তোমায় যবে পাই দেখিতে - পর্ব ১৮ - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরির পরে প্রিয়ন্তিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজেও বাড়ির দিকে এগোলো তিয়াস। আজকে রাতেই হবু শ্বাশুড়িকে বাড়ি ফেরার কথা বলবে বলে সিন্ধান্ত নিয়েছে তিয়াস। 

" তিয়াস কিছু মনে করো না। তোমার যদি খুব সমস্যা হয় তাহলে আমি পাশের বাড়িতে গিয়ে থাকবো এই কয়দিন। তারপর তোমাদের বিয়ের পরে আমি অন্য কোথাও চলে যাবো। তবুও আমি ওই বাড়িতে ফিরবো না।"
অর্পার কথায় চমকালো তিয়াস। খাওয়াদাওয়া শেষে হবু শাশুড়ির ঘরে এসেছিল কথা বলার জন্য। 
" না না আন্টি আপনাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার তো মা থেকেও নেই! সেই জায়গায় আপনাকে বসিয়েছি। আপনি আমাদের সাথে আজীবন থাকবেন। তাছাড়া কিছুদিনের মধ্যেই তো আমরা নতুন বাড়িতে চলে যাবো।"

অর্পা জানে এসব কথা নিশ্চিত রেজওয়ানের শেখানো। নইলে একই কথা একসাথে তিয়াস ও প্রিয়ন্তি বলতো না। কিন্তু এসবে কোনো লাভ নেই। মানুষগুলো চিত্ত থেকে একবার উঠে গেলে তাদের জন্য এ জীবনে আর চিত্তে জায়গা হওয়ার নয়। জুতো মেরে গরু দান সব জায়গায় খাটে না। 
" এমনিতেই আমি ভেবেছিলাম তোমাদের সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে তারপর... "
" আমাকে ক্ষমা করবেন আন্টি। আমি না চাইতেও আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। দয়া করে আমাদের ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা আর কখনো বলবেন না। "
অর্পার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিয়াস হাতজোড় করে বলে। অর্পা তিয়াসের হাত ধরে ঠুকরে কেঁদে উঠে। 
" বাবা আমার একমাত্র মেয়ে প্রিয়। তোমার কাছে শুধু এটুকু চাওয়া আজীবন পাশে থেকো ওর। স্বামী সুখ বড়ো সুখ মেয়েদের জন্য। "
" আপনি চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ আমি আজীবন আপনার মেয়েকে একইভাবে আগলে রাখবো।"
" দোয়া রইলো তোমার জন্য।"
তিয়াস মিষ্টি হাসি দিয়ে ঘর ত্যাগ করলো। নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কেবল। না সবকিছু একেবারে ভেঙে গেছে। কোনোভাবে আর প্রিয়ন্তির বাবা-মায়ের সম্পর্ক ঠিক হওয়ার নয়।

পাঁচ দিনের মধ্যেই রেজওয়ান ধুমধামে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করে। স্ত্রী না ফেরায় বুকে এক আকাশ শূন্যতা থাকা স্বত্বেও মেয়ের জন্য অনবরত হেসে যাচ্ছে লোকটা। মানুষের সুখর জীবন নষ্ট করার জন্য একটা ভুলই যথেষ্ট। যদি আসমাকে জীবনে জায়গা না দিতো তাহলে আজ অর্পা এই সংসারে থাকতো। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে দু'জনে হাতে হাত রেখে বাকিটা জীবন পার করে দিতো অনায়াসে। 
আজকের দিনটা অন্য রকম। এরচে সুখের দিন মনে হয় প্রিয়ন্তির জীবনে আর আসেনি। লাল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বউ বেশে পর্দার আড়ালে বসে আছে প্রিয়ন্তি। সাথে বান্ধবীরা আছে কয়েকজন। রিক্তা,স্নেহা তো আছেই! বাইরে থেকে কাজী সাহেব প্রিয়ন্তিকে উদ্দেশ্য করে কবুল উচ্চারণ করতে বলছেন। কী সুন্দর অনুভূতি! তিন কবুল বলে প্রিয়ন্তি সারাজীবনের জন্য তিয়াসের বৈধ ভালোবাসায় আবদ্ধ হলো। খুশিতে তিয়াসের চোখের কোণে পানি জমেছে। এতটুকু জীবনের প্রাপ্তি বলতে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়া। আজ থেকে দু'টি মানব-মানবীর নতুন সংসার শুরু। বিয়ে শেষে রাতেই নতুন বউ নিয়ে ফেরে তিয়াস। সবকিছুর মধ্যে রেজওয়ান ভীষণ একা হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আগেও কতো মানুষজন ছিলো আর এখন! এ ঘরের লক্ষ্মী মেয়েটি আজ পরের ঘরের লক্ষ্মী হয়ে গেছে। অর্পা মেয়েকে বউ বেশে দেখে কান্না সংবরণ করতে পারেনি। প্রিয়ন্তির চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। মেয়েটার জীবনে আজীবন এই খুশির ঝিলিক বজায় থাকুক। 

" অর্ষা!"
" হুম বলো।"
" আমার না!"
" কী বলছো? তোমার না আবার কী?"
ফোনের ওপাশে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে অর্ষা। আজকে যে প্রিয়ন্তি আর তিয়াসের বিয়ে ছিলো সেটা অর্ষা ভালো করে জানে। বেচারা আবরিশামের এজন্যই বিয়ের জন্য মন আনচান করছে।
" আমার বিয়ে বিয়ে ফিলিংস হচ্ছে। চাকরি না হয় পরে পাবো আগে চলো বিয়েটা করে নেই।"
" উঁহু সেটা হবে না। "
" তাহলে আগে বাচ্চা হোক তারপর বিয়ে। আমি যাবো কালকে তোমার কাছে। "
" আবু ভাই! সংযত হও,সংযত হও। নয়তো অর্ষাকে ছোঁয়া তো দূর চক্ষু দর্শনও করতে পারবে না। "
অর্ষার এরকমের কথা শুনে মুহুর্তেই আবরিশামের মুখটা মলিন হয়ে গেছে। সমস্ত মজা যেনো মাটি হয়ে গেছে। 
" অর্ষা! প্লিজ রাগ করো না। আমি ফাইজলামি করেছি। এরকম কথা আর কখনো বলবে না। "
" তাহলে বিয়ের আগে এরকম অসভ্য কথাবার্তাও বলবে না। চাকরি হলেই বিয়ে করবো।"
" আমি যদি চাকরি না করি তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে না? যদি চাকরি পেতে পেতে চার-পাঁচ বছর লেগে যায়? "
অর্ষা নিজেও জানে চাকরি পাওয়া মুখের কথা নয়। অর্ষা শুধু সময় নিয়ে দেখতে চাচ্ছে তার প্রতি আবরিশামের অনুভূতি কি ভালোবাসা না-কি মোহ? মোহ কেটে গেলে সম্পর্কে ফাঁটল ধরে। তাই আগেই বুঝেশুনে সম্পর্কে জড়ানো ভালো। 
"দুই মাসের মধ্যে যদি চাকরি না হয় তাহলে আমরা এমনি বিয়ে করবো।"
" লক্ষ্মী বউ আমার, ভালোবাসি। "
" আমিও ভালোবাসি, রাখছি।"

প্রিয়তমা ফোন কাটতেই রাতের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে আবরিশাম। চাঁদ না-কি প্রিয়তমা কে বেশি মোহনীয়? 

ফুলের গয়না আর হালকা গোলাপি রঙের শাড়িতে সুন্দর করে সেজেগুজে বিছানায় বসে আছে প্রিয়ন্তি। বুকটা কেমন ধুকপুক ধুকপুক করছে। সেহ্না,রিক্তা,শিরীন একটু আগে তিয়াসের কাছ থেকে হাজার টাকার কয়েকটা নোট নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তিয়াস দরজা আঁটকে প্রিয়ন্তির পাশে বসেছে মিনিট পাঁচেক হবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউ কারো সাথে কথা বলে উঠতে পারেনি। শেষমেশ প্রিয়ন্তি আগ বাড়িয়ে তিয়াসকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে উদ্যত হয়। কিন্তু তিয়াস প্রিয়ন্তির হাত চেপে ধরে দু'হাতে। 
" পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হয় না প্রিয়। তোমার জন্য সব সময় আমার দোয়া থাকে। তোমার স্থান আমার পদতলে নয় বক্ষপিঞ্জরের মধ্যে। "
তিয়াস আলতো করে প্রিয়ন্তিকে জড়িয়ে ধরে। প্রিয়ন্তিও তিয়াসের বক্ষে মুখ গুঁজে পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেলে। একটু পর তিয়াস প্রিয়ন্তিকে বাহুডোর থেকে সরিয়ে চোখের ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে। ড্রয়ার থেকে একটা ছোটো বাক্স বের করে নিয়ে আবারও প্রিয়ন্তির পাশে বসে। তারপর পকেট থেকেও আরেকটা ছোট্ট আংটির বাক্স বের করে। 
" এসব কেনো কিনতে গেলে বলো তো?"
" আমার একমাত্র স্ত্রী'র জন্য আমার পক্ষ থেকে সামান্য উপহার, গ্রহণ করেছো?"
হাতে আংটি পরিয়ে দিয়ে মুচকি হাসে তিয়াস। প্রিয়ন্তি লজ্জা মাখা চেহারায় দৃষ্টি সংযত রেখে বলে,
" অবশ্যই! কিন্তু ওই বাক্সে আবার কী?"
" ওয়েট প্রিয় রাণী...... "
প্রিয়ন্তি হাসি হাসি মুখে হাতের বাক্সটা খুলে একে একে সব শুকনো ফুলগুলো প্রিয়নতির দু'হাতে দেয়। প্রিয়ন্তি শুকনো বেলি ফুলে বেশ অবাক হয়েছে। বিস্ময় চাপিয়ে না রাখতে পেরে প্রশ্ন করে উঠে প্রিয়ন্তি। 
" এতগুলো শুকনো বেলি ফুল কোথায় পেলে?"
" কতগুলো বলো তো?"
" হবে দেড় কিংবা দুশোরও বেশি। কিন্তু এগুলো! আগে তো তা-ও তাজা বেলি ফুল দিতে।"
" আজকে তিনশো ত্রিশ দিন পর তুমি আমার কাছে এসেছো। এতদিনের বেলি ফুল আমি সযত্নে এই বক্সে রেখেছি। তুমি ছিলে না বলে ফুলগুলো আর দেওয়া হয়নি। তাই যখন বাড়ি ফিরলে,ভাবলাম আমাদের বিশেষ রাতে এগুলো দেখিয়ে চমকে দিবো তোমাকে। "
প্রিয়ন্তি বাকরুদ্ধ! একটা মানুষ এভাবেও ভালোবাসতে পারে? প্রতিদিন তাকে নিয়ে ভেবেছে তিয়াস! প্রিয়ন্তি তিয়াসকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। তবে এই কান্না অতিরিক্ত খুশির জন্য। 
" এই পাগলি! এভাবে কাঁদছো কেনো? এরচে বেশি ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছি তোমার জন্য এই বুকে।"
" ভালোবাসি! ভালোবাসি! ভালোবাসি। "
" তাহলে আসো ভালোবাসার কিছু চিহ্ন এঁকে দাও আমার বক্ষে।"
প্রিয়ন্তি তিয়াসকে ছেড়ে কয়েকটা ঘুষি মারলো বুকে। 
" অসভ্য হয়ে গেছো খুব। "
" তোমাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াতে হলে একটু তো অসভ্য হতেই হবে। "
তিয়াস এক এক করে প্রিয়ন্তির কানের দুল,গলার গয়না খুলে বালিশের পাশে রাখলো। প্রিয়ন্তি মাথানত করে বসে আছে। কীভাবে যে তিয়াসের দিকে তাকাবে ভাবতেই লজ্জার রেশ যেনো দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়ন্তি কিছু বুঝে উঠার আগেই তিয়াস তাকে কোলে তুলে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। 
" এখানে এলে?"
" নতুন বউকে নিয়ে চন্দ্রবিলাস করবোনা সেটা কি হয়? চাঁদের আলো গায়ে মাখিয়ে আদর করবো তোমাকে। "
" এসব বলবে না আর। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। "
তিয়াস আঙুল দিয়ে প্রিয়ন্তির ঠোঁট চেপে ধরে। কেমন ঘোরলাগা দৃষ্টিতে চাঁদের আলোতে দু'জন দু'জনাকে দেখছে। তিয়াস প্রিয়ন্তির ললাটে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো। বদলে প্রিয়ন্তি লজ্জামাখানো কন্ঠে বললো,
" আমার শীত লাগছে। "
" ঘরে যাচ্ছি, ভাবলাম অন্য কিছু বলবে।"
প্রিয়ন্তি হাসলো শুধু। বড্ড তাড়াহুড়ো লোকটার! 
তিয়াস প্রিয়ন্তিকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে নিজেও পাশে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছে। প্রিয়ন্তির কোমর চেপে ধরে একেবারে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে ফেললো। প্রিয়ন্তি শুধু কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার । প্রথম অনুভূতি সব সময় সুন্দর। 
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন