তোমায় যবে পাই দেখিতে - পর্ব ১৬ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


" কতবার কল দিয়েছিলাম তার কি হিসাব আছে? "
" হিসাব করার মতো পরিস্থিতি ছিলো না প্রিয়। বাসায় চলো সব বলবো।"
" ঠিক আছে, চলো আমিও যাবো তোমার সাথে। "

দুপুরে আর বাসায় ফেরেনি প্রিয়ন্তি। তিয়াসের সাথে ওদের বাড়ি চলে যায়। তিয়াস হাতমুখ ধুয়ে খাবার খেতে খেতে সবকিছুই খুলে বলছে। প্রিয়ন্তিও তিয়াসের সাথে খাচ্ছে। বাকিরা আগেই খাওয়াদাওয়া শেষ করেছিলো। তিয়াসের মুখে আবরিশামের কথা শুনে বেশ অবাক হয় প্রিয়ন্তি। মানুষটাকে যতটা খারাপ মনে করেছিলো ততটা খারাপ সে নয়। কেবল সঙ্গ দোষে হয়তো মেয়েবাজ হয়ে গেছিলো। মনুষ্যত্ব বেশ আছে। 
" ছেলেটার ভালো হোক। আজ আবরিশাম না থাকলে আমার মেয়ের কী হতো! তোমার সাথে এরকম কিছু ঘটলে প্রিয়ন্তি সহ্য করতে পারতোনা।"
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন অর্পা। তিয়াসের খালামনি ও খালুও একই কথা ভাবছেন। তিয়াস প্লেটে হাত ধুয়ে গামছায় হাতমুখ মুছে প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বললো,
" ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে ঠিক যে দিন ইদ্দতের( দ্বিতীয় বিয়ের নিষেধাজ্ঞা) সময়সীমা শেষ হবে তার পরের দিনই আমরা বিয়ে করবো। আমি আর দেরি করতে চাচ্ছি না আন্টি। এরমধ্যে বাড়িঘরের কাজ শেষ করতেও হবে। "
বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় মাথা নুইয়ে বসে আছে প্রিয়ন্তি। মুরব্বিদের সামনে এটুকু লজ্জা না পেলে তো মেয়ের লাজলজ্জা নেই বলবে! কথাগুলো ভাবতেই আনমনে হেসে উঠে প্রিয়ন্তি। 
" আমরাও সেটাই চাই তিয়াস। তোরা ভালো থাকলেই আমরাও খুশি।"
মজিবুরও তিয়াসের কথায় স্বায় দিলো। ছেলেমেয়েরা ভালো থাকলেই অভিভাবকদের শান্তি। 

