তোমায় যবে পাই দেখিতে - পর্ব ১৭ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


আগে তো তিয়াস প্রতিদিন ফুল রেখে যেতো,আসার পরে তো একদিনও ফুল দিয়ে যায়নি! না-কি ওসব আর ইচ্ছে করে না ওর? এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলো প্রিয়ন্তি। সত্যি কি তিয়াসের মনে নেই বেলি ফুলের কথা না-কি অন্যকিছু? 

" তাহলে তাই করো। তোমাদের বিয়ের জন্য তো আমিও অপেক্ষায় ছিলাম। অর্পা যখন বলেছে তখন এ সপ্তাহেই বিয়ে হবে। আমার আয়োজনে কোনো ত্রুটি হবে না, নিশ্চিত থাকো।"
বেলা এগারোটার দিকে রেজওয়ানের দোকানে এসে উপস্থিত হয়েছিল তিয়াস। প্রিয়ন্তির কথামতো বাসায় কথা বলেছে সকালেই। তিয়াসের বাড়ির লোকজন বলতে খালা আর খালু। উনারা তো সবাই আগে থেকেই রাজি। অর্পার সাথে কথা বললে তিনি বলেন যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে হলেই ভালো হয়। তাছাড়া সামনে প্রিয়ন্তির নতুন করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তিও আছে। এরমধ্যে বিয়ের ঝামেলা মিটলেই ভালো। রেজওয়ানও স্ত্রী'র কথায় এই সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছেন।
" ঠিক আছে আঙ্কেল। "
" বাবা একটা কথা বলবো? তুমি আমার ছেলের মতো না ছেলেই। আমার তো ছেলে সন্তান নেই, তাই তুমি মেয়ের জামাই আবার তুমিই ছেলে।"
" হ্যাঁ আঙ্কেল, অবশ্যই বলুন।"
রেজওয়ান ইতস্ততবোধ করছে কিছুটা। কিন্তু কিছু করার নেই। মান-মর্যাদা নিয়ে বসে থাকলে প্রিয়তমা স্ত্রী'কে ফিরে পাওয়া যাবে না। তাই সব ভাবনা বাদ দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
" তোমার কথা প্রিয়ন্তির মা ফেলতে পারবে না। তুমি একটু ওকে বলবে,বিয়ের কয়টা দিন যেনো আমাদের সাথে থাকে। তুমি এভাবে বলবে যে, বিয়ের সময় অর্পা তোমাদের বাড়ি থাকলে বিষয়টা ভালো দেখায় না। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো এই কয়দিনে অর্পার কাছ থেকে ক্ষমা পেতে।"
তিয়াস হবু শ্বশুরের চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা একসময় চরম অত্যাচার করেছে প্রিয়ন্তির মা'কে। কিন্তু আজ তার চোখে সেই মানুষটার জন্য তীব্র ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে তিয়াস। সময়ের আবর্তনে আর প্রিয় মানুষের অনুপস্থিতিতে মানুষটা অনুশোচনার অনলে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে গেছে।
" ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করবো। আশা করি এবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। "
" ইনশাআল্লাহ। "

মামার বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরে এসেছে আবরিশাম। আবরিশামের বাবা-মা, বোন সবাই ভীষণ খুশি। কারণ এভাবে যে অর্ষার সাথে বিয়েতে অর্ষার বাবা-মা রাজি হবেন ভাবেনি কেউ। আবরিশামের আকুতিভরা কথোপকথন আর মেয়ের পছন্দের কথা চিন্তা করেই রাজি হয়েছেন তারা। কিছুদিনের মধ্যেই অর্ষার পরিবার রাজশাহী আসবে। দীর্ঘদিন হয় বোনের বাড়ি বেড়াতে আসা হয়নি বেল্লাল হোসেনের। বেরানো হবে সাথে বিয়ের কথাবার্তাও এগোবে। সবকিছুর মধ্যে আনহার খুশি কে দেখে! আনন্দে উড়ছে মেয়েটা। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে ভাইয়ের রুমে এসেছে আনহা। বিয়েতে প্রচুর জিনিস বাগিয়ে নেওয়াই তার প্রধান উদ্দেশ্য। দরজা খোলাই ছিলো। আবরিশাম ল্যাপটপে কিছু করছে। আনহা ঘরে ঢুকতেই আবরিশাম না তাকিয়েই বললো,
" কী রে পড়া বাদ দিয়ে এখানে কেনো?"
" তুমি কীভাবে বুঝলে আমি এসেছি? "
" একটা মাত্র বোন আমার, তার অস্তিত্ব সর্বদা অনুমেয় আমার কাছে। "
আনহা ভাইয়ের পাশের চেয়ারে বসেছে।
" এতো কঠিন কথাবার্তা আমি বুঝি না। সামনে তোমার বিয়ে, বিয়েতে আমার অনেকগুলো নতুন পোশাক লাগবে। "
" অনুষ্ঠান চলবে ২/৩ দিন, তারচে বেশি জামাকাপড় কিনে করবি কী?"
" তুমি যদি আমার মনমতো সবকিছু না কিনে দাও তাহলে কিন্তু অর্ষা আপুকে বলে দিবো।"
আবরিশাম ল্যাপটপ বন্ধ করে এবার বোনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।
" বললে বলবি হুহ্। আপাতত বিয়ে হচ্ছে না। তোর অর্ষা আপু বলেছে বাবার হোটেলে খাওয়া ছেলেকে বিয়ে করবে না সে। এজন্যই চাকরির জন্য আবেদন করলাম কয়েক জায়গায়। "
" তারমানে যতোদিন তোমার চাকরি না হবে ততদিন বিয়ে হবে না? "
আবরিশাম আনহার গাল টিপে দিয়ে হেসে বললো,
" হবে না বোনটি আমার। এখন যাও মন দিয়ে পড়াশোনা করো। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে, ওকে?"
"হুম।"
আনহার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। চাকরি বিয়ের পরে খুঁজলে কী এমন হতো? ভাইকে আরকিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আনহা। ছোটো বোনের নীরবতা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে আবরিশাম। 
রেজওয়ানের কথামতো তিয়াস প্রথমে প্রিয়ন্তিকে বলে তার মা'কে বিয়ের সময় বাড়ি গিয়ে থাকতে। প্রিয়ন্তি ও তিয়াস দুজনেই এক কথা বললে নিশ্চয়ই ফেরাতে পারবেন না তিনি? এটা ভেবেই প্রিয়ন্তিকে বলা। 
" ঠিক আছে। আমি আজকেই মা'কে বলবো। বিয়ের তো মোটে পাঁচ দিন বাকি! আশা করি মা আমার কথা ভেবে হলেও ফিরবে। বাবা যদি আগের মতো থাকতো তাহলে আমি কখনো মায়ের কাছে এই অন্যায় আবদার করতাম না। কিন্তু বাবা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। "
" আমিও এইজন্যই তোমার কাছে বললাম। "
" আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, মাত্র পাঁচ দিন পর আমাদের বিয়ে! "
পার্কের এক পাশের বেঞ্চে বসে আছে দু'জন। কখনো একসাথে ঘোরা হয়নি বলে তিয়াসই বলেছিলো আজকে বিকেলে বাড়ির কাছাকাছি একটা পার্কে যাবে। 
" শোনো না!"
তিয়াসের হাবভাবে প্রিয়ন্তি ঠিক বুঝতে পারছে ছেলের মতিগতি সুবিধার না। আজকাল মাত্রাতিরিক্ত দুষ্ট হয়ে গেছে লোকটা। 
" না শুনছি না আমি। "
" আহা একটু শোনোই না।"
" বললেই তো শুনতে পাই না-কি? "
" যেহেতু সামনেই আমাদের বিয়ে, তাই বিয়ের আগে একটা ওষ্ঠ চুম্বন তো করাই যায় তাই না? "
প্রিয়ন্তি মুহুর্তেই চোখ পাকালো। তিয়াস তা দেখে কিছুটা চুপসে গেলো বটে। পরিস্থিতি ভয়ংকর হওয়ার আশংকায় তিয়াস জায়গা থেকে উঠে অন্য দিকে চলে গেলো। তিয়াস যেতেই ফিক করে হেসে ফেললো প্রিয়ন্তি। কিন্তু লোকটা গেলো কোথায়? পড়ন্ত বিকেল। সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। শীতের সময় এমনিতেই দিনের দৈর্ঘ্য কম হয়। তিয়াস গেলো বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে। এরমধ্যে দু'বার কলও দিয়েছে প্রিয়ন্তি। কিন্তু কেটে দিয়েছে তিয়াস। এবার বেশ খারাপ লাগছে। রাগ করলো না-কি সে? 
" আপনার হাতটা দিন মহারাণী। "
পেছন থেকে হঠাৎ তিয়াসের কন্ঠস্বরে চমকে উঠেছে প্রিয়ন্তি। পিছনে তাকিয়ে একইভাবে বসে রইলো সে। তিয়াসকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে ওর মনে কী চলছে। 
" চুম্বন না হয় নিষিদ্ধ তাই বলে কি হাতও ছোঁয়া যাবে না?"
একটু মনমরা হয়ে বললো তিয়াস। প্রিয়ন্তি দ্রুত নিজের হাতদুটো বাড়িয়ে দিলো তিয়াসের দিকে। তিয়াস মুচকি হেসে পকেট থেকে এক ডজন নীল রঙের কাঁচের চুড়ি বের করে, প্রিয়ন্তির ডান হাতে পরাতে লাগলো। প্রিয়ন্তি ভীষণ খুশি হয়েছে। আনন্দে চোখের কোণে জল এসেছে। তিয়াস মাথা কাত করে ইশারায় কাঁদতে বারণ করে প্রিয়ন্তিকে। চুড়ি পরানো শেষে চোখের পাপড়ির উপর ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে প্রিয়ন্তি। 
" এতো সুখ কি আমার কপালে সহ্য হবে তিয়াস?"
" ভয় পেও না। তোমার কপালে সহ্য হবে কি-না জানি না কিন্তু আমার জন্য নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা একটু হলেও শান্তি লিখেছেন! সারাজীবন তো গেলো একভাবে, বাকিটা জীবন ইনশাআল্লাহ তোমাকে নিয়ে সুখে কাটবে।"
" ইনশাআল্লাহ। তাই যেনো হয়। সন্ধ্যা হয়ে যাবে, চলো বাড়ি যাই।"
" রাত হলে হোক,আজকে রাতের শহরে রিকশায় চড়ে ঘুরবো দু'জন। তার আগে অন্য হাতটা দাও,চুড়ি কি এক হাতের জন্য কিনেছি না-কি শুধু? "
প্রিয়ন্তি হাসলো। বাম হাত এগিয়ে দিলো তিয়াসের দিকে। অন্য পকেট থেকে আবারও একই রঙের চুড়ি বের করে হাতে পরালো। প্রিয়ন্তিও নীল রঙের শাড়ি পরে আছে। নীল শাড়ি,চুড়ি মিলে সব যেনো নীলে ছেয়ে গেছে একেবারে। তিয়াস প্রিয়ন্তির দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অস্ফুটে স্বরে বললো, 
" নীলাম্বরী! "
প্রিয়ন্তি লজ্জা পেলো। লজ্জমাখা প্রিয়ন্তিকে দেখতে আরো বেশি সুন্দর লাগছে তিয়াসের। কী অদ্ভুত অনুভূতি! পৃথিবীতে এত কোটি নারী থাকতেও কেবল এই একটা নারী অবয়বে তিয়াসের চোখজোড়া আঁটকে আছে। ভালোবাসার মানুষের চেয়ে সুদর্শন মানুষ গোটা পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কারণ ভালোবাসার মানুষকে যে মনের চোখ দিয়ে দেখে। আর মনের চোখ দিয়ে দেখলে কোনো খুঁত নজরে আসে না। না তার গায়ের রঙ আর না তার বাহ্যিক সৌন্দর্য! ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরির পরে প্রিয়ন্তিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজেও বাড়ির দিকে এগোলো তিয়াস। আজকে রাতেই হবু শ্বাশুড়িকে বাড়ি ফেরার কথা বলবে বলে সিন্ধান্ত নিয়েছে তিয়াস। 
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন