মিশুর মুখটা দুহাতে ধরে মেঘালয় বললো, 'তুমি যতই বড় সাজার চেষ্টা করো, তোমাকে ততই বাচ্চা বাচ্চা লাগে।'
ভ্রু কুচকে মিশু জবাব দিলো, 'শাড়ি পড়লেও আমাকে পিচ্চি লাগে?'
- 'শুধু কি পিচ্চি? আমি ভাবছি বিয়ের দিন না জানি বাল্যবিবাহ ভেবে পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়।'
বলেই হেসে উঠলো শব্দ করে। মিশু মেঘালয়ের বাহু চেপে ধরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। কত্তদিন পর দেখছে ওকে। মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছে দেখে। মেঘালয় শেভ করেনা কয়েকদিন ধরে। কিন্তু চাপ দাড়ি গুলো ওর আউটলুকের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিশু খেয়াল করে দেখলো মেঘালয়কে কোট টাই পড়ে ফর্মাল ড্রেসে একেবারে ক্যাপ্টেনের মত লাগছে।
ও এগিয়ে এসে মেঘালয়ের গলা ধরার চেষ্টা করলো। কিন্তু মেঘ ওর চেয়ে এতটাই লম্বা যে গলা ধরতে পারছে না। মেঘালয় হাসতে হাসতে একটা ছোট্ট টুল নিয়ে এসে সামনে রেখে বললো, 'ওঠো। উঠে দাঁড়াও আর আমার গলা ধরো।'
হেসে ফেললো মিশু। টুলের উপর উঠতে যাবে তার আগেই মেঘালয় ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানার উপর এসে বসলো। পুতুলের মত মেয়েটা যেন পাখির মত হালকা ওর কাছে। বিছানায় বসে মিশুকে কোলে বসিয়ে বললো, 'এবার আমার গলা ধরবা না কি ধরবা ধরো।'
বলেই দুষ্টুমি হাসি হাসলো। মিশু মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, 'পরের জন্মে ৫ ফুট ছয় ইঞ্চি হয়ে জন্ম নিবো দেখো।'
- 'হা হা হা। ৫ ফুট ছয় ইঞ্চি সাইজের মেয়ে দেশে অনেক আছে। অন্তিকা, দুপুর এরা সবাই মোটামুটি লম্বা। কিন্তু ওরা তো মিশু না।'
মিশু চোখের পলক না ফেলে মেঘালয় কে দেখছে। ছেলেটা এমন কেন? কখনো কথা দিয়ে হারানো যায়না ওকে। বললো, 'আপনি শুকিয়ে গেছেন।'
- 'হ্যা। কারণ কি জানো? আম্মু প্রতিদিন আমাকে রোদে শুকাতে দেয়। হা হা হা।'
- 'আমাকেও দিতো। ছোটবেলা শীতকালে গোসলের পর রোদে গা শুকাতাম।'
- 'তুমি কিন্তু দারুণ সুন্দরী হয়ে গেছো মিশমিশ।'
মিশু হেসে বললো, 'মোটেও না। আপনার দৃষ্টি সুন্দর বলে আমাকে সুন্দর দেখছেন।'
- 'আমার দৃষ্টিতে তাহলে 'গু' ও সুন্দর। হা হা হা।'
মিশু ক্ষেপে বললো, 'সারাক্ষণ আপনার শুধু ফাজলামো। খিদা পায়নি? আসুন খেতে দেই।'
- 'কোলে বসেই খাওয়াও।'
- 'কাচ্চি রান্না করেছে। নিয়ে আসি?'
- 'ওহ কাচ্চি খেতে বলেছো? আমি ভাবলাম অন্য কিছু।'
বলেই আবারও শয়তানি হাসি শুরু করে দিলো মেঘালয়। মিশু ক্ষেপে শুকনো লংকার মত লাল হয়ে মাইর শুরু করলো মেঘালয়কে। মেঘ ওর হাত দুটো এক হাতে ধরে অন্যহাতে কাছে টেনে নিয়ে বললো, 'বাচ্চাটা রাগও করে?'
- 'হ্যা করে। আমাকে ছাড়ুন, খাবার নিয়ে আসি। এত রাত অব্দি না খেয়ে আছেন।'
- 'ওরে আমার দায়িত্ববান বউ রে। আমি খেয়ে এসেছি বাইরে থেকে। অনেকদিন পর সায়ান, আরাফের সাথে আড্ডায় গেলাম।'
- 'ওনাদেরকে আসতে বলুন না। কতদিন কথা হয়নি!'
মেঘালয় মিশুকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। তারপর গা থেকে টাই ও কোট খুলে ফেললো। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো, ' অনেক টায়ার্ড লাগছে। আমি শাওয়ার নিয়ে আসি?'
- 'আচ্ছা। তারাতাড়ি করবেন কিন্তু।'
- 'নাহ। এতদিন পর বউ এসেছে সেই খুশিতে সারারাত ধরে গায়ে পানি ঢালবো। হা হা হা।'
মিশু ক্ষেপে বললো, 'আপনি এত দুষ্টু কেন বলুন তো? কত রকম ইয়ার্কি করেন শুধু। আমি টাওয়েল আর প্যান্ট নিয়ে আসছি, আপনি গোসলে যান।'
- 'যাচ্ছি তো বাবা।'
- 'আমি আপনার বাবা নই।'
- 'ওকে, যাচ্ছি তো বউটা।'
- 'ধেৎ, শুধু ফাজলামি।'
মিশু উঠে যাচ্ছিলো বিছানা ছেড়ে। মেঘালয় এক হাত চেপে ধরে বুকের উপর টেনে নিলো ওকে। মেঘের বুকে ভর দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো মিশু। ইতিমধ্যেই শার্ট খুলে ফেলেছে মেঘ। মিশু বুকের পশমে আঙুল বোলাতে বোলাতে বললো, 'এখানে একটা ঘর বানাবো আমি। পুরুষ মানুষের শরীরের আসল সৌন্দর্য হচ্ছে এই রোমশ বুক।'
বলেই নিচু হয়ে মেঘালয়ের বুকে নাক ডুবিয়ে দিলো। মেঘালয় মিশুকে তুলে সোজা হয়ে বসতে বসতে বললো, 'গায়ে ঘামের গন্ধ। শাওয়ার নিয়ে আসি।'
- 'এই গন্ধটাই তো মাদকতাময়।'
- 'সেরেছে রে। যতটা বাচ্চা ভাবি ততটা নয়, ত্রিশ পারসেন্ট সেয়ানাও আছে।'
মিশু আবারও মেঘালয়ের বুকে কিল বসাতে বসাতে বললো, 'যান তো গোসলে যান। আমাকে জ্বালিয়ে মারে এই লোকটা।'
- 'তুমি নাকি আসবা না আর? আচ্ছা, আমি কি স্বপ্ন দেখছি? গিভ মি এ চিমটি প্লিজ?'
- 'সত্যিই এসেছি। মা গিয়ে নিয়ে এসেছেন আমাকে।'
- 'মা গিয়েছিলো! সিরিয়াসলি? কিছুই জানিনা।'
- 'মা অনেক আদর করে নিয়ে এসেছে আমাকে।'
- 'বাহ! তাই নাকি? কি কি খাইয়েছে শুনি?'
মিশু উৎফুল্ল হয়ে বললো, 'সকালে পায়েস রান্না করে রেখে গিয়েছিলো। পাটিসাপটা পিঠা, নারিকেলের নাড়ু, আমার জন্য আচার বানিয়েছে, কাচ্চি রেঁধেছে। আসার পর থেকেই শুধু খাচ্ছি আর খাচ্ছি। আইসক্রিম, ছানার সন্দেশ, পুষ্টির মিষ্টি। একটা লুকান্ত জিনিসও খাইয়েছে।'
মেঘালয় কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'লুকান্ত জিনিস?'
লজ্জায় ফ্যাকাসে হয়ে গেলো মিশু। মাথাটা নিচু করে বললো, 'বুঝেন না? কক্সবাজারে একদিন আপনিও খাইয়েছিলেন আমাকে।'
গলা খাকাড়ি দিলো মেঘালয়। দুষ্টু হাসি হেসে বললো, 'শ্বাশুরি তো অনেক খেয়াল রাখে তোমার। এদিকে আচার বানিয়েছে, ওদিকে আবার লুকান্ত জিনিসও খাওয়ায়। ছোটবাচ্চাদের বিয়ে করলে এই এক জ্বালা।'
মিশু মুখটা বাঁকা করে বললো, 'কে বলেছিলো আপনাকে বিয়ে করতে?'
- 'তোমার বাপ বলেছিলো। তোমার বাপ মা চোদ্দগুষ্টি ধরে বেঁধে বিয়ে দিলো ভূলে গেছো সে কথা?'
- 'আহারে। আমি তো বলেছিলাম আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন। বলিনি?'
মেঘালয় খপ করে মিশুর কোমরে চেপে ধরে নিজের বুকের উপর টেনে নিয়ে বললো, 'আরেকবার এই কথা বললে খুন করে ফেলবো একেবারে। আমি ফান করি, তুমিও ফান করো। কিন্তু ভূলেও এইসব অলক্ষুণে কথাবার্তা বলবা না।'
শক্ত করে মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো মিশু। তারপর কেঁদে ফেললো ঝরঝর করে। মেঘালয় বললো, 'কাঁদছো কেন পাগলী?'
- 'এই কয়েকদিন অনেক কষ্ট দিয়েছি তাইনা?'
- 'হুম। অনেক।'
- 'সরি। আমি তো চাই তোমার সাথে সম্মান নিয়ে চলাফেরা করতে।'
- 'এমনিতেও তোমার যথেষ্ট সম্মান আমার কাছে আছে। আর বাহিরের লোকদের কাছে তোমাকে সম্মানিত করাটা আমার আর আমার পরিবারের দায়িত্ব।'
- 'আমি তোমাদের ক্রেডিট নিতে চাইনি।'
- 'আমাকে নিজের থেকে আলাদা করে দেখছো কেন? আমি তোমার ই একটা সত্তা।'
কান্নার বেগ বেড়ে গেলো মিশুর। মেঘালয় বাঁধা দিলো না। কিছুক্ষণ কেঁদে মেঘালয়ের বুক ভিজিয়ে দিয়ে মিশু বললো, 'আর কাঁদবো না।'
- 'আরেকটু কাঁদো না। ভালোই তো লাগছিলো।'
- 'আমি কাঁদলে আপনার ভালো লাগে?'
- 'প্রচুর।'
- 'কিহ! কি খারাপ একটা লোক!'
হেসে ফেললো মেঘালয়। তারপর বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, 'টাওয়েল টা নিয়ে এসো।'
মিশু টাওয়েল হাতে নিয়ে ছোটাছুটি করে বাথরুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। দরজা খোলাই আছে। মেঘালয় হাত বাড়িয়ে টাওয়েল নিতে গিয়ে মিশুর হাতটা ধরেই টেনে ওকে বাথরুমের ভেতরে নিলো। তারপর দরজাটা লাগিয়ে দিলো খট করে। মিশু চেঁচাতে চেঁচাতে বললো, 'শাওয়ার বন্ধ করুন আমার শাড়ি ভিজে যাচ্ছে.. আমার শাড়ি ভিজে আরে এভা..'
মিশুর আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না। কিছুক্ষণ নিরবতা। সাড়া শব্দ নেই কোনো। তারপর পরই একটা মিষ্টি লাজুক সুর ভেসে আসলো, 'আপনি একটা খুব খারাপ।'
৭৩!!
ভেজা চুল মুছতে মুছতে মিশু বললো, 'বিজনেস কেমন চলছে?'
- 'দৌঁড়াচ্ছে। তোমাকে একদিন অফিসে নিয়ে যাবো। তোমার ও কাজ বুঝিয়ে দিবো।'
- 'আমার কাজ! পড়াশোনা করবে কে?'
- 'পড়াশোনা শেষ করে চাকরি বাকরি নিতে নিতে জীবনের অর্ধেকটা পার হয়ে যাবে। ততদিনে অনেকের বাবা মা ওপারে চলে যায়। আর চাকরি করে কিইবা করবে? বিজনেসের চেয়ে বড় কোনো প্রফেশন আছে নাকি?'
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, 'আমি তো কিছুই বুঝিনা ওসবের।'
- 'বুঝিয়ে দিবো৷ এরপর লোন দিয়ে দিবো, তুমি একা ব্যবসা করবা। তোমার বিজনেস তোমার, আর আমার টা আমার। তুমি লস করলে তার দায় তোমার। কেউ কারো বিজনেসে ইন্টারফেয়ার করবো না। যেকোনো কিছু আমরা আলোচনা করে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটা নিতে পারি।'
মিশু মুগ্ধ হয়ে বললো, 'স্ত্রীকে কেউ এভাবে উৎসাহ দেয় কিনা আমার জানা নেই।'
- 'আমিও চাই তোমার একটা পরিচয় থাকুক। আগে তুমি মিশু, তারপর মেঘালয়ের স্ত্রী।'
- 'হুম। বুঝেছি।'
- 'কচু বুঝেছো। চুলটাও ঠিকমতো আচড়াতে পারো না।'
মেঘালয় এসে টাওয়েল নিয়ে মিশুর চুল মুছে দিতে দিতে বললো, 'চুলগুলো বেশ বড় হয়েছে তো।'
- 'জানেন আমি একজন ফ্যাশন ডিজাইনারের কাছে গিয়েছিলাম। সারাদিন ছিলাম। উনি বলেছেন, আমার হাইট আর ফিগার অনুযায়ী, এক রঙা ফ্রক টাইপের জামায় আমাকে বেশি মানাবে। পুতুলের মত লাগবে।'
মেঘালয় মনোযোগ দিয়ে চুল মুছছে। বললো, 'ভালো বলেছে। এখন থেকে পুতুলের মত জামা কিনে দিবো।'
- 'ব্রাইট কালারগুলো পড়তে বলেছে। এক রঙা, কোনো ফুল থাকবে না।'
- 'হুম বুঝেছি। ঠিকই বলেছে।'
- 'জানেন আমি সারাদিন ওনার সাথে গল্প করেছি। আপুর কথাগুলো আমার খুবই ভালো লেগেছে। ওনার ডিজাইনার হওয়ার গল্প শুনেছি। আমার ও ছোট থেকে এটা ওটা ডিজাইন করতে ভালো লাগতো। ভাবছি ফ্যাশন ডিজাইনিং সাবজেক্ট নিয়ে পড়বো।'
- 'তাই! খুবই ভালো হবে। প্রচুর পরিশ্রম হবে শুরুতে, পারবে তো?'
- 'পারবো না কেন? আপনি তো আছেন ই।'
- 'হ্যা, চুল মোছার জন্য।'
বলতে বলতে চুলগুলো ভালোমতো মুছে দিলো মেঘালয়। তারপর মিশুকে সোজা করে দাড় করিয়ে দিয়ে বললো, 'ফাইনালি আমাদের বিয়ের প্রোগ্রামটা হচ্ছে?'
- 'হুম হচ্ছে।'
- 'রাত অনেক হয়েছে, সারারাত গল্প করেই কাটিয়ে দিই কি বলো?'
মিশু চমকে উঠে বললো, 'হুম। আমার অনেক গল্প আছে আপনাকে শোনানোর। অনেক গল্প, সব শোনাবো।'
মেঘালয় মিশুকে নিয়ে এসে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। মিশু ওর সামনে বসে মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকালো। মেঘালয় বললো, 'তোমার সব কথা শুনবো। বলো কি কি কথা পেটে উঁকিঝুঁকি মারছে?'
মিশু সোজা হয়ে বসলো গল্প বলার জন্য৷
—————
৭৪!!
মিশু বলতে আরম্ভ করলো, 'আচ্ছা স্বামীরা কেন বোঝেনা তাদের স্ত্রী রা কি চায়?'
মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, 'কাদের কথা বলছো বলো তো?'
- 'আরে আমার একটা কাজিন। ওদের প্রেমের বিয়ে। কিন্তু...'
মেঘালয় কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে। মিশু আমতা আমতা করছে দেখে বললো, 'বলো? কি হলো আবার?'
- 'আমার না খুব লজ্জা করছে। যদিও আপনার কাছে লজ্জা করাটা ঠিক না। আর আমিতো এসব কথাবার্তা আপনাকে ছাড়া আর কাউকে বলতেও পারবো না।'
- 'তুমি নির্দ্বিধায় বলো। কোনো অসুবিধা নেই। সময় লাগলে সময় নাও, তবুও লজ্জা কোরোনা।'
মিশু মাথা ঝাঁকালো। মেঘালয় বিছানায় হেলান দিয়ে বসে মিশুকে কোলের উপর টেনে নিলো। ওর কোলে মাথা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো মিশু।
মেঘালয় ভেজা চুলের গন্ধ শুঁকে বললো, 'পাগল করা ঘ্রাণ তোমার চুলে। আমার ঘুম এসে যায় এই গন্ধে।'
- 'মন খারাপের রাত গুলোতে চুলের ঘ্রাণ শুঁকিয়ে ঘুম পাড়াবো আপনাকে।'
- 'মন খারাপের রাত গুলো কখনো না আসুক। এবার সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে তোমার গল্পটা শুরু করো।'
মিশু আবারও শুরু করলো, 'আপু প্রচন্ড ভালোবাসতো ভাইয়াকে। দীর্ঘদিন প্রেম করে বিয়ে। বিয়ের আগে শুধুমাত্র হাগ, কিস এইগুলোই হয়েছে ওদের মধ্যে। একজন আরেকজনের অনেক কেয়ার করতো, বোঝাপড়াও ভালো ছিলো। দুজনে মিলে বাসায় জানালো তারা একে অপরকে পছন্দ করে। বাসা থেকে দেখাশোনা করে বিয়ে হলো। দুজনে কত খুশি ছিলো বিয়ের সময়! বিয়ের আগে পনের বিশ দিন ধরে শুধু প্লান ই করে গেছে। শুধু কি বিয়ে, প্রেম করার সময়েই তো সবাই প্লান করে ফেলে হানিমুন, বাচ্চাকাচ্চা এগুলো নিয়ে। ভাইয়া ওকে বলত বিয়ের রাতে সারারাত ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিবে, অনেক গল্প করবে দুজন মিলে। কিন্তু....'
মেঘালয়ের কৌতুহল আরো বেড়ে গেল। মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে মিশুর দিকে। মিশু কি যেন ভাবছে। দুই ভ্রুয়ের মাঝে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়েছে ওর। দেখতে ভালো ই লাগছে মেঘালয়ের।
মিশু বললো, 'বাসর রাতে ঘরে ঢুকেই ভাইয়া বিছানার দিকে এগোতে থাকে। আপু উঠে এসে সালাম করবে ভেবেছিলো। কিন্তু ওঠার পরপরই ভাইয়া আচমকা এসে ওকে জাপটে ধরে। আপুও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে ওকে। ভাইয়া আপুর চুলের গন্ধ নেয়, গালে চুমুও খায়। আর তারপর পরই পাগল হয়ে যায় একেবারে। আপুকে একটুও শাড়ি গয়না খোলার সুযোগ দেয়না। জোরে চাপ দিতে থাকে বুকে। আপুর গায়ে ভরি ভরি গয়না থাকায় ও প্রচুর ব্যথা পাচ্ছিলো। আপু উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, আমাকে একটু চেঞ্জ করার সময় দাও। কিন্তু ভাইয়া ওকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে পিছনে পুরুষাঙ্গ ঠেকিয়ে বারবার ঘষছিলো। কষ্টে কান্না করে দেয় আপু। মেয়েটা চেয়েছিলো স্বামী একবার হাসিমুখে পাশে বসবে, জিজ্ঞেস করবে এই বাড়িতে তার কেমন লাগছে? বাসার জন্য যেন মন খারাপ না করে, আগামী দিনগুলোর জন্য দু একটা কথা বলবে। মেয়েটা তার পরিবারকে ছেড়ে চলে এসেছে, তার অনুভূতিটা একবারও বোঝার চেষ্টাও করেনি। মেয়েটা চেয়েছিলো স্বামী তাকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরুক। অনেক ভালোবেসে স্পর্শ করুক। কিন্তু ছেলেটার তর সইছিলো না।'
মিশুর চোখেমুখে ফুটে উঠেছে বিতৃঞ্চা। মেঘালয় ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।
মিশু বললো, 'এটা কেমন ভালোবাসা মেঘমনি? বিয়ের অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। এখন দিনের পর দিন আপু তার স্বামীর কাছে ধর্ষিত হয়। যে স্পর্শে কোনো ভালোবাসা নেই, সেটা তো ধর্ষণ ই। একটা মেয়ে চায় একটু আদর, একটু কেয়ারনেস, ভালোবাসাময় স্পর্শ। কিন্তু অনেকের ই আজকাল বিয়ের পরপরই প্রেম পালিয়ে যায়। কত অদ্ভুত না? শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্কের জন্যই কি বিয়ে?'
মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, 'উহুম। বিয়ে মানে প্রেম। সবাই দায়িত্ব নিতে পারে কিন্তু প্রেমিক কি আর সবাই হতে পারে?'
- 'প্রেম করেই তো বিয়ে।'
- 'ধুর। আজকাল প্রেম করে বিয়ে করা সহজ কিন্তু বিয়ের পর প্রেম ধরে রাখাটা কঠিন। শুধুমাত্র বাবু খাইছো, একটু ঘোরাঘুরি, হাত ধরাধরি, চুমু খাওয়াকে প্রেম বলে? প্রেম হচ্ছে ঈশ্বপ্রদত্ত ক্ষমতা। এটা সবার থাকেনা।'
মিশু তাকালো মেঘালয়ের চোখের দিকে। ফিক করে হেসে বললো, 'ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা? দারুণ বলেছো তো।'
মেঘালয় বললো, 'প্রেম হচ্ছে একটা শক্তিশালী মানসিক ও শারীরিক আকর্ষণের নাম। কোনো প্রেমে শারীরিক সম্পর্কের পর মায়া কমে যায়। এদের ক্ষেত্রে মানসিক আকর্ষণ কম থাকে, এরা আলাদা হয়ে যায়। কোনো প্রেমে শারীরিক সম্পর্কের পর মায়া বেড়ে যায়, এদেরকে বলে স্বামী স্ত্রী আর এটা বেশিরভাগ সময় স্থায়ী হয়। যে প্রেমে মানসিক ও শারীরিক দুটোরই আকর্ষণ শক্তিশালী হয়, তারা আজীবন সুখী হয় আর আর এরা কখনো আলাদা হয়না।'
মিশু হুট করেই বললো, 'আমাদের ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক আকর্ষণ দুটোই শক্তিশালী।'
হেসে ফেললো মেঘালয়। বললো, ' এতকিছু বোঝো? বাব্বাহ!'
লজ্জা পেয়ে হাসলো মিশু। মেঘালয়ের গলা জাপটে ধরে বললো, 'সত্যিই। আগে বুঝতাম না এটা। এখন বুঝি। আপনার থেকে দূরে থাকতে আমার কি যে কষ্ট হতো। আপনি যদি চুপচাপ আমার সামনে বসে থাকেন, আমার তাতেও প্রশান্তি। দেখার জন্য কি যে ছটফট লাগে...'
- 'আমাদের ভালোবাসাটা পবিত্র। তাই এটার অনুভূতি গুলোও বিশুদ্ধ।'
- 'আহ! হুট করে বিয়েটা হয়ে ভালোই হয়েছে দেখছি। অবশ্য বরটা যদি মেঘালয় না হতো, আমি তো জানতাম ই না সুখ কি জিনিস।'
- 'তাহলে যে অভিমান করে দূরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে? আর কক্ষনো এরকম হবে না তো?'
- 'না গো হবেনা। আমিতো কনফিউজড ছিলাম শেষ পর্যন্ত আপনার থেকে দূরে থাকতে পারবো কিনা। এত যে দেখতে ইচ্ছে করতো...'
কথাটা বলেই মেঘালয়ের চোখে চোখ রাখলো মিশু। এই চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই বাকি জীবন টা পার করে দেয়া সম্ভব। সত্যিই স্বামী স্ত্রী দুজনের মনে যদি একই সাথে, একইরকম ভাবে ভালোবাসা তৈরি হয়, এটার মত সুখ বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও থাকেনা।
মেঘালয় মিশুর আঙু্লের ফাঁকে আঙুল রেখে বললো, 'একটা গুড নিউজ আছে।'
মিশু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কি?'
- 'তন্ময় সুস্থ হয়ে গেছে। আজকে ওকে দেখতে গিয়েছিলাম।'
চমকে উঠলো মিশু। এই তন্ময়ের জন্যই এত ভূল বুঝাবুঝি, আবার সেই তন্ময়! অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে।
মেঘালয় বললো, 'তন্ময় কথা বলতে পারে। আমার সাথে ওর অনেক ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। ছেলেটা অনেক ভালো বুঝলে।'
মিশু একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো, 'হুম জানি। কিন্তু তুমি হসপিটালে যাও এটা জানতাম না।'
- 'তুমি আমাকে এখনো কিছুই জানোনা মিশমিশ। আমার কোনো শত্রু নেই। শত্রুদেরকে বন্ধুতে পরিণত করাটা আমার অভ্যেস। সেখানে তন্ময়কে ওই অবস্থায় ফেলে আসার পর আমি আর খোঁজ নিবো না এটা ভাবলে কি করে?'
মিশু অবাক হয়ে বললো, 'কি বলছেন!'
- 'হুম ম্যাম। আমি অনেকবার গিয়েছি ওকে দেখতে। কখনো তোমাকে বলিনি কারণ ওর কথা তুললেই তুমি বিব্রতবোধ করবে।'
মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো মিশু। কেন যেন চোখে পানি এসে যাচ্ছে। এই মানুষটা এত ভালো কেন! ইস! সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
৭৫!!
সকালবেলা,
মিশুর ঘুম ভাংলো মেঘালয়ের ডাকে। চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করলো, 'এত সকালে ডাকলেন যে?'
- 'আম্মু উঠে নাস্তা বানাচ্ছে। তুমি গিয়ে একটু হেল্প করো।'
- 'আচ্ছা।'
মিশু উঠতে উঠতে চুল বাঁধছিলো। মেঘালয় মিষ্টি করে হেসে বললো, 'ঘুম থেকে ওঠার পর তোমাকে খুব মায়াবী লাগে।'
মিশু মাথাটা নিচু করে মেঘালয়ের কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, 'আমি যাচ্ছি। রান্নাঘরের আশেপাশে একটু ঘুরঘুর করবেন প্লিজ?'
মেঘালয় ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো, 'কেন?'
- 'আপনি ঘুরঘুর করলে আমার আনন্দ হবে।'
হাসি পেলো মেঘালয়ের। হাসি চেপে রেখে বললো, 'আচ্ছা যাও, আমি আসছি।'
মিশু ফ্রেশ হতে চলে গেলো। মুচকি হাসলো মেঘালয়। পাগলী একটা। এভাবে কেউ বলে? রান্নাঘরের আশেপাশে একটু ঘুরঘুর করবেন প্লিজ? ভেবে আরেক ঝলক হেসে নিলো মেঘালয়।