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে বিছানায় শুয়ে আছে প্রিয়ন্তি। হঠাৎ করে মনে হচ্ছে আবরিশামকে একবার কল দিয়ে ধন্যবাদ জানানোো দরকার। কিন্তু আবরিশামের ফোন নম্বর তো তার কাছে নেই! এতদিন এক বাড়িতে থেকেও লোকটার ফোন নম্বর পর্যন্ত দরকার পড়েনি তার। এসব ভাবতে ভাবতে শোয়া থেকে উঠে বসলো প্রিয়। এরমধ্যেই একটা অচেনা নম্বর থেকে কল এলো। একটু ভেবে কলটা রিসিভ করলো।
" হ্যালো কে?"
" কী খবর মিনি প্যাকেট? "
প্রিয়ন্তি চমকালো। আবরিশামের কাছে তার ফোন নম্বর ছিলো? 
" আপনি! কেমন আছেন? "
" হুম ভালো। তোমার কী খবর? "
" সবকিছু তো জানেন। আপনাকে কল দিয়ে ধন্যবাদ দিবো ভাবছিলাম কিন্তু নম্বর ছিলো না তো।"
" বুঝতে পেরেছি। "
অর্ষা আবরিশামের পাশেই বসে আছে। একটা জরুরি তথ্য জানাতেই অর্ষা আবরিশামকে প্রিয়ন্তির কাছে কল দিতে বলে। সেইজন্যই এই রাতে কল দেওয়া। আবরিশাম খুব করে চায় প্রিয়ন্তি আর তিয়াসের বিয়েটা দ্রুত হয়ে যাক। 
" আপনি হঠাৎ কল দিলেন?"
" দরকার আছে, আমার হবু বউয়ের কাছ থেকে একটা জরুরি তথ্য জানতে পারলাম। মেয়েটা নামাজি,এসব বিষয় জানে। শোনো,
যে নারীকে বিয়ের পর সহবাসের পূর্বে তালাক দেওয়া হয় তার ওপর কোনও ইদ্দত নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা মুমিন নারীদেরকে বিবাহ করবে অতঃপর তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বেই তালাক দিয়ে দেবে, তাহলে তোমাদের জন্য তাদের কোনো ইদ্দত নেই যা তোমরা গণনা করবে।’ (সুরা আহজাব ৪৯)"
প্রিয়ন্তি দ্বিতীয় বার চমকালো। তাহলে তো বিয়ের জন্য আর অপেক্ষা করতে হবে না। 
" আপনি কেনো আমাদের জন্য এতো ভাবছেন আবরিশাম? আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করতে চাই না। শুধু আপনারাও ভালো থাকুন এটাই চাই ও দোয়া করি। "
" ভালোবাসার মানুষদের একসাথে থাকতে দেখতেও ভালো লাগে। তাছাড়া আজকে যদি সত্যি তিয়াসের বিয়ে হয়ে যেতো কী হতো বলো তো? এজন্য ভাবলাম আর কোনো বাঁধা আসার আগে তোমাদের বিয়ে করে নেওয়া উচিত। আমরাও শীঘ্রই বিয়ে করবো। তোমাদের এলাকায় আমি গেলে কথাকথি হবে এজন্য তোমাদের বিয়েতে যেতে পারবোনা। কিন্তু আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে রাজশাহী আসতে হবে কিন্তু তোমাদের। অবশ্য বিয়ের পরের অনুষ্ঠানের কথা বললাম। তিয়াস নিশ্চয়ই এই গ্রামে আর আসতে চাইবে না!"
" আমরা অবশ্যই যাবো। ভালো থাকবেন, দোয়া রইলো। "
" সেইম টু ইউ, টাটা ডিয়ার।"

কথা শেষ করে অর্ষার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকালো আবরিশাম। মেয়েটা আবার রেগে গেলো না তো? নাহ! হাসি হাসিই আছে মুখখানা। 
" ওদের বিয়ে তো দ্রুত হয়ে যাবে মনে হয়, আমাদের কবে হবে অর্ষা?"
" সেটা তুমি আর বাবা-মা জানো। "
অর্ষা লজ্জা পেয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ছুটে ছাঁদের এক পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো।আজকের চাঁদটা ভীষণ সুন্দর। তাই দু'জনে খোলা আকাশের নিচে বসে চাঁদ দেখছিলো। তখনই অভিমানী স্বরে অর্ষা জানতে চেয়েছিলো প্রিয়ন্তিকে কি সত্যি স্ত্রী'র মর্যাদা দেয়নি সে? আবরিশাম যখন বুঝিয়ে বলে তখনই অর্ষার মনে পড়ে যে,সহবাস না করলে মেয়েদের ইদ্দত পালন করতে হয় না। তাই দ্রুত বিষয়টা প্রিয়ন্তিকে জানাতেও বলে সে। 
" দেখি আমার হবু বউয়ের লজ্জা মাখা মুখখানা। "
আবরিশাম এরমধ্যেই অর্ষার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এক হাতে থুতনি উঁচিয়ে চোখে চোখ রেখে অপর হাতে কোমড় ধরে নিজের কাছাকাছি নিয়ে এলো অর্ষাকে। 
" ছাড়ো আবু ভাই, বিয়ের আগে কোনো ছোঁয়াছুঁয়ি হবে না। "
" বিয়ের পরে কি চব্বিশ ঘণ্টা ছুঁতে দিবি?"
" তুমি খুব অসভ্য। "
" আর তুই পাজি। কতবার বললাম, আবু ভাই বলে ডাকবি না? বিয়ের পরে যদি এই ডাক একবারও শুনি তাহলে এমন অবস্থা করবো যে হাঁটতে পারবিনা।"
অর্ষা নিজেকে আবরিশামের কাছ থেকে ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বড়সড় করে বললো,
" পা ভেঙে দিবে না-কি তুমি? "
" আজ্ঞে না,খাট ভাঙবো। "
অর্ষা আর এক মুহুর্তও ছাঁদে না দাঁড়িয়ে দৌড়ে সোজা নিচে চলে গেলো। আবরিশাম একা একা হাসছে দাঁড়িয়ে। জীবনে কতো মেয়ে এলো গেলো অর্ষার মতো লজ্জাবতী কাউকে দেখেনি। মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে লোকটার। আসলে ছেলেরা যেমনই হোক,স্ত্রী সুন্দর চরিত্রের হবে এটা আশা করে। কিন্তু অন্যের চরিত্র ভালো চাওয়ার আগে নিজের চরিত্র সংশোধন করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

" কী হয়েছে বলো তো? এখন দেখা করতে বললে! আঙ্কেল কোথায়?"
ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে তিয়াস। খুব দ্রুত আসার জন্যই এই হাল তার। একটু আগেই প্রিয়ন্তি হুট করে বললো দেখা করতে হবে, এখুনি। ব্যস এতটুকু বলেই কল কাটলো। তিয়াসও তড়িঘড়ি করে ছুটলো তার প্রিয়র কাছে। বাসার সামনে রাস্তায় চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজনেই। 
" আব্বু ঘুমিয়ে গেছে। তুমি কাল একজন হুজুর কিংবা কাজীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, স্বামীর সাথে সহবাস না করলে তালাকের পরে মেয়েদের ইদ্দত পালন করতে যেহেতু হয় না সেহেতু এখন বিয়ে হলে কোনো সমস্যা আছে কি-না! "
" তোমাকে কে বললো এসব কথা? "
" যা বললাম তাই করো।"
" প্রিয়! তুমি কী শোনালে বলো তো? আমি তো তাহলে কালকেই বিয়ে করে ফেলবো তোমাকে। "
খুশিতে প্রিয়ন্তিকে কোলে তুলে নিলো তিয়াস। কয়েকটা ঘুরানি দিতেই থামতে বললো প্রিয়ন্তি। মাথা ঘুরছে মেয়েটার। তিয়াস প্রিয়ন্তিকে কোল থেকে নামিয়ে সহসাই বুকে জড়িয়ে নিলো। দু'জনের স্পর্শে দু'জনার হৃদয়ে ভালোলাগার রেশ বয়ে যাচ্ছে। এই অনুভূতি আলাদা, শুধুমাত্র কাঙ্খিত মানুষের সান্নিধ্যে এলেই এই ভালোলাগার রেশ অনুভব হয়।
" ধ্যাৎ! তুমি গিয়ে বাসায় বলো। কিন্তু আমি বলেছি সেসব আবার বলবে না। সবাই তাহলে আমাকে বিয়ে পাগলি ভাববে। "
" ঠিক আছে মহারাণী। আমি কালকেই সব কথাবার্তা বলবো বাসায়। "
" এখন এসো তাহলে, রাত হয়েছে। "
" খালি মুখে তো যাচ্ছি না।"
তিয়াসের ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি ফুটে উঠেছে। প্রিয়ন্তির বুঝতে অসুবিধা হলোনা সেটা। হুট করেই বগলে স্পর্শ করে প্রিয়ন্তি। বেচারা তিয়াস হাসতে হাসতে শেষ। প্রিয়ন্তি সেই সুযোগে বাসার মধ্যে ঢুকে গেইট আঁটকে হাসতে লাগলো।
" এবার যাও।"
" সবকিছু হিসাব করে রাখছি প্রিয়। দেখবো কে কতো সুড়সুড়ি দিতে পারে। শুভ রাত্রি! "
" শুভ রাত্রি। "
চুলগুলো হাতের আঙুল দিয়ে এলোমেলো করতে করতে বাড়ির দিকে এগোলো তিয়াস। প্রিয়ন্তি রুমে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। গেটের কথা মনে পড়তেই তিয়াসের দেওয়া বেলি ফুলের কথা মনে পড়লো। আগে তো তিয়াস প্রতিদিন ফুল রেখে যেতো,আসার পরে তো একদিনও ফুল দিয়ে যায়নি! না-কি ওসব আর ইচ্ছে করে না ওর? এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলো প্রিয়ন্তি। 
.
.
.
চলবে.........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন