধরে নিয়ে এসেছে, কেন মারছে, কিছুই জানেনা। ঐভাবে মা-র খাওয়ার পর ভীষণ ভয়ে আছে ও। ছোটাছুটি করার সাহসটাও পাচ্ছেনা। নিজেকে যথাসম্ভব গুটিয়ে নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে কেবল। খুব করে আমের ভিলার সবার কথা মনে পড়ছে। রাশেদের কথা, রুদ্রর কথা, প্রিয়তা, উচ্ছ্বাস, জ্যোতি সবার কথা। নীরব? নীরব কোথায় আছে এখন? সেকী ওকে খুঁজতে এসেছিল পুকুরপাড়ে? ওকে খুঁজে না পেয়ে কী অবস্থা হয়েছে নীরবের? ছেলেটাতো একদম পাগলাটে। ঠিক আছেতো? সামলাতে পারছেতো নিজেকে? নাকি নীরবেরও কোন ক্ষতি করে দিয়েছে এরা! চিন্তাটা মাথায় আসতেই দম বন্ধ হয়ে এলো কুহুর।
শান কাছেই ছিল। ফোন করার দুই মিনিটের মধ্যেই এসে হাজির হলো গোডাউনে। ভেতরে এসে একপলক দেখল; গুটিয়ে বসে থাকা অসহায় কুহুকে। মৃদু হাসল ও। জুতোর ছমছমে ঠক ঠক আওয়াজ করে এক পা, এক পা করে এগিয়ে এলো। এক হাঁটু ভেঙ্গে বসল কুহুর সামনে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে এলো কুহুর। এরকম অভিজ্ঞতা এর আগে কোনদিন হয়নি ওর। প্রাণপণে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে, কেন ওর সাথে এরকম করছে এরা? কেন আটকে রেখেছে ওকে? কিন্তু ওতো কথা বলতে পারেনা। শব্দ করার ক্ষমতাও সৃষ্টিকর্তা দেননি ওকে। জানা-অজানা আশঙ্কায় আরও গুটিয়ে বসল কুহু। মিশে রইল দেয়ালের সাথে। ইচ্ছে হল দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে। যাতে কেউ ওকে দেখতে পা পারে। ছুঁতে পা পারে। কেউ না। শান খানিকটা ব্যঙ্গ করে বলল, 'ভয় লাগছে, সুন্দরী?'
কুহু অসহায়, ভীত চোখে তাকাল শানের দিকে। হাত মুচড়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। উল্টে ব্যথা পেয়ে কেঁদে ফেলল। শান চুঁ চুঁ আওয়াজ করে কৃত্রিম সহানুভূতি দেখাল। মাথা নেড়ে বলল, ' সত্যি বলব? তোমার জন্যে মায়া হচ্ছে আমার। দিব্যি ছিলে নিজের পড়াশোনা, ভার্সিটি, ফ্যামলি নিয়ে। সহজ, সরল স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু রাশেদ আমেরের মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই তোমার জীবনের কাল হলো। জানো?'
কুহু কিছু বুঝল না। ভেজা, নিষ্পাপ চোখে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শানের দিকে। শান বলে চলল, 'তোমার বাবা আমাদের পেটে লা-থি মেরে, নিজের সম্রাজ্য তৈরী করেছিল। আর তুমি ছিলে সেই রাজ্যের রাজকুমারী। এখন রাজ্যও আমাদের হাতে আর রাজকুমারীও। এবার আমরা ওনার ঠিক কোথায় কোথায় লা-থি মারতে চলেছে তা কল্পনারও বাইরে। তোমার বাবার আসল পরিচয় জানো?'
কুহু বোকার মতো তাকিয়ে রইল কেবল। ওর বাবাতো বাবাই। তার আবার অন্যকোন পরিচআছে নাকি? কুহুর সহজ-সরল ধারণাকে গুড়িয়ে দিয়ে শান বলল, 'ক্রি-মি-নাল। বর্তমানে দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে বড় ক্রি-মি-নাল তোমার বাবা। এক্চুয়ালি, ছিল বলা যায়। কারণ এখন ওনার কাছে না কোন ক্ষমতা আছে আর না জোর। শুধুমাত্র তোমাকে বাঁচাতেই সব বিসর্জন দিয়েছেন ভদ্রলোক। একমাত্র মেয়ে বলে কথা! তার প্রাণ আর মান দুটোই লোকটার ভীষণ প্রিয়।'
কুহুর নরম মনের ভূমিতে যেন বজ্রপাত ঘটল। প্রচন্ড ঘৃণা লাগল ওর। নিজেকে সামলাতে পারল না আর। হঠাৎই পা দিয়ে সজোরে লা-থি মারল শানের পেটে। ছিটকে মাটিতে বসে পড়ল শান। আচমকা আ-ঘা-তে হকচকিয়ে গেল। পর মুহূর্তে কেঁপে উঠল রাগে। ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল কুহুর দিকে। শানের ঝলসানো দৃষ্টি দেখে আত্মাসহ কেঁপে উঠল কুহুর। আতঙ্কে জোরে জোরে শ্বাস ফেলল।
ক্রোধে ফেটে পড়ে ঠাটিয়ে এক চ-ড় মারল শান কুহুকে। চ-ড়ের দাপটে কাত হয়ে পড়ে গেল কুহু। চুলের মুঠি ধরে টেনে বসানো হল ওকে। অপর হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল ওর নরম গাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, 'একদম মে-রে পুঁতে দেব, শালী! খুব তেজ না? চিনিস আমাকে?'
চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল কুহু। ব্যথায় শ্বাস আটকে এলো যেন। ঝাড়া দিয়ে কুহুকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শান। ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি দুজনকে ডাকল। কুহুর দিকে তাকিয়ে থেকেই শক্ত কন্ঠে বলল, 'কক্সবাজার থেকে রুদ্রর লোকগুলো ঢাকা এলেই এইটাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ততক্ষণ নজর রাখ। ওদিকের কাজ শেষ হলে আমি এসে একে নিয়ে যাব। কোনরকম গন্ডগোল যেন না হয়।'
দুজনেই মাথা নাড়ল। কুহুর দিকে হিংস্র এক দৃষ্টি ফেলে বেরিয়ে গেল শান। শান বেরিয়ে যেতেই ছেলেদুটো একটু দূরে গিয়ে বসল। আয়েশ করে দুজনে দুটো সিগারেট জ্বালাল। মদের বোতল খুলে একদভ নিশ্চিন্তে নেশায় মত্ত হলো দুজন। কুহু সেদিকে তাকিয়ে আরও গুটিয়ে বসল দেয়ালের সাথে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেছে মেয়েটা। তেষ্টা পেয়েছে ভীষণ। শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে গলাটা। মাথা ঝাঁকিয়ে, পা নাড়িয়ে কয়েকবার পানির জন্য অনুরোধ করল কুহু। কিন্তু ছেলেদুটো দেখতেই পেলোনা। তারা নিজেদের নেশায় মত্ত।
-
জঙ্গলের কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে শীতও বাড়ছে সমানতালে। আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসেছে শওকত, সম্রাট, করিম আর পলাশ। করিম আর পলাশের ভয় পুরোপুরি না হলেও অনেকটা কমে এসেছে। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে দুজনেরই। নিশ্চিন্তে বসে বসে হুইস্কি গিলছে এখন চারজন। মাঝেমাঝে সিগারেটের ধোয়া ওড়াচ্ছে। এখন শুধু রুদ্রর লোকগুলো ঢাকা পৌঁছে গেছে তার নিশ্চয়তা চাই ওনাদের। তারপর পরবর্তী পরিকল্পনা সাজাবে। মৌনতা ভেঙ্গে পলাশ বলল, 'বলছিলাম যে রাশেদ আমেরের মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার আগে রুদ্রকে একেবারে প-ঙ্গু করে ফেললে হতো না? মানে উঠে দাঁড়াবার অযোগ্য আরকি। রিস্ক কম থাকতো।'
সম্রাট মুখ দিয়ে 'চ্যাহ' টাইপ একটা শব্দ করল। হুইস্কির গ্লাসটা চোখের সামনে এনে এদিক-ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, 'একটু বেশিই ভয় পান আপনি।'
হঠাৎই নিষ্ঠুর হাসি ফুটল সম্রাটের ঠোঁটে। এক ঢোকে ফাঁকা করে ফেলল গ্লাসটা। ফাঁকা গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বলল, 'কিন্তু আমার কাজটা করতে ভালোই লাগবে। তবে একেবারে না। একটু একটু করে। কয়েক ধাপে। ওদের কক্সবাজার থেকে ঢাকা পৌঁছতে অনেক দেরী। ততক্ষণে_'
বাক্যটা শেষ না করেই উঠে দাঁড়াল সম্রাট। আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল, 'যাই। প্রথম ধাপটা সেড়ে আসি। কী বলেন মীর্জা সাহেব?'
শওকত মীর্জা লম্বা টান দিলেন নিজের সিগারেটে। নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে আমোদিত কন্ঠে বলে উঠলেন, 'যাও যাও। তবে একটা কথা মনে রেখো কিন্তু। ওর বাঁ পায়ের ওপর অধিকার শুধু আমার। ওটা আমার জন্যে ছেড়ে দাও।'
কাঁধ ঝাঁকিয়ে কৌতুকপূর্ণ হাসি দিল সম্রাট। সাগ্রহে এগিয়ে গেল তাঁবুর দিকে। শওকত মীর্জা হো হো করে হেসে উঠল। করিম আর পলাশও নিঃশব্দে হাসলেন। যেন মহা উৎসবের রাত্রি আজ।
রুদ্রর শরীর থেকে শার্ট খুলে নেওয়া হয়েছে আরও আগেই। পরনে শুধুই একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর জিন্স। একদিকে প্রচন্ড শীত; সাথে গালে অযত্নে পড়ে থাকা গভীর জখম। এইমুহূর্তের যন্ত্রণাটা অনুমান করাটাও কষ্টসাধ্য। কিন্তু শারীরিক কষ্টটা বিন্দুমাত্র গুরুত্ব পাচ্ছেনা রুদ্রর কাছে। ওর মন-মস্তিষ্কজুড়ে কেবল কুহু, প্রিয়তা, সোলার সিস্টেম ঘুরছে। কীভাবে বের হবে এখান থেকে? কুহুকে কীকরে বাঁচাবে ওদের কাছ থেকে? সবকিছু কীকরে ঠিক করবে? আর প্রিয়তা? ঠিকভাবে ঢাকা যাচ্ছেতো সে? প্রিয়তার কথা মনে পড়তেই সকালের ঘটনা ভেসে উঠল রুদ্রর মানসপটে-
ব্রেকফাস্ট করে কফির মগ আর একটা জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল রুদ্র। বিশাল সমুদ্রের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবছিল নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। পরিকল্পনায় কোন ফাঁক আছে কি-না, ইত্যাদি। অনেকটা সময় পর যখন প্রিয়তার কোন সাড়া পেলোনা তখন হুশ এলো রুদ্রর। সিগারেট ফেলে ভেতরে এলো। এসে দেখল প্রিয়তা চুপচাপ বসে আছে বিছানায়। রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো। আস্তে করে ডাকল, 'প্রিয়?'
প্রিয়তা চমকালো। হকচকিয়ে তাকাল রুদ্রর দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অদ্ভুত কাজ করে বসল প্রিয়তা। দৌড়ে এসে মুখ লুকালো রদ্রর বুকে। রুদ্র অনেকটা অবাক হলো। মৃদু হেসে প্রিয়তার পিঠে হাত রেখে বলল, 'কী হলো?'
প্রিয়তা আরও ভালোভাবে মিশে রইল রুদ্রর সাথে। রুদ্র এবার প্রিয়তার বাহু ধরে ছাড়িয়ে নিল। দুই বাহুতে হাত রেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল, 'কী?'
প্রিয়তা রুদ্রর চোখে চোখ রাখল। শুকনো ঢোক গিলল। লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে বলল, 'জুনিয়র রুদ্র আমের আসছে।'
রুদ্র তখনই ধরতে পারল না কথাটা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। রুদ্রর ডান হাতটা নিল। অতঃপর আস্তে রাখল নিজের পেটে ওপর। রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলল, 'সোজাভা_'
হঠাৎই ব্যপারটা পরিষ্কার হলো রুদ্রর কাছে। বুঝতে পেরেই থমকে গেল ও। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়তার পেটের দিকে। যেখানে প্রিয়তা রুদ্রর হাত চেপে ধরেছে। বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না রুদ্র। কোনমতে নিজেকে সামলে অস্ফুট স্বরে বলল, 'সত্যি?'
প্রিয়তার চোখ ছলছল করছে। আবেগে আপ্লুত হয়ে মাথা নাড়ল মেয়েটা। রুদ্র বলল, 'বুঝলে কীকরে?'
রুদ্রর কন্ঠে তখনো অবিশ্বাস। যেন ঘোরে আছে ও। চোখের ইশারায় টি-টেবিলে রাখা কিটটা দেখাল প্রিয়তা। নিচু কন্ঠে বলল, 'পিরিয়ড মিস হওয়া, অসময়ে ঘুম আরও কিছু লক্ষণ আগেও টের পেয়েছি। ভেবেছিলাম আগে সোজা ডাক্তার দেখাব। আপনাকে বলেছিলামতো। কিন্তু তার আগেই_। এখানে আসার পর বমি ভাব, মাথা ঘোরা দেখে সন্দেহ গাঢ় হল। ঢাকা ফেরার অপেক্ষা করতে মন চাইল না। তাই সার্ভিসের মহিলাকে দিয়ে ওটা আনিয়েছিলাম। তারপরেই জানতে পারি। আমাদের রাজপুত্র আসছে!'
কথা শেষ হতে না হতেই আচমকা প্রিয়তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রুদ্র। কোন আবেগী শব্দ শোনালো না। সিনেম্যাটিক ডায়লগ বলল না। শুধু প্রিয়তার কপালে গভীর চুমু খেয়ে বলল, 'আমার সমস্ত সুখের চাবিকাঠি তুমি প্রিয়। রাজা-রাণীর সুখের ঘরে এক রাজকন্যার অভাব ছিল কেবল। তুমি সেই অভাব পূরণ করে দিয়েছো।'
প্রিয়তা রুদ্রর বুকে মৃদু আঘাত করে বলল, 'রাজপুত্র!'
রুদ্র হাসল। প্রিয়তার গালে হাত রেখে বলল, 'সে যেই আসুক। হবেতো আমাদেরই তাইনা? আমাদের রাজ্য ঝলমল করে উঠবে তার আগমনে।'
রুদ্রর বুকে কপাল ঠেকিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলেছিল প্রিয়তা। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী নারী সে-
তাঁবুর ভেতরে কারো আসার আওয়াজে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে রুদ্র। সম্রাট এসেছে। হাতে সেই সিমেন্টের খুঁটি। দুজনের চোখাচোখি হলো। রুদ্রর সামনে ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে হাসল সম্রাট। সকৌতুকে বলল, 'এখন কেমন বোধ করছো রুদ্র? সব ঠিক?'
রুদ্র কিছু বলল না। পলকহীন চোখে একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে রইল সম্রাটের দিকে। খুঁটিটা নাড়াতে নাড়াতে রুদ্রর সামনে দিয়ে হাঁটছে সম্রাট। ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি। কয়েক সেকেন্ডের নীরবতার পর সম্রাট বলল, 'এমনিতেতো খুব শক্ত শক্ত ডায়লগ ঝাড়ো। আজ কী হল? কাম অন! রুদ্র আমেরকে এতো শান্ত, চুপচাপ মানায় না।'
রুদ্র চুপ। সম্রাট এবার দাঁড়াল। হালকা ঝুঁকে বলল, 'শুনলাম তোর বউ নাকি প্রেগনেন্ট। ফোনেতো তাই বললি।'
রুদ্র এবার হিংস্র বাঘের মতো তাকাল সম্রাটের দিকে। সম্রাট আরেকটু ঝুঁকল। জঘন্য ইঙ্গিতপূর্ণভাবে হাসি দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, 'তা ঘটনাটা ঘটতে এতো দেরী হলো কেন? দমটা কম কার ছিল? তোর না তোর বউয়ের?'
শরীর ঝাড়া দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল রুদ্র। শিকলের ঝনঝন আওয়াজ হল। প্রচন্ড রাগে অশ্রাব্য কয়েকটা গা-লি বেরিয়ে এলো রুদ্রর মুখ থেকে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, 'যদি বাপের ছেলে হয়ে থাকিস হাত খুলে দিয়ে কথা বল ইউ ব্লাডি বা-স্টা-র্ড।'
ব্যস, এইটুকুই চাইছিল সম্রাট। যে আগুন ও জ্বালাতে চাইছিল তার জন্যে একটু বারুদ প্রয়োজন ছিল। সেটা সে পেয়ে গেছে। রুদ্রর গালিতে রেগেও গেছে ভয়ানক। হিংস্র গর্জন করে সিমেন্টের খুঁটিটা দিয়ে রুদ্রর ঘাড়ে প্রচন্ড বেগে আ-ঘা-ত করল সম্রাট। আঘাতটা সামলে ওঠার আগেই সর্বশক্তি দিয়ে পরপর দুটো গুতো মা-র-ল পাঁজরে। কেবল লম্বা একটা শ্বাস ফেলার অবসর পেলো রুদ্র। তারপরই নিষ্ঠুরভাবে আ-ঘা-তের পর আঘাত করে চলল সম্রাট। লাথিও চালালো সমানতালে। শেষ আ-ঘা-তটা মাথার ঠিক ডানপাশে করল সম্রাট। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এলো রুদ্রর। চেষ্টা করেও বসে থাকতে পারল না রুদ্র। লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। লম্বা প্রশ্বাসের সঙ্গে খানিকটা ধুলো ঢুকে গেলো নাকে। শুকনো দুটো কাশি বেরিয়ে এলো। শেষ আরেকটা লা-থি মেরে রাগে গজগজ করে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল সম্রাট। এদিকে সারা শরীর বেয়ে র-ক্ত ঝড়ছে রুদ্র। দম আটকে আসছে। জ্ঞান না হারালেও ব্যথায়, ক্লান্তিতে চোখ বুজে; মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে রইল রুদ্র আমের।
-
ছেলেদুটোর নাম সেন্টু আর বু-লে-ট। শান অনেক্ষণ হলো গেছে। এখনো ফেরেনি। এদিকে বেশ ভালোই নেশা চড়েছে সেন্টু আর বু-লে-টের। নেশায় মোটামুটি টলছে দুজন। তবে থামছেনা। এখনো অলস ভঙ্গিতে মাঝেমাঝে বোতলে চুমুক দিয়ে চলেছে। সিগারেটে ফুঁকতে ফুঁকতে কখনও কখনও আড়চোখে তাকাচ্ছে কুহুর দিকে।
একপাশে কাত হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে কুহু। চোখজোড়া বন্ধ। কার্নিস বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুর দাগ বোঝা যাচ্ছে। ভীষণ ক্লান্ত মেয়েটা।
আধঘন্টা যাবত কহুকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেন্টু আর বুলেটের মধ্যে। দুজনেই লোভাতুর চোখে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে কুহুর শরীরের প্রতিটা ভাঁজ। নারীলোলুপ নেকড়ের দৃষ্টি থেকে তো ছোট্ট শিশুও রেহাই পায়না। সেখানে কুহুর নিষ্পাপ, আহত মুখ ওকে বাঁচাবে সেটা ভাবা বোকামি। এতক্ষণ বসের অর্ডার আর বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক বিষয় বিবেচনা করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখলেও এবার ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ওরা। মদের নেশা, আর লালসার মিশ্রনে ভেতরের পশুটা পুরোপুরি জেগে উঠছে। কিছুক্ষণ পর সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসল দুজন। নেশায় মত্ত সেন্টু বলল, 'কী বলিস? যাবি?'
বু-লে-ট লোভাতুর দৃষ্টিতে আরেকবার আগাগোড়া দেখল কুহুকে। ঢোক গিলল একটা। কিন্তু মুখে বলল, 'কিন্তু বস?'
'আরে আমরা ওকে মেরে ফেলছি না-কি? আর বসের কাছে জীবিত দিলেইতো হলো। রাশেদ আমেরের মেয়ের কী হলো না হলো তাতে ওনাদের মনে হয়না কিছু যায় আসবে। এমন চান্স বারবার আসেনা, ভাই। খাসা মাল।' বলে জঘন্য ভঙ্গিতে ঠোঁট চেটে নিল সেন্টু।
'ঠিক বলেছিস। এমন চান্স বারবার আসবেনা। মিস করলে চিরকাল আফসোস।' বিশ্রী হাসি দিল বুলেট।
আরও কয়েক চুমুক মদ গিলে নেশাটা বাড়িয়ে নিল। অতঃপর টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল দুজন। নিজেদের জঘন্য উদ্দেশ্য পূরণ করবে এখন তারা। দুজন টলমলে পায়েই এগিয়ে গেল কুহুর কাছে। চোখ বুজে পড়ে থাকা কুহুর দিকে তাকিয়ে দুজনেই জঘন্যভাবে ভাবে হাসল। একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। নিজেদের চোখে চোখেই ঠিক করে নিল নিজেদের অবস্থান। সে অনুযায়ীই দুজন নিঃশব্দে বসল কুহুর দুপাশে। সেন্টু কামুক দৃষ্টিতে আরও কিছুক্ষণ দেখশ কুহুর শরীর। আস্তে করে হাত বুলালো কুহুর দাগ বসে যাওয়া গালটাতে।
কুহু সজ্ঞানে ছিল। কারো এমন ঘৃণ্য স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠল ও। ভয়ার্ত চোখে নিজের দুপাশে তাকাল। ঐ দুজন জঘন্য লোককে নিজের এতো কাছে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল ও। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে নড়ে উঠল। ছটফট করে দূরে সরে যেতে চাইল কিন্তু জায়গা পেলোনা। সেন্টু নিষ্ঠুর এক হাসি দিয়ে কুহুর দুটো পা একসাথে চেপে ধরল। কুহুর ঘাড় থেকে চুলগুলো মুঠো করে সরিয়ে কাঁধে মুখ নিয়ে শুঁকলো বু-লে-ট। দাঁত বের করে হেসে বলল, 'সেন্টুরে! মালটা আসলেই খাসা।'
ঘৃণায় সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল কুহুর। কী ভয়ানক ঘটনা ঘটতে চলেছে বুঝতে পেরে হাতপা ঠান্ডা হয়ে এলো। হাত বাঁধা, কথা বলার ক্ষমতা নেই ওর। চোখের ইশারায় বারবার আকুতি করল দুজনের কাছে। মিনতি করল। সেই দৃষ্টি বারংবার বলছে, "দয়া করে, আমার শরীরে তোমাদের নোংরা স্পর্শ দিওনা। আমি শুধুই আমার নীরবের। আমার ছোঁয়ার অধিকার শুধুমাত্র ওনার। এভাবে অপবিত্র করোনা আমাকে।" ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল কুহুর চখ দিয়ে। কিন্তু দুই পাষন্ড জানোয়ার বুঝল না ওর চোখের ভাষা। বিন্দুমাত্র গলল না ওদের মন। সেন্টু নিজের জঘন্য স্পর্শ দিতে শুরু করল কুহুর শরীরে। কুহু সর্বশক্তি দিয়ে ছটফট করে চলল। ওর অতিরিক্ত ছটফটানীতে ভীষণ বিরক্তি হল বুলেট ওর দুই কাঁধ চেপে ধরে জোর করে শুইয়ে দিল ওকে।
এক টানে কুহুর শরীর থেকে ওড়নাটা টেনে নিল বু-লে-ট।সেফটিপিন দিয়ে আটকানো ছিল বিধায় কামিজের অনেকটা অংশ ফ্যারফ্যার করে ছিড়ে এলো। কুহু করুণ চোখে তাকিয়ে দেখল খানিকটা দূরে ধীর গতিতে পড়তে থাকা লাল ওড়নাটা। এই স্যালোয়ার-কামিজটা নীরব উপহার দিয়েছিল ওকে। ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে। এই দুই বছরে একটাবারও পরেনি ও। সযত্নে তুলে রেখেছিল আজ পড়বে বলে। নীরবের সামনে। ওর মনে পড়ে শপিংমলেএই ওড়নাটা ওর মাথায় তুলে দিয়ে নীরব বলেছিল, 'আমার মিষ্টি বউ।'
চিৎকার করে কান্না পেল কুহুর। সব শক্তি দিয়ে মোচড়াতে শুরু করল। হাত পা ছোড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সেন্টু পা দুটো চেপে ধরায় কিছুই করতে পারল না। অসহায়, নিরূপায় হয়ে দেখে গেল নিজের সর্বনাশ। মাতাল পশুদুটো পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে কুহুর যন্ত্রণায়। নোংরা লালসায় চকচক করছে চোখজোড়া। নিজেদের মধ্যকার সর্বোচ্চ পাশবিকতা প্রদর্শন করছে ওরা আজ। কুহু প্রাণপনে ছটফট করছে। হাত বাঁধা থাকার পরেও ওকে কাবু করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে সেন্টু আর বু-লে-টকে। রেগে গিয়ে দু গালে পরপর আরও কয়েকটা চড় মারল বু-লে-ট। চেপে ধরল ফ্লোরের সাথে। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, ক্লান্তিতে জর্জরিত কুহুর শক্তি বেশিক্ষণ টিকল না। বাধ্য হয়েই আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ল।
চোখে দেখা এই সুন্দর দুনিয়ার লুকায়িত বিষাক্ততা হঠাৎই আজ উপলব্ধি করল কুহু। ওর না দেখা জগতের অন্ধকার ঠিক কতটা গভীর তা আজ গিয়ে জানল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছা করল কুহুর। কষ্ট, যন্ত্রণায় সারা শরীর যেন ঝলসে গেল। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল করুণ আর্তনাদ। বার কয়েক কেঁপে উঠল। নিঃশ্বাস নিতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। গলা ফেটে যাচ্ছে প্রচন্ড তৃষ্ণায়। একটু পানির জন্যে বহু কষ্টে মুখ ফাঁক করল মেয়েটা ঘনঘন শ্বাস নিল। চোখের সামনে সবকিছুই অন্ধকার মনে হলো।
রাশেদের বুকে গিয়ে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছা হলো ওর। রুদ্রর কাছে ঠোঁট ফুলিয়ে হাজারটা অভিযোগ করতে ইচ্ছে হলো এই নিষ্ঠুর থিবীর নামে। প্রিয়তা, উচ্ছ্বাস, জ্যোতিকে জানাতে ইচ্ছে হলো ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। কষ্টে মরে যাচ্ছে ও। নীরবের বলা সেই শেষ কথাটা মনে পড়ল ওর, 'আমি তোমাকে ভালোবাসি কুহু। মারাত্মক ভালোবাসি। বাঁচতে পারব না তোমাকে ছাড়া। চিরকাল আমার হয়েই থেকো প্লিজ।" কুহুর চোখ দিয়ে নীরব ধারায় জল গড়িয়ে নামল। নীরবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করল, "আমিও ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। আমি আপনার নীরব। শুধুই আপনার।"
ভোটকা গন্ধ ওয়ালা পুরোনো ঐ গোডাউন আর অবহেলায় পড়ে থাকা লাল ওড়নাটা সাক্ষী হয়ে রইল এক নির্মম, নিষ্ঠুর, কাঁপিয়ে তোলা ঘটনাক্রমের।
-
একসঙ্গেই তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করল শওকত, করিম, পলাশ আর সম্রাট। চারজনই। রুদ্র তখনও উপুড় হয়ে পড়ে আছে। স্যান্ডো গেঞ্জিটার একাংশ ছিড়ে গেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গা রক্ত জমাট বাঁধা লালচে দাগ। কোন কোন জায়গা ফেঁটে র-ক্ত ঝড়ছে। মুখের ডানপাশে কপাল থেকে শুরু করে চিবুক বেয়ে গলার নিচ পর্যন্ত র-ক্তে লাল হয়ে আছে ওর। গেঞ্জির কিছুটা অংশও ভিজে উঠেছে রক্তে। মৃদু কাশি দিচ্ছে রুদ্র। সম্রাট এসে বসল রুদ্রর পাশে। চুলের মুঠি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরল। মুঠি ধরেই সোজা করে বসালো ওকে। রুদ্র ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে দুটো কাশি দিল। বস্তায় হেলান দিয়ে তাকাল ওদের দিকে। এবার শওকত নিজেই এগিয়ে এলো। রুদ্রর সামনে এসে বসল। তার হাতে একটা স্ক্রু ড্রাইভার। রুদ্র ক্লান্ত গলায় বলল, 'কুহু কোথায়?'
'আছে। নিরাপদেই আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার লোক ঢাকা পৌঁছে যাবে। আর কুহুকেও ছেড়ে দেওয়া হবে।'
রুদ্র কিছু বলল না। শওকতও কোনরকম কথা না বাড়িয়ে রুদ্রর বাঁ পায়ে হাত বুলালো। চোখে ব্যঙ্গ, কৌতুক ঝিলিক দিচ্ছে তার। মুখে হাসি ধরে রেখে পা টা খানিকটা শূণ্যে তুলে নিল সে। রুদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শওকত সস্নেহে পায়ে হাত বুলালো রুদ্রর পায়ে। নরম গলায় বলল, 'লোহার ধারাল চাকাগুলো যখন ঘ্যাচঘ্যাচ করে পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায় তখন কেমন লাগে জানো রুদ্র?'
রুদ্র জবাব দিলোনা। তাকিয়ে রইল কেবল। হঠাৎই স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে রুদ্রর পায়ে আ-ঘা-ত করল শওকত। ড্রাইভারটা ঢুকে পুরো হাড়ে গিয়ে ঠেকল। সজোরে চেঁচিয়ে উঠল রুদ্র। ব্যথায় নীল হয়ে গেল চেহারা। আকস্মিক এই আঘাতটা আশা করেনি ও। শওকতের মুখে ফুটে উঠল হিংস্র হাসি। রুদ্র হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ড্রাইভারটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুবই নির্মমভাবে পা থেকে বের করল শওকত। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা সহ্য করল রুদ্র। কিন্তু চোখ-মুখ লালচে রঙ ধারণ করেছে। গলার শিরাটা ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এখানেই থামল না সেই নিষ্ঠুরতা।এভাবে পরপর তিনবার আ-ঘা-ত করল শওকত। পরেরবারগুলোতে রুদ্র চেঁচাল না। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে সহ্য করল। বাচ্চা ছেলের খেলে মন ভরে গেলে যেভাবে খেলনা ফেলে দেয়। সেভাবেই স্ক্রু ড্রাইভার ফেলে দিল শওকত। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, 'ন্যাহ্। ঠিক জমছে না। নতুন কী করা যায় বলোতো? হ্যাঁ! শুধু মাংস ফু টো হলে কী আর মন ভরে? হাড় ফুটো হলে তবেই না শান্তি।'
শওকত ইশারা করতে একটা ব্যাটরি নিয়ন্ত্রিত ড্রিল মেশিন আনা হলো। শওকত মেশিনটা হাতে নিয়ে বলল, 'এবার খেলাটা জমবে। তাইনা রুদ্র?'
রুদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেশিনটার দিকে। সবটাই পরিকল্পনা করা ছিল। কীভাবে এবং কী দিয়ে ওকে টর্চার করা হবে। সাজিয়ে গুছিয়েই রেখেছে লোকটা। একটুও যে ভয় লাগছেনা তা নয়। কিন্তু এখন ওর কিছু করারও নেই। উপায় না পেয়ে চুপচাপ বসে রইল রুদ্র। ইতিমধ্যে বাঁ পাটা র-ক্তে ভিজে গেছে। রুদ্রর পায়ের পাতা টেনে ধরল শওকত। দেঁতো হেসে বলল, 'এখান থেকে শুরু করি। কী বল?'
বলতে বলতেই মেশিনটা চালু করল। রুদ্র নিজের সমস্ত ইচ্ছাশক্তি একত্রিত করে নিজেকে প্রস্তুত করল এই ভয়ানক যন্ত্রণা সহ্য করার জন্যে। কিছু করার নেই ওর। কিন্তু মেশিনটা রুদ্রর পায়ে ছোঁয়ানোর আগেই শওকতের ফোন বেজে উঠল। আনন্দ উৎসবে ব্যঘাত ঘটায় বিরক্ত হলো শওকত। সম্রাট নিজেও ভীষণ উপভোগ করছিল বিষয়টা। থেমে যাওয়াতে মেজাজ খারাপ হয়েছে ওরও। শওকত মেশিনটা পাশে রেখে ফোনর্ট বের করে দেখল শানের কল। দ্রুত উঠে দাঁড়াল সে। একটু সরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে বললেন, 'হ্যাঁ বল।'
যা শুনলো তাতে চমকে উঠল শওকত। হাতপা ঠান্ডা হয়ে এলো। কথা না বাড়িয়ে সবাইকে ইশারা করে বেরিয়ে গেলেন তাঁবু থেকে। বাকিরাও কিছু বুঝতে পা পেরে দ্রুত বেরিয়ে গেল জঘন্যভাবে আহত রুদ্রকে তাঁবুকে একা ফেলে। চোখ বন্ধ করে শরীর ছেড়ে দিল রুদ্র। আপাতত কিছু চিন্তা করার মতো অবস্থা ওর নেই।
.
.
.
চলবে.........................