" তোর ভাই এসব শুনলে চুবানি দিবে গাঙের জলে। মন দিয়ে লেখাপড়া কর,সামনে পরীক্ষা। ভালো রেজাল্ট করলে আমি তোকে ননদী বলে মানবো নইলে বোন হিসেবে সারাদিন গাট্টা মারবো।"
" তুমি তো এরকম ছিলে না? ভাইয়ের সাথে মিশে গাট্টা মারা শিখে গেলে!"
আনহার অভিমানী মুখখানা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে অর্ষা।
" আগে ছিলাম তোর বোন আর এখন হলাম ভাবি।"
" তাহলে আমিও হলাম রায়বাঘিনী ননদিনী। "
আনহা, মিহু, উর্মি সবার হাসছে। অর্ষাও সাথে যোগ দিয়েছে বটে। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না ওদের। আবরিশামের আগমনে অর্ষা বাদে সবাই চুপ মেরে গেলো।
" কী হয়েছে? এতো হাসাহাসির শব্দ হচ্ছিলো ঘর থেকে! "
" তোমার বিয়ে হয়েছে ভাইয়া।"
আনহা দুষ্টমি করে বলতেই আবরিশাম আনহার গাল টিপে দিয়ে বলে,
" পরের নম্বর তোর,রেডি থাকিস।!
"ভাইয়া! তুমি একটা পঁচা। "
" ইশশ! গন্ধ ছুটছে তো, রুম থেকে বেরিয়ে যা এখন।"
আনহা,উর্মি আর মিহু রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অর্ষা ভেংচি কেটে বিছানার একপাশে বসলো।
" ওদেরকে বের কেনো করলে?"
" আদর করবো বউকে তাই। "
অর্ষা ভ্রুচিয়ে বললো,
" তুমি এতো পাজি কেনো আবু ভাই? "
" তুমি আবারও আবু ভাই বলে ডাকলে? "
আবরিশাম অর্ষার হাত ধরে হেচকা টানে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। অর্ষা চোখমুখ বন্ধ করে আছে। এরমধ্যেই আবরিশামের মায়ের কন্ঠস্বর শুনতে পেলো অর্ষা। আবরিশামকে ডাকছেন উনি।
" ফুপি আসছে। "
"এখন যাচ্ছি, মা ডাকছে আমাকে। এসে এরকম দরজা বন্ধ দেখলে লজ্জা পাবো। রাতে মজা দেখাবো,বুঝবে কত ধানে কতো চাল।"
আবরিশাম হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। অর্ষা হাসছে মিটিমিটি। প্রিয়তমকে কাছে পাওয়ার জন্য তো সে-ও মুখিয়ে আছে কিন্তু সেটা তো প্রকাশ করলে আরো পেয়ে বসবে লোকটা! তাছাড়া লজ্জা হলো নারীর ভূষণ। নারী লজ্জায় সুন্দর আর পুরুষ সেই লজ্জার কারণে সুন্দর।
বাসের মাঝামাঝি সিটে বসেছে প্রিয়ন্তি ও তিয়াস। আগামীকাল দুপুরের মধ্যে রাজশাহী পৌঁছে যাওয়ার কথা ওদের । সাই-সাই করে ছুটছে বাস। জানালাগুলো বন্ধ করা আছে। খোলা থাকলে তীব্র বাতাস লাগে। জানুয়ারীর শীতল আবহাওয়ায় চলন্ত বাসে পাশাপাশি বসে ভ্রমণ করাকে ভীষণ উপভোগ করছে প্রিয়ন্তি। তিয়াসের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে সে। বাসের মধ্যে রঙিন আলো জ্বলছে। ওদের মতো আরো অনেক দম্পতি আছে বাসে। আবার অনেকে একাও আছে।
" ঠান্ডা বেশি লাগলে চাদর বের করে গায়ে দাও।"
" না ঠিক আছে। লাগলে বের করবো। তুমি ঘুমাও প্রিয়। "
" তুমিও ঘুমাও।"
তিয়াস আলতো করে ললাটে চুম্বন এঁকে দিলো প্রিয়ন্তির। প্রিয় মানুষ পাশে থাকলে সব সময় সুন্দরতম লাগে।
ফুল দিয়ে সুসজ্জিত খাটে বসে আছে অর্ষা। ঘরের মেঝেতে রঙবেরঙে বেলুনগুলো নড়াচড়া করছে। আবরিশাম নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার স্ত্রী'র দিকে। মনে হয় পৃথিবীর সব সৌন্দর্য আজ অর্ষার মুখশ্রীতে ফুটে উঠেছে। অর্ষা লজ্জায় দৃষ্টিনত করে রেখেছে।
" আমার দিকে তাকাবে না?"
" নাহ,তুমি বাতি নিভিয়ে দাও প্লিজ। "
অর্ষা যে মারাত্মক লজ্জা পাচ্ছে আবরিশাম বুঝতে পেরেছে। সঙ্গীর কমফোর্ট জোন তো সঙ্গীকেই বুঝতে হবে। এজন্য সত্যি আবরিশাম রুমের আলো নিভিয়ে দিয়ে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে রাখে। যাতে করে আবছা দেখা যাবে সবকিছু।
" অর্ষা ভালোবাসি, ডু ইউ লাভ মি?"
" সব কথা কি বলে বুঝাতে হয়? ভালোবাসা কেবল বললেই প্রকাশিত হয় না প্রিয়। "
" বুঝলাম। কিন্তু তোমার মুখে শুনতে চাই। হৃদয়ের তৃষ্ণা নিবারন করো, নয়তো যে..."
অর্ষা আবরিশামের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়।
" আমিও ভালোবাসি।"
আবরিশাম অর্ষার আঙুল সরিয়ে ঠোঁটের দিকে ইশারা করে বলে,
" আঙুল নয় অন্য কিছু দিয়ে ঠোঁট আটকে দেখাও পারলে।"
" ভালো হও বুঝলে।"
" তাই? "
অর্ষা ঠোঁট টিপে হাসছে। আবরিশাম সহসাই বুকে জড়িয়ে ধরে ললাটে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো। দূরে কোথাও থেকে গানের সুর ভেসে আসছে....
এই রাত তোমার আমার
ওই চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কূজনের
এই রাত তোমার আমার
পরের দিন ঠিক যোহরের আজানের দিকে আবরিশামের বাড়ি পৌঁছুলো তিয়াস ও প্রিয়ন্তি। আনহা প্রিয়ন্তিকে দেখেই জড়িয়ে ধরে। প্রিয়ন্তুিও ছোটো বোনের মতো আদর করে দেয় আনহাকে। এ বাড়ির সবার সাথেই একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল প্রিয়ন্তির শুধু আসল মানুষটার সাথে হয়নি। অর্ষা প্রিয়ন্তির সাথে ভালোই মিশে যায় একদিনে। সন্ধ্যার দিকে আত্মীয়রা আসতে শুরু করেছে বাসায়। অর্ষা লাল বেনারসি পরে সুন্দর করে বউ সেজে বসে আছে। পাশে আনহা,মিহু,প্রিয়ন্তি আরো অনেকেই। প্রিয়ন্তিকেও দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। আবরিশাম আর তিয়াস গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে ও অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে।
" কোনো ধরনের অস্বস্তি রাখবে না মনে। আমার ভাই নেই, তুমি আমার বন্ধু প্লাস ভাইয়ের মতো। দুনিয়ার যে যা বলে বলুক আমরা চারজন ঠিক থাকলেই হবে। "
" দুনিয়ার লোকের কথায় আমার যায় আসে না আবরিশাম ভাই। যখন কষ্টে ছিলাম দুনিয়ার কেউ আসেনি খোঁজ নিতে। বরং এসেছিলো তাদের বর্বরতা দেখাতে। "
" মন খারাপ করো না। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যত সুন্দর হবে তোমাদের। "
" আল্লাহ ভরসা। "
আত্মীয়স্বজন,অতিথিরা আসছে আর অর্ষার সাথে কথাবার্তা বলছে। অর্ষার বাবা-মা এসেছেন বিকেলেই। নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তা থাকায় কোনো ধরনের নিয়মকানুন নেই মেয়ের বাড়ির আসায়। হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান হয় না তেমনি সব মানুষও একরকম না। এরমধ্যেই কয়েকজন আড়ালে প্রিয়ন্তি ও অর্ষাকে নিয়ে কথাকথি শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ তো বলছে, আগের বউটাই তো সুন্দরী ছিলো। তাহলে তাকে ছেড়ে এই শ্যামলা মেয়েকে কেনো বিয়ে করলো আবরিশাম? সব কথাই কানে এসেছে অর্ষার কিন্তু এরকম পরিস্থিতি যে সৃষ্টি হবে সে বিষয় আগেই সতর্ক করেছিলো আবরিশাম। তাই নিজেকে একেবারে স্বাভাবিক রেখেছে অর্ষা। ঘরের মানুষ ঠিক থাকলে বাইরের লোকজনের কথায় যায় আসে না।
তিয়াসরা নতুন বাড়িতে উঠেছে আজ। আজ থেকে শুরু হলো নতুন জীবন। অর্পার সাথে রেজওয়ানের শেষ পরিণতি বিচ্ছেদ। প্রিয়ন্তির একটু হলেও খারাপ লেগেছিল। কিন্তু কিছু করার নেই। অর্পা খুব করে চেষ্টা করেছিলো অন্য শহরে গিয়ে কাজ করতে কিন্তু তিয়াস আর প্রিয়ন্তির জন্য পারেনি। শেষমেশ মেয়ে-জামাইয়ের সংসারে উঠতে হলো। তিয়াস শুধু এটুকু বলেছিলো,স্বামীর মাকে যদি স্ত্রী মা বলে সারাজীবন একসাথে থাকতে পারে তাহলে স্ত্রী'র মায়ের সাথে কেনো নয়? মা তো মা-ই হয়। সামনে প্রিয়ন্তির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে। তাই ইদানীং সংসারের পাশাপাশি পড়ালেখায় মনোযোগী হয়েছে সে। রান্নাবান্নার কাজ প্রায় অর্পা করে। তিয়াসও মন দিয়ে ব্যবসার কাজ শুরু করেছে। দিন-রাত এক করে গরুগুলোকে মোটাতাজা করে বাজারে তুলছে। পাশাপাশি গরুর দুধ থেকে তো আয় হচ্ছেই। সবমিলিয়ে বেশ সুখে আছে এই দম্পতি।
আনন্দ বেদনার সংমিশ্রণে মানবজীবন। তাই সুখ কিংবা দুঃখ কোনোটাই স্থায়ী নয়। তিয়াসের জীবনেও ছোটো থেকে দুঃখে জর্জরিত থাকলেও ভাগ্যগুণে প্রিয়ন্তিকে পেয়ে সুখের মুখ দেখেছে। সৎ পথে থেকে উপার্জন করলে এবং ধৈর্য ধরে থাকলে একদিন ঠিক ভালো কিছু হয়।
আজকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ক্লাস প্রিয়ন্তির। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াস। হাসি মুখে প্রিয়ন্তি এগিয়ে যাচ্ছে তার স্বপ্নের দিকে। তিয়াসের হাত ধরে একদিন প্রিয়ন্তির জীবনেও সফলতা আসবে।
" প্রিয়!"
" হ্যাঁ বলো।"
" ভালোবাসি! "
" ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। "
.
.
.
সমাপ্ত............................